#প্রাসাদকথন
পর্বঃ৮
#সুলতানা_তানি
পেছন থেকে নওরাকে ডেকে আরশান বলেছে–“সম্ভার রাজ্যের রাজা রাকিন নয়, আমিই হবো। আর তোমাকেই চাই আমার রানী হিসেবে।”
নওরা ফুলবাগান থেকে সোজা এসে প্রবেশ করেছে নাবিহার কক্ষে। বোন,ভগ্নীপতি কক্ষেই ছিলো। শাহ্জাদী ক্ষুব্ধস্বরে তাসকিনকে শুধিয়েছে–“আমার ফুফুর মৃ’ত্যুর পরে আপনার বাবা যেনো কিভাবে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলো? আরশানের জন্মটা যেনো কিভাবে হয়েছিলো?”
“কেন, কি হয়েছে নওরা?”
“আমার প্রশ্নের জবাব দিন তাসকিন ভাই।”–ভীষণ রাগান্বিত স্বরে।
তাসকিন আন্দাজ করতে পেরেছে আরশানের কোনো আচরণে ক্ষুব্ধ নওরা। শাহ্জাদা ভাবছে সব বলে দেয়া উচিত নওরাকে। শুকনো ঢোক গিলে শাহ্জাদা বলছে–“শোনো তাহলে, আমার আম্মির গর্ভে যখন রাকিন আর শামস্ ছিলো তখন প্রাসাদে এক সুন্দরী নর্তকী আসে। গর্ভাবস্থায় আম্মি কখনো দরবার নৃত্য উপভোগ করতেন না। আম্মি ভাবতেন নাচ,গান উপভোগ করলে তার গর্ভের সন্তান ধার্মিক হবে না। আব্বা কিন্তু মাঝে মাঝে নৃত্য উপভোগ করতেন। ঐ নর্তকী দরবার নৃত্যের সময় আব্বার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতো। আব্বা কখনো ওসবে মাথা ঘামায় নি। দরবার নৃত্য বন্ধও করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা ছিলো আমাদের রাজমন্ত্রীকে নিয়ে। আমার ছোট চাচা রাজকীয় দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তাই আব্বা মন্ত্রী বানিয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। আব্বার মন্ত্রী বন্ধু মাঝে মাঝেই আমাদের প্রাসাদে রাত্রিযাপন করতো। আমার দাদীকে মা ডাকতো। মন্ত্রী দরবার নৃত্য ভীষণ পছন্দ করতো। মন্ত্রী বন্ধুর অনুরোধে আব্বা দরবার নৃত্য চালু রেখেছিলেন। ঐ মন্ত্রী যখনই নৃত্য উপভোগ করতেন তখন আব্বাকেও জোর করে সঙ্গী করতেন। আর সেই নর্তকীও আব্বাকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করতে থাকে। আম্মির গর্ভে দুই সন্তান থাকায় আম্মি শেষের দিকে বেশি চলাফেরা করতে পারতেন না। এদিকে আমার দাদীর সাথে নর্তকীটা ভীষণ ভাব জমিয়ে ফেলে। দাদীকে জানায় সে নাকি এক আমিরের মেয়ে। সে এতিম বলে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে। আমার দাদী এসব বিশ্বাস করে। দরবার নৃত্য শেষে সব নর্তকীরা দাসীপাড়ায় ফিরে যেতো। কিন্তু ঐ নর্তকী প্রাসাদে থাকার জন্য দাদীর কাছে অনুরোধ করে বসে। দাদী ওনার প্রতি এতোটাই মুগ্ধ ছিলেন যে সহজেই অনুমতি দিয়ে দেয়।”
“আপনার আম্মি প্রতিবাদ করে নি?”
“আমাদের রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী রাজার পরেই রাজমাতা ক্ষমতাধর। দাদীর উপরে আম্মি কথা বলতে পারতেন না।”
“তারপর?”
