#প্রাণোদাহ
|১০|
– নবনীতা শেখ
নীহমের আজ মন ভালো, দিন ভালো যাচ্ছে। এজন্য মাথা ব্যথাও হচ্ছে। তার ধারণা, তার মন ও মস্তিষ্ক একে-অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তার সর্বাঙ্গে প্রতিনিয়ত তারা যুদ্ধ করে। ক্লান্ত হয় দেহ। পড়ে যায় বিছানায়।
পুরো বেলা নীহম সেভাবেই বিছানায় পড়ে রইল। বিকেল হতেই কল এলো। বাবা কল দিয়েছে। নীহম বন্ধরত চোখেই ফোন হাতে নিল, আপার ভলিউম বাটনে ক্লিক করে কল রিসিভ করে কানে ঠেকালো। ওপাশ থেকে আলফাজ বললেন,
-“কী অবস্থা, আফরাহ্?”
-“বাবা, ঘুমাচ্ছিলাম। বলো।”
-“ডিস্টার্ব করলাম?”
-“হ্যাঁ বাবা, করলে তো।”
-“কিন্তু কথাটা তো জরুরি ছিল।”
-“কী কথা?”
আলফাজ সাহেব হেসে বললেন,
-“আমার একটা প্রজেক্টের জন্য বেশ কয়েকমাস ঢাকাতে থাকা লাগবে। কোম্পানি থেকে এপার্টমেন্ট দেওয়া হয়েছে থাকার জন্য। আমি আগামী সপ্তাহেই উঠছি।”
নীহম থমকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য চমকালোও অবশ্য। বন্ধরত চোখ খুলে গেল, কপালে ভাঁজ পড়ল তিনটা,
-“আর ইউ সিরিয়াস, বাবা?”
-“থাউজ্যান্ড পার্সেন্ট।”
নীহমের কপালের ভাঁজটা ঠোঁটের কোণে চলে এলো, চোখে খেলে গেল অজানা দ্যুতি,
-“মাকে বলব?”
-“কেন না? নিশ্চয়ই।”
নীহমের শান্তি শান্তি লাগল কেমন। বাবার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলা শেষে সে আরেক দফা ঘুমিয়ে নিল। দেয়াল ঘড়িটা তারপর বিকেল চারটার কাটা স্পর্শ করল। কিচেন থেকে ভেসে আসতে লাগল রান্নার শব্দ। মায়ের অফিস আওয়ার শেষ সাড়ে ছয়টায়, বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাতটার বেশি বেজে যায়। এই অসময়ে তবে কিচেনে কে?
কে আবার? বাড়ির তিন নম্বর চাবিটা যার কাছে আছে, সে ছাড়া আর কে? নীহম বড়ো করে শ্বাস ফেলতেই লক্ষ করল উঁচু আওয়াজের একটা ডাক,
-“আফরাহ্!”
নীহম না শুনে থাকার ভান করল। তার নাম আফরাহ্ নীহম হলেও, সদ্য ডাক দেওয়া মানুষটি তাকে আফরাহ্ বলে ডাকে না। কোনো নাম ধরেই ডাকে না। যখন খুব বেশিই প্রয়োজন পড়ে, তখন নীহম বলে ডাকে। আর অন্যথায় খুঁচিয়ে কথা বলতে আফরাহ্ ডাকে। মহারানি যে এখন খোঁচাখুঁচির মুডে আছে, সে ব্যাপার টের পেয়ে নীহম সাড়া নিল না। চুপ হয়ে পড়ে রইল।
আওয়াজটা এবার ধীরে ধীরে কাছে থেকে শোনা যেতে লাগল,
-“নাটকবাজ আফরাহ্, আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ আমায়।”
আওয়াজটা নীহমের মাথার কাছে এসে শোনা যাচ্ছে। বন্ধরত চোখ তার, কপালে তিনটা কোঁচকানো বক্ররেখা,
-“বলো আফরিন, কী সমস্যা?”
