প্রার্থনায় রবে তুমি পর্ব-১৭+১৮

0
289

#প্রার্থনায়_রবে_তুমি
#পর্ব_১৭
#Saji_Afroz

রুমে এসে পায়চারি শুরু করে রুজাইন। এটা কী শুনলো ও! ভিন্ন ধর্মের মেয়ে ইধা! কিন্তু ওকে দেখলে এটা মনেই হয় না। অবশ্য না বোঝারও কারণ রয়েছে। কারণ ইধার চালচলনে বোঝার উপায় নেই যে ও হিন্দু! এত বড়ো ভুল রুজাইন করে ফেললো! ভিন্ন ধর্মের এক মেয়েকে মন দিয়ে বসেছে ও৷
মুহুর্তের মধ্যেই রুজাইনের মাথা ব্যথা শুরু হয়। যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে ও৷ আশপাশে যেন ঝাপসা দেখছে ও। এমন দিনও দেখবে কখনো ভাবেনি রুজাইন!
অনেকক্ষণ যাবত ওয়াশরুমে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে ইধা। অনবরত চোখ থেকে পানি পড়ছে ওর৷ মাইশা দেখে চিন্তিত হবে বলেই ওর থেকে নিজেকে আড়াল রেখেছে ইধা।
রুজাইন সবটা জেনে নিশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর এটা বুঝতে পেরে ইধারও কষ্ট লাগছে।
রুজাইনকে কখনো অন্য চোখে দেখেনি ইধা। কিন্তু যেদিন ওকে রুজাইন মনের কথা জানায়, হঠাৎ-ই ইধার মনেও ভালো লাগার জন্ম নেয়। মনেহয়, রুজাইন ওর জীবনসঙ্গী হলে মন্দ হত না। ভালোবাসা বুঝি এমনি! কখন কার জন্য মনে জায়গা তৈরী হয়ে যায় বোঝা মুশকিল।

-ইধা হিন্দু! কীসব বলছ! ইচ্ছেকৃত মিথ্যে বলছ না তো?

সাদ্দামের কথা শুনে মাইশা বলল, মিথ্যে কেন বলব?
-হয়তো রুজাইনকে পছন্দ নয়, তাই এইটা বলে সরে যেতে চায়ছে।
-পছন্দ না হলে এমন একটা কারণ কেউ বলে! কত বড়ো বিষয় বুঝছ তুমি এইটা?
-রুজাইন কী বলেছে?
-কিছুই না। কথা বলো তার সঙ্গে। শান্তনা দাও।
-তাই দিতে হবে। মুসলমান মেয়ের তো অভাব নেই দেশে।
-তা ঠিক। কিন্তু আঘাত সারতে সময় লাগবে।

সাদ্দামের ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গেই রুজাইনের ফোনকল আসে। মাইশা রিসিভ করে।
রুজাইন ওপাশ থেকে বলল, কেন তোমরা এই কথা গোপন করেছ?
-ইধাকে আপনার পছন্দ হয়ে যাবে এমনটা ভাবিনি ভাইয়া।
-মাইশা ভাবী! আমার কী করা উচিত আমি কিছুই বুঝছি না। ও হিন্দু ধর্মের এটা কী তোমার বাসায় কেউ জানে না?
-না। ভিন্ন ধর্মের কাউকে আম্মু এলাউ করবে না বাসা শেয়ার করতে। এইজন্যই মূলত গোপন করা। তাছাড়া আপনার বাসায়ও একই নিয়ম। ভিন্ন ধর্মের কাউকে ভাড়া না দেওয়া। এইজন্য ইধা রায়কে ইধা বানিয়েই এই বাসায় তুলেছিলাম। আমি দু:খিত ভাইয়া! আমার জন্যই আপনার সঙ্গে এটা ঘটে গেল। আসলে ইধা এত অসহায় ছিল! আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠেছিল। ওর কষ্টটা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
-কী কষ্ট?
-ও এখানে পালিয়ে এসেছিল।
-কেন?

