#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫১।
ইশফাকের কথা শুনে হাসল মেহতাব। ইশফাক খানিক ভড়কাল। তার এই কথার বিপরীতে মেহতাবের হাসিটা ঠিক যুতসই ঠেকছে না, তাই সাহস করে প্রশ্ন করল,
‘হাসছেন কেন, ভাইজান?’
মেহতাব হাসি থামিয়ে বলল,
‘বুঝলে তো ইশফাক, ছোট কাকা এত অল্প বয়সে মারা যাক তা আমি চাইনি। কিন্তু, কী করার বলো? উনি তো নিজেই নিজের পায়ে কুঁড়াল মা রলেন। উনার জন্য এখন না আমার বড্ড মায়া হচ্ছে।’
ইশফাক বুঝল, এই হাসি বিদ্রুপের। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘এখন কী করা উচিত?’
‘বি ষ! বি ষ দিয়েই তো মা রতে চেয়েছিল আমাকে? সে বি ষেই প্রাণ যাবে তাঁর।’
ইশফাককে আর বাকিটুকু বলতে হয়নি, বুঝে গিয়েছে সে।
ইশফাক চলে যাওয়ার পর মেহতাব তার কক্ষে ফিরে আসে। মনে আজ অসুখ হয়েছে। যার দরুন, চারদিক ফ্যাকাশে লাগছে খুব। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তনুকা ঘরে নেই। হয়তো রেনুর ঘরে, নয়তো অন্য কোথাও। আজকাল মেহতাব বড্ড উদাসীন হয়ে ওঠেছে, হয়তো পরিকল্পনার শেষ পর্যায়ে তাই। চারপাশটা বিষাক্ত ভীষণ। এই বিষাক্ততা সে আর বেশিদিন কুলিয়ে উঠতে পারবে না। সময় হয়তো এসেছে, এবার তার বিবিজানকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়ার পালা। মেহতাব ম্লান হাসে। তনুকার মুখটা চোখে ভাসছে তার। মেয়েটাকে ভালোবাসে সে, তার বড্ড কাছের। অথচ মেয়েটা মূর্খ, বুঝল’ই না। মেহতাবের মন খারাপ হয়। চোখ বোজে শুয়ে থাকে তাই।
_____
‘বউমনি, আমি কি বিয়ের শপিং করব না?’
‘করবে তো।’
‘ভাইজানকে বলো না গিয়ে।’
‘আচ্ছা, বলব।’
রেনু খুশি হয়। আপ্লুত সুরে বলে,
‘আমি একটা লাল শাড়ি কিনব।’
তনুকা মাথা হেলিয়ে বলে,
‘আচ্ছা।’
‘তুমি কি কিনবে?’
‘আমার তো অনেক শাড়ি আছে, নতুন কিনতে হবে না।’
‘উঁহু, অবশ্যই কিনতে হবে। আমার বিয়েতে সবাই নতুন কাপড় কিনবে বুঝেছ?’
তনুকা হাসল। বলল,
‘ঠিক আছে।’
রেনু জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি মেহেদী পরাতে জানো?’
‘হ্যাঁ। পরবে?’
রেনু উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’
‘কিন্তু, মেহেদী এখন কোথায় পাবে?’
‘আমি এক্ষুনি গিয়ে ইশফাককে বলি, উনি নিয়ে আসবেন।’
‘আচ্ছা তুমি বসো, আমি তোমার ভাইজানকে দিয়ে বলাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে।’
তনুকা তার ঘরে ফিরে। মেহতাব শুয়ে আছে বিছানায়। এক হাত কপালে তোলা। ঘুমন্ত মুখ দেখেও মনে হচ্ছে সে ভীষণ চিন্তিত। তনুকা আস্তে করে ডাকে তাকে,
‘শুনছেন?’
মেহতাব চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই বলে,
‘হু, বলো।’
‘কাউকে একটু মার্কেটে পাঠিয়ে দুইটা মেহেদী আনাতে পারবেন?’
‘হঠাৎ মেহেদী?’
