#প্রাসাদকথন
পর্বঃ৫
#সুলতানা_তানি
বাহার রাজ্যের রাজপ্রাসাদ থেকে ফিরে যাচ্ছে আরশান। রাজকন্যাদের নিয়ে আরশান এসেছিলো এ প্রাসাদে। আজ বাহার’রাজ মুনাওয়ারের সাথে পরিচয় হয়েছে ছেলেটির। সাধারণ কুশল বিনিময় শেষে রাজার উদ্দেশ্যে আরশান বলেছিলো– “মহারাজ, যদি আপনি অনুমতি দিন তবে একটি বার্তা দিতে পারি!”
“বলো, কিসের বার্তা?”
“আপনার কনিষ্ঠা কন্যা নওরা আমাদের শাহ্জাদা রাকিন মুনতাসিরের সাথে নাজায়েজ সম্পর্কে জড়িয়েছে।”
“তুমি মিথ্যে বলছো শাহ্জাদা!”–ধ’মকের সুরে বলেছেন রাজা মুনাওয়ার।
“আমায় মার্জনা করবেন মহারাজ। জানেন, আজ আপনার কন্যার সাথে শাহ্জাদা রাকিন এসেছে। কিন্তু এ প্রাসাদে প্রবেশ করে নি।”
“কেনো? প্রাসাদে প্রবেশ করে নি কেনো রাকিন?”(কৌতূহলী সুরে)
“আপনার কন্যার সাথে নাজায়েজ সম্পর্ক শেষে প্রণয় নদে গোসল করেছিলো রাকিন। সিক্ত দেহে থাকায় প্রাসাদে আগমন করে নি।”
“আমার মেয়ের সাথে নাজায়েজ সম্পর্ক! এতো বড় স্পর্ধা রাকিনের! ওকে আমি হ’ত্যা করবো!”
“মহারাজ, তাসকিন ভাইকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে শাহ্জাদা রাকিন। ও আসলে একজন বেঈমান!”
“আমি অন্যায়ের উপযুক্ত বিচার করবো।”
হাতের তালু একটু ঘষে অনুরোধের সুরে আরশান বলেছিলো– “মহারাজ, যদি অনুমতি পাই তবে আরও একটি বার্তা দিতে পারি।”
রাজা মুনাওয়ার গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলো–“বলো।”
“শাহজাদা তাসকিনও জঘন্য চরিত্রের পুরুষ। রাজকীয় দায়িত্ব নেই তো ওনার! সূরা পান আর নারী নিয়েই মেতে থাকে রাতদিন।”
“যদি তোমার কথা সত্য হয় তবে ওদের সাথে কোনো সম্পর্কেই আমি আর জড়াতে চাই না।”(রাজা)
“মহারাজ, আমি এখন প্রস্থান করতে পারি?’
“হুম।”
…………….
কথোপকথন শেষে মহা খুশিতে যাত্রা করেছিলো আরশান। যেকোনোভাবে সৎ ভাইদের ক্ষতি করতে চায় ছেলেটি। কু’চক্রী আরশান এখন ফিরে এসেছে প্রণয় নদের তীরে। রাজতরী আবারও যাত্রা শুরু করেছে। রাকিন তো আগেই ফিরে এসেছিলো সিক্ত দেহে। শাহ্জাদা বিভোর ছিলো নতুন স্বপ্নে,নতুন কল্পনায়। ভীষণ ঈর্ষান্বিত হয়ে আছে ওর সৎ ভাই। কুচক্রী আরশান ভাবছে–“রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারও রাকিন, আবার সুন্দরী রাজকন্যাও পাবে রাকিন! কোনোভাবেই ওকে সফল হতে দেয়া যাবে না।”
ধীরে ধীরে চলছে রাজতরী। প্রণয় নদ পাড়ি দিচ্ছে আঁধার কে’টে। সম্পর্কে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে আরশান বেশ নির্ভার আছে। ভীষণ খুশি সে। এদিকে উত্তাল প্রণয় নদের চেয়েও উত্তাল রাকিনের হৃদয়। নবপ্রণয়ের নব স্রোত কোথা থেকে কোথায় ভাসিয়ে নিচ্ছে তার হৃদয়কে!
……………….
