প্রাসাদকথন পর্ব-০১

0
484

#প্রাসাদকথন
সূচনা পর্ব
#সুলতানা_তানি

১. রাজপুত্রের বয়স পঁচিশ বছর। বিয়ের পাত্রী খোঁজা হচ্ছিলো পুরো রাজ্য জুড়ে। বহু সুন্দরী মেয়েও আছে সম্ভার রাজ্যে। কিন্তু রাজপুত্র বড়ই উদাসীন। নিজ রাজ্যে পাত্রী পছন্দ হয় নি তার। অবশেষে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিলো পার্শ্ববর্তী রাজ্যে। রাজপুত্র আজ সেখানেই যাচ্ছে এক রাজকন্যার মুখদর্শন করতে। রাজকীয় নৌযানে করে প্রশস্ত একটি নদ পাড়ি দিচ্ছে। নদের এক পাড়ে বাহার রাজ্য, অন্যপাড়ে সম্ভার রাজ্য। মাঝখানে প্রণয় নদ। এ নদ বড়ই উত্তাল। যখন-তখন ঝড় আসে নদে। একবার ঝড় এলে সহজে কি আর থামে! ঝড়ের ঝাপটার এক পাড়ের জল অন্য পাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে। শুধু একজন রাজপুত্র নয়, আজ সম্ভার রাজ্যের তিন রাজপুত্র যাচ্ছে বাহার রাজ্যে। পুত্রদের সঙ্গী হয়েছেন স্বয়ং রাজাও। পঁচিশ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তাসকিনের জন্যই পাত্রী দেখতে যাওয়া হচ্ছে। বাকি দুজন রাজপুত্র যমজ। তেইশ বছর বয়সী যমজ রাত্রপুত্রদ্বয়ের নাম রাকিন এবং শামস্। এই তিন রাজপুত্রের নানাবাড়ি হচ্ছে বাহার রাজ্যে। বাহার রাজ্যের রাজকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন সম্ভার রাজ্যের রাজা। যমজ রাজপুত্রদ্বয় রাকিন এবং শামসের জন্মের সময় মা’রা যান তিনি। আল্লাহর ইশারায় তখন বেঁচে গিয়েছিলো যমজ রাজপুত্রদ্বয়। তেইশ বছর বয়স যমজ দু’ভাইয়ের। স্বাভাবিকভাবেই ওদের মায়ের মৃ’ত্যুও হয়েছে তেইশ বছর আগেই। মা জীবিত ছিলেন না, তাই নানা বাড়ির সাথে গভীর কোনো সম্পর্কও তৈরি হয় নি রাজপুত্রদের। নানা বাড়ি বাহার রাজ্যে তেমন আসা-যাওয়াও ছিলো না। গত কয়েক বছরে শামস্ আর রাকিন কয়েকবার এসেছিলো বাহার রাজ্যে। সেটা ছিলো রাজকীয় প্রয়োজনে রাজার(মামা) সাথে সাক্ষাৎ করতে। বাহার রাজ্যের রাজকন্যাদের সাথে সাক্ষাৎ হয় নি কখনো। সে রাজ্যের রাজা সম্পর্কে আপন মামা ওদের। কিন্তু ওদের মা নিজেই তো যমজ পুত্রদ্বয় জন্মদানকালে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। মা জীবিত নেই, রাজকার্যে চরম ব্যস্ত মামার সাথে আর কতোদূর সম্পর্ক হবে! শৈশবে মামার রাজ্য থেকে ওদেরকে নিমন্ত্রণ পাঠানো হতো। অতিথি হিসেবে আগমনের অনুরোধ জানানো হতো। কিন্তু তখন অতিথি হিসেবে কখনো আগমন ঘটে নি রাজপুত্রদের। এ যৌবনে যমজ রাজপুত্রদ্বয় নানা বাড়ি বাহার রাজ্যে এসেছিলো বটে! তবে রাজকীয় প্রয়োজনে এসে রাজদরবার থেকেই ফিরে গিয়েছিলো ওরা। রাজকন্যারা তো আর রাজ দরবারে এসে বসে থাকে না! তাই ওদের কখনো সাক্ষাৎ হয় নি বাহার রাজ্যের রাজকন্যাদের(মামাতো বোনদের) সাথে। যমজ ভ্রাতৃদ্বয় রাজকীয় প্রযোজনে কয়েকবার বাহার রাজ্যে এলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে জ্যেষ্ঠ রাজপুত্রের বেলায়। শৈশবে মায়ের মৃ’ত্যুর পরে তাসকিনের একবারও আগমন ঘটে নি বাহার রাজ্যে। অথচ আজ ওর বিয়ের ব্যাপারেই যাওয়া হচ্ছে সেখানে। বাহার রাজ্যের রাজকন্যার সাথে বিয়ের কথোপকথন চলছে রাজপুত্র তাসকিনের। রাজকীয় পোশাকেই যাচ্ছেন রাজা এবং তিন রাজপুত্র। রাজ তরাবারিও এঁটে রাখা আছে পোশাকে। কয়েকজন রাজরক্ষীও সাথেই রয়েছে। নৌযান থেকে তীরে নেমে বাহার রাজ্যের রাজপ্রাসাদে যেতে হবে। তাই নৌযানে কয়েকটি রাজ’ঘোড়াও নিয়ে আসা হয়েছে। প্রণয় নদ পাড়ি দিয়ে ঘোড়ায় চড়েই বাহার রাজ্যের রাজপ্রাসাদে গমন করতে হবে। এ প্রণয় নদ খুব প্রশস্ত। এক তীরে দাঁড়িয়ে অন্য তীর দেখা যায় না। নদ আজ নিস্তরঙ্গ নয়। ছোট-বড় ঢেউ খেলা করছে নদে। এ নদ খুব গভীর। সাগরের সাথেও আছে সংযোগ। বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছে ভরপুর এ প্রণয় নদ। শুধু মাছ নয়, কুমিরও আছে এ সুগভীর প্রশস্ত নদে। আজ বিশাল রাজকীয় নৌযান ঢেউ কে’টে পাড়ি দিচ্ছে নদ। নৌ কর্মচারীরা তড়িঘড়ি করে ঐ তীরে নিয়ে যেতে চাচ্ছে নৌযানটিকে। হঠাৎ করেই ঝড় উঠে যেতে পারে প্রণয় নদে! বিশ্বাস তো নেই এ নদকে। ওসব ঝড়-ঝঞ্ঝা নিয়ে ভাবছে না যমজ রাজপুত্রদ্বয়। রাজপুত্র শামস্ তো আছে ভিন্ন টেনশনে। কৌতূহলী স্বরে পিতাকে জিজ্ঞেস করছে–“আব্বা,আমাদের ছোটবেলায় তো নানাবাড়ি থেকে অনেক নিমন্ত্রণ আসতো। আমাদেরকে অতিথি করে কেনো পাঠাতেন না বাহার রাজ্যে?”
“শৈশব থেকেই তো তোমরা মাতৃহারা। তোমরা আমাদের রাজপ্রাসাদের বাইরে থাকলে আমার দুশ্চিন্তা হতো তোমাদেরকে নিয়ে। তাই কখনো অতিথি করে পাঠাই নি।”–শান্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছেন রাজা।

