#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৫।
পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজে নিয়েছে মেহতাব। তার পুরো শরীরের র ক্ত যেন গরম হয়ে ওঠেছে। এই কয়েক ক্ষণ তনুকাকে না দেখেই যেন, জীবন তার অসাড় হয়ে পড়েছে। শরীর কাঁপছে তার। হুট করেই মেয়েটা উধাও হয়ে গেল কী করে? কারই বা এত বড়ো সাহস যে, মেহতাবের কলিজায় হাত দিয়েছে?
বর্তমানে সে দাঁড়িয়ে আছে তার চিরশত্রু রাজীব ভূইয়ার বাড়ির সামনে। সব জায়গা খোঁজা শেষ। সব বাড়ি বাড়ি দেখেছে সে। একমাত্র এই বাড়িটাই বাকি। গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে রাজীব ভূইয়া। ছোট থেকেই তাদের দুজনের সম্পর্ক সাপে নেউলে। একবার এক কারণে মেহতাব রাজীবকে মেরেছিল খুব। সেদিন থেকেই রাজীব ওঁত পেতে রয়, সুযোগ পেলে সেও ছোবল দিতে ভুলবে না। রাজীবের বাড়ির দারোয়ান মেহতাবকে দেখে ভীত হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘বাবু, আপনে?’
মেহতাব কর্কশ স্বরে বলে,
‘রাজীব ভূইয়াকে এক্ষুনি ডাকো।’
দারোয়ান হুকুম মানতে দৌড়ে গেল। তারপর আবার দৌড়ে এসে জানাল,
‘বাবু, আপনে ভেতরে আইয়েন। ছোট সাহেব ভেতরেই আছেন।’
মেহতাব বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। রাজীবের সব চ্যালা-প্যালারা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছে মেহতাবকে। কেউ কেউ আবার সালাম দেয়। রাজীবের হয়ে কাজ করলেও মেহতাবকে তারা ভীষণ ভয় পায়। মেহতাব তীক্ষ্ণ চোখে প্রত্যেকটা ছেলের ভাবমূর্তি মুখস্থ করে। তার মনে হয়, ছেলেগুলো যেন একটু বেশিই ভয় পাচ্ছে। কেমন যেন চোরের মতো মুখ করে রেখেছে।
মেহতাবের সামনে হরেক রকমের ফল মিষ্টি রাখা হলো। সে তাতে বিমুখ ভাব দেখিয়ে বলল,
‘আমি এখানে ফল মিষ্টি খেতে আসেনি। কাজে এসেছি, রাজীব ভূইয়াকে ডাকো।’
‘রাজীব ভূইয়া হাজির, জমিদার বাবু। বলুন, কী সেবা করতে পারি আপনার?’
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে রাজীবের দিকে তাকায়। অনেক বছর পর রাজীবকে দেখছে সে। কেমন বিদঘুটে দেখতে লাগছে। নেশায় যেন পুরো শরীর নষ্ট করে ফেলেছে তার। রাজীব এসে মেহতাবের মূখোমুখি সোফাটাতে পায়ের উপর পা তুলে বসে। মেহতাবের কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে আসে তাতে। চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার বিবিজান কোথায়?’
রাজীব এমন একটা ভাব করে তাকায় যেন, সে আকাশ থেকে পড়েছে। বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলে,
‘তুমি তোমার বিবিকে নিয়ে আমার গ্রামে এসেছো? আগে বলবে না, তাহলে দাওয়াত করে খাওয়াতাম তোমাদের।’
মেহতাব চোয়াল শক্ত করে। বলে,
‘নাটক করো না, রাজীব ভূইয়া। এর ফল কিন্তু খুব ভয়ানক হবে।’
রাজীব হাসে। তার বিশ্রী হলুদ দাঁতগুলো দেখা গেল সেই হাসিতে। বলল,
‘রাজীব ভূইয়া কোনো নাটক ফাটক করতে পারে না, মেহতাব মজুমদার। তোমার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। দেখো গিয়ে, বউ আবার অন্য কারোর হাত ধরে পালিয়ে গেল কিনা।’
মেহতাব ক্রোধ প্রশমিত করতে না পেরে সজোরে লাথি মেরে বসে সামনের সেন্টার টেবিলটাতে। কাচের টেবিলটা ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। রাজীব তা দেখে ক্রূর হাসে। ভারী মজা পায় সে। বলে,
‘আহারে! সত্য বুঝি হজম হয় না? আমার কাছে হাজমোলা আছে, খাবে?’
