প্রাসাদকথন পর্ব-০২

0
303

#প্রাসাদকথন
#পর্বঃ২
#সুলতানা_তানি

কুমিরের গ্রাস থেকে রাজকন্যার ফিরে আসা কি এতোই সহজ!

কুমিরটি মুখে বিশাল হা’ করে এগোচ্ছে। এ যেনো এক হৃদয় বিদীর্ণকারী দৃশ্য। এমন নির্মম দৃশ্য দেখে ভীষণ মর্মাহত সম্ভার রাজপুত্রগণ। রাজপুত্র রাকিনের নিশানা খুবই নিখুঁত। শাহ্জাদা প্রথমেই নিজ পায়ের জুতো খুলে নি’ক্ষেপ করেছে কুমিরের উন্মুক্ত দন্তপাটিতে। নিমিষেই কুমিরের দন্তপাটিতে আটকে গেছে সে জুতোটি। লোভী কুমিরটি এবার ব্যস্ত হয়েছে দন্তপাটি থেকে জুতো ফেলে দিতে। এরই মাঝে রাজকন্যাও খানিক এগিয়ে এসেছে। কুমিরটি এখন কয়েক হাত দূরে তার নিকট থেকে। রাজকন্যা প্রাণপণে সাঁতার কাটছে বাঁচার জন্য। নিরন্তর চেষ্টায় এগিয়ে আসতে চাচ্ছে নৌযানের দিকে। জুতো ছুঁ’ড়ে রাকিন দৌড়াচ্ছিলো নৌযানের পাটাতন ধরে। শামস্ পেছন থেকে উৎকণ্ঠিত সুরে বলছে–“আমরা তরবারি ছু’ড়ে মা’রতে পারি কুমিরকে লক্ষ্য করে। তাহলে মেয়েটিকে বাঁ’চানো যেতে পারে।”

শাহ্জাদা রাকিন নৌযানের রসুইঘরে প্রবেশ করতে করতে জবাব দিয়েছে–“কুমির হ’ত্যার জন্য প্রথমেই রাজ তরবারি ব্যবহারের দরকার নেই।”

“তাহলে কি করতে চাস?” — পেছন পেছন দৌড়ে এসেই শামস্ প্রশ্ন করেছে রাকিনকে।
“রাজকন্যাকেও বাঁচাবো, কুমিরটিকেও রক্ষা করবো।”—কথাটা বলেই রসুইঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে রাকিন। দড়ি বাঁ’ধা জীবিত মুরগিগুলো হাতে নিয়ে এসেছে। কুমিরকে লক্ষ্য করে জীবন্ত মুরগিগুলো ছুঁড়ে মে’রেছে নদে। মুরগীগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছিলো নদের পানিতে। লোভী কুমির ক্ষণিকেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। ভাসমান মুরগীগুলোকে দেখে দিশেহারার মতো ভ’ক্ষণে মগ্ন হয়েছে বোকা প্রাণীটি। কুমির তো আর বাঘ নয় যে লক্ষ্য ঠিক রাখবে! রাকিন কিন্তু অলসভাবে কালক্ষেপণ করে নি। রাজকীয় নৌযানটিকে তীরে বাঁ’ধার জন্য কাছি ছিলো নৌযানে। মেয়েটিকে লক্ষ্য করে সে কাছির এক প্রান্ত নি’ক্ষেপ করেছে নদে। মেয়েটি শক্ত হাতে কাছি ধরে নিয়েছে ক্ষণিকেই। কাছির অন্য প্রান্ত রাকিন বেঁ’ধে নিয়েছিলো নৌযানে। খানিক বাদেই মেয়েটি কাছি ধরে উঠে এসেছে। কুমির এখনো ব্যস্ত রয়েছে শেষ মুরগীটি ভ’ক্ষণে। মেয়েটি নৌযানে উঠে আসায় সম্ভার রাজ এগিয়ে এসেছেন সবার আগে। নিজ শরীর থেকে রাজকীয় চাদরখানি খুলে মেয়েটির হাতে দিতে দিতে রাজা বলছেন–“আমাদের নৌযানে মেয়েলি কোনো পোশাক নেই। তুমি তো একদম ভিজে গেছো। ধরো তো, আমার চাদরখানা জড়িয়ে রাখো।”

এতোগুলো পুরুষলোকের সম্মুখে সিক্ত পোশাকে থাকায় রাজকন্যাও লজ্জিত ছিলো। সহজেই চাদরখানা জড়িয়ে নিয়েছে সিক্ত শরীরে। জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তাসকিন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেছে–“কে আপনি? বাহার রাজ্যের শাহজাদী নাকি?”

