#প্রাণোদাহ
|১৬|
– নবনীতা শেখ
স্মরণ নীহমকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে চাইলেও, নীহম পালটা প্রতিক্রিয়ায় বলল,
-“তোমার সামনে এখন আগামী কয়েকটা ঘন্টা আমি থাকতে পারব না। লজ্জা জিনিসটা আমার মধ্যে নেই। তবে যা আছে, তা হলো অস্থিরতা। আমি তোমাকে এই মুহূর্তে তা দেখানোর মতো প্রস্তুত নই।”
স্মরণ শান্ত রইল, নীহমকেও শান্ত করার কিঞ্চিৎ প্রচেষ্টায় বলল,
-“রিকশায় উঠিয়ে দিই?”
-“আই ক্যান ডু ইট বাই মাইসেলফ, স্মরণ। গুড নাইট। এবার বাড়ি ফেরো।”
নীহম আর পিছে তাকাল না। অধৈর্য চলনে বড়োরোডের ধারে এসেই রিকশা ডাক দিলো। এই মুহূর্তে রিকশায় বসে থাকাটাও তার জন্য কষ্টকর হয়ে আসছে। সে অর্ধেক পথেই নেমে গেল। ব্যাগ থেকে এক্সট্রা কী বের করতে করতে ঢুকে পড়ল খালার বাড়িতে।
বাড়িতে প্রবেশ করেই বসার ঘরে শেফাকে দেখে নীহম এগিয়ে গেল। নীহম সচরাচর এ বাড়িতে আসে না, যখন যখন আসে—কোনো বারই কারণ থাকে না। ব্যাপারটা যে একেবারে অকারণা, তা বলাটাও ভুল। মেয়েটার তালগোল ঠিক থাকে না। সাধারণ মানুষের মতো কাজ করতে পারে না। আলস্যতে সারাক্ষণ শুয়ে-বসে যখনই দীর্ঘ করে একটা শ্বাস আসে, তখনই সে এ বাড়িতে চলে আসে। ব্যাপারটা পানিভাতের মতো সরল ও মজার। এ বাড়িটাকে নীহমের নিজস্ব ঘর লাগে। এ বাড়ির মানুষগুলোকে তার নিজের লাগে। ব্যাপারটা মজার না?
শেফা নির্দ্বিধায় বলে বসল,
-“চা খাবে?”
মাসখানেক পর দেখা। কেন আসছে, কোনো সমস্যা কী না কিছুই জিজ্ঞেস করল না শেফা। নীহমের প্রতিটা অস্বাভাবিক কাজ, তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে আসে। মোহ তার প্রাণ হলে, নীহম তার আত্মা। এই দুই ক্ষেত্রে সে কোমলপ্রাণ।
নীহম মাথা নাড়ল,
-“হ্যাঁ, আম্মু।”
-“তুমি মোহনার রুমে গিয়ে বসো, আমি বানিয়ে আনছি।”
শেফা উঠে কিচেনে যেতে লাগল। নীহম মোহর রুমের দিকে যেতে চেয়েও, গেল না। কিচেনের পথমুখে শেফাকে পেছন থ্বক্ব জড়িয়ে ধরল। শেফার ওড়নায় মিশে থাকা মা মা ঘ্রাণটায় নীহমের বুকের ভেতরের কাঁপুনি বেড়ে গেল, চোখ ঘোলা হয়ে এলো। জড়ানো আওয়াজে বলল,
-“আম্মু, আমি কিছুদিন থাকি?”
শেফা একহাতে উঠিয়ে তার কাঁধে গোঁজা নীহমের গালে রাখল। স্মিত হেসে বলল,
-“যতদিন ইচ্ছে হয় থাকো, সোনাই।”
-“তুমি বলেছিলে, প্রতিটা মানুষের কোনো না কোনো দূর্বলতা থাকে। শত্রুকে নত করার সবচেয়ে ভালো পন্থা হচ্ছে তার দূর্বলতা খুঁজে বের করা। তাই আমাদের উচিত দূর্বল না হওয়া। সব কিছুই মায়া।
আমি নিজেকে ওভাবেই তৈরি করলাম, অহংবোধের সাথে হেসে বলতাম—আমার কোনো দূর্বলতা নেই বলে।
অথচ দেখো.. সবসময় কীভাবে তোমার কাছেই ছুটে আসি! আম্মু?”