মেহতাব এগিয়ে গিয়ে রাজীবের শার্টের কলার চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠে,
‘আমি যদি তনুকে না পায় তবে, এই পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিব, রাজীব। তাই সময় থাকতে বলে দে, কোথায় রেখেছিস তনুকে?’
রাজীব পাত্তা দিল না তেমন। কলার থেকে মেহতাবের হাত সরিয়ে সে জায়গাটা ঠিক করে নিল। তারপর বেশ দায়সাড়া ভাব নিয়ে বলল,
‘তোমার কেন মনে হচ্ছে যে, তোমার বউ আমার কাছে? অন্যের বউ নিয়ে টানাটানি করার স্বভাব আমার নেই, মেহতাব মজুমদার। তাই অযথা আমার পিছে না লেগে, নিজের রাস্তায় যাও।’
মেহতাব রাগে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। আশেপাশে সবগুলোর ছেলের দিকে একবার এমন ভাবে তাকাল যেন, এখনই গিলে খাবে সবকটাকে। তারপর আরো একবার গর্জে উঠে বলল,
‘আমি তনুকে খুঁজে বের করবই।’
রাজীব হেসে বলল,
‘ওকে, অল দ্যা বেস্ট।’
মেহতাব বেরিয়ে আসে। আজকের দিনটা এরকম চায়নি সে। নিজের উপরই রাগ হচ্ছে খুব। সে তনুকাকে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারেনি। মেয়েটা এখন কোথায় আছে, কোন অবস্থাতে আছে কে জানে। দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে মেহতাবের। অস্থিরতায় হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছে। সে রাজীব ভূইয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে আবার নদীর পাড়ে আসে। এখন রাতের অন্ধকার। চাঁদের ম্লান আলোয় কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে আরো মায়াবী লাগছে। এই তো কিছুক্ষণ আগেই এই মায়াবী গাছের নিচে তার মায়াবতীকে প্রথম স্পর্শ করেছিল সে। সেই সুখকর মুহূর্তটা এখনও তার মস্তিষ্কে বিচরণ চালিয়ে যাচ্ছে।কষ্ট হচ্ছে তার, ভীষণ কষ্ট। কয়েক ঘন্টা ধরে চোখের আঁড়ালে তনুকা অথচ মেহতাবের মনে হচ্ছে কত যুগ দেখে না তাকে। তার এই অতিরিক্ত প্রেম এখন বড্ড পোড়াচ্ছে যে।
মেহতাব উপায়ান্তর না পেয়ে ইশফাকের নাম্বারে কল দেয়। ইশফাক কল রিসিভ করে সঙ্গে সঙ্গেই। মেহতাব বলে,
‘আগের থেকে কি একটু সুস্থ আছো?’
‘জি ভাইজান, অনেকটাই।’
‘তবে, মনোহর নদীর দক্ষিণ পাড়ে এসো। আর শোনো, আসার সময় আমার চাপাতিটাও নিয়ে এসো সাথে।’
ইশফাক শোয়া থেকে উঠে বসে। ভাবে, আজ হয়তো আরো একটা খু ন হবে।
_____
ঘন্টা খানেকের ব্যবধানে ইশফাক এসে হাজির হয় সেখানে। কাঁধে এক ব্যাগ। মেহতাব জিজ্ঞেস করে,
‘প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এনেছ সব?’
ইশফাক মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক আছে তবে, ব্যাগটা আমাকে দিয়ে ভূইয়া বাড়ি যাও। রাজীব ভূইয়াকে এক ঘন্টার ভেতর ঐ ছাউনিতে এনে হাজির করো।’
ইশফাক মাথা নাড়িয়ে আবার কী ভেবে জিজ্ঞেস করে,
‘বউমনি কোথায়, ভাইজান? আপনার সাথেই না এসেছিল?’