‘বিয়েতে পরে না? রেনুরও শখ হয়েছে।’
‘আচ্ছা, আমি একজনকে পাঠিয়ে দিব।’
‘ইশফাক ভাইকে এখনই বলে দিন।’
‘ইশফাক অন্য কাজে গিয়েছে। ফিরতে লেইট হবে অনেক। অন্য কাউকে দিয়ে আনিয়ে দিব আমি।’
‘আচ্ছা।’
তনুকা পা বাড়াতেই ওড়না’ই টান পড়ে। গলায় হাত দিয়ে ঘুরে তাকায় সে। মেহতাবের এক হাতে তার ওড়না প্যাঁচানো দেখে। অথচ তার ভাবমূর্তি এখনো আগের মতোই। তনুকা জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু বলবেন?’
‘জরুরি কোনো কাজ না থাকলে আমার পাশে একটু বসবে?’
তনুকা বসল মেহতাবের পায়ের কাছে। মেহতাবের হাতে এখনো তার ওড়না প্যাঁচানো। ওড়নাটা সে বুকের কাছে নেয়, তারপর চেপে ধরে শক্ত করে। বলে উঠে,
‘কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো, বিবিজান?’
তনুকা অবাক হলো। বলল,
‘হঠাৎ এসব কথা কেন বলছেন?’
মেহতাব চাইল চোখ মেলে। বলল,
‘তোমাকে হারিয়ে আমি কী নিয়ে বাঁচব, বলো তো? কী আছে আমার? কিচ্ছু নেই। আমি যে তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই, বিবি। প্লিজ, আমায় ছেড়ে যেও না।’
তনুকা হতভম্ব। সারাদিন সিংহের ন্যায় দাপট করে বেড়ানো পুরুষ মানুষটা এখন তার নিকট নিত্যান্তই এক অসহায় বেড়াল ছানা বনে গিয়েছে। কী আশ্চর্য! লোকটা এত আবেগী হয়ে উঠছেন কেন? তনুকা মাথা নুইয়ে বলে উঠে,
‘আপনার কেন মনে হচ্ছে, আমি আপনাকে ছেড়ে যাব?’
মেহতাব হাসে। ওড়নাটাতে খানিক টান দিয়ে বলে,
‘ভালোবাসালে মানুষ এমনিতেই সব বুঝতে পারে।’
তনুকা চেয়ে বলে,
‘তেমন কিছুই না। অযথা এসব নিয়ে না ভেবে বোনের বিয়ে নিয়ে ভাবুন।’
‘একটা গল্প বলব, শুনবে?’
মেহতাব তনুকার পূর্বের কথাকে পাত্তাই দিল। বিরক্ত হলো তাই সে। বলল,
‘না।’
মেহতাব কপাল কুঁচকাল। ওড়না টেনে বলল,
‘না শোনা অবধি ছাড়ছি না।’
‘বাচ্চাদের মতো করছেন কেন?’
মেহতাব হাসে ফের। বলে,
‘শুনো তবে…’
তনুকা বিমুখ মুখে বসে রইল। মেহতাব শুরু করল তার গল্প বলা,
‘আমার গল্পটা হলো এক অসহায় ছেলেকে নিয়ে। সেই ছেলেটা ছিল ভীষণ বদমাশ; ছোট থেকেই এমন সে। ভীষণ ডানপিঠে, একরোখা, ফাজিল একটা ছেলে। তাও আমার চোখে সে ভীষণ অসহায়। কেন বলছি জানো? কারণ সে জীবনে সব পেলেও তার সবথেকে প্রতীক্ষার, ভালোবাসা, ভালোলাগার জিনিসটাকে সে পায়নি কখনো। তার ক্ষমতা অনেক। অথচ সেই ক্ষমতা দিয়েও সেই জিনিস হাসিল করতে পারেনি। তুমিই বলো, সবকিছু কি আর ক্ষমতার জোরে পাওয়া যায়? যায় না তো। তাই ছেলেটা তার সেই প্রিয় জিনিস না পাওয়ার দুঃখে একদিন প্রচন্ড মন খারাপের বশে আত্মহ ত্যা করে বসে। অথচ বোকা ছেলে জানেই না, ম রে যাওয়া সবকিছুর সমাধান না। ম রে গেলেই কি সেই প্রিয় জিনিস তার হয়ে যাবে? যাবে না তো। তবে ম রে কী লাভ, বলো? বরং মে রে ফেলাটা লাভের। যেই প্রিয় জিনিস কখনো আমার হবে না, সেই প্রিয় জিনিসের এই দুনিয়াতে থাকারও কোনো অধিকার নেই। ওর জায়গায় আমি থাকলে তো আগে ঐ প্রিয় বস্তুটাকে দুনিয়া ছাড়া করতাম, তারপর বাকি কাজ।’
মেহতাব হাসল। তনুকা তার ওড়না টেনে বলল,
‘এসব আজগুবি কথা শোনানোর জন্য আমাকে বসিয়ে রেখেছেন? ছাড়ুন, আমার আরো অনেক কাজ আছে।’
মেহতাব ছেড়ে দিল। তনুকা পা বাড়াতেই সে বলল,
‘ঘেমে গেলে কেন, বিবিজান? গরম লাগছে খুব?’
