#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৫।
সূর্যখানা উঁকি দিয়েছে সবে। বাইরে পরিষ্কার আলো। বাগানের গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। একটু আঁড়ালেই দাঁড়ান দুইজন মানব মানবী। জরুরি আলোচনা চলছে হয়তো তাদের মাঝে। চোখে মুখে দারুণ চিন্তার ছাপ। কপালেও ভাঁজ পড়েছে বেশ। এরপর পরিবেশটা আরেকটু ফকফকা হতেই পুরুষ লোকটি দ্রুত চলে গেল মহলের ভেতর।
ইশফাক ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়। দীঘির জলে গোসল সেরে বিচার মহলে যেতে হবে। তাই দ্রুত সব কাজ সারে। গোসল শেষ করে গায়ে গামছা জড়িয়ে তার কক্ষ বরাবর আসতেই তনুকাকে দেখতে পায়। এই অসময়ে তার ঘরের সামনে তনুকাকে দেখে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে সে। গামছাটা ভালোভাবে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে ইতস্তত সুরে বলে,
‘বউমনি, আপনি?’
তনুকা ফিরে তাকায়। সদ্য গোসল সারা ইশফাককে দেখে আবার উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ায় সে। বলে,
‘আপনি কাপড় পরে আসুন; কথা আছে।’
ইশফাক কথামতো দ্রুত কাপড় গায়ে বাইরে এল। জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু হয়েছে, বউমনি?’
তনুকা আবার চাইল। কিঞ্চিৎ হাসল সে। ভদ্রতা দেখাতে ইশফাকও হাসল ক্ষীণ। তনুকা বলল,
‘আপনি নাকি আপনার ঘরে গোলাপ লাগিয়েছেন?’
ইশফাক আঁতকে ওঠে। এমন ভাবে তাকায় যেন, চোখ তার এখনই বেরিয়ে আসবে। এই কথা বউমনি কী করে জানল? তনুকা তার ভীত মুখশ্রী দেখে হাসল খুব। বলল,
‘ভয় পাবেন না, রেনু সব বলেছে আমায়।’
ইশফাক ঢোক গিলে। এই রেনু মেয়েটা দেখি আস্ত এক আহাম্মক। এভাবে বউমনিকে সব বলে দিল? এবার বুঝি সত্যিই জান যাবে তার। তনুকা তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘বললাম তো, ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আমি কাউকে কিছু বলব না। আপনি স্বাভাবিক থাকতে পারেন।’
ইশফাক কী বলবে বুঝতে পারছে না। মাত্রাধিক অস্বস্তি আর লজ্জায় রা হারিয়েছে। তনুকা ফের জিজ্ঞেস করে,
‘রেনুর জন্য নাকি গোলাপ গাছ লাগিয়েছেন? ও আমাকে দেখতে পাঠাল।’
‘রেনু পাঠিয়েছে?’
‘জি।’
ইশফাক বিস্মিত হয়। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,
‘কোনো গাছ আমি লাগাইনি, বউমনি। ওটা শুধু রেনুকে খুশি করতে বলেছিলাম।’
তনুকা এক পল ভেবে প্রশ্ন করে,
‘সত্যিই লাগাননি?’
‘না। বাগানে এত গাছ থাকতে ঘরের ভেতরে লাগিয়ে কী লাভ?’
তনুকা ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল। বলল,
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক।’
‘দয়া করে এটা রেনুকে জানাবেন না। মেয়েটা কাল খুশি হয়েছিল, আমি ওর খুশি নষ্ট করতে চাই না।’
তনুকা নিমিষ কিছুক্ষণ চেয়ে বলল,
‘রেনুকে ভালোবাসেন?’
