#প্রাসাদকথন
পর্বঃ৬
#সুলতানা_তানি
মধ্য দুপুর। প্রণয় নদের তীরে থেমেছে সম্ভার রাজ্যের নৌবহর। শত শত বরযাত্রী। বাহার রাজ্যের তীর এটি। বরযাত্রীকে গ্রহণ করার জন্য কিছু ঘোড়ার গাড়ি প্রস্তুত ছিলো তীরে। সম্ভার’রাজ তারিক এবং রাজপুত্ররা ব্যক্তিগত ঘোড়া নিয়ে এসেছেন রাজতরীতে। ঘোড়া প্রস্তুত করা হয়েছে তীরে। ঘোড়ায় আরোহণ করেছেন তারা। শাহ্জাদা তাসকিন রয়েছে পালকিতে। বেহারারা পালকিতে করে নিয়ে যাবে জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তাসকিনকে। ওদের সৎ ভাই আরশানের ষ’ড়যন্ত্র কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি বিয়ের সিদ্ধান্তে। বাহার রাজ মুনাওয়ার তার ফুফুর সাথে আলাপ করেছিলেন। নওরা আর রাকিনের ব্যাপারেই হয়েছিলো আলাপ। রাজকন্যাদের সাথে তো বৃদ্ধা গিয়েছিলেন সম্ভার রাজ্যে। তিনি জানিয়েছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মুনাওয়ারকে–“সম্ভার রাজ্য থেকে ফেরার পথে সেদিন প্রণয় নদ ভীষণ উত্তাল ছিলো। রাজতরীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নওরার পাশ দিয়ে রাকিন হেঁটে যাচ্ছিলো। তখন হঠাৎ রাজতরী দুলে ওঠে। অসাবধানতাবশত রাকিন
পড়ে যায় নদে। তাই তো ভিজে গিয়েছিলো ছেলেটি। নওরার সাথে সম্পর্কের কথা মিথ্যে। আমি নিজেই তো ওদের সাথে গিয়েছিলাম।”
” ওহ্, ধন্যবাদ ফুফু।”
“শোনো মুনাওয়ার, রাকিনদের সৎ ভাইটা বেশ খা’রাপ। ডা’ই’নীর ঘরের ছেলে ও! ভালো হওয়ার তো কথা নয়। হয়তো কোনো ষ’ড়যন্ত্রে মেতেছে ছেলেটি। তাছাড়া আমার মনে হয় ও নিজেই নওরাকে পছন্দ করে। সেদিন বারবার আমাদের কক্ষের সামনে থেকে আসা-যাওয়া করেছিলো আরশান।”
“বুঝেছি ফুফু।”
সেদিন নওরা মিথ্যে বলেছিলো দাদীকে। রাকিনকে নদে ফেলে দেয়ার ঘটনা দাদীকে জানায় নি মেয়েটি। দাদী নাতনীর কথা বিশ্বাস করেছে। সেটাই জানিয়েছে বাহার রাজ মুনাওয়ারকে। রাজাও বিশ্বাস করেছেন ফুফুর কথা। মিথ্যে বলায় উল্টো আরশানের উপর ভীষণ ক্ষি’প্ত হয়েছেন তিনি। বাহার রাজ মুনাওয়ার আলাপ করেছিলো ভ্রাতুষ্পুত্র নওশাদের সাথে। নওশাদও জেনেছে নওরাকে পছন্দ করে আরশান। আজ আরশান আসবে বলে বেচারা বিশাল সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
………………
দুপুর একটা। রোদের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। শীতের আমেজ নেই প্রকৃতিতে। বরযাত্রী এসে পৌঁছেছে বাহার রাজ্যের রাজপ্রাসাদে। রাজবাড়ির মাঠ সাজিয়ে সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের। বরযাত্রীকে বরণ করা হচ্ছে। নওশাদ বরণ করার দায়িত্বে রয়েছে। রাজপুত্র তাসকিন পালকি থেকে নেমেছে। এ বরকে বরণ করা হচ্ছে সানন্দে। পাত্রী নাবিহা রয়েছে পর্দার আড়ালে। সব নারীরাই পর্দার আড়ালে। শাহ্জাদা রাকিন