প্রার্থনায় রবে তুমি পর্ব-১৯

0
291

#প্রার্থনায়_রবে_তুমি
#পর্ব_১৯
#Saji_Afroz

কমবেশি সবার জীবনে প্রেম আসে। কেউ নিজের মানুষকে মনের কথা জানিয়ে তাকে পেয়ে যায়। আবার কেউ পায় না৷ কেউ পেয়েও হারায়! এভাবেই তো চলে জীবন!
ইধাকে অনেকভাবে রুজাইন বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ওকে কতটা ভালোবাসে! সব ঝড় ঝাপটা সামাল ও দিতে পারবে, এটাও বুঝিয়েছে। কিন্তু ইধা হয়তো সত্যিই ওকে চায় না!
তাই ওকে বারবার প্রত্যাখ্যান করছে। ইধা ওকে ভালোবাসে কি না ও জানে না। কিন্তু ওর কারণে ইধা বিরক্ত হচ্ছে এটা জানে। তাই রুজাইনও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইধাকে ও আর বিরক্ত করবে না। এভাবে ওকে বিরক্ত না করে ওর মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিজের জীবনে মনোযোগী হওয়া উচিৎ । আজ থেকে সেটাই করবে রুজাইন!
মনস্থির করে শুয়ে পড়ে ও৷ তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পায়।
ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখলো রুজাইন। রাত বারোটা বাজলো সবে। কে এসেছে এই রাতে!
আবারও কড়া নাড়লে রুজাইন উঠে পড়ে৷ দরজা খুলে ইধাকে দেখে চমকায় ও৷ ইধার চোখে পানি৷ রুজাইন বিচলিত হয়ে বলল, কিছু হয়েছে?

ইধা ভেতরে আসে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ও বলল, আমি দু:খিত। ওত মানুষের সামনে আপনাকে ছোটো করা মোটেও উচিত হয়নি।
-আমি দু:খিত! তোমাকে অপ্রস্তুত করে ওসব করা আমারও উচিত হয়নি৷ আসলে আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমিও আমায় ভালোবাসো। আমার ভাবনা মিথ্যা হবে ভাবিনি।
-মিথ্যে নয়।

রুজাইন অবাক হয়ে তাকায় ইধার দিকে। ও বলল, আমার ভাবনা মিথ্যে নয়?

না সূচকভাবে মাথা নাড়ে ইধা। রুজাইন কাঁপা কণ্ঠে বলল, তবে?

ইধার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কিছু বলতে চেয়েও যেন পারছে না ও! রুজাইন বলল, ভালোবাসো আমায়?

এইবার হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ে ইধা। রুজাইনের মুখে ফোটে হাসি৷ ও আনন্দে চোখ জোড়া নাচিয়ে ইধার দিকে আরও ভালো করে তাকায়।
মেয়েটা নিশ্চয় অনেক কান্না করেছে। তাই মুখ, চোখ লাল হয়ে আছে। সঙ্গে রয়েছে ফোলা ভাব।
রুজাইন বলল, সত্যি ভালোবাসো? নাকি আমাকে খুশি করতে বলছ?
-ভালো না বাসলে আপনাকে খুশি করার কথাও আমি ভাবতাম না।
-তবে এভাবে কাঁদছ কেন?
-আমি আপনাকে ভালোবাসি। পথ চলতে চাই আপনার সঙ্গে। কিন্তু এই পথ চলাটা সহজ হবে না ওত! চলতে পারব তো? নাকি মাঝপথে ছেড়ে দিতে হবে হাত! আমি কী মনের কথা জানিয়ে আমাদের জীবনে ঝড় আনছি! এসব ভেবেই আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

রুজাইন ওর অনেকটা কাছে এসে বলল, ভালোবাসলে এত ভাবতে হয় না! প্রতিটা মুহুর্তকে উপভোগ করতে হয় শুধু৷ যখন ঝড় আসবে তখন সামাল দেব। কিন্তু দেব-ই! ছেড়ে যাব না কেউ কাউকে।
-সত্যি ছাড়বেন না?

ইধার ডান হাতটা নিয়ে নিজের বুকের উপরে রাখে রুজাইন। ইধার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে ও বলল, সম্ভব-ই না!