তাসকিনের আওয়াজ যেনো আচানক ভারী হয়ে উঠেছে। কাতর কণ্ঠে শাহ্জাদা জানাচ্ছেন–“রাকিন আর শামসকে জন্মদানকালে আম্মি মা’রা যান। আম্মির মৃ’ত্যুতে আব্বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। দাদী তখন আব্বাকে পরামর্শ দেয় সেই নর্তকীকে বিয়ে করার জন্য। সুন্দরী বিয়ে করলে নাকি আব্বা স্ত্রী-শোক ভুলে থাকতে পারবেন। আব্বা রাজি হননি ঐ নর্তকীকে বিয়ে করতে। যদিও আমাদের তিন ভাইকে নাকি নর্তকী ভীষণ ভালোবাসতো।”
নওরা কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করেছে–“ভালোবাসার অভিনয় করতো। তাই না?”
“হ্যাঁ,অভিনয় করতো। আমার দাদী অভিনয় বুঝতে পারে নি। দাদী আব্বাকে বুঝিয়েছিলো রাজকুমারী পুত্রবধূ সে আব্বার জন্য আনবে না। রাজকুমারী আনলে নাকি সে বউ নাকি আমাদের সাথে শত্রুতা করবে। নর্তকী তো আমাদেরকে ভালোবাসতো। নর্তকীই নাকি আমাদের যোগ্য মা হবে। শত্রুতা করারও সাহসই পাবে না। এতোসব বোঝানোর পরেও আব্বা নর্তকী বিয়ে করতে রাজি হন নি।”
“তো নর্তকীর সাথে বিয়েটা হলো কিভাবে?”–নাবিহা প্রশ্ন করেছে স্বামীকে।
তাসকিন ধীর কণ্ঠে জানাচ্ছে –“আম্মির মৃ’ত্যুর পর থেকেই আব্বা স্ত্রী হারানোর শোকে খুব সুরা পান করতেন। দাদী আর মন্ত্রী পরামর্শ করে এক রাতে কৌশলে আব্বার কক্ষে নর্তকীকে ঢুকিয়ে রাখে। ম’দ্যপ অবস্থায় আব্বা নর্তকীর সম্ভ্রম নষ্ট করেছে,এমনটা বুঝিয়ে আব্বাকে নর্তকী বিয়ে করতে বাধ্য করে আমার দাদী। নর্তকী হয় সম্ভার রাজ্যের রানী।”
“তারপর?”–নাবিহা শুধিয়েছে স্বামী তাসকিনকে।
“বিয়ের পরে সৎ মা কোনোদিন আমাদেরকে ভালোবাসে নি। দাদী আর ফুফু আমাদেরকে পালতেন। রাকিন আর শামসের বয়স তো তখন মাত্র তিন মাস ছিলো। সৎ মা ওদের দিকেও ফিরেও তাকাতেন না। দাদী নিজ হাতে গরুর দুধ খাওয়াতেন ওদের দুজনকে। আমার ফুফুও ভালোবাসতেন আমাদেরকে। ফুফু আবার সেই নর্তকী রানীকে পছন্দই করতেন না। বিয়ের পরে আমাদের প্রতি নর্তকীর আচরণ বদলে যাওয়ার ঘটনায় আমার ফুফু ভীষণ চিন্তিত হয়েছিলেন।”
“ওহ্।”
তাসকিন শীতল কণ্ঠে বলছে–“আমাদের রাজপ্রাসাদের দোতলায়ও একটি রসুইঘর ছিলো। রাজ পরিবারের মানুষেরা শখের বশে কালেভদ্রে সেখানে রান্না-বান্না করতো। সৎ মা নিজেও মাঝেমাঝে রসুইঘরে যেতেন। রাকিন আর শামসের দুধ দাদী ঐ রসুইঘরেই রাখতেন। একদিন মধ্যাহ্নভোজ শেষে দাদী,ফুফু,চাচাসহ সবাই বিশ্রাম মগ্ন ছিলো। আব্বা ছিলেন রাজদরবারে। সৎ মা নিজেও বিশ্রামেই ছিলেন। প্রাসাদে উপস্থিত দাসীরা থাকতো প্রাসাদের অন্য প্রান্তে। সেদিন ফুফুর কেনো যেনো ঘুম হয় নি। কক্ষের দরজা সামান্য উন্মুক্ত রেখেই চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন ফুফু। সৎ মা নাকি সেদিন চুপিচুপি