প্রাণোদাহ পর্ব-১৭

0
52

#প্রাণোদাহ
|১৭|
– নবনীতা শেখ

-“আমাদের প্রথম দেখা বলে এত চুপচাপ আছো, না কি তুমি আসলেই এমন?”
-“প্রথম দেখা বলেই হয়তো..”

অতসী হেসে ফেলল আলগোছে। প্রীতিকে চমকে দিতে অকস্মাৎ সে বলে উঠল,
-“মিথ্যেবাদী মেয়ে, মিথ্যে বলছ! ভুল না হলে আমাদের প্রথম দেখা আশকোনার সন্ধ্যাতে হয়েছিল। যখন আমি তোমার ‘হতে যাচ্ছে স্বামী’কে জড়িয়ে ধরেছিলাম, তোমাকে একপাশে দেখতে পেয়েছিলাম।”

প্রীতি টুকরো টুকরো শ্বাস ফেলছে ক্রমাগত,
-“জি, আপু।”
-“তোমার জায়গায় আমি হলে, ওই জায়গাতেই একটা সিন ক্রিয়েট করে বসতাম। তুমি এনাফ ম্যাচিউর।”

প্রীতি তাকিয়ে রইল কেবল। অতসী মেয়েটা অনেক শান্ত। তবুও কেন শব্দে এত বিষের ছোঁয়া? কেমন বিরহ বিরহ গন্ধ! প্রীতির দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। আমরা যতটা চাপ নেব, তার দ্বিগুণ চাপ অনুভব করব। প্রীতি প্রলম্বিত এক শ্বাসের সাহায্যে নিজেকে হালকা করে ফেলল। যতটা শান্ত থাকা যায়, যতটা বোঝাহীন কাঁধে শক্ত থাকা যায়..

অতসী ফের বলল,
-“আজকের ব্যাপারটাও এত সুন্দরভাবে হ্যান্ডেল করতে পারছ কী করে?”
-“আহামরি কিছু তো নয়, আপু।”
-“সিম্পল কিছুও নয়। ও কী বলেছে আমার ব্যাপারে?”
-“কিছু বলেনি।”
-“তুমি কতটা জানো?”

প্রীতি মাথা নাড়ল আনমনে,
-“আমি আংশিকও জানি না।”
-“যাহ! বললে আরেক ঝুঁট! আমরা সবাই কিছু না কিছু জানি, কেউ কেউ অনেক কিছু জানি। সেই ‘কেউ কেউ’তে আমি আছি, আমি জানি তুমিও আছো। বলো, কতটুকু জানো।”

প্রীতি তাকিয়ে রইল অতসীর দিকে। তার সংক্ষেপে বলে গুটিকয়েক বাক্যের ভাব সম্প্রসারিত করলে অনেক বড়ো কিছু সত্য পাওয়া যায়। আমরা কত কিছু জানি, অথচ দ্বিধায় পড়ি কিংবা মানতে চাই না। সত্য না মানলে কখনো মিথ্যে হয়ে যায় না। পরিস্থিতি অস্বীকার করলেই পাড় হওয়া যায় না। যা যায়, তা হলো কেবল এবং কেবলই মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া নয়তো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অস্বীকার করা, বিরুদ্ধ-আচরণে প্রতিবাদ করা।

প্রীতি বলল,
-“আমি কখনো নক্ষত্রের পাস্ট লাইফের ব্যাপারে কিছু জানতাম না। জানার আগ্রহ দেখাইনি। সবারই পাস্ট আছে, ওর কম্ফোর্টজোনে আমি এলে, ও নিজ থেকেই বলবে। তবে ভাবিনি ঠিক এভাবে আমার জানা হবে। যাই হোক!”