এমন প্রশ্নে ভড়কাল ইশফাক। ইতস্ততও হলো ভীষণ। কথা ঘুরাতে বলল,
‘আপনি এখন মহলে যান, বউমনি। ভাইজান উঠার সময় হয়েছে যে।’
‘আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি।’
‘অন্য কোনোদিন দিব, আজ থাক।’
‘ঠিক আছে। তবে, সেই অন্য কোনোদিন কেবল এই এক প্রশ্নের উত্তর দিলেই চলবে না, আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এখন থেকেই তাই প্রস্তুতি নিতে থাকুন।’
তনুকা মহলের দিকে পা বাড়াল। ইশফাক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে ভাবল, সে আবার ধরা পড়ে গেল না তো?
________
ডাইনিং এ খেতে বসেছে সবাই। আজ অনেকদিন পর ছোটো কাকাও বসেছেন সবার সঙ্গে। মেহতাবের নিষেধের পর তিনি আর বসেননি। আজই প্রথম বসেছেন। বরাবরের মতোই বড়ো কেদারাতে মেহতাবের স্থান। সে আয়েশ করে বসেছে তাতে। রাদাভ বসেছে তার উল্টো দিকের চেয়ারে। ভাইকে নির্নিমেষ চেয়ে দেখছে। এর মাঝেই খাবার সব বাড়া শেষ। সকলে বসে পড়েছে। তনুকা বসে আছে রাদাভের মুখোমুখি চেয়ারটাতে। তার পাশেই রেনু। মেয়েটা তাড়াতাড়ি খাচ্ছে, আজ স্কুলে যেতেই হবে। আর কিছুদিন পর থেকে যে মাধ্যমিক শুরু। তনুকার খাবার গতি অতিশয় ধীরস্থির। রাদাভ খাওয়ার মাঝেই বলল,
‘তোমার লোকদের মাঝে কি কাউকেই এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি, ভাইজান?’
মেহতাব একপলক চাইল। জবাব দিল,
‘একজনকে তো মৃ ত পেয়েছে তবে, অন্যজন এখনো নিখোঁজ।’
‘পুলিশ এখনো একটা জলজ্যান্ত মানুষকে খুঁজে বের করতে পারছে না। কেমন ভাবে কাজ করছেন উনারা? তুমি তাগাদা দিচ্ছ না?’
‘যতটুকু তাগাদা দেওয়ার দিচ্ছি। এরপর বাকিটা উনাদের হাতে।’
‘আমার মনে হয় কি, আমাদের সিকিউরিটি আরেকটু বাড়ানো উচিত।’
‘হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।’
এইটুকু বলে মেহতাব ছোট কাকা মতিব মজুমদারের দিকে চাইল। ভ্রু কুঁচকাল সঙ্গে সঙ্গে। বলল,
‘কাকা, আপনি কার অনুমতিতে আবার টেবিলে বসেছেন?’
আচমকা এমন প্রশ্নে নিবৃত্ত দেখাল মতিব মজুমদারকে। তিনি কী বলবেন বুঝতে পারেন না। তাই বোকার মতো হেসে বললেন,
‘না, আসলে ঐ রাদাভ বলেছে, তাই।’
রাদাভ জিজ্ঞেস করল,
‘কেন ভাইজান? ছোট কাকা আমাদের সাথে বসে কেন খেতে পারবেন না?’