“জ্বী।”–অবনত নয়নে জবাব দিয়েছে মেয়েটি। সম্ভার রাজ্যের রাজা অমায়িক কণ্ঠে শুধিয়েছেন– “নাম কি তোমার শাহজাদী?”

“শাহজাদী নেহেরিন নানজিবা।”

“তুমি রাজা মুনাওয়ারের জ্যেষ্ঠ রাজকন্যা?” (কৌতূহলী কণ্ঠে)

“জ্বী। কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন যে আমি জ্যেষ্ঠ রাজকন্যা? আর আমার বাবাকে নাম ধরে কেনো ডাকছেন আপনি?”

“আমি সম্ভার রাজ্যের রাজা তারিক মুনতাসির, সম্পর্কে তোমার ফুফা।”

“ওহ্, আমি ভীষণ দুঃখিত। আপনাকে আমি চিনতেই পারিনি। কিন্তু আপনি হয়তো আমায় একদম ছোটবেলায় দেখেছেন। কিভাবে চেহারা মনে রেখেছেন এতো বছর পরেও?”(কৌতূহলের সাথে প্রশ্ন করেছে নেহরিন)
সম্ভার রাজা ধীর কণ্ঠে বলছেন–“নাহ্, তোমার চেহারা আমি মনে রাখি নি। তুমি দেখতে একদম তোমার ফুফুর মতো হয়েছো। আমার মহারানীর মতো দেখাচ্ছিলো বলেই বুঝতে পেরেছি যে তুমি ওর ভাতিজি,বাহার রাজ্যের রাজকন্যা। আর নাম! তোমার নামটাও একদম ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েক বছর আগে তোমার বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিলো আমাদের রাজ্যে। তখন নামটা আবার স্মৃতিতে এসেছিলো।”

“ওহ্।”

“আচ্ছা শাহ্জাদী,তুমি আজ আ’ত্মহ’ত্যা করতে চেয়েছিলে কেনো?”(গম্ভীর কণ্ঠে)

“আপনি হয়তো জানেন আমার স্বামী মা’রা গিয়েছে। আমার আব্বা চাচ্ছেন আমায় আবার বিয়ে দিতে। আমি আমার বাপের রাজ্যে রাজকন্যা হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম। তবুও শীঘ্রই আর বিয়ে করতে চাই নি। কিন্তু আব্বা আমার কথা কিছুতেই শুনছে না। বিভিন্ন পাত্র দেখছেন আমায় আবার বিয়ে দেবার জন্য। তাই আ’ত্ম’হত্যা করতে চেয়েছিলাম।”

“আপনি আপনার ইচ্ছেমতোই জীবনযাপন করবেন।”–রাকিন আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিয়েছে শাহ্জাদী নেহেরিনকে। সম্ভার রাজও নিশ্চুপ থাকে নি। নেহেরিনকে আশ্বাসের সুরে বলেছেন–“তোমার বাবা যেনো তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারে সেই ব্যবস্থা করবো। ”

“ধন্যবাদ মহারাজ।” (নেহেরিন)

“তোমার মেজো বোনের সাথে আমার পুত্র তাসকিনের শাদী প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। তুমি জানতে না যে আজ আমরা অতিথি হয়ে আসবো তোমাদের রাজ্যে?”