শেফা শান্ত কণ্ঠে বলল,
-“মা শুনছে, বলো তুমি।”
-“তোমার গা দিয়ে এত মা মা গন্ধ কেন?”
-“কারণ আমি তোমার আম্মু।”
-“তাহলে আমার নিজের মাকে কেন এত পর পর লাগে?”
-“কারণ তোমার মা নির্বোধ।”
নীহমের গলার আওয়াজ যতটা অশান্ত, শেফারটা তারও অধিক শান্ত,
-“আমরা মানুষ সর্বদা যেটা চেয়ে এসেছি, সেটা বড়ো হওয়ার পর কোথাও পেয়ে গেলে দূর্বল হই। স্বাভাবিক এটা। মেনে নাও। তবে কাউকে জানিয়ো না। জানালেই তারা আঘাত করবে। নিজেকে খুব ভেঙেচুরে কারো সামনে উপস্থাপন কোরো না, সে তোমাকে পুরোপুরি ভেঙে দেবে। ততটুকুই সামনের মানুষটাকে বলো—যতটাতে তোমার প্রহেলিকা গাঢ় হয়, খোলে না..”
শেফা ঘুরে দাঁড়াল। নীহমের এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“মন খারাপ কেন, বাবা?”
নীহম মাথা নাড়ল দু’বার,
-“মন খারাপ না। মন ভালোও না। আমি একটু ডিস্টার্বড কেবল। আর তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছিল। তুমি জানো, পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই..”
-“এত সত্য বোলো না। তোমার বাবা-মা কষ্ট পাবে।”
-“তারা কষ্ট পেলেও আমার কখনো কোনোকিছু ফিল হয় না। এটা কেন?”
-“কারণ তুমি যখন সর্বোচ্চ কষ্ট পেয়েছিলে, তারা তোমায় ফিল করেনি।”
নীহম পুরোনো সময়গুলো মনে করতে লাগল। চাপা শ্বাস আটকে এলো কেবল, কোনো লাভ হলো না। শেফা জিজ্ঞেস করল,
-“তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?”
নীহম মাথা নাড়ল,
-“হ্যাঁ।”
-“রাতে শুনব। চা নিয়ে আসি। ফ্রেশ হও, যাও।”
-“আচ্ছা, আম্মু।”
নীহম মোহর রুমে চলে গেল। মোহ বারান্দায় বসে আছে। পরনে স্বর্ণাভ পাড়ের মলিন সাদা শাড়ি। হাঁটু লম্বা ভেজা চুলগুলো মাঝসিঁথি করে ছেড়ে রাখা। তার সম্মুখের ইজেলে রাখা একটা ১২×১৮ ইঞ্চির ক্যানভাস। পাশের টেবিলে ছড়ানো ছেটানো কালার প্যালেট। হাতে চিকন সাইজের একটা ব্রাশ। ক্যানভাসে আঁকা এক নারীদেহ। সে পেট অবধি জলে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে সম্মুখে। নারীটির শরীরের ওপর পাতলা ফিনফিনে এক সাদা পোশাক। যাতে সবকিছু প্রায় স্পষ্ট। মোহ ডিটেইলস দিতে দিতে বলে উঠল,
-“রাত এগারোটা চল্লিশ বাজছে। বাইরে কী করছিলে?”
মোহ উলটো ঘুরে বসে আছে। নীহম কোনো সাড়াশব্দও করেনি। তবু কী করে যে মেয়েটা সব টের পেয়ে যায়! নীহম ব্যাগ আর ওড়নাটা বেডের ওপর ফেলে বারান্দায় এগিয়ে গেল। ক্যানভাসটা ভালোমতো দেখে বলল,
-“স্মরণের সাথে ছিলাম।”
-“ভালো।”
প্রতিক্রিয়াবিহীন আওয়াহ মোহর। নীহম ফ্রেশ হয়ে এসে এক চেয়ার টেনে পাশে পা তুলে বসল। তারপর আচমকা বলে বসল,
-“আই কিসড হিম..”
কিঞ্চিৎ চমকের স্পর্শে মোহর হাত থেমে গেল, কপাল কুঁচকে এলো ক্রমশ। সরু চোখে তাকাল নীহমের দিকে,
-“কাকে?”
-“স্মরণ ছাড়া আর কাকে?”