তনুকা ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘না, ঠান্ডা লাগছে আমার।’
বলেই ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে যায় সে। মেহতাব শব্দ করে হেসে ফেলে। বলে উঠে,
‘আহারে, বেচারি! গল্প শুনেই ঘাম ছুটে গিয়েছে।’
____________
মেহতাব রাতে খাবার খায়নি। অনেক জোর করেও তাকে খাবার টেবিলে বসাতে পারেনি কেউ। যার ফলপ্রসূ মতিব মজুমদারের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছে। বেজায় রেগে আছেন তিনি। কপালের চামড়া কুঁচকে আছে। রাহীলা কতক্ষণ নিজে নিজেই মেহতাবকে গালমন্দ করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মতিব মজুমদারের চোখে ঘুম নেই। দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। অর্ধেকটুকু খেয়ে রেখে দেন। তখনই কল বাজে তার। রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
‘মেহতাব মজুমদারের মৃত্যু চাইলে এক্ষুনি বাগানের বড়ো আম গাছটার কাছে চলে এসো, আমি অপেক্ষায় আছি।’
ফোনটা কেটে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। মতিব মজুমদার অজ্ঞাত ব্যক্তিটাকে ঠিক চিনে উঠতে পারলেন না। কিন্তু, ভয় পেলেন। লোকটা মেহতাবের মৃত্যুর কথা বলছে, তার মানে সে জানে যে তিনিও মেহতাবের মৃত্যু চায়। কিন্তু, সে কে? তাঁর এই চাওয়া সম্পর্কে একমাত্র রাদাভ’ই জানে। তবে কি রাদাভ’ই ডেকেছে তাঁকে? হয়তো তাই। হয়তো সে কোনো দূর্দান্ত পরিকল্পনা কষেছে মেহতাবকে মা রার। মতিব মজুমদার আর দেরি করলেন না, দ্রুত বেরিয়ে গেলেন সেই জায়গার উদ্দেশ্যে। অথচ এত আগ্রহ নিয়ে সেখানে গিয়ে পেলেন না কাউকেই। বিরক্ত হয়ে এদিক ওদিক খুঁজলেন। তিনি ব্যতিত আর কেউ নেই সেখানে। তিনি ভয় পেলেন বোধ হয়। দ্রুত তাই পা বাড়ান মহলের দিকে। তবে এর আগেই ঘটে যায় সেই অঘটন। আচমকা একটা ঘ্রাণ পেয়ে সহসাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। একেবারে জ্ঞান শূণ্য হবার পর ইশফাক তাঁকে উঠিয়ে কাঁধে তুলে নেয়।
‘হাতের এটা কী, ভাইজান?’
‘পয়জন, যাকে বাংলায় বলে বি ষ। এই এক শিশি খেলে মরবে না, ইশফাক?’
‘হ্যাঁ, ম রে যাবে তো।’
মেহতাব হেসে বলে,
‘আর আমার চাপাতিটা তৈরি তো?’
