প্রাণেশ্বর পর্ব-৫৯

0
381

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৯।

হাসপাতাল থেকে খবর আসে, অপারেশনের পর ইশফাক এখন ঠিক আছে। জীবিত সে। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে স্বাভাবিক ভাবেই। ডাক্তার তনুকাকে মৃত ঘোষণা করেছেন, তার সাথে রাদাভকেও। তবে, মেহতাব আই সিউ তে। তার বিষ পানের আধ ঘন্টার ভেতর সেখানে পুলিশ সহ গ্রামের মানুষ হাজির হয়। বিচার মহলের দরজা ভেঙে তাদের সবাইকে উদ্ধার করে পুলিশ। তনুকা সেখানেই মৃত ছিল। তবে, শ্বাস প্রশ্বাস চলছিল ইশফাক আর মেহতাবের। তাদেরকে তাই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আর মহলের বাকি সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। সবাই সবকিছু সম্পর্কে অবগত থাকলেও রেনু ছিল একেবারে প্রস্ফুটিত পুষ্প। সে জানত না কিছুই। নিজের সদ্য বিবাহিত স্বামী, ভালোবাসার ভাইজান আর প্রিয় বন্ধু তনুকার শোচনীয় অবস্থা দেখে বেচারি ভেঙে পড়েছে একেবারে। কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে এখন থম মেরে বসে আছে কেবল। মুখে কোনো রা নেই। আশেপাশের কিছুই কানে যাচ্ছে না তার। পুলিশ তার সাথেও কথা বলতে চেয়েছিল তবে, তার এহেন করুণ অবস্থা দেখে আর প্রশ্ন করেনি।

এস.আই দ্রুত হাসপাতালে যান। ডাক্তারের কাছ থেকে মেহতাবের খোঁজ নিতেই তিনি জানান,

‘বিষটা পুরোপুরি বের করা হলেও এর বিষক্রিয়া ঘটে গিয়েছিল আরো আগেই। অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। তাও আই.সি.ইউ তে রেখেছি আমরা। এখন বাকিটা ভাগ্যের ব্যাপার। আর ইশফাক বলে যিনি আছেন, তিনি আপাতত বিপদ মুক্ত আছেন। উনাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান ফিরে আসবে।’

‘ঠিক আছে, ডক্টর; ধন্যবাদ।’

ডাক্তার তাঁর অন্য কাজে গেলেন। এস.আই গেলেন মেহতাবের আই.সি.ইউ কেবিনের সামনে। মুখে অক্সিজেন মাক্স দেওয়া, হাতে স্যালাইন চলছে। কিছুক্ষণ আগেও যার দাপটে একটা গ্রাম চলত, সে এখন নিত্যান্তই এক অসহায় মানব যে প্রতিনিয়ত তার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছে। মেহতাবের সমস্ত কথা শুনে অফিসার নিজেও অবাক হয়েছেন। তাকে দেখে একবারের জন্য মনে হয়নি সে মানসিক ভাবে অসুস্থ। অথচ, আজ এত কিছু শুনে মনে হচ্ছে যেন, মানুষটা সাইকো। নাহলে এত জঘন্য সব কাজ কেউ করতে পারে!

ইশফাককে কেবিনে দেওয়ার আধ ঘন্টার পর জ্ঞান ফিরে তার। সে চোখ মেলে তাকিয়ে প্রথমেই দেখে তার নববধূকে। চোখ পিটপিট করে ভালো ভাবে মেলে ধরে। রেনু চেয়ে আছে। নিরেট শূণ্য সেই চাহনি। ইশফাকের ক্লান্ত দৃষ্টি তার অসহায় মনটাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই পুলিশের কাছ থেকে সব শুনেছে সে। ইশফাকের করা সমস্ত প্রতারণার সাথেও অবগত। তাও একেবারে নীরব নিস্তব্ধ দেখাল তাকে। ইশফাক ঠোঁট নাড়িয়ে যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু, পারে না। কষ্ট হচ্ছে তার। পেটে টান অনুভব করছে। রেনু নিজ থেকেই এগিয়ে আসে। ইশফাকের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বলে,

‘আমাকে ঠকালেন কেন, ইশফাক? আমার কি ভুল ছিল?’