সম্ভার রাজের প্রশ্নে ইষৎ অপরাধবোধ এলো নেহেরিনের মলিন বদনে। মেয়েটি অনুতাপের সুরে জবাব দিয়েছে –“জানতাম তো, সবই জানতাম! তবে আমি বহুদিন ধরেই আ’ত্ম’হ’ত্যার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমায় পাহারা দিয়ে রাখা হতো। রাজপ্রাসাদ থেকে পালাবার চেষ্টাও করেছিলাম। সেটাও পারিনি। আজ আপনারা আতথি হয়ে আসবেন বলে ভীষণ ব্যস্ততা ছিলো প্রাসাদে। আমার উপরে নজরদারিও কম ছিলো। আজ সুযোগ পেয়েছি বলে আজই প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়েছি।”

সম্ভার রাজ্যের রাজা শান্তস্বরে বলছেন–“শোনো মেয়ে, তোমার বাবাকে আমি বোঝাবো। তুমি আর কখনো আ’ত্ম’হ’ত্যার চেষ্টা করবে না।”

“জ্বী, মহারাজ।”

একজন একজন করে তিন রাজপুত্রের সাথে নেহেরিনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রাজা। ওদের কথোপকথনের মাঝেই নৌযান তীরে বাঁ’ধা হয়েছে। বাহার রাজ্যের বৈচিত্র্যময় তীর এটা। ঘোড়া নামিয়েও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে তীরে। সবাই নৌযান থেকে নেমে গেছে সন্তর্পণে। ধীরে ধীরে ওরা আরোহণ করেছে ঘোড়ায়। রাজকন্যা নেহেরিনও নিজ ঘোড়ায় আরোহন করেছে। তিন রাজপুত্র একসাথে নানার রাজ্যে আগমন করতে পেরে ভীষণ খুশি। আবারও মধুর সম্পর্কের নতুন বাঁধন তৈরি হতে যাচ্ছে মায়ের বংশের সাথে। পুরনো তানপুরাটায় হয়তো নতুন সুর বাজবে। এ সুরে বেসামাল হবে দু’রাজ্য। মাঝখানে বয়ে চলা প্রণয় নদ নবপ্রণয়ের স্রোতে হয়তো উত্তালও করতে পারে। প্রণয় নদের প্রণয় উত্তাল হবার ক্ষণ এখনো আসে নি। এখন তো ওদের ঘোড়া ছুটছে বাহার বাজ্যের রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। রাজবাড়ি প্রস্তুত ছিলো সম্ভার রাজ্যের অতিথিদের বরণ করার জন্য। ত্রিতল রাজপ্রাসাদ সেখানে। নিচে অতিথিশালা,রাজ দরবার হল,রসুইঘর,দরবার নৃত্যের ঘর এবং রাজকীয় পাঠাগার। দায়িত্বরত দাস,দাসীদের জন্য কয়েকটি কক্ষও আছে নিচ তলায়। দোতলায় রাজা,রানী এবং রাজ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কক্ষ। আর তিনতলায় রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ্জাদা নওশাদ থাকেন। পরিবারের ঘনিষ্ঠ অতিথিদের জন্যও কিছু কক্ষ রয়েছে সেখানে। তিন তলায় আরো রয়েছে একটি দরবার নৃত্যের কক্ষ। সেখানে রাজ নর্তকীরা শাহ্জাদা নওশাদের মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্য পরিবেশন করেন। রাজপ্রাসাদের পাশেই রয়েছে ফুলের বাগান। রয়েছে একটি রাজকীয় উদ্যান। পেছনেও একটি উদ্যান আছে। উদ্যানের পশ্চাতেই ফলের বাগান। তারপরে বেশ কয়েকটি পুকুর। পুকুরের অন্য পাড়ে রাজপ্রাসাদের দাস,দাসীদের ঘর। ওদেরও ঘর লাগোয়া বাগান এবং পুকুর রয়েছে। পুকুর থেকে খানিক দূরে বিশাল সীমানা প্রাচীর। রাজবাড়ির সীমানা প্রাচীর এটি। রাজবাড়ির রাজতোরণ দক্ষিণমুখী। এই মুহূর্তে সে তোরণে এসে গেছে সম্ভার রাজ্য থেকে আসা অতিথিগণ। নেহেরিনকে অতিথিদের সাথে আগমন করতে দেখে হতবাক হয়েছে সবাই। যদিও হতবাক হয়ে