উদগ্রীব নওরাকে দেখার বাসনায়। কিভাবে দেখা করবে সে নওরার সাথে! এদিক-সেদিক তাকিয়ে খুঁজছে শাহ্জাদা। কি করে খুঁজে পাবে! নারীরা তো রয়েছে পর্দার আড়ালেই। মনের মানসীর খোঁজে শাহ্জাদা এসেছে প্রাসাদে। অনুসন্ধানী দৃষ্টি তার। কোথাও নেই নওরা। নিচ তলায় তো আর থাকে না শাহ্জাদী! কি করে সাক্ষাৎ করবে রাকিন! ঐদিকে তাসকিন আর নাবিহার বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে যাবে। তাই রাকিন ফিরে যাচ্ছে অনুষ্ঠানে। বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বিশাল পর্দার সম্মুখে তাসকিনসহ অন্যান্যরা রয়েছে। আর আড়ালে রয়েছে নাবিহাসহ নারীরা। পর্দার আড়াল থেকেই কবুল পড়েছে নাবিহা। বিয়ের পরে শুরু হয়েছে ভোজন পর্ব। রাজভোজ বলে কথা! ধুমধাম খুব। সবাই মগ্ন হয়েছে আহারে। নওশাদ আজ সকালে খুব ব’কেছে নওরাকে। আদেশ করেছে অনুষ্ঠানে না যাবার জন্য।নওশাদের মনে ভয়। বেচারা জেনেছে আরশান পছন্দ করে তার বাগদত্তাকে।নওরা যদি আবার আরশানের প্রেমে পড়ে যায়! এমন ভাবনায় শাহ্জাদীকে প্রাসাদে থাকার আদেশ করেছে নওশাদ। প্রাসাদে থাকলেও নওরা বারবার আসা-যাওযা করছে সিঁড়ির নিকটে। কেনো যেনো মনে হয় শাহ্জাদা রাকিন আসবে প্রাসাদে। তার সাথে সাক্ষাৎ না করে রাকিন যেতেই পারে না। বড়বোন নেহেরিনও আজ নাবিহার সাথে কক্ষেই রয়েছে। ভোজন পর্ব শেষে রানী মাঠ থেকে প্রাসাদে এসেছে। দুই রাজকন্যা তো প্রাসাদেই আছে। এদের দুজনেরও তো খোঁজ নিতে হয়। রাকিন আবারও এসেছিলো প্রাসাদের সম্মুখে। যদি বাতায়ন থেকে একবার দর্শন পাওয়া যায় নওরার। রানীকে প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেখে রাকিন পিছু নিয়েছে। শুরু থেকেই রাকিনের সাথে ভীষণ সদ্ব্যবহার করছেন রানী। রাকিনের ইচ্ছে রানীর সাথে কথা বলার বাহানায় যদি উপর তলায় গমন করা যায়! তাহলে সাক্ষাৎ করে আসবে সে নওরার সাথে। কিন্তু রানীর সাথে আলাপ করতে হয় নি। সিঁড়িতে উঠতেই দেখা হয়ে গেলো শাহ্জাদীর সাথে। রানী দেখেছে রাকিন এসেছে। নওরার হাস্যোজ্জ্বন বদনও দৃষ্টি এড়ায় নি তার। সবকিছু দেখেও রানী চলে গেছে সিঁড়ির সম্মুখের কক্ষে। সে কক্ষটি জ্যেষ্ঠ রাজকন্যা নেহেরিনের। রাকিন এসে দাঁড়িয়েছে শাহ্জাদী নওরার সম্মুখে। লাজরাঙা হাস্যোজ্জ্বল বদন শাহ্জাদীর। কৌতূহলী রাকিন প্রশ্ন করেছে–” এই, আমার চিঠির জবাব দাও নি কেনো?”
“কোনো জবাব ছিলো না আমার কাছে।”
“তোমার মনের গোপন কিন্তু আমি জেনে গেছি। এবার শুধু ওয়াদা দিলেই হবে!”
অনুতাপের সুরে জবাব দিয়েছে নওরা–“আমি এই প্রাসাদের রাজশিকলে বন্দী। কি করে ওয়াদা দেই আপনাকে!”
রাকিন রাশভারি কণ্ঠে বলছে–“একবার ওয়াদা দাও! সকল শিকল থেকে তোমায় মুক্ত করে নিয়ে যাবো আমি। আমার প্রাণে প্রাণপাখি করে রাখবো তোমায়!”