সবটা রুজাইনকে খুলে বলল মাইশা। এরপর ও আরও বলল, যা হয়েছে সব ভুলে যান। ভুল মনে করে সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। অনেক ভালো মেয়ে আসবে আপনার জীবনে।
-হয়তো!

এই বলে ফোনের লাইন কাটে রুজাইন।

আজ মাইশার সঙ্গে বের হবে ইধা।
মাইশা ও সাদ্দাম যাচ্ছে কক্সবাজার হানিমুনে। ওদের সঙ্গে ইধাকে জোর করেই নিয়ে যাচ্ছে৷ ইধা একদমই রাজি ছিল না সাথে যেতে। কিন্তু মাইশা জানে, ও কখনো কক্সবাজার দেখেনি। তাই ওকে নিয়ে যাচ্ছে।
ব্যাগ নিয়ে নিচে এসে দাঁড়ায় মাইশা ও ইধা। ওদের দেখে দারোয়ান সালাম জানায়। মাইশা মালকিনের আত্মীয় জানার পর এই এলাকায় ওর সম্মানটা বেড়ে গেছে। মাইশাও এই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে।

ওরা সাদ্দামের জন্য অপেক্ষা করছে৷ হঠাৎ রুজাইন আসে। ওর কাঁধে ব্যাগ দেখে মাইশা বলল, ভাইয়া কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
-হু। বেড়াতে।
-আমরাও।
-গুড!

এরইমাঝে একজন মধ্য বয়সী মহিলা আসেন বাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্যে৷ তার কপালে সিঁদুর দেখে দারোয়ান জানায়, এখানে হিন্দু ভাড়া দেওয়া হয় না। কথাটি শুনে মহিলা চলে যান। ইধা ভ্রু কুচকে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে দারোয়ান বলল, কিছু বলবেন আপা মনি?
-হিন্দু ভাড়া দিলে কী অসুবিধে?

মাইশা ধীরকণ্ঠে ইধাকে বলল, ছাড় না ওসব!

দারোয়ান একগাল হেসে বলল, এখানে দেওয়া নিষেধ।
-হিন্দুরা কী মানুষ নয়?
-ওতশত বিষয় আমার জানা নাই৷ যেমন আমারে বলছে তেমনি করি।

এইবার মুখ খুললো রুজাইন। ও বলল, আমাদের পাশের গলিতে ইয়াশ নামের এক লোকের বিরাট বাড়ি আছে। ওখানে সব হিন্দু পরিবার থাকে। কোনো মুসলমান বা অন্য ধর্মের কেউ ভাড়া নিতে পারে না। এই মানে কী অন্যরা মানুষ নয়? আসলে মানুষ জাত এক হলেও ভিন্ন ধর্ম হলে নিয়মেও কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সেই ভিন্নতার জন্য অনেকে অন্য ধর্মের মানুষকে ভাড়া দিতে চায় না। আবার সবার মানুষিকতা তো এক নয়! অনেক বাসায় দেখবে, হিন্দু মুসলমান মিলেমিশেই পাশাপাশি থাকে।
-অনেক বাসায় থাকলেও আপনার বাসায় থাকে না। এর মানে বুঝছেন তো?

রুজাইন কিছু বলার আগে সাদ্দামের গাড়ি চলে আসে।

মাইশা ও ইধা এসে গাড়িতে বসে৷ রুজাইনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে সাদ্দাম। এরপর সেও গাড়িতে এসে বসে৷ গাড়ি চলতে শুরু করে। রুজাইন তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

কক্সবাজার চলে এসেছে ওরা কয়েকঘন্টা হলো। পাশাপাশি রুম নিয়েছে মাইশা ও ইধা। রুমে আসার আগেই দুপুরের খাবার ওরা খেয়ে নেয়। ফ্রেশ হয়ে আরাম করে ওরা চলে আসে সমুদ্র সৈকতে। এই প্রথম সমুদ্রের বিশালতা দেখলো ইধা৷ ও হা করে তাকিয়েই রইলো। মাইশা ওকে ডাকতেই আচমকা জড়িয়ে ধরলো ওকে। মাইশা বলল, কী ব্যাপার?
-আমাকে সমুদ্র দেখানোর জন্য তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
-ভালো লাগছে না বল তোর?
-অনেক! এত সুন্দর সবকিছু!