রাহীলা সুযোগ পেলেন। নাক মুখ ছিটকে বললেন,
‘আমাদের কি আর এই সংসারে কোনো দাম আছে? আমরা তো এই সংসারের ফেলনা কেবল, তাই তো এত অবহেলা।’
মেহতাব মুখের খাবারটা গিলে সোজা হয়ে বসল। রয়েসয়ে বলল,
‘নিজেদের কাজে-কর্মেই ফেলনা হচ্ছেন; কেউ জোর করে আপনাদের ফেলনা বানাচ্ছে না।’
অপমানে মুখ থমথমে হলো রাহীলার। আর কোনো কথা বললেন না। মেহতাব বলল,
‘রাদাভ বলেছে বলে আর কিছু বললাম না। পরের বার যেন আমার কথার কোনো হেরফের না হয়।’
_______
বিচার মহলের নিস্তব্ধ পরিবেশ। মেহতাবের কপালে হাত। চোখ বোজা। তার পাশের একটা চেয়ারে রাদাভ। বিরক্ত ভঙিতে বসে আছে কেবল। এই চেয়ারখানা মোটেও পছন্দ হয়নি তার, মুখের ভাবমূর্তি তাই বলছে। জনগনের অভিমুখে একজন ছেলে দাঁড়ান; অপর পাশেই কালো বোরকা পরিহিতা এক মেয়ে। মেয়েটির পুরো শরীর বোরকার আঁড়ালে হলেও চোখ দুটি দৃশ্যমান। সেই চোখের শ্রান্ত দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে, সে এই মুহুর্তে ঠিক কতটা ভীত। মেহতাব চোখ মেলে তাকায়। ছেলে মেয়ে দুইজনকে পরখ করে বলে,
‘বিয়ের পরও অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক এক ঘৃণ্য অপরাধ। এর শাস্তিও ভয়ানক। আমি চাই না আমার গ্রামে এইসব জঘন্য অপরাধ আর হোক। আজ এই মেয়ের শাস্তি দেখে প্রত্যেকে শিক্ষা নিবে যে, পরকীয়ার শাস্তি কতটা ভয়ংকর। ভবিষ্যতে এমন কাজ করার আগে হাজারবার ভাববে সবাই। এখন আপনারাই বলুন, আপনারা কী চান; মেয়েটা শাস্তি পাক?’
উপস্থিত সকলে সমস্বরে বলে উঠে,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চাই।’
এমনকি মেয়ের পরিবারের মানুষও একই কথা বলে। মেহতাব নিশ্বাস ফেলে। ইশফাককে হুকুম দিয়ে বলে,
‘উনাকে নিয়ে বড়ো মাঠের মাঝখানে বাঁধো।’
মেয়েটি ভয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে। অনেক আকুতি মিনতি করে, তাও মন গলে না পাষাণ জমিদার মেহতাব মজুমদারের। সবকিছুর ছাড় হলেও, কোনো বিশ্বাসঘাতকের ছাড় তার কাছে নেই। তার হুকুম মতোই করা হলো সব। মেয়েটাকে বাঁধা হলো মাঠের মাঝখানে। মেহতাব গাছের ছায়ার নিচে আরাম করে বসেছে। এবার হুকুম দিয়েছে, পাথর নিক্ষেপ করার। উপস্থিত গ্রামবাসী বিদ্বিষ্ট মনে তাই করল। একের পর এক নিক্ষিপ্ত পাথরে ক্ষত বিক্ষত হলো মেয়েটার শরীর। র ক্তে রক্তিম হলো সারা গা। একসময় আঘাত সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল মেয়েটা। মেহতাব উঠে দাঁড়াল এরপর। সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
‘এবার বাড়ি যান আপনারা। মনে হচ্ছে না আর বাঁচবে বলে। মা রা গেলে দাফনের ব্যবস্থা আমি করব। আর মেয়েটার পরিবারের লোকেরা যেন কোনো আফসোস না করে। কোনো পাপীর জন্য কখনো আফসোস করতে নেই।’
মেহতাবের কথা মতো অজ্ঞান অবস্থাতেই মেয়েটাকে কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া হলো। কোথায় নিয়ে গিয়েছে সেটা মেহতাব আর ইশফাক ছাড়া কেউ জানে না। রাদাভ ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘মেয়েটাকে মে রে ফেলার কি খুব দরকার?’
মেহতাব চেয়ে জবাব দেয়,
‘অবশ্যই। আমার গ্রামে কোনো বিশ্বাসঘাতকের জায়াগা নেই।’
শেষের উক্তিতে যেন একটু কঠিন শোনাল মেহতাবের স্বর। রাদাভ আর ঘাটাল না। যা খুশি সে করুক, তাতে তার কী? কেবল তার উদ্দেশ্য সফল হলেই হলো।
চলবে…..