“যদি মহব্বতের ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা না রাখতে পারি!”–ই’তস্তত করে জবাব দিয়েছে শাহ্জাদী।
“তুমি শুধু ওয়াদা দাও। সে ওয়াদা পূরণের দায়িত্ব আমিই পালন করবো।”
নওরা মৃদু হেসেছে। ইদানিং আর বিষণ্ণতায় ভোগে না মেয়েটি। বরাবরই এক স্বপ্ন ছিলো শাহ্জাদীর। ছিলো এক কল্পনাও। হয়তো এক রাজকুমার আসবে। তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে এ প্রাসাদ থেকে। এ রাকিনই হয়তো সে স্বপ্নের রাজকুমার। আজ রাকিনের কথা শুনে ভীষণ পুলকিত শাহজাদীর হৃদয়। সে অভিব্যক্তি প্রকাশিত হচ্ছে চোখেমুখে। হয়তো আজ কিছু শোনাতেও চেয়েছিলো রাকিনকে। হঠাৎ নওশাদ এসেছে সিঁড়ির মুখে। বেচারা জানে না রাকিনের সাথেই নওরার মনের লেনা-দেনা চলছে। সে তো জানে আরশান তার বাগদত্তার দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। রাকিনকে দেখে সন্দিহান না হলেও নওরার উপরে ক্ষি’প্ত সে। শাহ্জাদীকে ধ’মকিয়ে বলছে–“নওরা, তুই এখানে কি করছিস?”
নওরার হয়ে জবাব দিয়েছে রাকিন–“আমার সাথে কথা বলছে নওশাদ ভাই।”
রাকিনকে জবাব দেয় নি নওশাদ। উল্টো আবারও ধ’মকাচ্ছে নওরাকে–“পরপুরুষের সাথে তোর কথা বলা উচিত নয়!”
পুনরায় রাকিনই জবাব দিয়েছে–“আপনিও কিন্তু পরপুরুষই নওশাদ ভাই।”
“শাহ্জাদা রাকিন, আমি ঠিক পরপুরুষ নই। কারণ নওরা আমার বাগদত্তা।”–আরশান ক্ষুব্ধস্বরে বলছে রাকিনকে।
“নওরা আপনার বাগদত্তা কিন্তু স্ত্রী নয়।”
নওশাদ হয়তো বলতে চেয়েছিলো আরো কিছু। কিন্তু সিঁড়ির সম্মুখের কক্ষ থেকে নওরার মা বেরিয়ে এসেছে। রানী এসেই ধ’মক দিয়েছে নওশাদকে–“তুমি কিন্তু আমার মেয়ের স্বাধীনতা কে’ড়ে নিচ্ছো নওশাদ!”
“আপনার মেয়েকে তো আপনিই ন’ষ্ট করছেন চাচী। পরপুরুষের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছেন!”
“একজনের সাথে কথা বললেই মেয়ে ন’ষ্ট হয়ে যায় না! আর পুরপুরুষের ব্যাপার! তুমি নিজেও তো এখনো পরপুরুষ! আগে নিজে ঠিক হও। তারপরে আমার মেয়ের ব্যাপারে খ’ব’রদারি করতে এসো!”(রানী)
নওশাদ প্রত্যুত্তর করেছে রানীকে–“আপনি কিন্তু ভীনদেশী রাজপুত্রের সামনে আমায় অপমান করেছেন!”
রাকিনের যেনো ধৈর্য্যের বা’ধ ভেঙেছে আজ। প্রতিবাদ করেছে সে নওশাদকে–“আমি হয়তো ভীনদেশী। তবে এটা আমার নানাবাড়ি। আর অপমান! আপনার মান-সম্মান থাকলে আপনি এমন ব্যবহার করতে পারতেন না! ”
রানীও ভীষণ রাগান্বিত স্বরে জবাব দিয়েছে নওশাদকে–“আমার মেয়ে ভীনরাজ্যের রাজপুত্রের সাথে সাধারণ কথা-বার্তাই বলে যাচ্ছিলো। তুমিই প্রথমে নওরাকে অপমান করতে এসেছো। আমার মেয়ের সাথে তুমি খবরদারি করেই যাচ্ছো। তোমার সাথে ভদ্র ব্যবহার আমি কিভাবে করবো নওশাদ?”