-“ঘুমাচ্ছ কেন?”
-“আমার ইচ্ছা। তোমার ইচ্ছা হলে তুমিও ঘুমাও।”
-“খিদে পেয়েছে আমার।”
-“রান্না করো, খাও।”
-“ভারি বেয়াদব মেয়ে তুমি।”
-“জানা কথা।”
সে হাওয়ায় শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“তোমার চেয়ে গুণে গুণে দুই মাসের বড়ো আমি। তোমার বাসায় এসেছি আর তুমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ? আতিথেয়তা কই?”
নীহম এবার তাকাল, চোখে প্রহেলিকা, ঠোঁটে শব্দের জাল,
-“তোমাকে আমি কখনো অতিথি ভাবিনি, মোহ। উমম.. স্মেলস নাইস। পাস্তা হচ্ছে?”
-“হ্যাঁ।”
-“এমনিতে তেল-মশলা এভয়েড করি আমি। বাট তুমি রান্না করছ যেহেতু, সো ইটস ওকে। আই’ল ম্যানেজ।”
-“তোমার জন্য রান্না করিনি।”
-“তাহলে তোমার ভাগেরটা আমার। খালামণি কেমন আছে?”
-“মা ভালো আছে৷ মামাবাড়ি গেছে।”
-“ওহ আচ্ছা।”
নীহম আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। গায়ে তার প্রচণ্ড আলস্য। মোহ বলল,
-“রঙ্গনের সাথে ঝগড়া করে এসেছি।”
-“ঝগড়া করেছ?”
-“হ্যাঁ। লোকের কথা-বার্তা গায়ে সয় না।”
-“ভাইয়া জানে তুমি এখানে?”
-“নাহ।”
-“ফোন বন্ধ করেছ তো?”
-“করেছি।”
-“ঠিকাছে, চলো পাস্তা খাই।”
-“হু। চলো।”
নীহম একফাঁকে ওয়াশরুম থেকে মুখে পানি দিয়ে এসে মোহর পিছে পিছে যেতে লাগল। ওর ওড়না দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে বলল,
-“বুঝলে মোহ, যৌবন টগবগিয়ে ফুটছে। ঘুম থেকে উঠলেই খিদে পায়, প্রচণ্ডরকমের। এক্ষেত্রে সামনে স্মরণকে রাখা গেলে ভালো হতো। তা যেহেতু নেই, তো ঝাল খাবারই সই। আফটার অল, দুটোতেই স্পাইস আছে।”
মোহ নীহমের লাগামছাড়া কথা শুনে পিছে ফিরে তাকাল। অবাক হয়ে বলল,
-“স্মরণ? এই মেয়ে! তোমরা শুয়েছ?”
নীহম সব ক’পাটি দাঁত বের করে হাসল,
-“দুষ্ট মোহ, ওসব সরাসরি জিজ্ঞেস করতে নেই। ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করো। যেমন: নীহম, তোমাদের মধ্যে কি আনএক্সপেক্টেড অ্যাক্সিডেন্টাল ব্যাপারটা ঘটে গেছে? অথচ নাহ.. তুমি তো তুমিই। দুষ্টবতী মোহনা আপু।”
মোহ শক্তগলায় বলল,
-“মজা করছি না, নীহম। বলো।”
-“নিরামিষ, মোহ।”
-“হ্যাঁ, আমি জানি। যেটুকু জানি না, তা জানাও।”
-“ওসব কিছু হয়নি। নাটক করলাম।”
নীহম গিয়ে কিচেনের ছোট টেবিলটার সামনের চেয়ার টেনে পড়ল। মোহ দুটো বাটিতে খাবার বেড়ে মুখোমুখি হয়ে বসল। নীহম বড়ো করে শ্বাস টেনে খাবারের ঘ্রাণ নিল। তারপর খাবার মুখে নিল।