মেহতাবের কপালের রগ ফুলে ওঠে। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বলে,
‘ঐ জা নোয়ার আমার কলিজাতে হাত দিয়েছে; আজকে ওর কলিজা বের না করা অবধি আমি ক্ষান্ত হবো না।’
ইশফাক ঢোক গিলে। রাজীবের ভয়ংকর অবস্থার কথা চিন্তা করে তার কমে আসা জ্বরও যেন বেড়ে যায় তরতরিয়ে। সে দ্রুত কাজে যায়। মানুষ তুলে আনা আজকাল তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। যদিও এবার একটু রিস্ক আছে তাও সে জানে, সে অবশ্যই পারবে।
ব্যাগটা সাথে নিয়ে মেহতাব নৌকায় উঠে বসেছে। দৃষ্টি তার নদীর স্বচ্ছ জলে। চাঁদের আলোয় সেই জলে তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। এখানে আরো একটা প্রতিচ্ছবি তার কাম্য ছিল তবে, ঐ রাজীব ভূইয়া নষ্ট করেছে সবটা। মেহতাব ব্যাগ খুলে চাপাতিটা পানিতে ভিজিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে সাইডে রাখে। তারপর আনমনেই বলে উঠে,
‘আর কিছুক্ষণ বাদেই তুমি আমার সামনে থাকবে, বিবিজান। আর কিছুটা সময় অপেক্ষা করো।’
____
‘তোমার জামাই আস্ত একটা মা*ল। ঠিক বুঝে ফেলেছে, তোমাকে আমি এনেছি। কী হুমকি ধমকি দিয়ে গেল, তোমাকে নাকি খুঁজে বের করেই ছাড়বে। বোকা মেহতাব, সে তো আর জানে না শেয়ালের কাছ থেকে মুরগী নেওয়া এত সহজ না।’
তনুকা ফিচেল হেসে বলে,
‘আমি মুরগী নই, রাজীব ভূইয়া। আমি হলাম বাঘিনী, আর বাঘিনীকে আটকে রাখার অপরাধে আমার বাঘ আজ আপনাকে ছিড়ে খাবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
রাজীব হাসে। তার এই হাসি অতিশয় জঘন্য ঠেকে তনুকার নিকট। রাজীব এগিয়ে এসে তনুকার গাল চেপে ধরে। হিসহিসিয়ে বলে,
‘তার আগে আমিই যদি তোমাকে ছিড়ে খাই, তবে?’
তনুকার রাগে শরীর রি রি করে উঠে যেন। রাজীবের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে,
‘আজরাইল আপনার আশে পাশেই ঘুরছে, আজ মৃ ত্যু নিশ্চিত।’
রাজীব ফের হাসে। তনুকার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,
‘তোমার রূপের আগুনে আমি তো সেই কবেই পুড়ে মরেছিলাম, আজ না হয় আবার নতুন করে ম রব। ঐ মেহতাবটা সবসময় আমার সব কাজে বাঁধা ছিল কিন্তু, আজ সে আর নেই। তাই আজ আর কোনো বাঁধাও নেই। আজকের রাতের জন্য তুমি শুধু আমার, কেবল আমার।’
এই বলেই রাজীব তাকে জড়িয়ে ধরতে যায়। তনুকা সজোরে থা প্পড় মেরে বসে। চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘খবরদার কাছে আসবি না। আগেও একবার আমাকে অসম্মান করেছিলি বলে মেহতাব তোর কী অবস্থা করেছিলে, মনে নেই? কলিজায় এইটুকুও ভয় থাকলে ছেড়ে দে আমায়, নয়তো মেহতাব কিন্তু তোকে ছাড়বে না।’
রাজীব এই কথা শুনে আরো বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। সে উন্মাদের মতো এগিয়ে আসতে নেয় তবে, কাছে আসার আগেই দরজায় জোরে জোরে করাঘাত করে কেউ। বিরক্ত হয় সে। দরজাটা এসে খুলে দেয়। তারই একটা ছেলে তখন হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠে,
‘ভাই, আমাদের ম দের গোডাউনে আগুন লেগেছে। জলদি চলুন।’
রাজীব আর সাত পাঁচ না ভেবেই দ্রুত দরজায় তালা লাগিয়ে দৌড় দেয় তার গোডাউনের দিকে।
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৬।
হাত পা বাঁধা তার, মুখও বাঁধা কাপড়ে। এমতাবস্থায় হাঁসফাঁস করছে রাজীব। নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু, সম্ভব না। এই হাত পায়ের বাঁধন খোলা কোনোভাবেই সম্ভব না। রাজীবের শরীর কাঁপছে রাগে। সে জানে, এই কাজ মেহতাবের। সে একবার নিজেকে ছাড়াতে পারলে, মেহতাবকে খু ন করে তবেই ফিরবে। প্রতিজ্ঞাটা খুব শক্ত ভাবে করল সে।
মেহতাব ঘরে প্রবেশ করল তখনই। মেঝেতে পড়ে থাকা রাজীবকে পা দিয়ে লাথি মেরে বলল,
‘কীরে, কেমন লাগছে?’
রাজীব তাকে দেখে জ্বলে ওঠে। পানি বিহীন মাছের মতো ছটফটাতে থাকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য। মেহতাব হাসে তা দেখে। বলে,
‘আহারে! তোকে দেখে না বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার।’
রাজীব যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিতে চায়ছে মেহতাবকে। মেহতাব তার সেই চাহনি দেখে আরো একবার লাথি দেয়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘একটু পর তাকানোর জন্য আর ঐ চোখ দুটোও থাকবে না। তনুকে কোথায় রেখেছিস বল?’