রসুইঘর থেকে বের হয়েছিলো। উনি বুঝতে পারেন নি যে ফুফু সজাগ রয়েছে। শয্যা ছেড়ে উঠার পরে ফুফু আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আচানক খেয়াল হয় তার একটি কানে দুল নেই। পুরো দোতলায় কানের দুল খুঁজতে থাকে ফুফু। কানের দুলটি ফুফুর প্রেমিক মহাবীর উদয় বেগ দিয়েছিলেন। ফুফুর ভীষণ পছন্দের কানের দুল! পছন্দের জিনিস হারিয়ে যাওয়ায় ফুফু বেশ মনঃক্ষুণ্ন হয়। শেষ পর্যন্ত খুঁজতে খুঁজতে রসুইঘরে চলে যান ফুফু। রসুইঘরের দরজার সম্মুখে একটি ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্র থাকতো। দোতলার সব ময়লা জমা করা হতো সে পাত্রে। সন্ধ্যার আগে সব ময়লা ফেলে দেয়া হতো। ফুফু ভেবেছে দুপুরে দোতলা ঝাড়ু দেয়া হয়েছে। ময়লা ফেলা হয়েছে রসুইঘরের সামনের পাত্রে। যদি দুপুরের আগে কানের দুল হারিয়ে থাকে তবে ঝাড়ু দেয়ার সময় সেটা ময়লার সাথে জড়িয়েছে। যদি দুলটি চোরে না নিয়ে থাকে তবে সেটা ময়লার পাত্রেই রয়েছে। এমনটা ভেবেই ময়লার পাত্রের সব ময়লা ফুফু ঢেলে ফেলে দেয় মেঝেতে। একটি লাঠি দিয়ে নাড়া দিতে থাকে ময়লাগুলো। আচানক একটি প্যাঁচানো লাল কাপড় দেখে ফুফু চমকে যায়। কি আছে এ প্যাঁচানো লাল কাপড়ে! লাঠি দিয়েই প্যাঁচানো কাপড়টিকে খুলে নেয় ফুফু। দুধেভেজা বেশ কয়েকটি সাদা ধুতরা ফুল বেরিয়ে আসে কাপড়ের ভেতর থেকে। ফুলগুলো এমনভাবে থেঁতলানো ছিলো যেনো বিষাক্ত রস ভালোভাবে নির্গত হয়। ঐ রসুইঘরে শুধু রাকিন আর শামসের দুধই ছিলো সেদিন। সবার খাবার নিচের রসুইঘরে থাকতো। ফুফু বুঝতে পারে যমজ শিশুদের দুধে ধুতরা ফুলের বি’ষ মিশ্রিত করা হয়েছে। রানী যেহেতু চুপিচুপি রসুইঘরে এসেছে সেহেতু উনিই দুধে ধুতরা ফুলের রস মিশিয়েছে। ফুফু তৎক্ষণাৎ দৌড়ে এসে কড়া নাড়ে রানীর কক্ষে। কক্ষদ্বার খুলতেই চুলে ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে রানীরূপী ডা’ই’নীকে। ফুফুর চিৎকারে সবাই ছুটে আসে। ঘটনা শুনে দাদী প্রহরীদেরকে আদেশ করে রানীকে বেঁ’ধে ফেলার জন্য। আব্বাও দরবার থেকে দৌড়ে এসেছিলেন। অন্য কোনো বিষাক্ত জিনিস অবশিষ্ট আছে কিনা সেটা খুঁজতে সৎ মায়ের কক্ষ তল্লাশি করা হয়। বিছানার নিচ থেকে আরও কয়েকটি ধুতরা ফুল বের করে আনে রাজ কর্মচারীরা! হয়তো আব্বাকে,আমাকেও মে’রে ফেলেতো কৌশলে। রাজ কর্মচারীদের সামনে রসুইঘর থেকে যমজ শিশুদের দুধ নিয়ে আসা হয়। ধুতরা ফুল ভেজানো সেই বিষাক্ত দুধ একটি বিড়ালছানাকে খেতে দেয় ফুফু বিড়ালছানাটি সে দুধ খেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মা’রা যায়। তখন আব্বা রানীকে বনবাসে পাঠিয়ে দেয়।”
“রাকিন আর শামসকে হ’ত্যা করলে কি লাভ হতো ওনার?”