আড়চোখে মোহকে দেখে সে নিজের ফোন হাতড়ে কিছু একটা করে কানে তুলল। আর তারপর শুরু হলো তার যত ঢং। মোহ রঙ্গনের সাথে সম্পর্কের শুরুর দিকে সদা সিঙ্গেল নীহমের সামনে দাঁড়িয়ে নানান ঢং করত। এখন যেন দ্বিগুণ সুদে আসলে নীহম হিসেব তুলছে। কল রিসিভ করেই নাটকীয়তার সাথে বলা শুরু করল,
-“হ্যাল্লো, বেইব! কী অবস্থা? উম্ম, আ’মিসিউ। লেটস মিট, বেইবি। বাড়িতে আসো। উঁহু, কেউ নেই। শুধু তুমি-আমি, আমি-তুমি আর আমরা।”
ধরণী যেন মোহর সামনে নীহমের বেইজ্জতি ভীষণ পছন্দ করে। তাই তো কথা বলতে থাকা অবস্থাতেই নীহমের ফোন বেজে উঠল। ধরা পড়ে যাওয়া মুখ তার অত্যান্ত শান্ত। সে দু টুকরো কেশে ফোন সামনে তুলে দেখল, এবার সত্যি সত্যি কল দিয়েছে স্মরণ। অসহ্য! এমনিতে তো একদমই কল দেয় না। আজ আবার কী হলো!
মোহ আনমনে খাবার খেতে লাগল। যেন এসব স্বাভাবিক। ভীষণ স্বাভাবিক কিছু। নীহম কল রিসিভ করে বলল,
-“বলো।”
-“আজ ক্যাম্পাসে আসোনি?”
-“না।”
-“কেন?”
-“ঘুম পাচ্ছিল।”
-“আচ্ছা। লাঞ্চ ডান?”
-“খাচ্ছি।”
-“এত দেরিতে?”
-“ঘুমাচ্ছিলাম।”
-“আচ্ছা। খাও। বাড়ি ফিরে কল দেবো।”
-“আচ্ছা।”
মোহ কেবল নীহমের কথাগুলোই শুনতে পেল। বলো, না, ঘুম পাচ্ছিল, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছিলাম, আচ্ছা! বয়ফ্রেন্ডের সাথে এই টাইপের রোমান্টিক কথা বার্তায় মোহ না হেসে পারল না। কটাক্ষ করে তো বলেও বসল,
-“বাড়ি আসতে বলতে। খালি বাড়ি৷ কেউ নেই৷ শুধু তোমরা। মজা হতো না?”
-“আহ মোহ, শাটআপ!”
মোহ শব্দ করে হেসে উঠল,
-“আমার ঢঙ্গী নীহম রে, তোমার দৌড় কদ্দূর এটুকু আমি ছাড়া আর কে জানে? বলো।”
_______
“ইয়ে মোহ মোহ কে ধাগে
তেরি উঙ্গলিও সে যা উলঝে।”
সন্ধ্যে সাতটার কাছাকাছি এক সময় তখন। আশকোনায় বসে আছে প্রীতি। সামনের কয়েক সিঁড়ি নিচে বাঁশিওয়ালা। আজ এ-পাশের লাইটগুলো ঠিক করা হচ্ছে৷ অনেকদিন যাবত বন্ধ ছিল, নষ্ট হয়ে ছিল। সেজন্য বেশ লোক ঘুরছে এদিক দিয়ে। তবু লোকটার সংকোচ নেই কোনো কিছুতে। প্রীতি হাসল। এমনই হওয়া উচিত। নিজের কাজে দৃঢ়।
সে বাঁশি থামাতেই প্রীতি বলল,
-“আমার আর কখনো এখানে আসা হবে না।”
-“কেন?”
-“আমি আসব না।”
-“কারণ?”
-“আশকোনা আমার মন খারাপের জায়গা৷ যখন সবকিছুতে বিষ অনুভব করতে শুরু করেছিলাম, তখন এখানে এসে স্বস্তি পেয়েছিলাম। আপনার বাঁশির সুর আমাকে কতটা বিষমুক্ত রাখে তা আপনি জানেন না।”
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে তারপর শুধাল,
-“এখন পুরোপুরি ক্ষত নিরাময় হয়ে গেছে?”