“আপনি নিজেও তো বেড়াতে নিয়ে আসতে পারতেন আমাদেরকে!”–জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তাসকিন বলেছে পিতাকে।

“রাজকার্য নিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। সময় পাই নি তোমাদেরকে নিয়ে অবকাশ যাপনে যাবার জন্য। অনেক শত্রুও ছিলো তখন আমাদের। আমি রাজপ্রাসাদের বাইরে থাকলে আমাদের সম্ভার রাজ্যের যেকোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো!”

রাজার কথা শুনে চিন্তিত হয়েছে যমজ রাজপুত্রদ্বয়ের আরেকজন। বরফশুভ্র গায়ের রঙে নীলাভ বাদামী চোখ রাজপুত্রের। ভ্রমরকালো ঘন ভ্রুযুগল আর সূচালো নাক যেনো কোনো শিল্পী এঁকে দিয়েছে। ট্রিমড দাড়ি,অসিত রঙা শ্রেডেড চুল মুখাবয়বে দিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য্য। এমন সুদর্শন রাজপুত্র রাকিনের চেহারায় হঠাৎ নেমে এসেছে মেঘের ছায়া। মেঘমলিন বদনে রাকিন পিতাকে বলেছে–“আব্বা, আজ যে আমাদের রাজ্যের দায়িত্ব মন্ত্রী আর উদ্বেগের কাছে দিয়ে এসেছেন! আজ কোনো ঝামেলা হবে না তো?”