‘জি, সেটাও তৈরি।’
‘তাই! তবে আর বিলম্ব কীসের? কাকার মুখটা চেপে ধরো তো ভালো করে।’
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫২।
ইশফাক ইতস্তত সুরে বলল,
‘ভাইজান, একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
‘দয়া করে গ্রামের মানুষকে এই মাংস খাওয়াবেন না।’
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘কেন?’
ইশফাক মাথা নোয়ায়। মেহতাবের মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই তার। তাও খানিক সাহস সঞ্চয় করে বলে,
‘আসলে ভাইজান, আমি চাই না আমাদের বিয়েতে কাউকে হারাম কিছু খাওয়ানো হোক।’
ইশফাকের কথা শুনে মেহতাব সশব্দে হাসে। বলে,
‘তুমি আবার কবে থেকে হারাম হালালেল পোরোয়া করছো, ইশফাক?’
ইশফাক অপ্রস্তুত হলো। আজীবন মেহতাবের করা সমস্ত কাজে সাহায্য করে এসেছে সে, প্রথমে ইতস্তত বোধ করলেও এখন সে অভ্যস্ত। কখনোই সে মেহতাবকে বাঁধা দেওয়ার সাহস করেনি। আজও করা উচিত নয়। কিন্তু, কোথাও একটা বিবেকে বাঁধছে যেন। যতই হোক, বিয়েটা তো তার। ইশফাক ঢোক গিলে। ইশফাকের যবুথবু অবস্থা দেখে মেহতাব হাসে ফের। বলে,
‘কাকার মুখটা চেপে ধরো।’
ইশফাক বলে,
‘কাকাকে বিষ খাওয়ালে সেই মাংস অন্য মানুষকে কী করে খাওয়াবেন? তাতে তো সেসব মানুষদেরও ক্ষতি হবে।’
‘অন্যের ক্ষতি নিয়ে তুমি আজকাল একটু বেশিই ভাবছ, ইশফাক। আর তোমাকে কে বলেছে এই মাংস আমি তোমার বিয়েতে দাওয়াত দেওয়া মানুষদের খাওয়াব? মতিব মজুমদারের মতো জঘন্য মানুষের মাংস খাবে রাজীব ভূইয়ার কুকুর। ওর কুকুরটা এনেছ না?’
‘জি ভাইজান, পাশের ঘরে বন্ধী আছে।’
‘সাড়া শব্দ যে পাচ্ছি না।’
‘অজ্ঞান হয়তো এখনো।’
‘ওহ। ঠিক আছে এবার জলদি করে কাজে নাম।’
জ্ঞানহীন অবস্থাতেই মুখে বিষ পুরে দিল মেহতাব। গলা দিয়ে সেই পানীয় পেটে যাওয়া ঘন্টা খানেকের মধ্যেই শুরু হয় এর প্রতিক্রিয়া। ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠে মতিব মজুমদারের শরীর। তাঁর চোখ বোজা। তাও শরীর কাঁপছে অনবরত। বাইরে থেকে ভেতরে চলা অশান্তি ঠাহর করা যাচ্ছে না। মেহতাব দূরে চেয়ারে বসা। খুশ মেজাজে বসে বসে মতিব মজুমদারের ছটফটানো দেখছে। চিত্ত জুড়ে শান্তির স্রোত বইছে তার। ইশফাককে পাঠিয়েছে রেনুর জন্য টুকটাক কেনাকাটার জন্য। আর সে বসে অপেক্ষা করছে মতিব মজুমদারের মৃ ত্যুর। তিনি মা রা গেলেই তাঁর নিথর দেহটাকে তার আরেক চরম শত্রুর কুকুরের খাদ্য বানাবে। হাসল মেহতাব। তার সমস্ত পরিকল্পনা সফল। আর বেশি মানুষ নেই, কেবল চারজন। তারপরই মুক্তি তার।
অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটাতে ছটফটাতে এক পর্যায়ে শরীরটা এক বিশাল ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়। মেহতাব বুঝে, জঘন্য আত্মাটা মুক্তি পেয়েছে। সে উঠে দাঁড়ায়। মতিব মজুমদারের শরীরটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পাশের ঘরে যায়। রাজীব ভূইয়ার কুকুরটা সেখানেই। তার জ্ঞানও ফিরেছে। মেহতাবকে দেখেই ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। মেহতাব তার কাঁধের শরীরটা কুকুরটার সামনে ফেলে। হেসে বলে,
‘এই নে তোর খাবার। তোর মালিকও হয়তো জীবনে এত দামী খাবার তোকে দেয়নি। খুশ মেজাজে এবার খেয়ে নে তো।’
কুকুটা ক্ষুধার্ত চোখে দেখছে মতিব মজুমদারের নিথর শরীরটাকে। তারপর এগিয়ে আসে। নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে। মেহতাব হাঁটু ভাঁজ করে বসে। জিজ্ঞেস করে,
‘এভাবে খেতে পারবি? নাকি কেটে টুকরো টুকরো করে দিয়ে সাহায্য করব?’