কালক্ষেপণ করে নি তারা। অতিথিদের অভিবাদন করতে ব্যস্ত হয়েছে নিমিষেই। সবাইকে প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে। সম্ভার রাজ আসন গ্রহণ করেছেন বাহার রাজের অনুরোধে। সামান্য কথোপকথন শেষেই বাহার রাজকে কন্যা নেহেরিনের ঘটনা অবগত করেছেন সম্ভার রাজ। কন্যাকে নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করেছেন বাহার রাজ। থেমে গিয়েছেন খানিক বাদেই। বহুবছর পরে ভগ্নীপতিকে পেয়েছেন তিনি। রাজকন্যার কথা ভেবে আজকের খুশি নষ্ট করতে চান না। আজ আয়োজনের কোনো ঘাটতি নেই রাজপ্রাসাদে। মধ্যাহ্ন এখন। তাই শুধু মিষ্টি মুখ করেছে অতিথিরা। একটু পরেই তো মধ্যাহ্নভোজ। তখন না হয় ভুরি ভোজ করবে। বাহার রাজ্যের দ্বিতীয় রাজকন্যার নাম নাবিহা নানজিবা। এই রাজকন্যা নাবিহার সাথেই বিয়ের কথোপকথন চলছে সম্ভার রাজ্যের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তাসকিনের। রাজকন্যা নাবিহা দেখতে ভীষণ সুন্দরী। কাজলকালো মায়াবী চোখ আর তীরের মতো সূচালো নাক রাজকন্যার। বাঁকা ঠোঁট জুড়ে থাকে মুক্তোঝরা হাসি। নিদারুণ সে হাসি, তাকে ভুলতে চাইলেও যেনো ভোলা যায় না। আজ এ রাজকন্যা শুভ্ররঙা সিল্কের পোশাক জড়িয়েছে গায়ে। তার উপরে রয়েছে রাজকীয় ডিজাইনে তৈরিকৃত মসলিনের পোশাক। মাথায় পরেছে শুভ্ররঙের পাথরখচিত রাজমুকুট। রানী ধীর কদমে অতিথিদের সম্মুখে নিয়ে এসেছেন রাজকন্যা নাবিহাকে। রাজকন্যাকে দেখে তাসকিনের নয়নে যেনো নেশা লেগে গেছে। সে নেশা ছুঁয়েছে তার বেখেয়ালি হৃদয়কেও। বেখেয়ালি মনের হেয়ালি ভাবনার ঘোরে নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়িয়েছে তাসকিন। রাজকন্যার দর্শন পেয়ে কোথায় যে হারিয়েছে নিজেকে সে হুশই যেনো নেই। ভীষণ মুগ্ধতা তার প্রেম প্রেম দৃষ্টিতে। মনে হয় যেনো আজন্ম এ রাজকন্যারই অপেক্ষায় ছিলো তাসকিন। নাবিহাকে বসানোর পরে তাসকিনকেও বসার নির্দেশ দিয়েছেন সম্ভার রাজ। এই তো খানিকক্ষণ ধরে স্বপ্নরাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলো সে। এবার যে ঘোর কে’টেছে শাহ্জাদার। কিছু আলাপন হয়েছে সবার মাঝে। সম্ভার রাজের বেশ পছন্দ হয়েছে নাবিহাকে। পুত্রবধূ করতে আর কোনো বাধা নেই। দু’রাজ্য থেকে আগেই নেয়া হয়েছে যাবতীয় খোঁজ-খবর। দু’পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতেও আপত্তি নেই। এখন পাত্র,পাত্রী কথোপকথন সেরে নিলেই হয়। পার্শ্ববর্তী কক্ষে ওদেরকে কথোপকথনের আদেশ দেয়া হয়েছে। অতিথিশালার পর্দা সরিয়ে পার্শ্ববর্তী কক্ষে এসেছে ওরা। সেখানে থাকে নি নাবিহা। সে কক্ষ থেকে বারান্দায় আসার ইশারা দিয়েছে তাসকিনকে। আরো একটি পর্দা সরিয়ে ওরা দুজন চলে এসেছে রারান্দায়। রাজপুত্রের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। বদনে হাসির রেখা। রাজকন্যা নাবিহা নিশ্চুপ হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনো। শাহ্জাদা তাসকিন প্রশ্ন করেছে নাবিহাকে–” শাহজাদীর বয়স তো আঠারো! তাই না?”
“জ্বী।”