ওরা কিছুক্ষণ একসঙ্গে সময় কাটায়। ইধা বলল, তোরা একাকী সময় কাটা দু’জনে। আমি এখানেই আছি।

সাদ্দাম বলল, আরেহ কী বলো! একা কী করবে তুমি!
-উপভোগ করব সৌন্দর্য। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। প্লিজ আপনারা আপনাদের মুহুর্তটা উপভোগ করুন।

ইধার কথাতে ওরা হাত ধরে একসঙ্গে পানিতে নামলো। ইধা পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছে।
-সমুদ্রের গভীরতা উপলব্ধি করছ?

পাশে তাকিয়ে রুজাইনকে দেখে চমকায় ইধা। ও বলল, আপনি?
-আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করাতে এলাম তোমায়।

অবাক হয় ইধা। রুজাইন বলল, আমি আসব জানলে আসতে না তুমি। তাই বলিনি তখন।
-মাইশা জানে?
-উহু! সাদ্দাম ভাই জানে।

একটু থেমে ইধা বলল, ঠিকই বলেছেন। জানলে আসতাম না।

এই বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় ইধা। রুজাইন ওর সামনে এসে বলল-
এই ক’টা দিন অনেক ভেবেছি। সারা দিন ভেবেছি, ভেবেছি সারা রাত! ভুলতে পারব না তোমাকে। মন দিয়ে বসেছি যাকে, তাকে ভোলা কী এতই সহজ!

ইধা জোরালো কণ্ঠে বলল, কেন এসব বলছেন! এটা কোনো ভাবেই সম্ভব না!
-সম্ভব! তুমি আমি চাইলেই সব সম্ভব। লড়াই করতে আমি প্রস্তুত৷ তুমি মনোবল শক্ত করলেই চলবে।

ইধা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, শর্ত ছুড়ে দেবেন জানি। মুসলিম হতে বলবেন আমায়। তাই তো?
-উহু৷ বিনা শর্তে তোমাকে চাই আমি৷ যেভাবে তুমি আছ সেভাবেই।
-এসব আবেগীয় কথাবার্তা।
-মনের কথা আমার। ভালোবাসার কথা বলতে পারো!

ইধা কিছু বলে না। রুজাইন বলল, অনেক ভালোবাসি তোমাকে। বিশ্বাস করো!

ইধা এখনো কিছু বলল না। এভাবে নীরবে দাঁড়িয়েই কেটে গেল অনেকটা সময়।

রাতের খাবার খেতে সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে আসলো। মাইশা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। ও বিশ্বাসই করতে পারছে না, রুজাইন এখানে। আর রুজাইন সব জেনেও ইধাকে চায়৷ এটাও মানতে ওর কষ্ট হচ্ছে। এসবের জন্য ওর বিবাহিত জীবনে কোনো সমস্যা আসতে পারে বলেও চিন্তিত ও৷ দুই পরিবারের মধ্যে না আবার কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হয়!
.
চলবে

#প্রার্থনায়_রবে_তুমি
#পর্ব_১৮
#Saji_Afroz

-আমাকে একটাবারও বললেন না, রুজাইন ভাই আসবে এখানে!