প্রীতি থামল, বড়ো করে শ্বাস টেনে বলল,
-“আমি আশকোনাতে আপনাকে আর নক্ষত্রকে দেখে অবাক হইনি। পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষমানুষের প্রেম থাকার ঘটনা।
নক্ষত্র ম্যাচিউর। শক্ত করে ধরতে জানে, ছেড়ে দিলে ফিরে তাকানোর অনিচ্ছে দেখাতে জানে। সে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মতো বেকুব নয়, সে স্থির। কাজেই ব্রেকআপ হয়েছিল, এটুকু নিশ্চিত ছিলাম। আমি সেই রাতে সিনক্রিয়েট করিনি, কারণ ব্রেকআপের পর অনেকেই আবার প্যাচআপ করে নেয়। ফিলিংসের ব্যাপার, প্রায়োরিটির ব্যাপার। তাই সম্পূর্ণটা নক্ষত্রের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম।”

প্রীতি এখানটায় এসে হেসে ফেলল,
-“তারপর নক্ষত্র পরদিন এসে আমাকে আস্বস্ত করল, আমি ছাড়া আর কেউ না।”

অতসী নতমুখী হয়ে হাসল,
-“তোমার মুখে ওর নামটা বেশ শোনায়।”
-“জি, ধন্যবাদ।”
-“তুমি খুব চালাক, প্রীতিলতা।”

প্রীতি স্মিত হাসির সাহায্যে কথাটাকে নিজের প্রশংসা হিসেবে নিয়ে নিল। অতসী এই কথাটা বলেছে, তার কিছুক্ষণ আগে বলা ‘আশকোনাতে আপনাকে আর নক্ষত্রকে দেখে অবাক’ হওয়ার প্রসঙ্গে। এখানে প্রীতি ‘আপনাদেরকে’ না বলে দুইজনকে আলাদা করে উল্লেখ করেছে। পরবর্তী বাক্যেই আবার বলেছে “আমার নক্ষত্র”! স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে, নক্ষত্র কতখানি প্রীতিলতার এবং এর সামান্যতম অংশীদার কেউ নয়।

অতসী বলল,
-“টেইক কেয়ার অভ হিজ হার্ট, প্রীতিলতা।”
-“শিওর।”

প্রীতি আত্মগরিমায় রসাত্মক হাসল। এতক্ষণ নিজের প্রতি যতটা অশান্তি কাজ করেছে, নিজেকে যতটা হেয় করেছে—তা ছিল অপ্রাসঙ্গিক ও অহেতুক। ব্যাপারটা টের পাচ্ছে প্রীতি। ভীষণ রকমের স্থির হয়ে বসে আছে। এত আত্মবিশ্বাসী সে হয়েছিল শেষবার তার প্রাক্তনের বিয়েতে। দ্বিতীয়বার আজ, এখন, এই মুহূর্তে।

নক্ষত্র অতসীর মতো স্মার্ট মেয়ের বদলে প্রতিবার ও বার বার কেবল প্রীতিকে নিজের করে নেবে, বিষয়টার গভীরতম উপলব্ধিতে প্রীতিলতার মনে-প্রাণে বসন্তের কোকিল ডাকছে। সে কতটা বিশেষ, তা টের পাচ্ছে।

অতসী বলল,
-“বাচ্চা তুমি, বয়সের হিসেবে আমার অনেক ছোট। একটা এডভাইস দিচ্ছি, শোনো।”
-“জি, আপু।”
-“কখনো কম্প্রোমাইজ কোরো না। তোমার ভালো থাকাটা তোমার কাছে সবার আগে প্রায়োরিটি পায় যেন। নিজেকে গুরুত্ব না দিলে, বিপরীত ব্যক্তিটি তোমাকে ভালো রাখতে অপারগতা দেখাবে। নয়তো দেখা যাবে, সামনের মানুষটা ভেবেই রেখেছে—তুমি অযত্নে কষ্ট পাও না, অবহেলায় মূর্ছা যাও না। প্রীতিলতা? কখনো নিজের অসম্মান কোরো না।”

প্রীতি চোখে হাসল,
-“আমি কারো যত্নের বাগানের অর্কিড নই, যে অযত্নে মারা যাব। আমি বনফুল। আত্মনির্ভরশীল, সহনশীল, অকৃত্রিম সুন্দর, শক্তিশালী, দৃঢ় আর আমার মূল পরিচয়—আমি স্বতন্ত্র।”