রানী আর রাকিনের সাথে বাকযু’দ্ধে হেরে গেছে নওশাদ। প্রস্থানও করেছে তৎক্ষণাৎ। রানীর কথা শুনে বেচারা ভেবেছে আসলেই সাধারণ আলাপচারিতা ছিলো। তাছাড়া রাকিনকে নিয়ে সন্দিহানও নয় নওশাদ। ঘুণাক্ষরেও বেচারা আন্দাজ করতে পারে নি যে তার শিকল থেকে বের করারই আলাপ চলছে। নওশাদ প্রস্থান করার পরে রাকিনের মনোযোগ আকর্ষণ করে রানী বলেছে–“শোনো শাহ্জাদা রাকিন, কোনো লক্ষ্যে এগোলে সাবধানী হতে হয়!
“জ্বী,মামী।”
“শুনে রেখো, আমার মেয়ের খুশিই আমার খুশি।”
“আমি আপনার সহযোগিতা কামনা করছি মামী।”
রানী কোনো জবাব না দিয়েই প্রস্থান করেছে। একজন দাসী ছিলো খানিক দূরে। রানী ডেকে নিয়ে গেছে দাসীকেও। মনে হয় যেনো প্রেম করার সুযোগ করে দিয়েছে রাজকন্যাকে। রাকিনও বেশ মুগ্ধ রানীর আচরণে। আবারও আলাপ শুরু করেছে রাকিন–“শাহ্জাদী, কেনো ওয়াদা দিচ্ছো না আমায়? তোমার মহব্বত সাথে থাকলে আমি সব অমানিশায় আলো জ্বালাতে পারবো, সবকিছু জয় করতে পারবো।”
“সত্যিই পারবেন?”
“পারবো। তোমায় পেলে আমি বিশ্ব জয় করতে পারবো।”
“বিশ্বজয়ের সুখ চাই না আমি। আমার এই প্রাসাদবন্দী জীবনে সুখ এনে দিতে পারবেন আপনি?”
“একবার হাতে হাত রেখে দেখো, পৃথিবীর সব সুখ এনে দেবো।”
কোনো জবাব দেয়া হয় নি শাহ্জাদীর। রানী ডেকেছেন মেয়েকে। একজন দাসী এগিয়ে এসে ডাকছে তাকে। ইশারায় দাসীকে ফিরিয়ে দিয়েছে নওরা। নিজেও প্রস্থানরত হয়েছে স্মিত হেসে। শাহ্জাদা রাকিনের হাত ছিলো পকেটে। ভীষণ সুন্দর একটি প্যাঁচানো রুমাল বের করেছে সে পকেটের কোটর থেকে। নওরার হাতে রুমালটি দিয়ে বলেছে–“তোমার জন্য খুব সামান্য একটি উপহার।”
শাহ্জাদী হাস্যোজ্জ্বল বদনে গ্রহণ করেছে উপহার। বিদায় লগ্নে রাকিন জানিয়েছে–“আবার মোলাকাত হবে আমাদের, হয় আজ নাহয় অন্য কোনো শুভদিনে।”
ওড়নায় রুমালখানি ঢেকে শাহ্জাদী ফিরে এসেছে বড়বোন নেহেরিনের কক্ষে। রানী স্মরণ করেছিলো কন্যাকে। রানীর ইশারায় দাসীরা কক্ষ ত্যাগ করেছে। জ্যেষ্ঠ রাজকন্যা নেহেরিন কক্ষেই ছিলো। ছোটবোনকে জিজ্ঞেস করেছে–“ওড়নায় কি লুকিয়ে রেখেছিস নওরা?”
ওড়নার নিচ থেকে হাত বের করে হাসিমুখে জবাব দিয়েছে নওরা–“আপু, খুব সামান্য একটি উপহার দিয়েছে শাহ্জাদা রাকিন।”
বড়বোনের দিকে রুমালখানি এগিয়ে দিয়েছে নওরা। হৃদয়জ সম্পর্ক দু’বোনের মাঝে। শাহ্জাদী নেহেরিন রুমাল খুলতেই একটি চিরকুট বেরিয়ে এসেছে। নওরা চিরকুটটি সরিয়ে নিয়েছে নিজ হাতে। চিরকুটের নিচেই ছিলো চেইনে আটকানো একটি লকেট। মহামূল্যবান কোহিনূরে তৈরি লকেট। নেহেরিন রানীকে দেখিয়ে বলেছে–“আম্মি, দ্যাখেন তো এ লকেটটি ভীষণ সুন্দর!”