মাইশার কথা শুনে সাদ্দাম বলল, সারপ্রাইজ ছিল।
-আমার জন্যে মোটেও এটা সারপ্রাইজ নয়।
-তোমাকে জানালে তুমি ইধাকে বলে দিতে সবটা। ওর জন্যে অবশ্যই সারপ্রাইজ।
-ওর জন্যেও নয়। ইধাও বিষয়টা পছন্দ করেনি এবং করছে না।
-তুমি কিভাবে শিওর হলে?
-আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ও।
-তাই বলে ওর পেটের কথাও তুমি জানবে?
-মনের কথা জানব।

মাইশার পাশে আসে সাদ্দাম। ওর হাত ধরে বলল, কেন এসব নিয়ে এত ভাবছ বলো তো! ওদের বিষয় ওদেরই বুঝতে দাও না!
-আপনারা কেন বিষয়টা জটিল করছেন! হিন্দু ও মুসলমানের রিলেশন এটা হয় কখনো বলেন?
-কখনো দেখোনি?
-অনেক ঝড়ঝাপটা সামাল দিতে হয়।
-দিতে হলে ওরা দেবে।
-কিন্তু ইধাকে কোনো জটিলতায় আমি পড়তে দেখতে পারি না।

একটু থেমে সাদ্দাম বলল, রুজাইনকে শেষ চেষ্টা করতে দাও৷ ইধা এরপরেও রাজি না হলে আমি নিজে রুজাইনকে সরে যেতে বলব।

ওর কথা শুনে যেন শান্তি পায় মাইশা। সাদ্দাম বলল, এইবার খুশি তো?

হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ে মাইশা। সাদ্দাম বলল, তবে কাছে আসো এখন।

মাইশা লাজুক হেসে বলল, যখন তখন দুষ্টুমি!
-এসবের মানেই তো হানিমুন ম্যাডাম!

এই বলে মাইশাকে কাছে টেনে নিলো সাদ্দাম।

আজ শান্ত সাগর ইনানীতে এসেছে সবাই৷ প্রবাল পাথরের দেখা মেলে এখানে। যা দেখে বিস্মিত হলো ইধা। কারণ ওর এসব প্রথম বারের মতো দেখা।
কক্সবাজারের মতো উত্তাল নয় এই সাগর৷ এই শান্ত সাগর দেখেই বিমোহিত হলো ইধা। এক নজরে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো ও।
-একটা হাসি দাও?

ক্যামেরা হাতে রুজাইনকে দেখলো ইধা। রুজাইনের কথার পিঠে কোনো কথা না বলে অন্যদিকে ঘুরে তাকায় ইধা। রুজাইন ওর সামনে এসে বলল, এমন ফোলা গালে মৎস্য কন্যার মতো লাগছে।

ইধা ভ্রু কুচকে বলল, আজব! আমি পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি নাকি? এসব আজগুবি কথা বলেন কেন?
-না বললে কী তোমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হবে? তাছাড়া মৎস্য কন্যা খারাপ কী! বেশ সুন্দর।
-যেন দেখেছেন?
-শুনেছি। রূপকথার গল্প তুমি শোননি?
-রূপকথাতেই মানায় ওসব।

এই বলে হাঁটতে শুরু করে ইধা। রুজাইনও ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, চলো না! আমরাও একটা ইতিহাস গড়ি?
-কী ইতিহাস?
-আমাদের প্রেমের ইতিহাস।
-ইতিহাস গড়তে গিয়ে না আবার হতে হয় হতাশ!
-হতাশ হওয়ার কোনো চান্স নেই।

ইধা থামে। ও বলল, কেন এমন করছেন?
-ভালোবাসি তাই।
-আমি বাসি না।
-চোখে চোখ রেখে বলো?
-বাংলা সিনেমা চলছে না এখানে।
-হৃদয় এর তো চলছে!

কোনো কথা আর ইধা বলল না। মাইশাদের দেখে ওদের দিকে এগিয়ে যায়।
ইধাকে দেখে মায়া হয় মাইশার৷ বুঝতে পারছে ও বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু কিইবা করবে! রুজাইন বলে এসব মেনে নিচ্ছে। নাহলে ইধাকে বিরক্ত করার শাস্তি ও ঠিকই দিয়ে দিতো!