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৬।
‘জানো বউমনি, আজ মাঠে এক মেয়েকে বেঁধে সবাই পাথর মেরেছে।’
তনুকা রান্নাঘরে কিছু একটা করছিল। রেনুর কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন?’
‘মেয়েটা ভালো না; তার স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ভাইজান তাই এই শাস্তি দিয়েছেন।’
তনুকা নির্বাক তাকিয়ে থাকে। কপালের ঘাম আঁচলে মুছে বলে,
‘তোমার ভাইজান খুব নিষ্ঠুর, রেনু।’
রেনু আঁতকে উঠে বলে,
‘না না, কী বলো! আমার ভাইজান মোটেও নিষ্ঠুর না। মেয়েটা তার স্বামীকে ঠকিয়েছে, পরকীয়া করেছে; তুমিই বলো, এই শাস্তি কি মেয়েটার প্রাপ্য নয়?’
তনুকা বাক্য সাজাতে ব্যর্থ। রেনুর প্রশ্নের বিপরীতে যুতসই জবাব পেল না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ছোটো মাছের চচ্চড়ি খাও তুমি?’
‘হু, খাই তো। তুমি বানাচ্ছো না কি?’
‘হ্যাঁ। জলদি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।’
রেনু মাথা নাড়িয়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। তনুকা চামচ নাড়ানো বন্ধ করে প্রশ্বস্থ বাগানের দিকে আনমনে চাইল। মনে চিন্তার ভার বাড়ল তার। সত্যিই তো, বিশ্বাসঘাতককে ক্ষমা করা উচিত না। কিন্তু, সে তো বিশ্বাসঘাতক নয়। নিজের এই জবানে অঢেল অবিশ্বাস তার। বুকে হাত দিয়ে হয়তো কখনোই বলতে পারবে না যে, “আমি বিশ্বাসঘাতক নয়।” মনে সংশয় থাকবে, আজীবন থাকবে।
_______
খাবার টেবিলে তনুকার বানানো ছোট মাছের চচ্চড়ি বেশ প্রশংসিত হলো। সবথেকে বেশি প্রশংসা করল রাদাভ। আঙ্গুল চেটে খেয়েছে সে। তনুকা যেন তাতেই তৃপ্ত। তার এইটুকু রান্নার এত প্রশংসা সে আশা করেনি। এই রান্নাটুকুই খুব কষ্টে ইউটিউব দেখে শিখেছিল।
বিকেলের দিকে ভাত ঘুম দিতে সকলে যার যার ঘরে গিয়েছে। মেহতাবেরও চোখ লেগে এসেছে ততক্ষণে। তার পাশেই তনুকা শায়িত। চোখে ঘুম নেই তার। মেহতাবের চোখ লেগে আসতেই উঠে বসল সে। ভালো ভাবে দেখল, মেহতাব ঘুমিয়েছে কি না। যখন মনে হলো, ঘুমিয়েছে, তখন বেড়াল পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল। সোজা গেল রান্নাঘরের সম্মুখে বাগানের জায়গাটুকুতে। কাল রাতে অন্ধকারে সেই ছায়ামূর্তিটাকে যেখানে দেখেছিল, তনুকা এই মুহূর্তে সেখানেই দন্ডায়মান। তবে সে নিশ্চিত নয়, এটাই সেই জায়গা কি না। তাও তীব্র সংশয় নিয়েই সেই অংশের মাটি খুঁড়তে আরম্ভ করল সে। প্রথমে পেল না কিছু। হাতের ছোট ছু ড়ি জাতীয় জিনিসটা দিয়ে বেশ কয়েক জায়গা দেখে নিয়েছে কিন্তু, কোথাও তেমন কিছু পায়নি। আশাহত হলো। বিষন্ন মন নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তবে কি সবটাই তার মনের ভুল কেবল? মনের ভুল’ই যদি হয় তবে, ঐ ছায়ামূর্তিটা কে ছিল? ইশফাক ছিল না?