আবার ক্ষণিকের নীরবতা। যেনো সলজ্জ দুজনই। শাহ্জাদী নাবিহা আড়চোখে একবার তাকিয়েছে রাজপুত্রের বদনে। কতোক্ষণ থাকবে নীরব হয়ে! নিজেই কথা বলছে এবার– “আমার জন্মের পরে আপনি কখনো আসেন নি আমাদের রাজবাড়িতে। আজ কেমন লাগছে আমাদের রাজবাড়িটা?”

শাহ্জাদা তাসকিন জবাব দিয়েছে শীতল কণ্ঠে–“রাজবাড়িটা কেমন লাগছে সেটা এখনই জানাতে পারছি না। পুরো রাজবাড়ি এখনো দর্শন করা হয় নি তো! তবে রাজকন্যার দর্শন পেয়ে হৃদয়,মন দুটোই জুড়িয়ে গেছে।”

রাজপুত্রের জবাব যেনো হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে নাবিহার। রাজপুত্র কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করেছে–“আমায় পছন্দ হয়েছে শাহ্জাদীর?”

লাজনম্র বদনে চেয়ে সম্মতিসূচক হাসি দিয়েছে নাবিহা। এ জবাবে সন্তুষ্ট নয় শাহ্জাদা তাসকিন। গম্ভীর স্বরে বলেছে–“শুধু হাসিতে নয়, সহাস্য জবাব শুনতে চাই আমি আপনার মুখ থেকে। বলুন, আমায় কি পছন্দ হয়েছে আপনার?”

“হু-হয়েছে।” (মৃদু হেসে)

“ধরুন, আমি রাজা হলাম না। আমৃ’ত্যু রাজপুত্র হয়েই থাকলাম! রাজা না হলেও কি ভালো লাগবে আমায়?”

“যদি ভরা জোছনায় একসাথে জোছনাবিলাস করা যায়, যদি বিনিদ্র রজনীতে হাতে হাত রেখে গল্প করা যায়, যদি নিরঙ্কুশ ভালোবাসা পাওয়া যায় তবে এ জীবনে আমার রাজার প্রয়োজন নেই।”

“আপনার বিনিদ্র রজনীতে আমি স্বপ্নসারথি হবো। সুখ পাখি হয়ে হাতে হাত রেখে আপনায় ভালোবাসার গল্প শোনাবো। ভরা জোছনায় একসাথে জোছনাবিলাস করবো। আপনি আমৃ’ত্যু থাকতে পারবেন আমার হয়ে?”

“পারবো।”–আবেগঘন কণ্ঠে নাবিহা।

“তো শাদী হচ্ছে আমাদের?”–তাসকিন প্রশ্ন করেছে আগ্রহের সাথে।

“ইনশাআল্লাহ্।”

“চলুন, তাহলে ফিরে যাই আমাদের অভিভাবকদের কাছে।”
“হুম, যাবো। তবে আমায় তুমি করে বললে খুশি হবো।”
“ধন্যবাদ শাহ্জাদী!”