রাতে কাসুন্দি রেস্তোরাঁয় এলো ওরা। মাইশার অনেক শখ ছিল এখানে আসার। আগে কক্সবাজার আসা হলেও এখানে এই প্রথম। সারাদিন ঘুরাঘুরির পর এখানে রাতের খাবার খাবে ওরা ঠিক করলো।
ভিডিওতে এই লাইভ মিউজিক কত দেখেছে মাইশা! আজ বাস্তবে দেখে অনেকটা খুশি ও। ইচ্ছেটা পূরণ হলো বলে!

ওরা খাবার অর্ডার করে। খানিকবাদে খাবার আসে। গান শুনে শুনে রাতের খাবার সেরে নেয় ওরা।
খাওয়া শেষে হঠাৎ রুজাইন সেই বড়ো নৌকা আকৃতির স্টেজে উঠে পড়ে। মাইশা অবাক হয়ে বলল, উনি ওখানে কেন যাচ্ছেন?

সাদ্দাম বলল, এটাও সারপ্রাইজ!

ওকে দেখে স্টেজে থাকা শিল্পী মাইকটা হাতে দেয়। রুজাইন স্মিথ হেসে বলল, গান তেমন পারি না। তবে আমার প্রিয় মানুষের গান অনেক পছন্দের। তাই তার জন্যেই একটু চেষ্টা!

সবাই করতালি দিয়ে উঠে। ইধাও বেশ অবাক হয়ে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
রুজাইন গাইতে শুরু করে–

তুমি না ডাকলে আসব না
কাছে না এসে ভালোবাসব না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি….

গান গাইতে গাইতে নিচে নেমে আসে রুজাইন। ইধার সামনে এসে দাঁড়াতেই চমকায় ইধা। মনে মনে ভাবে ওকে কিছু বলবে রুজাইন!
মনের কথা ঠিক হয়ে গেল ওর।
রুজাইন গান থামিয়ে বলল, আজকের এই রাত তোমার জন্যে! আমার গান তোমার জন্যে! এই আমি শুধু তোমার জন্য! ভালোবাসি তোমাকে। সবার সামনে এই সরল স্বীকারোক্তি আমার! এইবার তো বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি!

মাইশা উঠে দাঁড়ায়। আশপাশে তাকিয়ে ও বলল, হোটেলে গিয়ে বাকি কথা হবে। চলুন ভাইয়া।
-এখানেই হোক মাইশা। হয়তো আজ শুরু হবে, নয়তো শেষ!
-ভাইয়া প্লিজ! এভাবে সবার সামনে এসব না করলে হয় না?

সাদ্দাম বলল, মাইশা তুমি এসবে জড়াচ্ছ কেন? ওদের ব্যাপার ওদেরই বুঝতে দাও!
-ইধা আমার সঙ্গে এসেছে। ও আমার দায়িত্ব। ওকে এভাবে সবার সামনে বিব্রত আমি হতে দিতে পারি না।

রুজাইন বলল, বিব্রত আমি করছি না। মনের কথা বলছি!

ইধার দিকে তাকিয়ে রুজাইন বলল, মনের কথা বলার রাইট আমার অবশ্যই আছে। তোমারও হ্যাঁ বা না বলার অপশন আছে। প্লিজ তুমি বলো কিছু!

মাইশা নিজের রাগকে সামাল দিতে না পেরে বলল-
দেখুন ভাইয়া! আপনি আমার অনেক হেল্প করেছেন। এরজন্য আমি আপনাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তাই বলে সত্যিটাকে সত্যি বলতে পারব না এমন না!
-কী সত্যি?
-আপনি রীতিমতো ইধাকে বিরক্ত করছেন। ও আপনাকে রিজেক্ট করেছে। এরপরেও ওকে ডিস্টার্ব করছেন। ফখরুল আর আপনার মধ্যে তফাৎ কোথায়!

কথা বলে উঠলো সাদ্দাম। ও বলল, মাইশা! তুমি কেন এত উত্তেজিত হচ্ছ বলো? কার সঙ্গে কাকে তুলনা করছ!
-এটা কখনো হতে পারে বলুন আপনি?
-আমি তুমি কেউই বলার নয়। যা বলার বলবে ইধা।

রুজাইন মাইশার এসব কথা উপেক্ষা করে হাঁটু গেড়ে বসে ইধার সামনে। যা দেখে চোখ জোড়া ছলছলে হয়ে আসে ইধার।
রুজাইন পকেট থেকে একটি গোলাপ বের করে বলল, আমি জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো। তাই না বলো?