‘এখানে কী করছেন, ভাবি?’
চমকে তাকায় তনুকা। রাদাভকে দেখে নিশ্বাস ছাড়ে। আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
‘আপনি এখানে কেন?’
রাদাভও আশপাশ দেখে একবার। তারপর একটু এগিয়ে এসে এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু কি খুঁজছিলেন না কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী?’
‘আপনার ভাইজানের লুকায়িত জিনিসটা।’
রাদাভ হাসে। বলে,
‘ভাইজান লুকিয়ে থাকলে জীবনেও সেটা পাবেন না। খুঁজে লাভ নেই কোনো।’
তনুকা এগিয়ে আসে। হাতের ছু ড়িটা রাদাভের হাতে দিয়ে বলে,
‘তাহলে আপনিই খুঁজে বের করুন। এখানে কিছু একটা লুকানো হয়েছে, কী লুকানো হয়েছে আমি জানতে চাই সেটা।’
রাদাভ ভ্রু কুঁচকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘এত জেনে আপনি কী করবেন?’
তনুকা চোখ মুখ কালো করে বলল,
‘করার মতো অনেক কিছু আছে। আমায় সাহায্য করবেন ওয়াদা করেছিলেন, এখন পিছপা হবেন না। ঐ ইশফাককেও আমার সন্দেহ হয়। মেহতাবও কিছু জানেন নিশ্চয়ই, এসব কিছুর রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব আপনার।’
রাদাভ আরেকটু এগিয়ে আসে। তনুকা ভয়ে পিছিয়ে যায়। রাদাভ ফিসফিসিয়ে বলে,
‘মেহতাব মজুমদারকে এখনো চিনেননি দেখছি। ভয়ংকর উনি, একটু আঁচ করতে পারলে জীবনের সমাপ্তি সেদিনই ঘটবে।’
‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’
তনুকার প্রশ্নে শব্দ করে হাসে রাদাভ। বলে,
‘আমাকে দেখে ভীতু মনে হয়? ভীতু হলে কি আর এতকিছু করতে পারতাম। যাকগে সেসব, ঘরে যান। ভাইজান জেগে গেলে বিপদ।’
তনুকা রাদাভের দিকেই চেয়ে থাকে। রাদাভ তার মুখের উপর তুরি বাজিয়ে বলে উঠে,
‘ঘরে এত সুদর্শন স্বামী রেখে দেবরের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে যে পাপ হবে, ভাবি। আমি আপনাকে পাপী বানাতে চাই না।’
তনুকা মৃদু হাসে। রাদাভকে আরেক পলক দেখে চলে যায় সেখান থেকে। রাদাভ হাতের ছুড়ি খানা মাটিতেই ফেলে দেয়। তারপর দু হাত ঝেড়ে ক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘উনার সন্দেহ মেটাতে আমি না কি এখন বসে বসে মাটি কাটব? কামলা পেয়েছে আমাকে, আশ্চর্য!’
_______
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ হলো। চারদিক অন্ধকার এখন। পুরুষ মানুষ কেউ বাড়িতে নেই। রাদাভ কোথাও একটা গিয়েছে একা। মেহতাব বরাবরের মতোই ইশফাককে সাথে নিয়ে বেরিয়েছে। দুই কাকা বাজারে, বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে গরীব খাওয়ানো হবে তাই।
_______
মাংসের উপর চাপাতি’টা পড়তেই র ক্ত সব ছিটকে পড়ল। গায়ের পরিচ্চদ-রক্ষক বহিরাবরণটা ভরে গেল তাতে। মুখেও লাগল তার কিছু। সে হাতের ইশারা করতে টিস্যু বক্সটা এগিয়ে দেওয়া হলো। টিস্যু নিল, মুখ মুছল তাতে; অতঃপর আবার কাজে মনোযোগ দিল। মাংস টুকরো করার মাঝেই প্রশ্ন করল,
‘কী মনে হয়, মাংস কি শর্ট পড়বে?’