কুকুর কি আর মানুষের কথা বুঝে? তাও সেই কুকুর ঘেউ ঘেউ করে কী যেন বোঝায়। মেহতাব হেসে বলে,
‘বুঝেছি, তোর সাহায্য লাগবে।’
সে উঠে গিয়ে তার চাপাতিটা নিয়ে আসে। তারপর আবার হাঁটু ভাঁজ করে বসে তার কাকার নিথর শরীরটার সম্মুখে। ডান হাতটা টেনে ধরে কোপ বসায়। র ক্ত বের হতে শুরু করে। র ক্ত দেখে কুকুরটা আরো বেশি উদগ্রীব হয়ে ওঠে যেন। জিভ বের করে লালসার চোখে তাকায়। মেহতাব খুব সযত্নে মতিব মজুমদারের হাতের একটা অংশ কেটে কুকুটার সামনে রাখল। কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘খেয়ে নে এবার।’
মতিব মজুমদারের শরীরের টুকরোগুলো কুকুরটা বেশ আমোদ করে খাচ্ছে। মেহতাবকে তৃপ্ত করছে সেই দৃশ্য। সে হেসে ইশফাককে কল দেয়। সাথে সাথে রিসিভ করে ইশফাক। মেহতাব জিজ্ঞেস করে,
‘শপিং হয়েছে তোমার?’
‘জি, ভাইজান।’
‘চলে এসো তাড়াতাড়ি। এখানের কাজগুলোও গুছাতে হবে।’
‘জি, আসছি ভাইজান।’
____________
মহলের অভিমুখে এক বারান্দা আছে। বারন্দার চার কোণে চারখানা পাতাবাহারের বড়ো টব রাখা। রেলিং করা বারান্দায় গ্লিল নেই কোনো। আজ পূর্ণিমা নয়। আজ থেকে আরো পাঁচদিন আগে ছিল পূর্ণিমা। তাও চাঁদের বাঁকা অংশে অন্তরীক্ষে সেজেছে। মেঘের অপার্থিব আলোয়ে অঙ্গ সাজিয়েছে যেন। তনুকা অভিভূত। মিষ্টি হেসে বলে,
‘চাঁদটা আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে, তাই না?’
তার পাশের মানুষটি এসবে আগ্রহ দেখাল না। কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে চাঁদ দেখে বলল,
‘জমিটা কবে পাব বলো তো?’
তনুকা হতাশ হলো। বলল,
‘জমি পাওয়ার পর আমরা চলে যাব, কেমন?’