-“এসব ক্ষতগুলো পুরোপুরি নিরাময় হতে নেই। কিছু চিহ্ন, হালকা ব্যথা অনুভূতিতে রাখা লাগে। যাতে ভবিষ্যতে দোষ রিপিটের সময় এরা আমায় আটকায়।”
-“দোষ রিপিট করার চান্স আছে?”
-“না থাকার তো কথা নয়। পৃথিবী কতটা গোল, তার ধারণা নিশ্চয়ই রাখেন।”
-“হুম, রাখি। আর সেই ধারণা থেকে বলছি, আমাদের আবারও দেখা হবে।”
প্রীতি বড়ো করে শ্বাস টানল, তারপর হাসল,
-“কিন্তু আমি তা চাইছি না।”
-“কেন?”
-“আপনার প্রতি আমার সামান্য একটা টান আছে, এটুকু টের পান?”
-“আগে পাইনি, এখন পেলাম।”
-“সেই টানটা যেন বাড়াবাড়ি ধরনের কোনো অনুভূতি তৈরি না করে ফেলে, এজন্য আমাদের আর দেখা হওয়া উচিত না।”
-“সমস্যা কী ওরকম কিছু হলে?”
-“আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। সামনের সপ্তাহেই।”
লোকটার দু-ঠোঁটের ফাঁক গলে সিগারেটের ধোঁয়ার পাশাপাশি এক খণ্ড হাসিও বেরোল। যা কোনোভাবেই প্রীতির চোখে পড়ল না। সে বলল,
-“তো?”
-“তো কিছু নয়। আমি আর আসব না। আজ যাচ্ছি। ভালো থাকবেন।”
-“শুভ কামনা।”
-“থ্যাংক ইউ।”
প্রীতি চলে যাবে বলেও গেল না। সেখানেই বসে রইল। লোকটা তখন হেসে ফেলল,
-“তুমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে?”
-“হ্যাঁ।”
ভাবার প্রয়োজন পড়ল না প্রীতির,
-“কিছু ব্যাপারে এত ভাবাভাবি করা লাগে না। তাছাড়া বিয়েটা আমার পছন্দের মানুষের সাথেই হতে যাচ্ছে।”
-“পছন্দের মানুষ?”
-“হ্যাঁ।”
-“কীভাবে পছন্দ হলো?”
-“আমি জানি না। আচমকা একরাতে জ্বরের ঘোরে টের পেলাম লোকটাকে আমি পছন্দ করি। আমি যাই। পিছে ফেরার সুযোগ না থাকলে পিছুটান তৈরি হতে দেওয়া উচিত না।”
-“আমি পিছুটান?”
-“এখনো না।”
প্রীতি উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে একবার আবদুল চাচার দোকানে গেল,
-“চাচা, চা দিন তো।”
-“মন খারাপ, মামনি?”
-“না, চাচা। কিছু সিদ্ধান্তের ওপর আছি। তাই একটু ডিস্টার্বড৷ আপনার দিন কেমন কাটছে?”