সম্ভার রাজ্যের রাজপুরী নিস্তব্ধ। মধ্যরাত এখন। পুরো রাজপুরী হয়তো এখন ঘুমন্তপুরী। তবে ঘুমন্ত নয় মাহিরা। সম্ভার রাজ্যের সেনাপতি উদয় বেগের কন্যা হচ্ছে মাহিরা। সম্পর্কে ফুফাতো বোন রাকিনদের। আজ বিকেলে অতিথি হয়ে এসেছে সম্ভার রাজ্যের রাজপ্রাসাদে। নিচতলার অতিথিশালায় শয়ন করেছিলো মেয়েটি। কিন্তু ঘুম আসে নি চোখে। অনেকক্ষণ ধরে কক্ষ বন্ধ রাখায় কেমন যেনো বদ্ধ লাগছে কক্ষটি। মেয়েটি উঠে এসেছে শয্যা ছেড়ে। বাতায়ন এবং কক্ষের দ্বার খুলে দিয়েছে। সে ভাবছে একটু বাতাস চলাচল করলে হয়তো বদ্ধ ভাবখানা চলে যাবে। অতিথিশালায় একটি পাঠাগার রয়েছে। সেখান থেকে থেকে একটি বই নিয়ে এসেছে মাহিরা। বাতায়ন হয়ে শীতল বায়ুর প্রবেশ ঘটছে কক্ষে। শীতের কারণে সিল্কের ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বই নিয়ে বসেছে মেয়েটি। কিছুক্ষণ বই পড়ে সময় কা’টাতে চায়। কক্ষটি স্বাভাবিক হলে দ্বার আর বাতায়ন বন্ধ করে দেবে। নানাবাড়ি এলে এই কক্ষেই থাকে মাহিরা। এখন বই নিয়ে পাঠে মগ্ন হচ্ছিলো মেয়েটি। হঠাৎ বাতাসে ওড়না উড়ে গেছে প্রদীপের নিকটে। ক্ষনিকেই আগুন লেগে গেছে সিল্কের ওড়নায়। অতিথিশালার পাঠাগার থেকে একটি বই নিতে শাহ্জাদা শামস্ এসেছে নিচে। মধ্যরাতে মাহিরার কক্ষদ্বার উন্মুক্ত দেখে উঁকি দিয়েছিলো শাহ্জাদা। তাকিয়ে দেখে ফুফাতো বোন মাহিরা অগ্নিদগ্ধ ওড়না শরীর থেকে খুলছে। জামাতেও আগুন লেগে গেছে মেয়েটির। এমন অবস্থা দেখে শামস্ দৌড়ে এসেছে এ কক্ষে। মাহিরাকে এক টানে মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছে শামস্। চিৎকার করে বলছে–” তুই এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি কর তো! আগুন নিভে যাবে।”
মাহিরা গড়াগড়ি করতেই আগুন নিভে গেছে। সামান্যই অগ্নিদগ্ধ হয়ছে মেয়েটি। ছোট একটি ফোস্কা তৈরি হয়েছে বাহুতে। শামস্ চিৎকার করে প্রশ্ন করেছে–“তোর ওড়নায় আগুন লাগলো কিভাবে মাহিরা?”
“খোলা জানালা থেকে বাতাস এসেছিলো। বাতাসে ওড়না উড়ে গিয়ে আগুনে লেগেছে।”
” শীতকালে কেউ জানালা খোলা রাখে?”
“এ রুমটি কিছুটা বদ্ধ লেগেছিলো। তাই জানালা খুলে দিয়েছিলাম।”
“ওহ্, আচ্ছা। এখন তাহলে পোশাক পাল্টে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাক!”–বলেই প্রস্থান করছিলো শামস্।
মাহিরা পেছন থেকে প্রশ্ন করেছে–“আপনি আমায় পছন্দ করেন শাহ্জাদা?”
“বোকা নাকি! কি সব বলছিস?”–ধ’মকের সুরে।
“তাহলে মধ্যরাতে আমার ঘরে উঁকি দিয়েছিলেন কেন?”
“তোর দরজা খোলা দেখে আমি হুশিয়ার করতে এসেছিলাম।”
“কেনো, আমার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয় নাকি?”
” মারবো একটা! মধ্যরাতে আপনজনের ঘরের দরজা এমন খোলা থাকলে সবাই হুশিয়ার করে।”
“তাহলে ধরে নিলাম আমি আপনার আপনজন। ”
“ধুর! আমি কি ওভাবে কিছু বলতে চেয়েছি নাকি?”
“তাহলে কিভাবে বলতে চেয়েছেন শাহ্জাদা? মহব্বতের সাথে?”
“তুই একটা বেয়াদব! সারাবছরই তো আমার পিছু লেগে থাকিস! এবার ভালো হয়ে যা তো!”– মাহিরাকে ছোট খাটো ধ’মক দিয়ে প্রস্থান করছিলো শামস্। পেছন থেকে জোর গলায় মাহিরা বলেছে–” আপনার মহব্বত পেলে সত্যিই ভালো হয়ে যাবো শাহ্জাদা।”
“তুই আর কোনোদিন বেড়াতে আসবি না আমাদের এই প্রাসাদে।”–মুচকি হেসে বলেছে শামস্।
“ঠিক আছে, আর বেড়াতে আসবো না। এখন থেকে পুরোপুরি এখানেই থেকে যাবো।”
রাজ্যের অনেক মেয়েরই স্বপ্ন রাজকুমারদেরকে পাবার। সেনাপতির মেয়ে মাহিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। রাজকুমার শামসকে ভীষণ পছন্দ করে মেয়েটি।
…………..