আজই কক্সবাজারে থাকার শেষ দিন। দুপুরের বাসে রওনা হবে ওরা।
মাইশার ইচ্ছে ছিল আজ সমুদ্রের পাড়ে সূর্য উদয় দেখবে। ইধাকে বলেছিল সঙ্গে যেতে। কিন্তু ইধা যাবে না জানিয়েছে গত রাতে। ওদেরই যেতে বলেছে। তাই আজ আর ইধাকে জাগালো না ঘুম থেকে। সাদ্দামের সঙ্গে মাইশা চলে আসে সমুদ্রের পাড়ে।

রুজাইন ও ইধা দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের পাশে। সূর্য উদয় হচ্ছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে ইধা বলল-
মাইশা বলছিল ওর প্রিয় মানুষের সাথে এই দৃশ্য দেখার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন আগেই। তখন ওকে বলতে পারিনি, আমারও এমন ইচ্ছে ছিল।
-এভাবে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল এমন সুন্দর দৃশ্য?

ইধা হাসে। রুজাইন ওর পাশে এসে বলল, কাঁধটা ফাঁকা লাগছে ম্যাম।

রুজাইনের ইঙ্গিত বুঝতে পারে ইধা। ওর কাঁধে মাথা রেখে সুন্দর এই দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে ইধা।

হোটেলে এসে ইধাকে মাইশা ও সাদ্দাম পায় না। রুজাইনও রুমে নেই। ওদের জন্যেই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে ওরা। ভেবেছে একসঙ্গে নাস্তা খাবে। কিন্তু ওদের না পেয়ে ইধাকে ফোনকল দেয় মাইশা। ইধা রিসিভ করলে মাইশা বলল, এত সকালে কোথায় গেলি তুই?

ইধা আমতাআমতা করে বলল, আছি আশেপাশেই।
-এখানকার কিছু তুই চিনতে পারবি! আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে।

ইধা লাজুক কণ্ঠে বলল, আমার সঙ্গে রুজাইন আছে।

মাইশা হেসে বলল, তাই!
-হু।

এইবার ও সুর টেনে বলল, তবে কী শুরু হয়ে গেছে?
-কী?
-প্রেম লীলা!
-ধ্যাত!
এই বলে ফোনের লাইন কাটে ইধা। সাদ্দাম বলল, কী হলো?
-দুটো একসঙ্গেই আছে।
-তাই?
-হু। হয়তো মিলমিশ হয়ে গেছে।
-এইতো ভালো খবর।
-হু। সামনেও যেন সব ভালো থাকে, এই প্রত্যাশা করি!

আজ সেই ভোর থেকে রুজাইনের সঙ্গেই ছিল ইধা। পুরো সময়টা নিজেদের মতো উপভোগ করেছে ওরা।
দুপুরে মাইশাদের সঙ্গে খাবার খেয়েই বাসে উঠেছে ওরা।
রুজাইন ও ইধা আজ পাশাপাশি সিটে বসেছে। সারাটা দিন ইধার হাত ধরে ছিল রুজাইন। এখনো ওর হাত ধরে বসে আছে ও। ব্যাপারটা ভালোই উপভোগ করছে ইধা।
কখনো ভাবেনি, কেউ ওকে এতটা ভালোবাসবে! ওর জন্যে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকবে। রুজাইন ওর জীবনে আশীর্বাদ। যাকে ও হারাতে চায় না৷
গাড়ি চলতে শুরু করে। মাঝপথে রুজাইনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে ইধা। ওর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। এক মুঠো চুল যেন কপালেই লেপ্টে আছে। আলতো করে সেসব সরিয়ে দেয় রুজাইন। খুব করে ইচ্ছে করছে, ওর কপালটা ঠোঁটে ছুইয়ে দিতে। কিন্তু ইধার অনুমতি ব্যতীত এটা ও করবে না। তবে এই ইচ্ছে কেও বেশি দিন দমিয়ে ও রাখবে না। এই ভেবে মুচকি হাসে রুজাইন।

ওরা বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ হলো। রাত ন’টা বাজতেই আতিয়াতকে পড়াতে আসে ইধা। বরাবরের মতো পাশের রুমেই আছে রুজাইন। মাঝেমধ্যে ইধাকে মেসেজ পাঠাচ্ছে ও। বেশ কয়েকবার এসে দেখাও দিয়েছে ওকে। ওর এসব কাণ্ডে ইধার ভালোই লাগছে৷ সেও বিষয়গুলো উপভোগ করছে।
-কেমন আছ ইধা?

আশামনিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ও। ওকে বসতে বলে আশামনি বলল, শুনেছি মাইশার সঙ্গে তুমিও গিয়েছ কক্সবাজারে।
-জি। আসলে মাইশা জোর করে নিয়ে গেছে। হঠাৎ যাওয়া হলো, তাই আগে আপনাকে জানাতে পারিনি।
-আত্নীয় এর বান্ধবী তুমি। চাইলেও কিছু বলতে পারব না।

কথাটি শুনেই রুজাইন চলে আসলো৷ ও বলল, তিনদিন পড়াতে পারেনি তো? আধাঘন্টা করে বেশি পড়িয়ে দেবে।
-আতিয়াতের উপরে প্রেসার পড়বে এভাবে।

ইধা বলল, ছুটির দিন গুলোতে পড়িয়ে দেব।
-সেই ভালো। অন্য কেউ হলে বেতন কেটে রাখতাম। কিছু না জানিয়ে এভাবে হাওয়া হয়ে গেলে তো ওমন করতেই হত!

রুজাইন বলল, এসব কী বলছ ফুফু! অন্য কেউ তো আর ইধা নয় তাই না? তাহলে এসব বলছই বা কেন!
-দেখ রুজাইন! যখন ওকে নিয়োগ দিয়েছি তখন কিন্তু আত্মীয় ও ছিল না। আমার মেয়ের জন্য বেস্ট কাউকে আমি নিয়োগ দিতে চেয়েছি। তোর কথাতে ইধাকে নির্বাচন করেছি। কিন্তু ওর কখনো শরীর খারাপ হয়, বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত থাকে আবার কখনো হাওয়া হয়ে যায়! টানা এভাবে গ্যাপ পড়লে আতিয়াতের ক্ষতি হবে পড়ায়, এটা তুই বুঝতে পারছিস?

ইধা শান্ত গলায় বলল, আমি বুঝতে পারছি। আর এমনটা হবে না।
-গুড। দু:খিত ইধা। অন্তত এই বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে আত্মীয় এর মতো ব্যবহার করতে পারব না। তুমিও তাই। আতিয়াত অমনোযোগী হলে যেমন তোমাকে শাসন আমি করতে বলেছি; তেমনি তোমার ক্ষেত্রেও আমি কঠোর হব।
-জি।

রুজাইন কিছু বলতে চাইলে আশামনি বললেন, ভেতরে এসে বল যা বলার।

ওরা ভেতরে যায়। উপস্থিত আছেন শারমিন আক্তারও।
রুজাইন তার উদ্দেশ্যে বলল, দেখেছ আম্মু? ফুফু রিতীমত শাসিয়ে এসেছে ইধাকে। মাইশা ভাবীর বান্ধবী ও। এটা ভালো দেখায় বলো?

আশামনি বললেন, কেবল বান্ধবী। বোন নয়। সাদ্দামের শালিকা ও নয়। যদি হত তবে আমি এই বিষয়ে ভাবতাম। কড়া কথা বলতে না পারলে টিউশনি বাদ দিতাম। ইধার ক্ষেত্রে এটা করলাম না৷ একবার জানালাম। ও না শুধরালে ওকে বাদ দেব।

এই বলে আশামনি হনহনিয়ে সেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। শারমিন আক্তার বললেন, রুজাইন! কেন এই সামান্য বিষয়ে কথা বাড়াচ্ছিস? ওদের ব্যাপার ওদের বুঝতে দে।
-কত কড়াভাবে ইধাকে ওসব বলেছ জানো তুমি?
-হুট করেই আতিয়াতের ক্লাস টেস্ট নেওয়া হয়। ইধা না থাকায় সেই রাতটা আশাকে পড়াতে হয়েছে। আশার সেদিন জ্বরও ছিল। তাই আরকি মুড খারাপ হয়েছে। আর ও খারাপও বলেনি। ইধা একবারও জানাবে না ও তিন দিন আসতে পারবে না!

আশামনি কথাগুলো এতটাই জোরে বলেছে; সবই শুনেছে ইধা। ওর চোখে পানি চলে আসে৷ ভুল ওর এটা ও মানছে। অন্য কেউ এসব বললে হয়তো খারাপ ওর লাগতো না। যেই পরিবারের ছেলে ওকে ভালোবাসে সেই পরিবারের কেউ ওকে ভালোবাসে না। এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে ওর।
রুজাইনের জন্য সবটা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ঝড়ঝাপটা আসলেই সামাল দিতে পারবে তো রুজাইন!
.
চলবে