-“বেশ ব্যস্ততায় চমৎকারভাবে কেটে যাচ্ছে। যে যত ব্যস্ত মানুষ, তার দুঃখ তত কম। অবসরে আমরা কষ্ট পাই, পুরোনো স্মৃতিচারণে বুক ভারি হয়ে আসে। ব্যস্ততায় তার সুযোগও থাকে না।”
প্রীতি চেপে রাখা শ্বাসটা ফেলে মুচকি হাসল,
-“ধন্যবাদ, চাচা। আপনি আমাকে মাঝেমধ্যেই অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। এগুলো আমার খুব কাজে লাগবে।”
-“আমাদের প্রতিটা ধাক্কা, প্রতিটা পরীক্ষাও জীবনে কাজে লাগে।”
আবদুল চাচার সাথে কথা বলা শেষে চায়ের কাপ নিয়ে প্রীতি আবারও বাঁশির ধারে গেল। আরেকবার বিদায় জানাবে। এবার সুন্দর করে বলবে। আর বিয়ের দাওয়াত দেবে। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই কোত্থেকে যেন এক মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এলো। এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার গায়ে। মেয়েটা কণ্ঠে অনুশোচনা ও আবেগ মিলেমিছে অন্য এক সুরের সৃষ্টি করেছে,
-“আমি অনেক মিস করেছি তোমায়। বিশ্বাস করো, নক্ষত্র। এই যে ধরলাম, এবার আর ছেড়ে যাব না।”
লাইটগুলো জ্বেলে উঠল সব। স্পষ্ট নক্ষত্রকে একটা মেয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে ঠিক প্রীতির সম্মুখে৷ এই লোকটা যে নক্ষত্র হতে পারে, এই ধারণা প্রীতির কখনো আসেনি। অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় বসে থাকত বলে দেখতে পায়নি৷ আওয়াজও শুনতে পেরেছে এই কিছুদিন হলো। কণ্ঠটা চেনা লেগেছে, তবে মেলাতে পারেনি। বিশাল এক পুকুরের সামনে বসে সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে কথা বলাতে আওয়াজটাও তুলনামূলক ভারি শুনিয়েছে প্রতিবার। তাছাড়া…
মেয়েটার হাত দুটো নক্ষত্রের পিঠের শার্ট মুঠো করে ধরেছে। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রীতির বুকের ভেতর কী যে হলো। কিছুই বোঝা গেল না। মুখটা থমকানো, চোখ দুটো ভীষণ শান্ত।
চলবে…
#প্রাণোদাহ
|১১|
– নবনীতা শেখ
তখন নক্ষত্র এডমিশন ক্যান্ডিডেট। বয়সে উনিশের তরুণ। স্বভাবে অন্তর্মুখী অথচ রগচটা, তবে ভীষণ শান্ত আর প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্ত। একা থাকতে পছন্দ করে। এদিকে বাবা-মার থেকে “অসামাজিক” বলে গালিটা তার পছন্দ না। কাজেই প্রতিবছর ইদের ও শীতের ছুটিতে তার দাদার ভিটেতে ময়মনসিংহ যাওয়া লাগে।
এবারের শীতে বাড়ি ফিরে দেখতে পেল ভিন্ন ঘটনা। প্রতিবারের তুলনায় ভীষণরকম অস্বাভাবিক সময় কাটতে লাগল তার। অন্যান্য সময় সে বাড়ি গেলে সব কাজিনদের আলোচনার মধ্যমণি হয়ে থাকে। আর এবার অন্য এক মেয়ে এসে ভাগ বসাল। মেয়েটার নাম অতসী। তার ফুপাতো বোন। জন্ম, বড়ো হওয়া, বেড়ে ওঠা সব ইউকেতে। ছুটিতে এসে বেড়িয়ে যায়। অথচ মুখোমুখি হওয়া হয়নি সেভাবে, খেয়াল করা হয়নি। বড়ো হওয়ার পর তো দেখাই হয়নি।
নক্ষত্রের হিংসের বহিঃপ্রকাশ শীতের শীতলতায় মিশে গেল। মুখোমুখি কয়েক দফা দেখা হওয়ার পরও অতসী বা নক্ষত্র, কেউই কারো সাথে কথা বলল না৷ তাদের মধ্যে চলতে লাগল নীরব যুদ্ধ। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। নিজেদের অহংবোধে যেন বরফ মেশানো পানি পড়েছে, ভালোবাসায় বসেছে ভাগ।
চতুর্থদিনের ঘটনা। ছাদের একপাশে বসে রুবিক্স কিউব মেলানোর সময় আচমকা তার পাশাপাশি এসে কেউ একজন দাঁড়াল। কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর বসে পড়ল। ওদিকে না তাকিয়েও নক্ষত্রের কপাল কুঁচকে এলো আস্তে-ধীরে।
অতসী বসে বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তাকিয়ে আছে ছাদের অমসৃণ মেঝেতে। নখ চুলকাচ্ছে। পরনে কালো শাল টাইপের কিছু। কাঁধ অবধি চুলগুলো ছেড়ে রাখা। ছোট, গোল ও ভীষণ ফরসা মুখটায় অসম্ভব কাঠিন্য।
নক্ষত্র মেয়ে মানুষদের লক্ষ করতে পছন্দ করে না, তাদের দিকে তাকাতে অপ্রস্তুত বোধ করে, কথা বলতে তো দুনিয়ার যত আলস্য আছে সবই যেন গায়ে চলে আসে। কাজেই সে তাকাল না। কিউবের দিকে চোখ ও হাতের গতিবিধিতে লক্ষ রেখে সে বলল,
-“কিছু বলতে চাও?”