বড়ো সাহিত্যরসের সাথে প্রীতি এর উত্তর দিলো। দেখতে পেল, অতসী কেমন খুশি হচ্ছে। তার ভালো লাগছে, প্রশান্তি পাচ্ছে। প্রীতি তার চোখে দেখতে পেল, অন্য কারো সঠিক মনোভাবের বিপরীতে তার কোনো একসময়ের ভুল অনুভূতি চাপা পড়ে গেল।

প্রীতি নরম হলো। শান্ত কণ্ঠে ডাকল,
-“আপু?”
-“হ্যাঁ!”
-“আপনার শব্দগুলোর ব্যথা আমি টের পাচ্ছি।”
-“যাহ! ব্যথা কই? আমি জাস্ট এমনিই বললাম..”

প্রীতি মাথা নাড়ল। সে ছোট, বয়স কম, তাই বলে অবুঝ নয়। কেউ মানতে না চাইলে তাকে জোর করাও অনুচিত। প্রীতি বলল,
-“চিন্তা করবেন না আপনি। আমার মানুষকে আমি ভালো রাখব, তবে এক্সপেকটেশন রাখব না। তাকে আমি ততটুকু ভালোবাসব, যতটুকুতে ফিরতি ভালোবাসা দিতে সে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। যত্ন, গুরুত্ব, সম্মান—এসব আমার ভালোবাসারই অংশ..”

বসার ঘরে পৌলিকে দেখে শামার কাছে প্রীতির অবস্থান জেনে এখানে আসতে এক মুহূর্তও দেরি করেনি নক্ষত্র।
প্রাক্তন আর বর্তমানকে মুখোমুখি দেখে নক্ষত্রের মুখের রঙ উড়ে গেল। সে কি এখান থেকেই কেটে পড়বে? নাকি এগিয়ে যাওয়া উচিত? এগিয়ে গিয়েই বা কী বলবে? হ্যালো গার্লস?

নক্ষত্রের কিছুই করা লাগল না। প্রীতি তাকে দেখে মুচকি হাসল। এগিয়ে এলো আলগোছে। একহাতে নক্ষত্রের বাহুর দিকের শার্ট চেপে ধরে অতসীকে বলল,
-“আমাদের বিয়েতে থাকবেন, প্লিজ। নেক্সট উইকেই বিয়ের ডেইট। ঘরোয়া আয়োজন, বেশি মানুষ আসবে না। আমি পুরোপুরি অ্যাশিওর করছি, আপনি কম্ফোর্ট পাবেন। আমরাও খুশি হব।”

নক্ষত্র কিছু বলল না। অতসী যে কষ্ট পাবে এবং পাচ্ছে, এটুকু খুব করে টের পেয়েও কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল প্রীতির দিকে। গতবারের ভুলটা আর করবে না। তবে শাস্তি? অন্যায় তো অন্যায়ই। প্রায়শ্চিত্তও নিশ্চিত। প্রীতি ক্ষণ গুনল..

________
ছাদের মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে বসে আছে শেফা। তার কোলে নীহমের মাথা। মোহ চা বানিয়ে নিয়ে এসে পাশে বসল। নীহম বলল,
-“মোহর বিয়ের অনুষ্ঠান কবে হবে, আম্মু?”

শেফা হাসল,
-“আমার মনে হয় না হবে। কবে দেখা যায় মেয়ে আমার এককাপড়ে এই ছাদ টপকে ওই ছাদে চলে গেল। এরপর আমাকে বলল, ‘শোনো, আম্মু! আমি সেটেল্ড। আজ থেকে আমি তোমার প্রতিবেশী ভাবির ছেলেরবৌ। চিনি চাইতে এসো। গুডবাই।’ আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।”

মোহ মুখ ভেঙচাল,
-“হ্যাঁ, দুইজন মিলে এখন বিনোদন নাও। টপিক মোহনা আফরিন: দ্যি পাড়াতো ব্রাইড।”

শেফা শব্দ করে হাসল। সে হাসিটা এক পর্যায়ে মোহকেও হাসাল। নীহমের চোখ দুটো পালাক্রমে এই দুইজন নারীর দিকে আবদ্ধ।

নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে নিচতলায়। দুপুরে ছাদে কাপড় দিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো নিতেই ভদ্রমহিলা ওপরে এলেন। নাম রুকসানা, বয়স পঞ্চাশের ঘরে। দেখতে আভিজাত্যপূর্ণ ও সুসাস্থ্যবান বেশ। স্বামী রেজাউল সাহেবের একটা চাকরিজনিত কারণে ওনাকে আগামী কিছুমাস এই শহরে থাকা লাগবে। স্ত্রীকে ছাড়া ভদ্রলোক থাকতে পারবেন না, তাই এই জোগাড়।

রুকসানা ছাদে উঠে সবার আগে দেখতে পেলেন শেফার কোলে শুয়ে থাকা নীহমকে। নীহম আর মোহ দেখতে তাদের মায়েদের মতো হয়েছে, এদিকে আবার তাদের মা শেফা ও নীপা দেখতে প্রায় একরকম। রুকসানা নীহমকে একদেখায় মোহ মনে করে ভুল করে বসল। কাপড় তোলার আগে এগিয়ে গেল তাদের দিকে। মোহ কাপগুলো কর্নারের টেবিলের ওপর রেখে এখানে এলে রুকসানা তাকে দেখতে পেল, এবার বেশ অবাক হয়েই বললেন,
-“ভাবি, আপনার দুই মেয়ে আগে বলেননি তো!”

জবাবে শেফা কেবল হাসল। কিছু বলল না। রুকসানা বললেন,
-“নাম কী?”

নীহম পাশ হাতড়ে নিজের ওড়নাটা দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। তার আগে বলল,
-“আফরাহ্‌ নীহম।”

রুকসানা শেফাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“ছোট মেয়ে?”
-“হ্যাঁ।”
-“কীসে পড়ছে?”
-“অনার্স করছে। ফাইনাল সেমিস্টারে আছে।”
-“বাহ! বেশ বড়ো হয়ে গেছে। বড়ো মেয়েকে তো কাবিন করিয়ে রেখেছেন। আর ছোটটাকে?”
-“এখনো না।”
-“বিয়ে দেবেন না?”
-“জি, এত সুন্দর মেয়ে আমার। কেন দেবো না?”

রুকসানা মনে মনে হিসেব মেলালেন। এরপর বললেন,
-“ওকে দেখি না যে! অন্য কোথাও থাকে?”
-“জি, ভাবি।”
-“আমার ছেলেও অন্য শহরে থাকে চাকরির জন্য।”

রুকসানা বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেলেন। নীহম বলল,
-“আবার বিয়ের প্রপোজাল আসবে! বিরক্তিকর লাগে, আম্মু।”

মোহ বলল,
-“এবার লাগবে না।”

নীহম ওড়না সরিয়ে তাকাল,
-“খুব জানো?”
-“হ্যাঁ। তুমি আম্মুকে বলবে না-কি আমি বলব?”

মোহর ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় নীহম উঠে বসল ধপ করে। শেফার চোখে চোখ রেখে বলল,
-“আমি স্মরণকে বিয়ে করতে চাই, আম্মু।”
-“শিওর তুমি?”
-“হ্যাঁ।”
-“আর স্মরণ?”
-“সে-ও।”
-“তবে তাকে বোলো, তোমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে ফ্যামিলি থেকে। এরপর তার প্রতিক্রিয়া আমাকে জানিয়ো। সে তোমার প্রেমিক হিসেবে তখনই পার্ফেক্ট, যখন তোমার দায়িত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গে দু’বার তার ভাবা লাগবে না।”

নীহম ক্লান্ত গলায় বলল,
-“ঠিক আছে, আম্মু। তবে কিছুদিন পর জানাই। অন্তত এক সপ্তাহ লাগবে আমার নিজেকে রেডি করতে। নয়তো এখন যদি সে রাজি হয়ে যায়, তখন মুসিবতে পড়া লাগবে।”

জবাব শুনে শেফা শব্দ করে হাসতে লাগল। ও-ধারে কল এলো স্মরণের। নীহম রিসিভ করল। স্মরণ কোনো হাই হ্যালো করল না। সোজা বলে উঠল,
-“নীহম? লেটস গেট ম্যারিড..”

চলবে…