আশপাশ থেকে অনেকেই উচ্চস্বরে বলছে, বলে দাও বলে দাও!

মাইশার দিকে তাকায় ইধা। ওর রাগান্বিত মুখ দেখে উঠে দাঁড়ায় ও৷ রুজাইনের উদ্দেশ্যে ও বলল, এসব তামাশা না করলেই পারতেন।

এই বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে ও। মাইশা বলল, আমি বলেছিলাম! বলেছিলাম এসব ওর পছন্দ হচ্ছে না।

এই বলে মাইশাও ইধার পিছু নেয়।

রুজাইন!
দিন দিন এই নামটা ইধার মনে অনেকটা জায়গা দখল করে নিচ্ছে। নিজেকে যেন ওর থেকে দূরে সরানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে ইধার জন্যে৷ আজকের করা রুজাইনের এই কান্ডে ইধা আসলেই বিরক্ত হয়েছে?
না তো! বরং এসব দেখে একরাশ ভালোলাগা কাজ করছে মনে। ওকে কেউ এভাবেও ভালোবাসবে কখনো ভাবেনি। অবহেলায় কেটেছে আজীবন ওর৷ মাইশার বন্ধুত্ব আর রুজাইনের ভালোবাসা ওর জীবনে আশীর্বাদ। কিন্তু মাইশাও চায় না, রুজাইনের সঙ্গে ও জড়াক। এর কারণ ইধা জানে। এসব ঝড় ঝাপটা ওর বিবাহিত জীবনের হুমকি হতে পারে।

মাইশা ওর রুমেই আছে। মাত্র এলো ও। ইধাকে নিশ্চুপ দেখে বলল, আমি গল্প করতে এলাম আর তুই মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস?
-ঝগড়া করে এসেছিস সাদ্দাম ভাই এর সঙ্গে?
-মোটেও না।
-তবে?
-আসতে পারি না বুঝি?
-অবশ্যই পারিস৷

একটু থেমে মাইশা বলল-
টাকা দিয়ে কাসুন্দি রেস্তোরাঁয় নিজে গান গাওয়ার আয়োজন করেছিল রুজাইন ভাই! তুই রাজি হলে সব শিল্পীরা তোদের নিয়ে গান গাইতো। তখন চারপাশে ফুলের পাপড়ি আর বেলুন উড়ানো হত। এমনি পরিকল্পনা ছিল৷ উনি তোকে অনেক ভালোবাসে রে!
-তুই বলছিস এসব?
-একটু আগেও পুরো বিষয়টা আমার কাছে বিরক্তিকর ছিল। কারণ তুই বিরক্ত হচ্ছিস৷ কিন্তু তার কান্না দেখে বুঝলাম, এই ভালোবাসা মিথ্যে নয়!
-কান্না?
-উনি আমার কাছে এসেছিল। আমাদের বিব্রত করে থাকলে দু:খিত জানায়। আর উনি বুঝেছে, তুই ভালোবাসলেও বলবি না কখনো। তোকে পাবে না বলতেই কান্না করে ফেললো। ছেলের কান্না মিথ্যে হয় না। তুই কী আসলেই ভালোবাসিস রুজাইন ভাইকে? বাসলে সবকিছুর উর্ধে নিজের ভালোবাসাকে গুরুত্ব দে। সব নিয়ম ভেঙে নিজেরা নতুন নিয়ম গড়ে তুলে নে। আমি তোর সিদ্ধান্তে পাশে থাকব। আমি শুধু তুই বিরক্ত হচ্ছিস ভেবেই এমন আচরণ করেছি। যদি জানি তুইও তাকে ভালোবাসিস, কেউ তোর সঙ্গ না দিলেও আমি দেব!
.
চলবে