ইশফাকের নিষ্পলক চাহনি। অপ্রিতভ ভাবমূর্তি। রেনুর চোখ ছলছল করছে জলের উদ্বেগে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

‘আপনি কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেননি, তাই না?’

ইশফাক ফ্যালফ্যাল করে চাইল। হালকা ঠোঁট নাড়াল সে। একেবারেই ক্ষুদ্র আওয়াজে বলল,

‘তনুকা কেমন আছে?’

রেনু ঢোক গিলে বলল,

‘বেঁচে নেই।’

ইশফাক হকচকিয়ে ওঠে। অস্থির হয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। বসতে নেয় দ্রুত। তাতে পেটে আচানক চিনচিন করে ব্যথা করে ওঠে। তার অস্থিরতা দেখে রেনু ঘাবড়ে যায়। এক হাতে ইশফাককে আগলে ধরে বলে,

‘অস্থির হবেন না। সব হারিয়ে আপনার আশাতেই বেঁচে আছি। প্লিজ, আপনি একটু শান্ত হোন।’

ইশফাকের গলা দিয়ে আওয়াজ না বের হলেও চেঁচিয়ে উঠল সে। বলল,

‘শান্ত হব? কী করে শান্ত হতে বলছো? তোমার ঐ জানো য়ার ভাই বি ষ দিয়ে আমার বোনটাকে মে রে ফেলেছে। নিজের বোনের মৃ ত্যুর খবর শুনেও শান্ত থাকতে বলছো আমায়? কোথায় সে? কোথায় সেই জালিম? আমি নিজ হাতে আজ তাকে খু ন করব।’

তার চেঁচামেচিতে নার্স, ডাক্তার সকলেই দ্রুত কেবিনে এসে হাজির হয়। ডাক্তার উদ্বিগ্ন সুরে বলেন,

‘নার্স, উনাকে দ্রুত ইনজেকশন দিন। উনার শান্ত হওয়াটা জরুরি।’

নার্স তাই করল। জোর করে একটা ইনজেকশন পুষ করল ইশফাকের হাতে। ইশফাক হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে এক পর্যায়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রেনু অসহায় চোখে তাকাল ডাক্তারের দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘উনি এমন করছেন কেন, ডাক্তার?’

‘আমার যতটুকু ধারণা কোনো বিষয় নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়েই এমন করছিলেন উনি। আপাতত উনাকে অতীত নিয়ে কোনোপ্রকার চাপ দেওয়ার দরকার নেই। যতটুকু পারুন, সুস্থ হবার জন্য আশ্বাস দিন। সেটাই কাজে দিবে। আগের কথা এখন আর কিছু না বললেই ভালো।’

ডাক্তার চলে গেলেন। নার্স রয়ে গেল কেবিনেই। রেনু আস্তে করে বাইরে বেরিয়ে আসে। গিয়ে দাঁড়ায় ভাইয়ের কেবিনের সামনে। চোখে নিয়ন্ত্রিত জলের উদ্বেগ এখন গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। কন্ঠস্বর ভেঙে আসে তার। বিধ্বস্ত সুরে বলে উঠে,

‘এমনটা কেন করলে, ভাইজান? বউমনিকে কেন মা রলে? কেন গ্রামের মানুষদের সাথে এতটা অন্যায় করলে? কেন নিজের বাবা কাকাসহ আরো কত শত মানুষের খু নি হলে? কেন, ভাইজান; কেন? কেন এমন করলে? আজ তোমার জন্য আমি সব হারিয়েছি। আমার এত এত কষ্টের দায়ভার কি নিবে তুমি, বলো? বলো, ভাইজান। নিজের আপন ভাইটাকেও বাঁচতে দিলে না। এত নিষ্ঠুর তুমি কী করে হতে পারলে, বলো?’