মহব্বতের আবেশে দিশেহারা রাকিন। মন বারবার চাচ্ছে মহব্বতের বার্তা দিতে। বাহার রাজ্যের রাজকুমারী নিদ কেড়ে নিয়েছে তার। শ্বেত-হরিদ্রা বর্ণের গায়ের রঙ শাহজাদী নওরার। মাথায় দীঘল কালো রেশমি চুল। হরিণী আখিঁযুগলে
মায়া আছে, আছে বিষণ্নতার ছায়া। যদিও এ বিষণ্নতা কেড়ে নিয়েছে রাজকুমারীর ভুবনভুলানো হাসি। এখন আর হাস্যোজ্জ্বল নয় সে। তবুও যদি একবার হাসে তবে সে হাসি কাছে টানতে পারে কত শত পুরুষকে! এমন সুন্দরী,স্বপ্নময়ীর সাথে হৃদয়জ লেনা-দেনা চলছে রাকিনের। ভালোবাসার বার্তা না দিয়ে কি থাকা যায়! আজ প্রথমবার ভালোবাসার বার্তা পাঠিয়েছে রাকিন। পোষা পায়রা বাহার রাজ্যে এসেছে তার মহব্বতের বার্তা নিয়ে।
…………………
মধ্যাহ্ন এখন। চারদিক রৌদ্রকরোজ্জ্বল। রোদের দাপটে শীতের প্রকোপও তেমন নেই। তাই বাহার রাজ্যের রাজপ্রাসাদের বাতায়নগুলো উন্মুক্তই আছে। মধ্যাহ্নভোজ শেষে নওরা একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলো। মখমলের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে রাজকন্যা। এরই মাঝে একটি পায়রা এসেছে প্রাসাদে। উঁকি দিচ্ছিলো প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষের বাতায়নে। অবশেষে দেখা মিলেছে রাজকুমারী নওরার। বাতায়নে একটি চিরকুট রেখে অপেক্ষমান রয়েছে পায়রা। রাজকন্যা নওরা সন্দিহান হয়েছে এ পায়রা দেখে। উঠে গেছে শয্যা ছেড়ে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাতে নিয়েছে চিরকুট। কেনো যেনো হৃদয়টা কাঁপছে এখন। ধীরে ধীরে খুলেছে সে চিরকুট।
প্রেয়সী নওরা,
কেনো এতোকাল মোলাকাত হলো না আমাদের? হঠাৎ কেনো হলো এ অনাকাঙ্ক্ষিত মোলাকাত? যেনো চাঁদ হয়ে এসেছো তুমি আমার হৃদয় অম্বরে। এ চাঁদের টানে বাঁধভাঙা প্রণয় স্রোত এসেছে আমার জীবন সায়রে। এ স্রোতে নিশিদিন বদলে যাচ্ছি আমি। স্বপ্নে,কল্পনায়,অনুভবে শুধু যেনো তোমাকেই খুঁজে পাই। তোমারও কি এমনই হয়? যদি হৃদয়ের সুর এমনই হয় তবে বুঝে নিও মহব্বত এসেছে জীবনে। একবার ওয়াদা দাও আমার হবে! সব নিগড় মুক্ত করে আমি নিয়ে আসবো তোমায়। এ মৃদু প্রণয় স্রোতে নয়, মহব্বতের এক সায়র স্রোতে ভাসতে চাই তোমায় নিয়ে।
ইতি,
তোমার আশিক
রাকিন
চিরকুটের জবাব দেয় নি নওরা। পায়রাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ইশারায়। তবে আজ ভীষণ খুশি রাজকন্যা। রাকিনের মতো এমন কাউকেই তো চেয়েছে সে এতোদিন।
…………….
রবি আসে প্রতিদিন, আসে রবিকিরণ। নিশি আসে, আসে চন্দ্রকিরণ। দিবানিশি পেরিয়ে যায় আপন ধারায়। সময়ও গড়িয়ে যায় দিবানিশির সাথে। সময়ের এই পরিক্রমায় পেরিয়ে গেছে কয়েকদিন। এরই মাঝে সম্ভার রাজ্য থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছিলো বাহার রাজ্যে। বিয়ে উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জিনিসও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আজ বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। সম্ভার রাজ তারিক মুনতাসির রাজকীয় নৌবহরে বরযাত্রী নিয়ে যাত্রা করেছেন। সম্ভার রাজ তো বিয়ের সবকিছু ঠিক করে রেখে গিয়েছিলেন আগেই। বাহার রাজ মুনাওয়ার ক্ষি’প্ত হয়ে আছেন। আরশান বিষ ঢেলে রেখে গেছে সম্পর্কে। রাজা কি রাজকন্যা নাবিহার শাদী হতে দেবেন তাসকিনের সাথে! নাকি সম্ভার রাজ পরিবারকে অপমান করে ফিরিয়ে দেবেন আজ!
চলবে