প্রার্থনায় রবে তুমি পর্ব-০৭

0
387

#প্রার্থনায়_রবে_তুমি
#পর্ব_৭
#Saji_Afroz

মাইশাকে বেশ কিছুক্ষণ যাবত অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। মনমরা হয়ে কী যেন ভাবছে। ইধা মাত্রই বাসায় এসেছে। এসেই মাইশার মলীন মুখ দেখার পর থেকেই চিন্তিত ও৷ ফ্রেশ হয়ে এসে মাইশাকে প্রশ্ন করেই বসলো, কী হয়েছে তোর?

মাইশা মলীন মুখেই বলল, অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার ফোনকল এসেছে। ফখরুইল্লা নয়তো!

ওর কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠে ইধা। মাইশা বলল, আমার দু:খে তুই হাসতে পারলি?
-আমি ফখরুইল্লা শুনে হাসলাম।
-হাসার কিছু নেই। ওর নাম এটাই।
-আচ্ছা আচ্ছা! তবে আমি তোর চিন্তামুক্ত করতে পারি।
-কিভাবে?
-ফোনটা ফখরুল মানে ফখরুইল্লার নয়।
-তবে?
-সাদ্দাম ভাইয়ের।
-কে?
-রুজাইন ভাই এর কাজিন। মানে ওই পুলিশ।

মাইশা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল, উনি কেন আমায় ফোনকল দিচ্ছেন?
-খবরাখবর নেওয়ার জন্য।
-ওহ! আমি ভয়ে রিসিভ করিনি। এখন কী কল ব্যাক করা প্রয়োজন আমার?
-অবশ্যই।
-কিন্তু তুই কীভাবে জানলি ওটা সাদ্দাম ভাই?
-রুজাইন ভাই জানিয়েছে। নাম্বার আমার থেকেই নিলো।
-ওহ!

ইধার কথা শুনে সাদ্দামকে ফোনকল দেয় মাইশা। একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে সাদ্দাম। মাইশা সালাম জানিয়ে বলল, আসলে আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। ভেবেছিলাম ফখরুল হয়তো ফোন করেছে।
-ওহহো! তাই বলে এভাবে ফোন ইগনোর করবে? প্রয়োজনীয় ফোনও হতে পারতো!
-আসলে আমি এসব ঘটনা ঘটার পরে একেবারে ভেঙে পড়েছি। ফখরুলের ভয় কেন যেন মন থেকে সরাতেই পারছি না।
-এমন হলে জীবন চলবে! তোমাকে এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
-চেষ্টা করব।
-এখন থেকেই। আমি তোমাকে সাহায্য করব।
-কীভাবে?
-কিছু মনে না করলে আমি তোমায় মাঝেমধ্যে ফোন দিতে পারি? তোমার এই ভয়টা আমিই দূর করতে চাই।
-আপনি কেন কষ্ট করবেন! যা করেছেন তাতেই অনেক। বিনা পয়সায় এতটুক রুজাইন ভাই এর কথাতে করেছেন। আর আপনাকে প্যারা দিতে চাই না।
-আমি নিতে চাই প্যারা।
-মানে?

আমতাআমতা করে সাদ্দাম বলল, প্লিজ তুমি না করো না। তুমি এই পরিস্থিতিতে আছ জেনে আমার ভালো লাগছে না। তোমার সাহস ও শক্তি দুটোই আমি জোগাতে চাই। প্লিজ!

সাদ্দামের কথার পিঠে কী বলবে খুঁজে পায় না মাইশা। ও কেন মাইশাকে ফোনকল দেবে এর মানেও বুঝতে পারছে না। কেবল মানবতার খাতিরেই এসব করছে ও?

মাইশার সাড়া না পেয়ে সাদ্দাম বলল, কী এত ভাবছ! রুজাইন নিজের বোনের মতো দেখে তোমায়। আর রুজাইনের বোনের জন্য আমি এতটুক করতেই পারি! আমার মনেহচ্ছে এই পরিস্থিতি থেকে আমিই তোমাকে বের হতে হেল্প করতে পারি। এইজন্যই এসব বলা।

মাইশা হেসে বলল, ঠিক আছে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মাইশা ফোন রেখে ইধার দিকে তাকিয়ে বলল, কেইসটা কী হলো!
-কী?
-উনি আমায় নাকি এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হেল্প করবেন। কিন্তু কেন!
-রুজাইন ভাই এর জন্য হয়তো।
-ফখরুলকে নিয়ে ভয়ের কথা রুজাইন ভাইকে জানিয়েছিলাম। উনিই হয়তো পুলিশ ভাইকে সাহস দিতে বলেছেন আমায়।
-তাই হবে।
-সত্যিই রুজাইন ভাই মানুষটা দারুণ। গোপনেই আমাকে কত বড়ো একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন।