অতসী এবার সোজা প্রসঙ্গে চলে এলো,
-“ইগনোর করছ কেন?”
-“ইগনোর করছি না।”
-“যাই করছ না কেন, লোকে নোটিস করছে। ডোন্ট ডু দ্যাট।”
অতসী থামল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকাল,
-“তুমি আমার কাছে ম্যাটার না করলেও, লোকের উইয়ার্ড কোয়েশ্চনগুলোর এন্সার করতে আমার নিজেকে কাইন্ড অভ স্টুপিড লাগে।”
কথাটা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। যা সব প্রশ্ন! সেসবের উত্তরটা স্বাভাবিকভাবে দেওয়া গেলেও, উত্তর দেওয়ার পর খুব একটা সময় স্বাভাবিক থাকা যায় না।
নক্ষত্র বলল,
-“আমাকে কেউ কিছু আস্ক করেনি।”
-“কজ দ্যে আর নট মাচ ফ্রি উইথ ইউ।”
-“তোমাকে কী বলা হয়েছে?”
-“শ্যুড আই টেল ইউ?”
-“আমাকে নিয়ে হলে বলা উচিত।”
অতসীর ঠোঁটের চামড়া ছিঁড়ে গেছে কামড়াতে কামড়াতে। বড়ো বাজে এই স্বভাবটা তার ছোট থেকেই৷ কোত্থেকে শিখেছে, কীভাবে শিখেছে তার জানা নেই। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাতে গিয়ে লবণাক্ত কিছু টের পেতেই চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। ওভাবেই বলল,
-“রাইমা আর অর্থী আমাকে এ নিয়ে ফোর্থ টাইম আস্ক করেছে, আমি তোমার সাথে ঝগড়া করেছি কি না। আর অভি ময় নাকি কী যেন একটা ওয়ার্ড ইউজ করল..”
-“অভিমান।”
-“হ্যাঁ। মান। ওই অভি আর মান করেছি কি না। জিজ্ঞেস করলাম এর অর্থ কী।”
-“কী বলল?”
-“বলল, হোয়েন উই আর ক্লোজ টু সামওয়ান, তখন আমরা অনেককিছু এক্সপেক্ট করি তাদের থেকে, না পেলে বা পেতে লেইট হলে অযথা যে রাগটা হয়, ওটাকে নাকি মান বলে।”
নক্ষত্রের কিউব মিলে গেছে। সে পুরোটা উলটে পালটে দেখছে। অতশী একনাগাড়ে খুব বেশিক্ষণ বাংলা বলে যেতে পারে না। হাঁপিয়ে ওঠে। তাই থামে। দুটো বাক্য পর পর অর্ধেকটা মিনিটের জন্য থেমে নেয়। এরপর দম নিয়ে ফের বলা শুরু করল,
-“অভিমান? মিনিংলেস শব্দ! আমি ইংলিশে এরকম কোনো ওয়ার্ডই খুঁজে পাইনি।”
-“এটাকে এক ধরনের রাগ ভেবে নেওয়া যেতে পারে, যা কেবল নিজের মানুষদের সাথে করা যায়।”
অতসীর চোখ মুখ কুঁচকে আসে,
-“লুক নক্ষত্র, এই টাইপের রাগ করার জন্যও কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা ওই টাইপের কিছু থাকা লাগবে। কী যেন বলে না? ওইযে..”