প্রশ্ন করার পর পরই মেহতাব তার মুখ থেকে কাপড়টা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই গালি দিয়ে উঠে রাজীব,
‘শু য়োরের বাচ্চা, তোর সাহস হলো কী করে আমাকে আটকে রাখার? তুই জানিস না আমি তোর কী অবস্থা করব।’
মেহতাব তার পেট বরাবর আরো একবার লাথি মেরে বলে উঠে,
‘নিজের অবস্থার কথা আগে ভাব, শালা। তনুর খবর না পাওয়া অবধি জ্যান্ত লা শ বানিয়ে রেখে দিব।’
রাজীব গর্জে উঠে বলে,
‘বলব না আমি, কী করবি তুই?’
মেহতাবের রাগ আকাশ ছুঁলো। সে চেঁচিয়ে ডাকল ইশফাককে। ইশফাক ছুটে এল বাইরে থেকে। মেহতাব বলল,
‘চাপাতি নিয়ে এসো এক্ষুনি।’
ইশফাক দ্রুত চাপাতি এনে মেহতাবের হাতে দেয়। মেহতাব চাপাতিটা রাজীবের মুখ বরাবর ধরে জিজ্ঞেস করে,
‘বলবি না তনু কোথায়?’
রাজীব চোখ মুখ খিঁচে বলল,
‘না।’
মেহতাব আর বিলম্ব করল না। সঙ্গে সঙ্গেই কো প বসাল রাজীবের ডান হাতের উপর। গলগলিয়ে রক্ত পড়তে আরম্ভ করল সেখান থেকে। রাজীব আঁতকে ওঠে যেন। রেগে যায় আরো। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট জারি রাখে। মেহতাব ফের প্রশ্ন করে,
‘বলবি না?’
‘না।’
রাজীব এখনো তার সিদ্ধান্তে অটল। মেহতাব চোখ বোজে নিশ্বাস নেয়। তারপর ইশফাকের দিকে চেয়ে বলে,
‘এর হাতের বাঁধন খুলে বাম হাতটা চেপে ধরো।’
ইশফাক তাই করল। হাতের বাঁধন খোলার সাথে সাথেই রাজীব দ্রুত মেহতাবকে আঘাত করতে চায়ল। তবে, পারল না। ডান হাতটা চেপে ধরে ইশফাক। বাম হাতে আঘাত পেয়েছে বলে সেই হাতে আর জোর পাচ্ছে না সে। মেহতাব এগিয়ে গিয়ে তার বাম হাতটা উঁচু করে ধরে। কাটা অংশে আবার কো প বসায়। এবার চেঁচিয়ে উঠে রাজীব। প্রথমবারের আকস্মিক আঘাতটা সে বুঝে উঠতে না পারলেও এবার বেশ বড়ো সড়ো ব্যথাই অনুভব করছে সে। সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য পাগলের মতো হাত পা ছুড়তে থাকে। মেহতাব শান্ত স্বরে শুধায়,
‘তনু কোথায়? বললে বেঁচে যাবি।’
রাজীব হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘জানি না আমি।’
মেহতাব আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। সে নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে তৃতীয় কো প বসায় একই জায়গায়। এইবার হাড়ে গিয়ে লাগে বোধ হয়। হাতটা বাঁকা হয়ে যায় এতে। অসহ্য যন্ত্রণায় গগনবিদারি চিৎকার দেয় রাজীব। তার ছটফটের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। মেহতাব বলে,
‘তনু কোথায়, বল? ছেড়ে দিব তোকে।’
রাজীব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। র ক্তের বন্যা বইছে যেন। সে আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না। চোখে নাকে পানি ছুটেছে। মেহতাব নরম গলায় বলল,
‘বলে দে, রাজীব। ছেড়ে দিব। অযথা কেন নিজের জীবন নিয়ে এভাবে খেলছিস?’