ইধা প্রসঙ্গ পালটে বলল, বই আর ক’টা যেন কিনতে হবে আমাদের?
-আরও তিনটে।
-কালই কিনে নেব। কী বলিস?
-ওকে। তোর জন্য সুখবর আছে একটা।
-কী?
-আরেকটা টিউশনি পেয়েছি।

ইধা আনন্দিত হয়ে বলল, সত্যি?
-হু।
-এইবার যেন পুরোপুরি চিন্তামুক্ত হলাম আমি। এই অচেনা শহরে চলাটা নাহয় কষ্টকর হয়ে যেত আমার জন্যে।

মরিয়ম জান্নাত ওদের দরজায় কড়া নাড়েন। মাইশা তাকে ভেতরে আসতে বললে আসেন তিনি। ইধা উঠে দাঁড়ায়। মরিয়ম বললেন, আমিও ইদানীং ব্যস্ত থাকি তাই তোমাদের খবর নেওয়া হয় না। নতুন কলেজ কেমন লাগছে?

ইধা বলল, ভালোই।
-পড়াশোনা শুরু করেছ তোমরা? নাকি শুধু টিউশনি করিয়েই সময় পার করছ?

মাইশা বলল, শুরু করছি। এখনো সব বই কেনা হয়নি।
-ক্লাসে যেভাবে পড়াচ্ছে তাল মিলিয়ে সেভাবে আগাও৷ তাহলে অনেকাংশে পড়া হয়ে যায়। আস্তেধীরে পড়ার মাত্রা বাড়াবে। পরীক্ষার অন্তত দুই মাস আগে সিলেবাস শেষ করতে হবে। দুই মাস কেবল রিভার্স দেবে।

দু’জনেই হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ে। তিনি আরও বললেন, কোনো হেল্প এর প্রয়োজন হলে আমায় জানাবে। দু’জনের রেজাল্ট ভালো আসা চাই আমার। ফিউচারে কী হওয়ার ইচ্ছে তোমাদের?

ইধা বলল, সাইকোলজিস্ট।
মাইশা বলল, তোমার মতো শিক্ষিকা।

মেয়ের কথা শুনে তিনি মৃদু হেসে বললেন, ইধার ভাবনাটাও ভাবতে পারো। বর্তমানে এটার ডিমান্ড বেশি।
-কিন্তু আগে থেকেই শিক্ষিকা হওয়ার ইচ্ছেটা আমার মধ্যে রয়েছে।
-তবে সেটার দিকেই ফোকাস করো। নিজের ইচ্ছের উপরে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। আর ইধা! তোমার জন্যেও শুভকামনা। আন্টি তোমাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করবে তোমার লক্ষ্যে আগানোর জন্যে।