নিজ রাজবাড়ি বলে শাহ্জাদী নাবিহা অগ্রগামী হয়েছে। শাহ্জাদা তাসকিন ছিলো পশ্চাতে। নাবিহা পশ্চাতে থাকা তাসকিনের বদনে চেয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো সম্মুখে। পর্দার কাছে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। পশ্চাতে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে মেয়েটি পর্দায় পেঁচিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। শাহ্জাদা তাসকিন এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে। কোনোমতে রক্ষা করেছে হবু বউকে। কিন্তু এবার বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। শাহ্জাদা তাসকিন এলোমেলোভাবে দৌড়ে এসেছিলো তো! কিভাবে যেনো তার রাজ তরবারিটি খোলস থেকে বেরিয়ে গেছে। তরবারিটির হাতলের অংশ রয়েছে পর্দা বরাবর। আর ধা’রালো অংশ রয়েছে নাবিহার কোমর বরাবর। তরবারিটি উঠাতে চেয়েছিলো দুজনই। কিন্তু একসাথে চেষ্টা করতে গিয়ে উল্টো ঝামেলা তৈরি হয়েছে। তরবারিটি হেলে পড়ে বি’দ্ধ করতে যাচ্ছিলো নাবিহার পা। রাজপুত্র নিমিষেই কোলে তুলে নিয়েছে রাজকন্যাকে। তরবারিটিও তৎক্ষণাৎ পড়ে গেছে মেঝেতে। রাজপুত্র কর্তৃক এভাবে কোলে নেয়ার ঘটনায় ভীষণ লাজ এসেছে নাবিহার বদনে। তাসকিন তাকিয়েছে সে লাজমাখা বদনে। মৃদু হেসে বাহুডোর থেকে ছেড়ে দিয়েছে মেয়েটিকে। ওভাবে কোলে নেয়ার কারণে নরম সুরে তাসকিন বলেছে–“কোলে নেয়ার মতো অনধিকার চর্চার জন্য আমি দুঃখিত।”

“আপনি আরও আমায় বিপদমুক্ত করেছেন। আমারই তো দুঃখপ্রকাশ করার কথা।”

“একজন প্রকাশ করলেই হয়। চলে এসো এখন!”–বলেই তরবারি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো রাজপুত্র। পেছন থেকে ডেকেছে নাবিহা–“শুনুন!”

“জ্বী,বলো।”

রাজকন্যা নাবিহা মৃদু হেসে বলছে–“আচ্ছা, তরবারি ছুটে গেলো কেনো আজ? আপনার সাথে যুদ্ধ হবে নাকি আমার?”
রাজপুত্র হেসেছে। শানিত কণ্ঠে জবাব দিয়েছে–“যুদ্ধ হলে এভাবেই তোমায় বাহুডোরে বেঁ’ধে নেবো। যু’দ্ধেরা তরবারির মতোই তখন দূরে ছিটকে যাবে।”

নাবিহা আবারও মুগ্ধ হয়েছে তাসকিনের জবাব শুনে। শাহজাদা তাসকিন ফিরে এসেছে অতিথিশালায়। নাবিহারও আগমন ঘটেছে। দুজনের অভিব্যক্তি দেখেই অভিভাবকরা আন্দাজ করতে পেরেছে ওদের মনের কথা। তবুও দুজনকেই আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। বিয়েতে সম্মতি আছে দুজনেরই। আংটিবদল শুরু হবে এখনই।

অতিথিশালায় প্রোগ্রাম চললেও সেখানে গমন করে নি বাহার রাজ্যের জ্যেষ্ঠা এবং কনিষ্ঠা রাজকন্যা। তিন রাজকন্যার মধ্যে কনিষ্ঠা রাজকন্যা সবচেয়ে সুন্দরী। মেজো বোনকে আজ পাত্র দেখানো হচ্ছে। পুরুষ অতিথি এসেছে অন্য রাজ্য থেকে। সম্পর্কে ওরা ফুফা,ফুফাতো ভাই হলেও ওদের সম্মুখে যায় নি রাজকন্যা। ষোড়শী এ কনিষ্ঠা রাজকন্যার নাম নওরা নানজিবা। নিজ কক্ষে বসেছিলো নওরা। বড়বোন শাহ্জাদী নেহরিন এসেছে নওরার কক্ষে। ধীর পায়ে এসে বসেছে বিছানার পাশে। নওরা প্রশ্ন করেছে নেহেরিনকে–“কিছু বলতে চান বড় আপু?”

“হুম।”

“কি?”