“আমি তো মৃগী রোগী। সিংহাসনে আরোহনের জন্য যথোপযুক্ত নই। বেঁচে থাকলে রাকিন অথবা শামস্ সিংহাসনের উত্তরাধিকার হবে। তাই ওদেরকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিলো সৎ মা। তাছাড়া ওদেরকে হ’ত্যা করলে আব্বা মানসিকভাবে ভে’ঙে পড়তো। তখন আব্বা রানীর হাতের পুতুল হয়ে যেতো। তার উদ্দেশ্য হাসিল করাও সহজ হতো।”
“বনবাসে পাঠালে আরশানের জন্ম হলো কিভাবে?”(নওরা)
“কিছুদিন পরে আব্বার মন্ত্রী বন্ধু অবকাশ যাপনে যায়। ওনার গন্তব্য ছিলো রাজ্যের শেষ প্রান্তের সেই বনে। অবকাশ যাপন শেষে ফিরে আসে মন্ত্রী। এসে আব্বাকে অবহিত করে যে বনে রানীর সাথে তার দেখা হয়েছিলো। সেই রানী গর্ভবতী,তার গর্ভে রাজার সন্তান। এই সংবাদে আব্বা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। রাজার সন্তান বনে জন্ম হবে! মন্ত্রী আব্বাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রানীকে বনবাস থেকে প্রাসাদে নিয়ে আসার জন্য। পরিবারের সবারও একই সিদ্ধান্ত ছিলো। সন্তানের কথা চিন্তা করে আব্বা প্রাসাদে নিযে এসেছিলেন সেই নর্তকীকে। এসে আবারও রানীর মর্যাদা পান উনি। কয়েকমাস পরে আরশানের জন্ম হয়।”
“সেই স্ত্রীকে হ’ত্যা করেছিলো কেনো আপনার বাবা?” (নওরা)
“আমার আব্বা মাঝে মাঝেই রাতে বের হয়ে যেতেন। ছদ্মবেশে প্রজাদের খোঁজ-খবর নিতেন। আরশানের জন্মের মাসখানেক পরে একরাতে আব্বা ছদ্মবেশে বের হয়েছিলেন। ঐ রাতেও আব্বার মন্ত্রী বন্ধু প্রাসাদেই ছিলেন। উনি তো বিশ্বস্ত ছিলেন। আমার দাদীকেও মা ডাকতেন। সেদিন অসুস্থতার অজুহাতে তিনি আব্বার সাথে ছদ্মবেশে গমন করেন নি। আব্বা অন্যান্য ঘনিষ্ঠ লোকদের নিয়ে বের হয়েছিলেন। শেষ রাতে প্রাসাদে ফিরে আসেন আব্বা। এসে দেখতে পান আমাদের সৎ মা’কে আর মন্ত্রীকে ব’ন্দী করে রাখা হয়েছে। আমার চাচা আটক করেছিলেন মন্ত্রীকে এবং সেই নর্তকীকে একই কক্ষে। ওরা মিলিতও হয়েছিলো।”
“সেই নর্তকী ছিলো মন্ত্রীর গুপ্তচর?”(নাবিহা)
“মন্ত্রীর প্রেমিকা ছিলো সেই নর্তকী। রাজ নর্তকী সেজে আমাদের প্রাসাদে এসেছিলো। প্রেমিক-প্রেমিকা মিলে আমাদের রাজ্য দখল করতে চেয়েছিলো।”
“মন্ত্রীর প্রেমিকা হলে আপনার আব্বাকে বিয়ে করলো কেনো?”
“আমাদের রাজপরিবার ধ্বংস করার জন্য। প্রাসাদে থেকে খুব সহজেই উদ্দেশ্য হাসিল করা যেতো। সবাইকে নিঃশেষ করার জন্য ওরা হয়তো যথাযথ সুযোগ পায় নি। দুজন হয়তো বড় কোনো পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছিলো। সফল হবার আগে নিজেরাই ধরা পড়ে গিয়েছিলো।”
“তারপর কি হয়েছিলো?”
“আমার আব্বা দুজনকেই হ’ত্যার আদেশ করেন। ঐ বনে নিয়ে জ’ল্লাদ দিয়ে মন্ত্রীকে আর নর্তকী রানীকে হ’ত্যা করা হয়। এরপরে মন্ত্রীর ভাই আব্বার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলো। কয়েকবার রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে। তখন আব্বা ওদের পুরো পরিবারকে রাজ্যছাড়া করেন।”
“ওহ্। নর্তকীর মৃ’ত্যুর পরে আরশান প্রাসাদে বড় হয়েছে রাজপুত্র হিসেবে। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো শাহ্জাদা…শাহ্জাদা স্বভাব নেই। নর্তকী মায়ের স্বভাব রয়ে গেছে। সবকিছু শুধু দখল করতে চায়।”–এটুকু বলে নওরা প্রস্থান করেছে মেজোবোন নাবিহার কক্ষ থেকে। নাবিহা তাসকিনকে বলছে–“আপনার সৎ ভাইকে কোনোভাবেই রাজপুত্রের মতো মনে হয় না। কি যেনো নামটা ওর..!”