-“ভালোবাসা বা টান?”
-“এক্স্যাক্টলি। ওটাই। ওরকম কিছু নেই। তাই উই শ্যুড বি নরমাল।”
-“ওকে।”
অতসী হাঁপ ছাড়ল। আর কথা বলার প্রয়োজন নেই। অনেকক্ষণ কথা বলেছে। এখন হাঁপাচ্ছে রীতিমতো। চারচোখা ছেলেটা অল্পতেই বুঝে গেছে। সে স্বস্তি পেল।
নক্ষত্র তখন জিজ্ঞেস করল,
-“এখানে কতদিন থাকবে?”
-“নট সো শিওর। মেবি সিক্স মান্থস। ওয়ান মান্থ অলরেডি চলে গেছে।”
-“ফুপিরা আসেননি?”
-“নাহ।”
-“এলোন জার্নি?”
-“হ্যাঁ। তুমি প্যানিকড হয়ো না। আর অনলি ফাইভ ডেইজ। তুমি তো ঢাকা ফিরে যাবে। আমিও আমার আন্টির বাড়ি চলে যাব।”
নক্ষত্র বড়ো স্বস্তি পেল। অতসী আর কিছু না বলে চলে গেল। এরপরের পাঁচটা দিন খুবই স্বাভাবিকভাবে কেটে যায়। দুইজন মুখোমুখি পড়ে গেলে কথা বলে। বাকিরা তাদের অকস্মাৎ পরিবর্তন বাঁকা নজরে দেখা শুরু করে। কী এক মুসিবত! আগে কথা বলত না, তখনও ঝামেলা। এখন বলে, এখন আরও বেশি ঝামেলা।
নক্ষত্র অতসীর চোখ-মুখ কুঁচকে গাল ফুলিয়ে বলা এসব কথায় না হেসে পারে না,
-“যা ভাবার ভাবতে দাও। ওদের ভাবনাতে চললে কখনো স্বস্তিতে থাকতে পারব না।”
-“হুম। ওরা নটি মাগি।”
নক্ষত্র হাসি আটকানোর প্রয়াসে দাঁতে ঠোঁট চেপে নেয়, ইতস্তত করতে করতে বলে,
-“একচুয়ালি অতসী, তুমি কারো সামনে মুখ খুলো না।”
-“কেন?”
-“ওগুলো খুব কঠিনভাবে বাংলা গালি।”
-“কোনগুলো? নটি-মাগি?”
নক্ষত্র ওপর-নিচ মাথা নাড়ে। অতসী অবাক হয়,
-“যাহ! এসব স্ল্যাং কী করে হয়? সেদিন ছোটমণিকে বলতে শুনেছিলাম এই ওয়ার্ডদুটো। নটি অর্থ তো দুষ্ট, আই নো দ্যাট। আর মাগি যেটা! রাইমাকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল, মাগি মানে মেয়ে। তো এখানে স্ল্যাং কই?”
নক্ষত্র অতিষ্ঠ হয়ে মাথা নাড়ে,
-“মেয়ে, আগে এগুলো বুলি ছিল। এখন গালি। বাজে চরিত্রের মেয়েদের এসব বলা হয়।”
-“ওহ ফাক! সরি সরি।”
অতসী দু-হাতে ঠোঁট চেপে নেয়। নক্ষত্রের হাত উঠে আসে কপালে। মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে সে! মুখ খুললেই তো বোম ফাঁটে।
ধীরে ধীরে ওদের চলে যাওয়ার দিন এলো। দেখা গেল মন খারাপ করে অতসীও লাগেজ গুছিয়ে রেডি। মা বলেছে, ঢাকায় গিয়ে মামার বাসায় থাকতে৷ আন্টির সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে তার। মামাও নাকি তার বাসায় থাকার জন্য খুব করে বলেছে। মামার বাসা মানে নক্ষত্রের বাসা। আহ কী অশান্তি!