“না, এখন আর কোনো ঝামেলা হবে না। কিন্তু উদ্বেগ কে?”–কৌতূহলের সাথে পুত্রকে প্রশ্ন করেছে রাজা।

নিশ্চুপ হয়ে আছে শাহজাদা রাকিন মুনতাসির। জবাব দিয়েছে বড় ভাই তাসকিন–“আব্বা, রাকিন আর শামস্ আমাদের সেনাপতি উদয় বেগ’কে উদ্বেগ বলে ডাকে।”
রাজা যমজ পুত্রদ্বয়কে সর্তক করে বলছেন–“রাজ্যের সেনাপতিকে তোমরা দুজন এভাবে হেয় করে কথা বলতে পারো না শাহ্জাদা!”

রাকিন তাকিয়েছে যমজ ভাই শামসের বদনে। অবিকল একই রকম দেখতে রাকিন আর শামস্। শুধু উচ্চতায় রাকিন একটু বেশি। রাজ্যের সেনাপতিকে উদ্বেগ নামে ডাকায় রাজা হয়তো আরো তিরস্কার করতে চেয়েছিলেন। প্রসঙ্গ এড়াতে রাকিন তড়িঘড়ি করে বড় ভাই তাসকিনকে বলছে–“ভাই, আপনার বিয়ের কথাবার্তা তো আগেই শেষ হয়েছে। আজ বাহার রাজ্যের রাজকন্যা পছন্দ হলে শীঘ্রই বিয়ে হয়ে যাবে আপনার।”

“হুম।”–মৃদু হেসে তাসকিন জবাব দিয়েছে।

“আপনাকে কিন্তু এই প্রণয় নদ পাড়ি দিয়েই শ্বশুরালয় বাহার রাজ্যে যেতে হবে।”

“তো?”–কৌতূহলী ভঙ্গিতে তাসকিনের প্রশ্ন।

“জানেন তো এ প্রণয় নদে কুমির আছে। আপনাকে কিন্তু কুমিরের সাথে যুদ্ধ শিখতে হবে। যদি শ্বশুরালয়ে যাবার সময় কখনো কোনো নৌ দুর্ঘটনা হয়ে যায়!”

রাজা কিছুটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তীরের পানে চেয়েছিলেন। বাবার অমনোযোগিতার সুযোগে তাসকিন ফি’স’ফিসিয়ে জবাব দিয়েছে রাকিনকে–“আমার সাথে তোকেও বাহার রাজ্যে বিয়ে করিয়ে দেবো। শ্বশুরালয়ে যাবার সময় দু’ভাই একসাথেই যাবো। নৌ দুর্ঘটনা হলে আমার হয়ে তুই নিজেই কুমিরের সাথে যু’দ্ধ করিস!”

“হবে না। আমি মানবোই না। রাকিনের বিয়ের কথা বলছেন। আমার বিয়ের কথা কেনো বলছেন না ভাই?”–অভিমানী সুরে ফি’স’ফিসিয়ে শামস্ প্রশ্ন করেছে বড় ভাই তাসকিনকে।
” তোর বিয়ের কথা তো চিন্তাই করছি না।”

“চিন্তা না করলে আমি আজ যাবো না আপনার শ্বশুরালয়ে।”

“আমার শ্বশুরালয়ে না যাস, আমাদের বাবার শ্বশুরালয়ে চল।”–শাহ্জাদা তাসকিন ফি’স’ফিসিয়ে জবাব দিয়েছে শামসকে।

“আগে ওয়াদা দিন আমায় শীঘ্রই বিয়ে করাবেন!”(তাসকিনের কানে কানে বলছে শামস্)

ওদের কথোপকথনের মাঝে রাজা পুত্রদেরকে বলছেন–“দেখেছো, ঐ যে তীর দেখা যায়! আমরা বাহার রাজ্যের একদম নিকটে চলে এসেছি।”

“জ্বী আব্বা।”

“তোমাদের একজন নৌযানের রসুইঘরে যাও তো! গিয়ে দ্যাখো এ জলযানের কর্মীদের দুপুরে ভালো খাবারের ব্যবস্থা আছে কিনা!”(রাজা, আদেশের সুরে)