রাজীব বড়ো বড়ো শ্বাস নিল। দম আটকে আসছে তার। রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে বলল,
‘আমার বাড়িতে, গোপন কক্ষে।’
মেহতাব আরো একবার আস্তে করে কো প বসাল। তারপর লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিল তাকে। ইশফাককে বলল,
‘ওর একটা ছেলেকে না টাকা খাইয়েছ, তাকে গিয়ে বলো তাদের ভাই বলেছে, তনুকে এখানে এনে রেখে যাওয়ার জন্য। আর শোনো, তনুকে হাতে পাওয়ার পর ঐ ছেলেটাকেও মে রে দিবে; আমি কোনো ঝামেলা রাখতে চাই না।’
ইশফাক উঠে দাঁড়ায়। মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ঠিক আছে।’
অতঃপর বেরিয়ে পড়ে ইশফাক। মেহতাব পায়ের উপর পা তুলে বসে। তার সম্মুখে পড়ে থাকা রাজীবের জ্ঞানহীন অসাড় শরীরটাকে দেখে আর ভাবে, “অনেকদিন হলো গরীব দুঃখী খাওয়ানো হচ্ছে না। আগামীকাল মহলে ফিরে আরেকটা আয়োজন করতে হবে।”
মেহতাবের কথা মতো সব কাজ সম্পন্ন হয়। রাজীবের সেই টাকা খাওয়া ছেলে ইশফাকের কথামতো মিথ্যে বলে তনুকাকে সেই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসে। যদিও তনুকা আসতে চায়ছিল না তবে, গেইটের বাইরে এসে ইশফাককে দেখে আশ্বস্ত হয় সে। বুঝে যায়, মেহতাব তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে।
তনুকাকে দেখেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরে মেহতাব। এত শক্ত ভাবে ধরে যে, তনুকা নিশ্বাস নেওয়ারও ফুরসত পাচ্ছে না। মেহতাব বিধ্বস্ত স্বরে বলে উঠে,
‘আমাকে ক্ষমা করো, বিবিজান। আমি তোমাকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে পারিনি।’
‘এই গ্রামে আপনার এত বড়ো শত্রু আছে, আগে বলেননি কেন আমায়?’
‘ভাবেনি ঐ হারাম’জাদার এত বড়ো কলিজা হবে। তবে, চিন্তা করো না ওর এই সাহসের উত্তম প্রতিদান দিব আমি।’
তনুকা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘উনি এখন কোথায়?’
‘আমার কাছে বন্দি আছে।’
তনুকা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলল,
‘সেকী! কীভাবে করলেন এসব?’
‘ইশফাক সাহায্য করেছিল। এখন এসব বাদ দাও। আর ও তোমার সাথে কোনোপ্রকার খারাপ ব্যবহার করেনি তো?’
তনুকা ইতস্তত সুরে বলল,
‘করতে চেয়েছিল তবে, আমিও চড় মেরে একদম সোজা করে দিয়েছি।’
মেহতাবের চোয়াল তাতেই শক্ত হয়। রাজীবকে নিজ হাতে টুকরো টুকরো করা না অবধি কলিজা ঠান্ডা হবে না তার। সে তনুকার গালে হাত রাখে। নরম সুরে বলে,
‘তুমি ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। ইশফাক ভেতরে খাবার রেখে দিয়েছে, খেয়ে নিও। আমি এক ঘন্টা বাদে আসছি।’
তনুকা উদ্বিগ্ন সুরে প্রশ্ন করে,
‘আপনি এখন কোথায় যাবেন?’
‘আশেপাশেই আছি। তুমি নিশ্চিন্তে গৃহের ভেতরে থাকতে পারো। আমি সেখানে প্রহরীর ব্যবস্থা করেছি।’
মেহতাব তনুকাকে রেখে তার অতি জরুরি কাজে যায়। তনুকা ঘরে বসে থাকে একাই। বাইরে প্রহরী আছেন দুজন। ভেতরে খাবার পানির সবকিছুর চমৎকার ব্যবস্থা আছে। সাথে চারদিক পরিপাটি করে সাজানো। তনুকা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। তার মন বলছে, রাজীব বোধ হয় আর বাঁচবে না।
প্রায় ঘন্টা খানিক বাদে মেহতাব তার অস্থায়ী আবাসে ফিরে আসে। তনুকা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহতাব ক্লান্তি ভরা দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীকে পরখ করে গভীর মনোযোগে। এত মায়া কেন মেয়েটার চোখে মুখে? এই মায়ার ইন্দ্রজাল’ই তো কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। মেহতাব তার শিউরে বসে। আলতো হাতে তার গাল স্পর্শ করে। এগিয়ে এসে কপালে চুম্বন করে। তারপর সরে আসে আবার। কিছুটা দূরত্ব রেখে বসে আনমনেই বলে উঠে,
‘আমার ভালোবাসায় এইটুকুও খাদ ছিল না, তনু। তাও তুমি আমায় ঠকালে; আমি এখন কী করে ক্ষমা করব তোমায়, বলো তো? আমি যে বড্ড পাষাণ, বড্ড পাষাণ, তনু।’
চলবে…..