“জানিস, সম্ভার রাজ্যের যে রাজপুত্র আজ আমায় কুমিরের হাত থেকে বাঁচিয়েছে ওর নাম রাকিন। আমাকেও বাঁচালো,কুমিরটাকেও মা’রলে না। রাজপুত্র রাকিন যেমন বুদ্ধিমান তেমনি ভীষণ সুদর্শন। মনে হয় কোনো শিল্পী এঁকে দিয়েছে ওর বদনখানি।”

“তাই নাকি!”–বিষণ্ণ বদনে বলেছে নওরা।

” হুম। তুই লুকিয়ে একটু দেখে আসবি নাকি? যমজ দুজনের বয়সও কম। শুনেছি আমার মতোই তেইশ বছর বয়স ওদের।”

নওরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছে–“এমন অল্পবয়সী সুদর্শন রাজপুত্র দেখে আমার কোনো লাভ আছে আপু!”

“ওরা তো সম্পর্কে আমাদের ফুফাতো ভাইও হয়। লুকিয়ে গিয়ে চেহারা দেখে আসতে পারিস। ওরা আবার কখন না কখন চলে যায়! এরমধ্যে আব্বা আর আম্মি তোকে ওদের সামনে যাবার অনুমতি দেবে না।”

“তুমি ঠিকই বলেছো। আমি কি তাহলে এখনই দেখেতে যাবো?”

“যা।”

” কিন্তু চিনবো কিভাবে যে কোনটার নাম কি?”

“যে দুজন দেখতে একইরকম ওরা যমজ। একইরকম চেহারা হলেও রাকিন একটু লম্বা আর চেহারা বেশি আকর্ষণীয়।”

“ওহ্।”

“শোন, রাকিন সোনালী রঙের শেরওয়ানি পরিহিত। আর শামস্ লাল রঙের শেরওয়ানি পরে এসেছে। বাদামী রঙের শেরওয়ানি যে পরেছে ঐটাই হচ্ছে নাবিহার হবু বর তাসকিন।”
“‘ ওহ্ আচ্ছা। আমি যাচ্ছি তাহলে!”
(নোটঃ গল্পের নায়ক রাকিন। অনেকেই কমেন্ট করেছেন নায়ক কে সেটা বুঝতে পারছেন না।)

অতিথিশালায় আংটিবদল হয়ে গেছে তাসকিন আর নাবিহার। কথোপকথন চলছিলো বিয়ের তারিখ নিয়ে। রানী এবং রাজকন্যা নাবিহাও সেখানেই ছিলো। কনিষ্ঠা রাজকন্যা নওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে অতিথিশালার নিকটে। রাজা,রানী দেখলে তিরস্কার করতে পারে রাজকন্যাকে। তাই নিঃশব্দে এসেছে মেয়েটি। খুব সন্তর্পনে কাছে এসে অতিথিশালার পর্দা সরিয়েছে নওরা। শুধু আঁখিযুগল বের করে উঁকি দিয়েছে অতিথিদের পানে। মন ভরে একটু অতিথি দর্শনও করতে পারে নি মেয়েটি। তার আগেই ঘটে গেছে দুর্ঘটনা। নওরার মায়াবী দৃষ্টি তীরের মতো বি’দ্ধ করেছে এক রাজকুমারের বক্ষকে। এ তীর হৃদয় বিদীর্ণকারী তীর নয়, এ তীর মহব্বতের তীর।রাজকন্যার এ গোপন আগমন দৃষ্টিগোচর হয় নি অন্য কারো। তবে দৃষ্টি এড়ায় নি সে রাজপুত্রের। লুকায়িত মুখশ্রীতে নওরার মায়াবী নয়নের চোরা চাহনি ঘায়েল করেছে তাকে। এভাবে এক রাজপুত্রের সাথে আচানক দৃষ্টি বিনিময় হতেই চুপিসারে প্রস্থান করেছে নওরা। কিন্তু তার সে চুপিচুপি দৃষ্টি চুপিসারেই প্রণয়দোলা দিয়েছে রাজপুত্রের খেয়ালি মনে। সর্বনাশের শুরুও হয়েছে এখান থেকেই।

চলবে