প্রাণেশ্বর পর্ব-৬০ এবং শেষ পর্ব

0
619

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬০।(অন্তিম পর্ব)

দুদিন পর মজুমদার বাড়ির সবাইকে কোর্টে এনে হাজির করা হয়। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে সমস্ত রহস্য উদঘাটন করেছেন। মজুমদার বাড়ির মানুষদের পাপের কমতি নেই। কেউ কারোর চেয়ে কম নয় যেন। পাপের হিসাব করতে বসলে বছর পেরিয়ে যাবে হয়তো। ইশফাকও অপরাধী। মেহতাবের সাথে থেকে তাকে খু ন করতে সাহায্য করেছে সে। আর শেষ খু নটাও সে নিজেই করেছিল।

সবাইকে যার যার অন্যায় অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জেলে পাঠানো হলো। তার মধ্যে ইশফাক আর আম্বিরা বেগমকে দেওয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর মেহতাবকে দেওয়া হলো, মৃত্যুদণ্ড। যেহেতু এখন অসুস্থ সে, তাই আপাতত তার শাস্তি স্থগিত করে রাখা হয়েছে। সুস্থ হলেই তা কার্যক্রম করা হবে।

মেহতাব এখনো হাসপাতালে। শঙ্কা মুক্ত হলেও বর্তমানে সে প্যারালাইজড। তার শরীর অসাড় হয়ে পড়ে আছে। এর মাঝেই দুই দিন আগে এক ছেলে মা রতে এসেছিল তাকে। তবে পুলিশের কারণে পারেনি। পরে তাকে ধরেও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। খবর নিয়ে জানা যায়, সে ইশফাকের’ই লোক।

রেনু একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। শরীর থেকে তার যেন কাঁচা হলুদের গন্ধটাও এখনো যায়নি, এর মাঝেই সব হারিয়ে শূণ্য সে। রেনুর চোখের কোটর জলে ভরে ওঠে। আর কত কাঁদবে? আর কত কাঁদলে সবকিছু আবার ফিরে পাবে সে?

একজন নার্স আসেন। বলেন,

‘ম্যাডাম, আপনি আপনার ভাইয়ের কেবিনে এখন যেতে পারেন।’

রেনু আঁচলে চোখ মুছে হাঁটা ধরল সেদিকে। মেহতাবের কেবিনে প্রবেশ করে তার পাশে বসল। চোখ মেলে চাইল মেহতাব। রেনুর দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। হাত পা নাড়াতে পারছে না ঠিক মতো। মস্তিষ্কটাও যেন বিকল হয়ে পড়ে আছে। কেবল সক্রিয় আছে জখম ভরা হৃদয়টা। যেখান থেকে অদৃশ্য র ক্তক্ষরণ হয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। সে কাঁদতে পারছে না, চেঁচিয়ে বলতে পারছে না, “কেন আমি বেঁচে গেলাম, আমাকে কেউ মে রে ফেল। মেহতাব তার তনুকাকে ছাড়া কোনোভাবেই বাঁচতে পারে না। আমাকে যে আমার তনুকার কাছে যেতে হবে। কেউ মে রে ফেল আমায়।”

মেহতাব কিছু বলতে পারবে না কিন্তু, শুনতে পারবে অবশ্যই। তাই রেনু’ই বলতে আরম্ভ করে,

‘আম্মাজান আর ইশফাককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ছোট কাকীর এক বছরের জেল। মেঝ কাকা আর মেঝ কাকীর দুই বছরের জেল। আর বাকি রইলে তুমি, তোমাকে কোর্ট থেকে ফাঁসির অর্ডার দিয়েছে। সুস্থ হলেই তা কার্যক্রম হবে তোমার উপর।’

সব শুনে আশ্বস্ত দেখাল মেহতাবকে। সে যেন বরং খুশিই হলো কোর্টের এমন নির্দেশে। স্বস্তিতে চোখ বুজল। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। তনুকার ফ্যাকাশে মুখটা বারবার দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে তার। কী এক যন্ত্রণা, আজ অবধি এত খু ন করেছে, কারোর মৃত্যু দৃশ্য এতটা পোড়ায়নি তাকে যতটা তার বিবিজানের মৃত্যু দৃশ্য তাকে পোড়াচ্ছে। মেহতাব ক্লান্ত। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই মস্তিষ্ক জুড়ে তনুকার বিচরণ শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না তাকে। এটা যেন মরণ যন্ত্রণার চেয়েও অধিক কষ্টদায়ক তার কাছে। তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিটা রেনুর নজরে পড়ল। হাসল মেয়েটা। বলল,

‘বউমনির জন্য কষ্ট হচ্ছে, ভাইজান?’