উত্তর এল,
‘বলতে পারছি না ঠিক।’
বিরক্ত হলো সে। বলল,
‘কোনটা ঠিক মতো বলতে পারো তুমি? খবর নাও গিয়ে, যাও।’
একটু পর খবর নিয়ে এলো সেই ব্যক্তি। বলল,
‘শর্ট পড়ার সম্ভাবনাও আছে।’
লোকটি ভাবল কিয়ৎক্ষণ। বলল,
‘আর কেউ আছে লিস্টে?’
‘একজন আছে। পূর্ব দিকের বাড়ির ঐ কমল মিয়া, বেয়াদবি করেছিল একবার।’
‘বয়স যেন কত তার?’
‘পঞ্চাশের ঘরে হবে হয়তো।’
‘ঠিক আছে, অজ্ঞান করে নিয়ে এসো।’
_________
মেহতাবের ফোনটা বাজছে ক্রমাগত। সে হাত মুছে এসে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে তনুকা জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায় আপনি?’
মেহতাব হেসে বলে,
‘কেন বিবি? খুব মনে পড়ছিল বুঝি?’
তনুকা বিমুখ সুরে বলল,
‘একদমই না। বাড়িতে পুলিশ এসেছে, তাই কল দিয়েছি। উনারা আপনার খোঁজ করছেন।’
‘আচ্ছা, আসছি আমি।’
মেহতাব কল কাটতেই তনুকা খাবার ঘরে গেল। আম্বিরা বেগমকে জানাল, মেহতাব আসছে। আম্বিরা বেগম সেই খবর বসার ঘরে পাঠালেন। তারপর তিনিও চলে গেলেন নিজের ঘরে। তনুকা দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই।
মেহতাবের পৌঁছাতে সময় নিল, আধঘন্টা। সে ভেতরে এসেই পুলিশ অফিসারের সাথে করমর্দন করে সৌজন্য বিনিময় করল। তারপর বসল সোফায়। অফিসার জানালেন, করিমুল্লাহ’র এখনো কোনো হদিস উনারা পাননি। হতাশ হতে দেখা গেল মেহতাবকে। জিজ্ঞেস করল,
‘তবে কি কোনোভাবেই আর ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে না?’
‘মনে হয় না আর যাবে বলে। এবার উনার নিজ থেকে ফিরে আসার অপেক্ষা করা ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারব না।’
মেহতাব সোফার হাতলে হাত ঠেকিয়ে চিবুক ধরে বসল। ভাবছে কিছু হয়তো। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন,
‘শুনলাম, আপনার বাবাও না কি মারা গিয়েছেন?’
মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘জি।’
‘স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল, তাই না?’
‘জি।’
‘মোটেও না, ভাইজান। বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক না।’
রাদাভ ঠিক সেই মুহুর্তেই উপস্থিত হয়ে এই জবাব দিয়ে বসে। তার উত্তর শুনে অবাক হন অফিসার। বলেন,
‘আপনার কি অন্য কোনো সন্দেহ হচ্ছে?’
‘জি, অফিসার।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে কী সন্দেহ হচ্ছে, বলুন তো।’
মেহতাব তীক্ষ্ণ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদাভ বেশ আয়েশ করে তার পাশে বসেছে। তারপর বলে উঠে,
‘আমার কাছে এটা খু ন মনে হচ্ছে, অফিসার। বাবা হুট করেই কী করে মা রা গেলেন!’
‘হুট করেই মা রা যাননি, রাদাভ। আব্বাজান অনেক অসুস্থ ছিলেন, সেটা নিশ্চয়ই জানো তুমি?’
রাদাভ বলে,
‘তা জানি। তাও বাবার মৃত্যু নিয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। আমি তদন্ত চাই। অফিসার আপনি তদন্ত শুরু করুন।’
অফিসার জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?’
চলবে…..