রানী এগিয়ে এসেছে রাজকন্যাদের কাছে। লকেটসহ চেইন হাতে নিয়েছেন তিনি। হঠাৎ যেনো মেঘমলিন হলো রানীর বদনখানি। নেহেরিন প্রশ্ন করেছে রানীকে–“কি হয়েছে আস্মি? আপনি মন খা’রাপ করেছেন যে!”
ভারী হয়েছে রানীর আওয়াজ–“তোদের ফুফুর কথা মনে পড়েছে রে। এই চেইনটি হয়তো নতুন। কিন্তু লকেটটি তোর ফুফুর। তারিক ভাই পারস্য থেকে এ লকেট এনে তোর ফুফুকে উপহার দিয়েছিলো। বউকে ভীষণ ভালোবাসতো তারিক ভাই। যমজ রাজপুত্র জন্মদানকালে অকালে মা’রা গেলো তোর ফুফু!”
নওরাকে ডেকে এনেছিলেন রানী। ননদের স্মৃতিচারণ করে আওয়াজ ভারী হয়ে গেছে তার। আর আলাপ করেন নি মেয়ের সাথে। নেহেরিন নওরার গলায় থাকা নেকলেস খুলে নিয়েছে। শাহ্জাদা রাকিন প্রদত্ত লকেটসহ চেইনটি পরিয়ে দিয়েছে সন্তর্পণে। নওরার যে তর সইছে না। চিরকুটের কথা যে জানতেই হবে! কালবিলম্ব না করে চিরকুট নিয়ে প্রস্থান করেছে সে কক্ষ। খুশিরা দোল খাচ্ছে রাজকুমারীর হৃদয়ে। চিরকুট খুলেছে ক্ষণিকেই–
মেহবুবা নওরা,
আমির আমি পরিচয়ে, ফকির আমি মহব্বতে। এ হৃদয়ে আমার মহব্বতের প্রদীপ কভু জ্বলে নি। সেথায় রয়েছে শুধু সীমাহীন অমানিশা। দীপশিখা হয়ে এসো তুমি, ঘুচে দিও এ হৃদয়ের সকল অমানিশা, মিটিয়ে দিও মহব্বতের সকল পিপাসা! আমি অপার হয়ে আছি তোমারই প্রতীক্ষায়। কোনো এক শুভক্ষণে ভালবাসি বলে দিও গোপনে। এ জীবনসফর আমি পাড়ি দিতে চাই তোমারই মেহবুব হয়ে।
ইতি,
তোমার মেহবুব
রাকিন
…………….
রাজভোজ শেষ হয়েছে। ভোজন শেষে রাজা তারিকের সাথে আলাপে ব্যস্ত রাজা মুনাওয়াব। সম্ভার রাজ তারিককে মুনাওয়ার বলছেন–“আপনার পরিবার নিয়ে আমার বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে তারিক ভাই!”
“কি রকম?”
“আপনার দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র আরশান ভীষণ কু’চক্রী। আপনার প্রথম পক্ষের পুত্রদের একজন বড় শত্রু হচ্ছে আরশান।”
“দ্যাখো মুনাওয়ার, আমার দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র আরশান তোমার ভাগ্নে নয়। তাই হয়তো ওকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না। তবে আমার পুত্র আরশান মোটেও ওর ভাইদের শত্রু নয়।”
“বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার। তবে আরশান আপনার পুত্রের শাদী ভেঙে দিতে চেয়েছিলো। ওর মাকে বিশ্বাস করেও আপনি কিন্তু সব হারাতে
বসেছিলেন! এবার দ্যাখেন ওকে বিশ্বাস করে সব হারাতে পারেন কিনা!”
“তুমি তোমার রাজ্যের চিন্তা নিয়ে থাকো তো মুনাওয়ার!”