গাড়িতে ওঠার সময়ও অসহায় চোখে তাকায় অতসী। নক্ষত্র হেসে ফেলে। মেয়েটাকে তার আর বিরক্ত লাগে না। বয়সে তার চেয়ে এক বছরের ছোট, অথচ দেখতে বাচ্চা, আবার একটু লক্ষ করলে দেখা যায় মেয়েটার সবেতেই অনেক অনেক বেশি ম্যাচিউরিটি। নক্ষত্রের মজা লাগে।
অতসীর অবাক হওয়া, শান্তমুখে রাগ করা, অবুঝ সেজে অজানা বাংলা গালি দেওয়া, বিরক্তিতে ঠোঁট কামড়ানো, হুটহাট একনাগাড়ে খুবই দ্রুতভাবে ইংরেজিতে কথা বলা, আর তারপরই থেমে গিয়ে বড়োবড়ো চোখে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সরি বলা—এ সব কিছু নক্ষত্র বেশ উপভোগ করে।
পাঁচ ঘন্টার জার্নি শেষে মামা-মামী আর মামাতো ভাই স্মরণ ও নক্ষত্রের সাথে অতসী তার মামার বাসায় প্রবেশ করল। এখানে আসার পর প্রথম যেই পরিবর্তনটা নক্ষত্রের জীবনে দেখা গেল, তা হচ্ছে অতসীর জন্য তার রুম ছেড়ে দেওয়া। ভাগ জিনিসটা নক্ষত্র কখনো মানতে পারত না। অথচ এবার যে তার কী হলো! একটা কথাও নেতিবাচকতায় বলল না। নিজের জামা-কাপড় সহ যাবতীয় যা লাগে সব নিয়ে ভাইয়ের রুমে শিফট হয়ে গেল।
অতসী প্রথম প্রথম ভেবেছিল, বড়ো অস্বস্তিতে পড়া লাগবে। অথচ এখানে আসার পর যেন সবকিছুতে স্বস্তি। মামা-মামি একদমই তার মা-বাবার মতো। স্মরণ তো সারাদিন বাসায়ই থাকে না। ইউনিভার্সিটি, টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত। ফেরে রাত করে। আর নক্ষত্র? তাদের বন্ধুত্বটা হয়ে গেল অদ্ভুতভাবে, না জেনে, না বুঝে, কিছু না বলেই।
দুইজন দুইজনকে খুব বুঝত। স্বভাবে, আচরণে প্রায় একই রকমেরই ছিল তারা। খুবই বুঝদার। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, তাদের মধ্যে আলোচনা করার মতো অনেক অনেক বিষয় খুঁজে পাওয়া গেল। বই নিয়ে, জার্নাল নিয়ে, ঘোরাঘুরি নিয়ে। তারা একে-অপরের সবেতেই আগ্রহ পেতে লাগল। একে-অপরকে প্রশ্ন করতে লাগল কারণে, অকারণে, অসময়ে, অযথা।
তারপর এলো দিন পরিবর্তনের সাঁঝ। দুই সপ্তাহ পরের এক সন্ধ্যা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আড্ডায় অতসী নামের মেয়েটার থেকে আচমকা একটা প্রস্তাব এলো, একদম সোজাসাপটা প্রস্তাব,
-“ওয়ানা বি মাই বয়ফ্রেন্ড?”
বড়ো অস্বাভাবিকতার সাথে তৎক্ষনাৎ নক্ষত্র উত্তর দিলো,
-“ইয়েস, ইউ আর মাই টাইপ।”
চলবে…