মেহতাব সাড়া দেয় না কোনো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেও না। রেনু ফের বলে,

‘বউমনিকে খু ন না করলেও পারতে তুমি। মেয়েটা তো কেবল তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে এসেছিল, সেই জন্য মে রে দিলে তাকে? কী নিষ্ঠুর তুমি, ভাইজান।’

মেহতাবের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। সে নিমীলিত পাতায় তার নিজস্ব জগতে বিভোর। রেনু পুনরায় বিধ্বস্ত সুরে বলে উঠে,

‘তোমার জন্য আমাকেও সবকিছু হারাতে হয়েছে, ভাইজান। আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। কখনো না।’

কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রেনু। মেহতাব এতক্ষণে চাইল। নিষ্পলক চেয়ে রেনুর যাওয়া দেখল সে। বুকের ভেতরের হাহাকার’টা দ্বিগুণ হলো তার। বেডের পাশে একটা লম্বা টেবিলে এক ঝুড়ি ফল রাখা। সেই ঝুড়িতে ফল কাটার ছুড়িও বিদ্যমান। মেহতাব সেটাকেই দেখছে। এখানে থাকলে হয়তো কোনো একদিন সে সুস্থ হয়ে ওঠবে, তারপর মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হবে তাকে। কিন্তু, ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার ধৈর্য্য নেই তার। এখনই ম’রে যেতে পারলে বাঁচে সে। মেহতাব হাত নাড়িয়ে ধীর গতিতে ছুড়িটা হাতে নেয়। সে যে হাত নাড়াতে পারে সেটা কেউ জানে না। সেই সুযোগটাকেই এখন সে কাজে লাগাবে। ছুড়িটা হাতে নিয়ে স্যালাইন দেওয়া হাতের কব্জি বরাবর ঢুকিয়ে দেয় সেটা। তারপর নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে আড়াআড়ি টান দেয়। কব্জির শিরাটা কেটে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। গলগলিয়ে র ক্ত বের হতে আরম্ভ করে। মেহতাবের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাস্যরেখা। সে হাতখানা আস্তে করে মুখের উপর ধরে। হাত থেকে টপটপ করে র ক্ত পড়ে তার মুখের উপর। তৃপ্তি তে যেন অন্তর ভরে আসে তার। আবেশে চোখ বুজে। মনে মনে ভাবে, “আর কেউ আমায় আটকাতে পারবে না, বিবিজান। আমি আসছি।”

নার্স দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে কেবিনে আসতে ঘন্টা খানিক সময় লেগে যায়। তবে কেবিনে এসে এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। পিলে চমকে উঠে যেন। চেঁচিয়ে ওঠে। তার গলা পেয়ে রেনুও ছুটে আসে। ভাইয়ের রক্তাক্ত শরীর দেখে অন্তঃস্থলে ভয়ানক কম্পন শুরু হয় তার। ডাক্তার আসে, পুলিশ আসে। এবার অনেক চেষ্টা করেও মেহতাবকে আর বাঁচানো যায়নি। যে নিজ থেকে বেঁচে থাকতে চায় না, তাকে হাজার চেষ্টা করেও বাঁচানো সম্ভব না, এটাই বাস্তব। রেনু হতভম্ব হয়ে বসে আছে এক জায়গায়। এই ছোট্ট জীবনে আর কী কী হারানোর বাকি তার? কেন এমন হলো? কেন এক দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু? তার কী দোষ ছিল? কেন তার সাথেই হলো এসব? কেন? রেনু আর কাঁদে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। বের হচ্ছে না কোনোভাবেই।

মেহতাবের মৃত্যুর খবরে পুরো গ্রামে উৎসব লাগে যেন।কিছুদিন আগেও যেই মানুষটা তাদের নিকট ফেরেশতা সম ছিল, আজ সেই মানুষটার মৃত্যুর খবর পেয়েই আনন্দে মেতে উঠেছে তারা।

জীবন বৈচিত্র্যময়। এই জীবনে কখন কী ঘটে কেউ বলতে পারে না। মেহতাব ভাবেনি এসব হবে কিন্তু, হয়েছে। তনুকা চেয়েছিল মেহতাবের পরাজয়, কিন্তু মৃত্যু তাকে সেই চাওয়াটা পূর্ণ করতে দিল না। ইশফাক প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে নিজের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটাকে বিসর্জন দিল। অথচ পেল না কিছুই, এখন বাকি জীবন জেলে পঁচে ম রতে হবে তাকে। রাদাভ লোভ দেখাতে গিয়ে প্রাণটাই খুইয়ে বসল। তবে, কী পেল সবাই? কিছুই না। দিনশেষে শূণ্য হাতেই ফিরতে হলো সবাইকে। তারপরও তাদের আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না কিন্তু।

সমাপ্ত।