-“ফার্স্ট কিস?”
-“বেসিক্যালি হ্যাঁ। বাট..”
-“বাট?”
নীহম নড়েচড়ে বসল। গলা শুকিয়ে আসছে তার। সে আশপাশে তাকিয়েও পানি পেল না। শুকনো ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
-“এর আগে তিনবার স্বপ্নে আমি ওকে কিস করেছি। সো ইটস নট দ্য ফার্স্ট ওয়ান।”
মোহ ঠোঁট চেপে তাকিয়ে থেকে পরপর অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় দু-ধারে মাথা নাড়ল,
-“আমি ভেবেছিলাম, অনেক আগেই হয়ে গেছে।”
-“তোমার যতসব ভাবনা! ফার্স্ট টাইমই এটা!”
-“তারপর?”
-“তারপর! তারপর অনেক কিছু। আমি শ্বাস নিতে পারছি না ঠিকঠাক। বার বার ওর ঠোঁটের টেস্টটা মনে পড়ে যাচ্ছে, ওর দাড়ির খোঁচাগুলোয় স্টিল জ্বলুনি হচ্ছে আমার। ও তো চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল, বাট আমি তাকিয়ে ছিলাম। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম ওর কপালের কোঁচকানো লাইনটা কেমন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। ওর গায়ের স্মেলটাও এখনো পাচ্ছি আমি। মানে আমি চোখ বন্ধ করলেই হুবহু ওর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। ভাবতে পারছ, মোহ? ইশ! টিপিক্যাল মেয়েলি ফিলিংস! ইয়াক!”
মোহ চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল,
-“প্রিভেসি রাখো, নীহম। সম্পর্ককে ঠাট্টার বানিয়ে ফেলো না। অন্য কারো কাছে নিজেদের স্পেশ্যাল মোমেন্টসকে এভাবে প্রেজেন্ট কোরো না। লোকে হাসাহাসি করবে তোমাদের ফিলিংস নিয়ে।”
নীহম হাসল,
-“তুমি ছাড়া কাউকে কখনো এসব বলার মতো বেকুব আমি নই। আমি জানি, তুমি জাজ করবে না।”
-“তবু বলবে না আর।”
-“উম্ম, ঠিক আছে।”
-“আর শোনো, নীহম।”
-“হুম?”
মোহ ঘুরে বসল,
-“তুমি নার্ভাস?”
-“মেবি। নট শিওর।”
-“বড়ো করে শ্বাস নাও, ছাড়ো। অনুভূতিগুলোকে লুকোও, তবে নিজের থেকে নয়। আর খুশি হও প্রচণ্ডভাবে।”
-“খুশি?”
-“সবাই ভালোবাসতে পারে না। যারা পারে তারা ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে। আর সৌভাগ্য তো সেখানে, তুমি যাকে ভালোবেসেছ সে-ও তোমার ফিরতি ভালোবাসে।”
অকস্মাৎ নীহমের পুরো গায়ে ছমছমে এক সুখ অনুভূত হলো।
________
প্রীতিলতা আজ মায়ের সাথে নক্ষত্রদের বাসায় ঘুরতে এসেছে। সময়টা বিকেল। স্মরণ ছাড়া বাকি সবাই বাড়িতে আছে। লিভিংরুমে উপস্থিত আছেন তৌহিদ ও নুরনাহার। বিভিন্ন গল্পগুজব করছেন তারা৷ নুরনাহার শামাকে ডেকে বলল,
-“শামা রে! প্রীতিকে নিয়ে একটু বাড়িটা ঘুরে আয়, মা। ও এখানে বড়োদের মাঝে খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। প্রীতি আম্মু, যাও ওর সাথে। খারাপ লাগলে বলতে হয়।”
প্রীতি মাথা নেড়ে শামার সাথে উঠে পড়ল। শামা ওকে নিয়ে ভেতরের দিকে যেতে যেতে বলল,
-“আপু, আপনার সাথে ছোটদার বিয়ে ঠিক হইছে, তাই না?”
প্রীতি ওপর-নিচ মাথা নাড়ল। শামা বলল,
-“আপু, আপনি জানেন কি? সেদিন ছোটদা কী বেশরমের মতো আপনাকে চাইছিল? আমার তো ভাবতেই লজ্জা লাগে।”
-“তাই নাকি? কী বলেছিল?”