বউকে মাথা চুলকাতে দেখে তাসকিন কাঁধে হাত রেখে দুষ্ট স্বরে বলছে–“আমার সৎ ভাইয়ের নাম তাসকিন মুনতাসীর।”
“আমায় বোকা বানাতে এসেছেন! তাসকিন মুনতাসীর তো আপনার নাম, আমার স্বামীর নাম!”
“ওরেহ্ বাবা, স্বামীর নাম মুখস্থ হয়ে গেছে নাকি!”
“জ্বী,স্বামীর নাম মুখস্থ করে এবার সন্তানের নাম লিখে মুখস্থ করছি।”
“সন্তান কোত্থেকে এলো?”
“ভবিষ্যতে আসবে। আগেভাগেই নাম রেখে মুখস্থ করে নিচ্ছি।”
“কয়জনের নাম মুখস্ত করবেন বেগম সাহেবা? আমার তো কয়েক হালি ছেলে-মেয়ে চাই।”
“মানে! কয়েক হালি সন্তানের মুখ দেখতে চায় শাহ্জাদা… শাহ্জাদা.. কি যেনো আপনার নামটা?”
“কয়েক হালি সন্তান হবে বলে চিন্তায় স্বামীর নামই ভুলে গেছেন!”
“হুম।”
……….
ঝলমলে প্রভাত। চারদিক সোনালী রোদের আলোয় আলোকিত। সম্ভার রাজপ্রাসাদের ডাইনিং টেবিলে বসে আছে রাকিন। প্রাতরাশ করছে। হঠাৎ শামসের আগমন ঘটেছে। শামস্ ফিরে এসেছে বাহার রাজ্য থেকে। রাকিনকে ইশারা করে উপরে চলে গেছে। রাকিন উঠে এসেছে যমজ ভাইয়ের কক্ষে। শামসের হাতে চিরকুট দেখে চিলের মতো ছোঁ মে’রে হাতে নিয়েছে রাকিন। ভীষণ উত্তেজনা। প্রথমবার প্রেমপত্র এসেছে। বাঁধভাঙা খুশি ছেলেটির। চিরকুট নিয়ে নিজ কক্ষে দৌড়ে চলে এসেছে। খুলেছে ধীরে ধীরে—
প্রিয়তম রাকিন,
আমি উড়তে শিখি নি, উড়বার শখও নেই। পুড়তে শিখি নি,পুড়বার সাহসও নেই। আমি ম’রতেও শিখি নি, ম’রবারও সাধ নেই। কিন্তু আচানক আমি যেনো ভালোবাসতে শিখে গেছি। দুর্বার আশা রয়েছে আমার, আপনার ভালোবাসায় হারাবার। কথা দিলাম সাথী হবো দুজনে, হারাবো একসাথে জীবনবেলার সুখ-দুঃখের সন্ধিক্ষণে।
ইতি,
আপনার মেহবুবা,
নওরা
……………..
নবপ্রভাত এসেছে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়েছে বাহার রাজ্যের ফুলবাগান। নওরা রয়েছে ফুলবাগানে। আজ নাবিহা সম্ভার রাজ্যে ফিরে যাবে। শামস্ খানিক বাদেই নিতে আসবে ওদেরকে। যদিও আরশান অতিথি হয়ে রয়েছে তাসকিনের সাথে,তবুও ওকে কেউ বিশ্বাস করে না।
রোদ উঠেছে। রোদে ঝিকমিক করছে চারদিক। শামস্ চলে এসেছে বাহার রাজ্যে। তাসকিন সস্ত্রীক ফিরে যাবে শামসের সাথে। আরশানের উপর ভরসা রাখে নি শামস্। বেচারা আরশান যে রাকিনের শত্রু, এটা নওরা ইতিমধ্যে আন্দাজ করতে পেরেছে। তাসকিন অথবা শামস্ কাউকেই এ ব্যাপারে অবগত করে নি শাহ্জাদী। কারণ রাজপ্রাসাদে ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা হয়। সিংহাসন ইস্যুতে যুদ্ধও হয়,ভাই ভাইকে খু’ন করে। রাজকীয় হিসাব-নিকাশ ভালোই বোঝে নওরা। আরশান তাকে যেসব বলেছে সেসব একমাত্র রাকিনকেই জানাতে চায় শাহ্জাদী। শামসের কাছে রাকিনের জন্য আজও একটি গোপন চিরকুট দিয়েছে নওরা। দিতে তো হবেই! আজ সকালেও আরশান বিরক্ত করেছে তাকে। রাকিনকে না জানালে হয়!