ইধা একগাল হেসে তাকে ধন্যবাদ জানায়।

বেশ ভালো ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে ইধার। নিজের পড়াশোনা, ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছে ও।
মাইশার বাসায় থেকে মনেই হয় না অন্য কারো বাড়ি এটি। বরং নিজের বাড়ির চেয়েও এখানে থেকে সুখে আছে সে। নিজের বাড়ির কথা মনে পড়তেই কান্না পায় ওর৷
ইধার বাবা পরকিয়ায় লিপ্ত হয়ে ওর মা কে ছেড়ে চলে গেছে। বাবার সঙ্গে মা এর তালাকের পর নানার বাড়িতে এসে উঠে ইধা আর ওর মা। তখন ইধা সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী।
নানী বেঁচে থাকা অবধি তিন মামা বেশ আদর যত্নে রেখেছিল ওদের। বছর খানেক পর নানী মারা গেলে মামা ও মামীদের আসল রূপ বের হয়। শুরু হয় ওদের উপরে মানসিক অত্যাচার। ছোটো মামা বাদে বাকি দুই মামা বউদের কথা শুনে ওদের অত্যাচার করতো। নিজেদের কাজের বুয়াকে তাড়িয়ে ইধার মা কে বানানো হয় কাজের মহিলা। এক সময়ে ইধাকেও কাজে হাত লাগাতে হয়। সেই সুবাদে ঘরের সব কাজই ও শিখে গেছে।
আস্তেধীরে এই মানসিক অত্যাচার রূপান্তরিত হয় শারীরিক অত্যাচারে।
পড়াশোনায় বেশ ভালো ইধা। কাজের চাপে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছিল না। আর তাই কাজ করা কমিয়ে দিয়েছিল ও। আর এতেই শুরু হয় মামীদের অত্যাচার।
ওকে অত্যাচারিত হতে দেখলে ছোটো মামা ছুটে আসতো। তিনি নিজেও ছাত্র ছিলেন। ভাইদের পয়সায় চলতেন। তাই বড়ো গলায় কিছু বলতে পারতেন না। তবে ইধাকে বেশ স্নেহ করতেন।
এভাবে সময় অতিবাহিত হয়৷
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ইধার ইচ্ছে ছিল চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু কোচিং ফি এর অভাবে ও কোনো কোচিং করতে পারেনি৷ রেজাল্ট ভালো ছিল বলে ন্যাশনালে পড়ার ইচ্ছে পোষণ করে। তবে শহরের ভালো কোনো কলেজে। আর এতেই
ইধার বড়ো মামী বাঁধা সৃষ্টি করে। তিনি আর খরচা বহন করতে পারবেন না জানান। ইধার জন্য পাত্র দেখতে বলা হয়৷ পাত্র তারা পেয়েও যান। বয়স্ক এক পয়সাওয়ালা! যার দু’টো সন্তান রেখে স্ত্রী মারা গেছেন। তিনি ইধাকে রানী করে রাখবেন জানায়। মামাদেরও টাকা দেবেন জানিয়েছেন। আর টাকার লোভে তারা ইধাকে বিয়ে দিতে চান।
ইধা লুকিয়ে ছোটো মামার সঙ্গে চট্রগ্রাম কলেজে এসে ভর্তি কার্যক্রম সেরে যায়। এর ক’দিন পরেই ছোটো মামা বিদেশে পাড়ি জমায়। তার সাহসেই ও মায়ের কথাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে ইধা। নতুবা ওই বয়স্ক লোকের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে যেত।
ভাগ্যিস মা, মামা আর মাইশা ওর সঙ্গে ছিল। মাইশা ওর জীবনে আর্শীবাদ। ওর জন্যই এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত ও নিতে পেরেছে।
ও বাড়ি ছেড়ে আসার পর মা এর সঙ্গে একটা বারের জন্যেও কথা ইধা বলতে পারেনি৷ যদি বাড়ির কেউ জেনে যায় এই ভেবে! ছোটো মামা ওকে হাত খরচের টাকা পাঠাবে বলেছেন। তবে তিনি সবে নতুন দেশে গেছেন। ছোটোখাটো একটা চাকরি পেয়েছেন। সেই চাকরির টাকায় তাকে চলতে হবে। বিদেশে যাওয়ার জন্যে অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেসব শোধ করতে হবে। এসব সামলে ইধার দায়িত্ব নেওয়াটা তার জন্যও কঠিন ইধা জানে। তাই ও নিজেও টিউশনি শুরু করেছে। মামাকে ওত বেশি কষ্ট ও দিতে চায় না। যতটুক প্রয়োজন ততটুকুই নেবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ওর ফোন বেজে উঠে। ছোটো মামার ফোন দেখে মুখে হাসি ফুটে ওর। বাড়ির মানুষ বলতে তার সঙ্গেই যোগাযোগ আছে কেবল। মা এর খবরও তার কাছেই পায়। তাই মা এর কথা মনে পড়লেও মামাকেই ফোন দেয় ইধা। কবে যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মা কে নিজের সঙ্গে রাখতে পারবে ইধা!

টিউশনি শেষ করে বাড়ির দিকে আসছে মাইশা। পথিমধ্যে ওর দেখা হয় আলিমের সঙ্গে। আলিম বলল, কী খবর মাইশা? আজকাল দেখা যায় না এলাকায়?
-ক্লাস শুরু হয়েছে। নিজের পড়ার চাপ, স্টুডেন্ট পড়াচ্ছি। এই নিয়ে ব্যস্ত। এলাকায় ঘুরার সময় কই!
-তোমার বান্ধবী কেমন আছে? তাকেও দেখা যায় না!
-সেও আমার মতো ব্যস্ত।
-টিউশনি করায় নাকি?
-করায়।
-আলিশাকে পড়াবে? ওকে যে পড়ায় বড্ড অনিয়ম করে। ভাবছি শিক্ষক বদলাবো। তোমাকেই বলতাম। তবে তুমি বেশ কয়েকজনকে পড়াও জানি। ওকে একটু সময় বেশি দিতে হবে। তোমার ওত সময় কই!
-আচ্ছা আমি ইধাকে বলে দেখব। জানাব আপনাকে।

এই বলে মাইশা বাসার দিকে রওনা হয়৷ আলিম আপনমনে ভাবে, ইধা রাজি হলে যেকোনোভাবেই ওর বোনের বর্তমান শিক্ষককে হটাতে হবে। এই একটা দারুণ সুযোগ ইধার কাছাকাছি আসার!
.
চলবে