প্রীতি কৌতূহলী হলো। শামা এরপর তাকে রংচঙ মাখিয়ে সেদিনের পুরো গল্পটা বিনা কোনো কিছু বাদ দিয়ে বলে গেল। প্রীতির বেশ মজা লাগল। হাসতে হাসতে গাল দুটোতে টসটসে ব্যথাও হলো। কোরিডোরের শেষমাথার বারান্দায় সামনে দাঁড়াতেই, ওপাশ থেকে অতসী বেরিয়ে এলো। মুখোমুখি দাঁড়াল প্রীতির।
প্রথম দেখায় অতসীকে চিনে ফেলতে এক সেকেন্ডও লাগেনি প্রীতির। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা ধুপ করে উঠল। হাসি নিভে এলো ক্রমেই। অতসী ব্যাপারটা লক্ষ করে বলল,
-“প্রীতি? তোমার ব্যাপারে অনেক শুনেছি। তুমি আসলেই বেশ মিষ্টি। আমার হিংসে করাটা যথার্থ।”
প্রীতি ইতস্তত করতে লাগল। অতসী শামাকে বলল,
-“তুমি লিভিংরুমে যাও, বাকিদের কিছু লাগে কি না দেখো! আমি প্রীতির সাথে আছি।”
শামা চলে গেল। অতসী বলল,
-“আমি নক্ষত্রের ফুপাতো বোন। আমার ব্যাপারে নিশ্চয়ই ও তোমাকে কিছু বলেনি?”
-“নাহ, বলেনি।”
-“বলার কথাও নয়। চলো ওপাশে হাঁটি।”
-“আচ্ছা।”
প্রীতি আড়চোখে বার বার অতসীকে দেখছে। মেয়েটা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফরসা, চোখের মণি হালকা রঙের। তার দিকে তাকালে, তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে জাগবে—অতসী ঠিক অমন সুন্দর। সে তুলনা প্রীতি নিজের সাথে করল। চাপা রঙ, দেখতে ভালো না, স্বভাবও মার্জিত না। কেমন যেন নিজেকে ছোট লাগতে শুরু করে তার! নক্ষত্রকে যদি প্রীতি ও অতসীর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বলা হয়, সে কী করবে? নক্ষত্রের জায়গায় প্রীতি হলে, সে একধ্যানে অতসীকে দেখতে পাশে কোনো মেয়ে আছে নাকি ছাগল, এ কথা তো ভুলেই বসত।
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতসী বলল,
-“আমাদের প্রথম দেখা বলে এত চুপচাপ আছো, না কি তুমি আসলেই এমন?”
-“প্রথম দেখা বলেই হয়তো..”
প্রীতি মিথ্যে বলল। সে প্রথম দেখাতেও সহজেই অন্যের সাথে মিশে যেতে পারে। আজ পারছে না। কারণটা নক্ষত্র। প্রীতি বসে তো আছে অতসীর সাথে। তবে তার মন, খেয়াল সব পড়ে আছে নক্ষত্রের সাথে কাটানো সময়গুলোতে, আশকোনার পাড়ে, প্রথম দেখা, প্রথম কথা বলা, সবকিছুতে। সে ভাবুক হয়। আচ্ছা, সবটা নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয়! নক্ষত্র তাকে কখন থেকে চেনে! আশকোনার ব্যাপারটা আর তার টিউশনি কি সংযুক্ত কোনো ব্যাপার? নক্ষত্র কি কিছু লুকোচ্ছে? তার আড়ালে এই সুন্দরী অতসীর মতো আর কী কী ব্যাপার আছে?
অতসী হেসে ফেলল আলগোছে। প্রীতিকে চমকে দিতে অকস্মাৎ সে বলে উঠল,
-“মিথ্যেবাদী মেয়ে!”
বসার ঘরে পৌলিকে দেখে শামার কাছে প্রীতির অবস্থান জেনে এখানে আসতে এক মুহূর্তও দেরি করেনি নক্ষত্র।
প্রাক্তন আর বর্তমানকে মুখোমুখি দেখে নক্ষত্রের মুখের রঙ উড়ে গেল। সে কি এখান থেকেই কেটে পড়বে? নাকি এগিয়ে যাওয়া উচিত? এগিয়ে গিয়েই বা কী বলবে? হ্যালো গার্লস?
চলবে…