………..
মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে। বাহার রাজ্য থেকে তাসকিনরা পৌঁছেছে সম্ভার রাজ্যে। রাজকার্যে ব্যস্ত রাকিন। শামস্ এসেছে ভাইয়ের নিকটে। হাতে একটি চিরকুট শামসের। রাকিন ভীষণ উত্তেজনার সহিত শামসকে বলছেে–“দে, চিঠি দে।”
“দেবো না। তুই প্রেম করোস। আমার প্রেমিকা কই রে?”(শামস্)
“তুই মাহিরার সাথে প্রেম করতে পারিস না।”–রাকিনের সোজাসাপ্টা জবাব।
“মাহিরাকে দেখলে আমার রাগ লাগে। ও খালি গায়ে পড়ে মহব্বত করতে চায়।”
“ওর মতো এমন করে তোকে আর কেউ পছন্দ করবে না। এবার যা, মাহিরার খোঁজ কর। আর চিঠিটা আমায় দিয়ে দে।”
শামস্ চিঠি দিয়ে প্রস্থান করেছে। ভীষণ উচ্ছ্বাসে চিরকুট খুলেছে রাকিন। কিন্তু ভেতরে লেখা রয়েছে —
প্রিয়তম রাকিন,
আপনার সাথে সাক্ষাৎ করাটা অতীব জরুরি। আজ এবং আজই দেখা করবেন আমার সাথে।
ইতি,
নওরা
এমন চিরকুটে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে রাকিন। কি হলো শাহ্জাদীর! তৎক্ষণাৎ চিরকুট লিখে নিয়েছে শাহ্জাদা। সেখানে লেখা ছিলো–“কখন এবং কোথায় সাক্ষাৎ করতে চাও? আমি সেখানে এসে বাঁশি বাজাবো। তুমি বাঁশির সুর শুনে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসবে।”
পায়রাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে শাহ্জাদা। বাহার রাজপ্রাসাদে চিঠি এসেছে বিকেলের শুরুতে। রাকিনের চিঠি পেয়ে শাহ্জাদী জবাব দিয়েছে–“আজ মধ্যরাতে প্রাসাদের উত্তরে দাসীপাড়ার পাশে থাকবেন। আপনি বাঁশি বাজালে আমি দাসীর বেশে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসবো।”
চিরকুট নিয়ে ফিরে গেছে পায়রা।
…………..
নিঝুম মধ্যরাত। পুরো রাজপ্রাসাদ যেনো নিদ্রিত। নিদ নেই শাহ্জাদী নওরার নয়নে। দুজন দাসীকে নিয়ে বসে আছে শাহ্জাদী। দাসী পাড়ার অনেক দাসী রাত অবধি রানী,রাজকন্যাদের সেবা করে। প্রাসাদের অধিকাংশ দাসীই বোরকা পরিধান করে। আজ রাতেও কয়েকজন বোরকা পরিহিত দাসী ছিলো। সন্ধ্যায় ঘনিষ্ঠ দুজন দাসীকে বোরকা নিয়ে উপস্থিত থাকার আদেশ দিয়েছিলো নওরা। সবকিছু হাতের নাগালে নিয়েই নির্ঘুম রয়েছে শাহ্জাদী। আচানক বাঁশির সুর শোনা গেলো। বাঁশির সুর শুনে চমকে উঠেছে শাহ্জাদী। দাসীর বোরকা পরিধান করে নিয়েছে ক্ষণিকেই। বড়বোন নেহেরিনের কক্ষে গিয়ে রাকিনের আগমন সম্পর্কে অবগত করে এসেছে। এবার দাসী সেজে প্রাসাদ থেকে বের হবার পালা। সাথে সেই দুজন দাসী রয়েছে শাহ্জাদীর। দাসী ভেবে প্রহরীরা বাঁ’ধা প্রদান করে নি। নির্দেশিত জায়গায়ই অপেক্ষমান রয়েছে রাকিন। ঘোড়াটি রয়েছে খানিক দূরে। নৌযানে করে ঘোড়াও নিয়ে এসেছে শাহ্জাদা। নওরা ধ’মকের সুরে বলেছে–“এতো দেরি করেছেন কেনো?”