পিতার আদেশে শাহজাদা রাকিন রওয়ানা করেছিলো নৌযানের রসুইঘরে। শামস্ও এসেছে যমজ ভাইয়ের পিছু পিছু। রসুইঘরে কয়েকটি মুরগী ছিলো। প্রতিটিরই পায়ে দড়ি দিয়ে বাঁ’ধা। মধ্যাহ্নভোজের জন্য জ’বাই করে রন্ধন করা হবে। তাই প্রতিটির পায়ে দড়ি বেঁধে এভাবে নিয়ে এসেছে নৌকর্মীরা। বড় একটি মাছ কা’টার প্রস্তুতি চলছে। ভাত রান্না হচ্ছিলো মাটির উনুনে। কিছু সবজিও রয়েছে। কর্মচারীদের কাছ থেকে রাজপুত্রদ্বয় জেনেছে বড় মাছটি এ প্রণয় নদ থেকে ধরা হয়েছে। ওদের দুপুরের খাবারে ভাতের সাথে মুরগীর মাংস থাকবে। সবজি আর মাছ ভাজাও থাকবে। রাজপুত্রদ্বয় ফিরে এসেছে রসুইঘর থেকে। নৌযানের এক প্রান্তে এসে দুজন নৌ’কর্মচারীর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করেছে। নৌকর্মীরা জানিয়েছে কাছি প্রস্তুত করাই রয়েছে। রাজকীয় নৌযান তীরে ভীড়লে তীরের খুঁটির সাথে কাছি দিয়ে বেঁধে নিতে হবে নৌযানটিকে। নৌযানটি এখনো বাহার রাজ্যের তীর থেকে কিছুটা দূরে। যমজ রাজপুত্র রাকিন এবং শামস্ ফিরে এসেছে পিতার নিকটে। কর্মচারীদের খাবারের ব্যবস্থা আছে শুনে রাজা চিন্তামুক্ত। জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র ঘোড়াগুলোকে প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়ে এসেছে। রাজপুত্রত্রয় এখন নির্ভার। নৌযানটির অবস্থানও তীরের বেশ নিকটে। সম্ভার রাজ্যের রাজা উঠে দাঁড়িয়েছেন। রাজপুত্রদেরকে নিয়ে আগমন করেছেন নৌযানের সম্মুখ প্রান্তে। প্রণয় নদ এখন কিছুটা তরঙ্গসংকুল। ময়ূরীর মতো নেচে নেচে ঢেউ খেলা করছে নদে। রাজকীয় নৌযান এখনো তীর থেকে আনুমানিক শত হাতের মতো দূরে। ধীরে ধীরে গমন করছে বাহার রাজ্যের তীরের দিকে। ওদের দৃষ্টিও নি’ব’দ্ধ ছিলো তীরে। হঠাৎ এক নারী ঘোড়ায় চড়ে ছুটে এসেছে নদের তীরে। ঘোড়া থেকে অবতরণ করেছে নিমিষেই। কোনোদিকে মনোযোগ নেই মেয়েটির। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে মুহূর্তেই ঝাঁপ দিয়েছে নদে। স্রোতের টানে তীর থেকে বেশ দূরে চলে গেছে পরমা সুন্দরী এ মেয়েটি। নদ থেকে বদনখানি ভেসে উঠেছে পানির উপরে। এ বদন যেনো সম্ভার রাজের চিরপরিচিত। রাজা চিৎকার করে বলছেন–“আরেহ এ মেয়ে তো দেখতে একদম তোমাদের মায়ের মতো! এ মেয়ে নিশ্চয়ই তোমাদের মামাতো বোন, বাহার রাজ্যের রাজকুমারী এটা!”

“জ্বী আব্বা, রাজকন্যাই হবে। বেশ-ভূষা তো রাজকন্যাদের মতোই।”–শাহ্জাদা রাকিন সম্মোহনী সুরে পিতাকে জবাব দিয়েছে।

জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তাসকিন মেঘমলিন বদনে পিতাকে জিজ্ঞেস করেছে–“আব্বা, এ মেয়ে তো নদে ঝাঁপ দিয়েছে। নিশ্চয়ই আ’ত্ম’হ’ত্যা করতে চায়! আপনি কি এই রাজকন্যার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করেছেন? ”

জবাব দিতে পারেন নি সম্ভার রাজ। তার আগেই এসেছে আরেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার পূর্বাভাস। বিশালকার একটি কুমির বিরাট একটি গ্রাস তুলে প্রস্তুত হয়েছে রাজকন্যাকে ভ’ক্ষণে। এ কুমিরের মুখ থেকে কি করে বাঁচাবে ওরা রাজকন্যাকে! আ’ত্ম’হননশীন রাজকন্যাও যেনো এখন বাঁচতে চাচ্ছে! হয়তো কুমিরের গ্রাসে প্রাণত্যাগের ইচ্ছে নেই রাজকন্যার। কিন্তু কুমিরের গ্রাস থেকে ফিরে আসা কি এতোই সহজ!

চলবে