“ঠিক আছে।”
………………
বিকেলের প্রথম প্রহর। ক্লান্ত রবি তেজ হারিয়েছে। রবিকিরণও মৃদু। রাজবাড়ির বিয়ের আয়োজন সমাপ্তির পথে। রাজকন্যা নাবিহাকে বিদায় দেয়ার লগ্ন এসেছে। পালকি এখন বাহার রাজ্যের রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায়। বোনকে বিদায় দেয়ার জন্য নওরা নেমে এসেছে প্রাসাদের আঙ্গিনায়। আজ তাকেও শ্বশুরালয়ে অতিথি করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো নাবিহা। কিন্তু নওশাদ যেতে দিতে রাজি হয় নি। নওশাদের ভয় হচ্ছে যদি আরশানের সাথে নাবিহার প্রেম হয়ে যায়! সেই ভাবনা থেকেই নওরাকে অতিথি করে পাঠাতে রাজি হয় নি সম্ভার রাজ্যে। নওরা এখন বোনের পালকির নিকটে। পালকির কাছেই ছিলেন রাজা এবং শাহ্জাদারা। নিচের দিকে কিছুটা ঝুঁকে নাবিহার সাথে আলাপরত নওরা। ওড়নার উপর দিয়ে গলা থেকে ঝুলে পড়েছে রাকিন প্রদত্ত লকেটটি। রাকিন দূর থেকে দর্শন করেছে এ দৃশ্য। রাজকুমারীর কণ্ঠে ঝুলছে তারই উপহার। আজ বেচারা দিশেহারা। যেনো সব পেয়ে গেছে সে। আজই শুরু হোক তার মহব্বতের আলাপ! কিন্তু এতোই কি সহজ! কত শত মানুষ এখানে! কি করে আলাপ করবে সে শাহ্জাদীর সাথে! বোনের সাথে আলাপ শেষ শাহ্জাদীর। উঠে দাঁড়িয়েছে সে। কণ্ঠে ঝোলানো লকেটখানি তো ওড়নার উপরেই ছিলো। লকেটে দৃষ্টি পড়েছে সম্ভার’রাজ তারিক মুনতাসিরের। এ লকেট তিনি তার মহারানীকে উপহার দিয়েছিলেন। লকেট কি করে এলো বাহার রাজ্যের রাজকন্যার কাছে! রাজার বোধগম্য হয়েছে তার কোনো এক পুত্রই উপহার দিয়েছে এ লকেট। রাজা তারিক দৃষ্টি নি’ব’দ্ধ করেছেন উপস্থিত পুত্রদের বদনে। রাজপুত্রগণ তো আর জানে না রাজার মনের কথা। শাহ্জাদা রাকিন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো নওরার বদনে। সে দৃষ্টিতে ছিলো প্রেম,ছিলো নব প্রণয়ের খুশি। রাজা উপলব্ধি করতে পেরেছেন এ লকেট রাকিনই দিয়েছে। পুত্রের মনের গোপন কথাও রাজা জেনে গেছেন।
……………..
শেষ বিকেল। রবি ফিরে গেছে। রবিকিরণ নেই প্রকৃতিতে। নববধূ নিয়ে রাজকীয় নৌবহর যাত্রা করেছে। নৌবহর মাত্রই ছেড়েছে বাহার রাজ্যের তীর। প্রণয় নদ বড় উত্তাল। অপরাহ্নে নদ একটু উত্তালই থাকে। হঠাৎ একটি কুমির দেখা গেলো নদে। রাজতরীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো কুমিরটি। রাজকীয় নৌযানে আজ কিছু সৈন্যও এসেছে। নিরাপত্তার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে সৈন্যদের। শাহ্জাদা আরশান কুমির দেখে ভীষণ উৎফুল্ল। একজন সৈন্যের হাত থেকে তীর নিয়ে ছুঁড়েছে কুমিরের গায়ে। কুমিরটির পিঠে বি’দ্ধ হয়েছে তীর। পিঠ থেকে কুমির নিজে তো আর তীর খুলতে সক্ষম নয়! বারবার ঘুরছে রাজতরীর পাশে। হয়তো খুব যন্ত্রণা হচ্ছিলো শরীরে। কুমিরের গায়ে তীর দেখে রাজা ডেকেছেন সবাইকে। চার শাহ্জাদাসহ অন্য সবাই ছুটে এসেছে। আরশান বিনা কারণে তীর ছুঁ’ড়েছে বলে ভীষণ ক্ষি’প্ত রাজা তারিক মুনতাসির। রাকিনও তিরস্কার করেছে আরশানকে। কুমিরটি হয়তো ম’রণ যন্ত্রণায় কাতর। একবার পানির তলায় যাচ্ছে আবার ছটফট করে উপরে ভেসে উঠেছে। রাকিন ঝাঁপ দিয়েছে প্রণয় নদে। তীর খুলে বাঁচাতে চায় কুমিরটিকে।
চলবে