রেনু চেঁচিয়ে ওঠে। হাসপাতালের অন্যান্য মানুষ বিরক্ত চোখে তাকায় তার দিকে। কিছুক্ষণ বাদেই একজন স্টাফ এসে বলেন,

‘চেঁচাবেন না, ম্যাডাম। বাকি রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে।’

রেনু তার কথা শুনে মুখে কাপড় চেপে কাঁদতে কাঁদতে ওয়াশরুমের দিকে দৌড়ে যায়।

____

পুরো গ্রামে হৈ চৈ পড়েছে এক। এক দল লোক এসে মহলে হামলা করে গিয়েছে। পাহারাদার সহ বাকি ভৃত্যদের বেদম পিঠিয়েছে। বাড়ির কাউকে পায়নি, পেলে বোধ হয় খু ন করতেও দুবার ভাবত না। আবার আরেকদল গিয়েছে থানায়। তারা পারছে না হাসপাতালে গিয়ে মেহতাবকে মে রে আসতে। তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে এত বছর এই জমিদাররা তাদের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছে তার শাস্তি স্বরূপ গা থেকে তাদের চামড়া তুলে নিলেও কম হয়ে যাবে। পুলিশ যথাসম্ভব তাদের শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে পুরো গ্রাম যেভাবে ক্ষেপেছে, কতক্ষণ বুঝিয়ে রাখতে পারবে তা চিন্তার বিষয়।

আবারও প্রায় দেড় ঘন্টা পর চোখ মেলে তাকায় ইশফাক। তখন কেবিনে নার্স, ডাক্তার বা রেনু ছিল না। সে আশেপাশে চোখ বুলায়। ধীরে ধীরে ওঠে বসে। শরীরে শক্তি পাচ্ছে না বিন্দুমাত্রও। সে হাত থেকে স্যালাইনের সুঁইটা এক টানে খুলে আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার কিছুটা সামনে আসতেই একজন ওয়ার্ড বয়কে দেখে সে। হাত নাড়িয়ে ডাকে তাকে। ছেলেটা এসে জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু লাগবে আপনার?’

ইশফাক ধীর আওয়াজে বলে,

‘ফোন আছে তোমার কাছে?’

ছেলেটা বলে,

‘হ্যাঁ, আছে তো।’

‘দাও, আমার এক আত্মীয়কে কল দিয়ে এখানে আসতে বলব।’

ছেলেটা তার ফোন দিল বের করে। ইশফাক একটু দূরে গিয়ে কাউকে একটা কল লাগাল। কলটা রিসিভ হতেই ধীর আওয়াজে সে বলল,

‘এতক্ষণে খবর নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছিস সব? আমার বোনকে খু ন করে মেহতাব মজুমদার এখনো জীবিত কী করে? আমার তোর সাহায্য লাগবে। তাকে খোঁজে বের করে যেভাবেই হোক খু ন কর।’

ওপাশ থেকে ছেলেটা বলল,

‘খুঁজে বের করতে হবে না। সেও এখন হাসপাতালেই, আই.সি.ইউ তে ভর্তি।’

‘বলিস কী! ওর কী হয়েছিল?’

‘শুনেছি, সেও নাকি বি ষ খেয়েছিল।’

‘তাহলে শা লা ম রল না কেন?’

‘দ্রুত হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করাতে বেঁচে গিয়েছে। তবে, এখনও বিপদ কাটেনি।’

‘তুই হাসপাতালে আসতে পারবি?’

‘আপনি বললে পারব, ভাই।’

‘চলে আয় তবে। যেভাবেই হোক মে রে দে ওকে।’

‘আচ্ছা। আমি দেখছি।’

কল কেটে নাম্বার ডিলিট করে মোবাইলটা আবার ফিরিয়ে দিল ওয়ার্ড বয়কে। তারপর সে গিয়ে ফের বসল তার জায়গায়। আচমকা এদিক ওদিক চেয়ে গলা উঁচিয়ে অযথাই চেঁচাতে আরম্ভ করল।

চলবে….