লোকটা ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
‘এত তাড়া দিলে হবে? এইটুকু জমি দিয়ে আমার কিছুই হবে না, পুরোটা লাগবে আমার।’
তনুকা উদ্বিগ্ন সুরে বলল,
‘এত লোভ ভালো না।’
লোকটা বাজখাঁই স্বরে বলল,
‘তোমাকে যতটুকু বলব ততটুকুই করবে। অযথা কোনো কথা বলবে না।’
তনুকার মনঃক্ষুন্ন হলো। মানুষটা চলে গেল তাকে একা রেখে। ঢোক গিলে ফের চাঁদের দিকে চাইল তনুকা। একটু আগের চমৎকার সুন্দর চাঁদটাকেও এখন বিষাদের এক ক্ষুদ্র খন্ড লাগছে কেবল। চাঁদের ন্যায় নিজেকেও বড্ড একলা মনে হলো। তখনই কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শে সে চমকায়। পেছন ফিরে মেহতাবকে দেখে ভীত হয় ভীষণ। মেহতাবের চোখ মুখের স্বাভাবিক দৃষ্টিও আতঙ্কিত করছে তাকে। মেহতাব জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি এত রাতে এখানে?’
তনুকা সেই প্রশ্ন উপেক্ষা করে উল্টো জানতে চাইল,
‘আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?’
‘কাজে। তুমি না ঘুমিয়ে এখানে কী করছো?’
তনুকা আই-ঢাঁই করছে। উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তাও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘ঘুম আসছিল না বলে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদ দেখছিলাম।’
মেহতাব আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে। চাঁদ অদৃশ্য। মেঘের মেলায় তলিয়ে গিয়েছে হয়তো। মেহতাব বলে,
‘চাঁদ তো হারিয়ে গিয়েছে।’
তনুকাও তাকায়। বলে,
‘হ্যাঁ, হারিয়ে গিয়েছে। আমিও এভাবে হারিয়ে যাব।’
মেহতাব হাসে। পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
‘তোমাকে তো আমি হারাতে দিচ্ছি না, বিবিজান।’
তনুকা মেহতাবের দিকে তাকায়। মেহতাব চট করে তনুকাকে কোলে তুলে নেয়। আচমকা এমন কিছুই ঘাবড়ে যায় তনুকা। মেহতাবের গলা জড়িয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। বলে উঠে,
‘কী করছেন, নামান আমায়।’
মেহতাব ম্লান হাসে। বলে,
‘উঁহু।’
তনুকা অনেক জোরাজুরি করেও মেহতাবের কোল থেকে নামতে পারে না। মেহতাব তাকে নিয়ে নিজের ঘরে যায়। বিছানার কাছে গিয়ে তাকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অতঃপর বাতি নিভিয়ে এসে সেও শুয়ে পড়ে তার পাশে। তনুকার অস্বস্তি হয়। মেহতাবের হাতের স্পর্শের গভীরতা তাকে সংকুচিত করে তুলছে যেন। তনুকার নড়া চড়া ক্ষান্ত হয়েছে। সে জমাট বাঁধা দৃঢ় শরীর নিয়ে শুয়ে আছে চুপচাপ। মেহতাবের উষ্ণ শ্বাস তনুকার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। খানিক নড়ে উঠে সে। মেহতাব তার হাতের বাঁধন শক্ত করে। তনুকা ক্ষীণ সুরে বলে,
‘আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন?’
‘তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে শান্তি দিচ্ছে না, বিবি।’
তনুকা বলে,
‘নিজ ইচ্ছায় কেউ হারাতে চাইলে তাকে কি আর জোর করে আটকাতে পারবেন?’
‘মেহতাব মজুমদার সব পারে।’
তনুকা মৃদু হেসে বলল,
‘এবার আর পারবেন না আপনি।’
মেহতাব আকস্মিক তনুকাকে আরো ভড়কে দেয়। গলায় তার দাঁতের স্পর্শে তনুকা চোখ মুখ খিঁচে নেয়। অস্থির হয়ে উঠে সে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
‘এভাবে কাউকে আটকে রাখা যায় না, মেহতাব মজুমদার।’
মেহতাব তার দাঁত লাগানো জায়গাতে ঠোঁট বুলিয়ে বলে,
‘আমি আগেও বলেছি, মেহতাব মজুমদারের অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছ তুমি, মৃত্যু ব্যতিত আর কেউ তোমাকে আলাদা করতে পারবে না, বিবিজান।’
‘তবে মৃত্যুই শ্রেয়।’
মেহতাব স্মিত হাসে। বলে,
‘সেটা অবশ্য আমার হাতেই।’
চলবে….