“ওঠো ওঠো, আগে ঘোড়ায় উঠে বসো।”
রাকিনের কথা শুনেই অশ্বারোহন করেছে নওরা। ঘোড়া ছুটছে সম্মুখে। ঘোড়ায় চড়েই আরশানের সব ঘটনা শাহ্জাদাকে অবগত করেছে নওরা। সৎ ভাইয়ের ঘটনা শুনে শাহ্জাদা রাকিন বেশ উদ্বিগ্ন,চিন্তিত। হঠাৎ যেনো নতুন মেঘের আগমন ঘটেছে হৃদয় অম্বরে। বাহার রাজ্যে নওশাদ,সম্ভার রাজ্যে আরশান মুখিয়ে রয়েছে তার প্রেয়সীর জন্য। এ যেনো ঘরে-বাইরে শত্রু। এসব ভাবনার মাঝেই ঘোড়া চলে এসেছে প্রণয় নদের তীরে। সম্মুখেই ছোট একটি নৌকা। দূরে রয়েছে রাজকীয় নৌযানটি। সম্ভবত ছোট নৌকাটিকে বড় নৌযানের সাথে বেঁ’ধে আনা হয়েছে। ছোট তরীতে প্রণয় নদে ভেসে শাহ্জাদা মহব্বতের আলাপ করতে চেয়েছে। তাই নিয়ে এসেছে এ ডিঙি নৌকা। রাকিন লাফ দিয়ে উঠে গিয়েছে নৌকায়। হাত ধরে উঠিয়েছে শাহ্জাদীকে। নৌকা দোদুল্যমান। দুজন বসেছে পাশাপাশি। বৈঠা চালিয়ে তীর থেকে খানিক দূরে নৌকা নিয়ে এসেছে শাহ্জাদা। সৎ ভাই আরশান তার প্রেয়সীর দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। সিংহাসনে আরোহনেরও তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষন করেছে। এ যেনো এক বিশাল শত্রুতা। এসব শুনে মেজাজ ভালো নেই রাকিনের। কুলুকুলু ধ্বনিতে বয়ে চলছে নদ। রাতের প্রণয় নদ কিছুটা নিস্তরঙ্গ। নৌকায় বসেই শাহ্জাদী বলছে–“আমি যে প্রাসাদ ছেড়ে এসেছি! নওশাদ ভাই জানতে পারলে আমায় মে’রেই ফেলবে।”
“তাহলে চলো আমার সাথে। সম্ভার রাজ্যে নিয়ে যাই তোমায়!”
“শাদী না করে কি যাওয়া যায়!”
“সেখানে পৌঁছে শাদী করে নেবো।”
“পারিবারিকভাবেই শাদী হোক! কিন্তু নওশাদ ভাই কি সেটা হতে দেবে!”(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)
“আমরা দুজন ঠিক থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না।”
“নওশাদ ভাইয়ের সাথে আমার আব্বাই পারে নি। আমরা কি পারবো!”
“আমায় ভরসা করো!”
” নওশাদ ভাই অনেক খা’রাপ। নওশাদ ভাইয়ের বেশ ক্ষমতাও আছে।”
“এই মেয়ে এই, একটা আছাড় দেবো তোমাকে। সেই কখন থেকে নওশাদ..নওশাদ জিকির শুরু করেছো! আর একবারও যেনো তোমার মুখে ওর নাম না শুনি।”–বিশাল এক ধ’মকে চুপ হয়ে গেছে নওরা। প্রথমবার মহব্বত করতে এসেই ধ’মক খেয়েছে শাহ্জাদী। প্রেমিক যে কিছুটা র’গচটা সেটা ভাবতেও পারে নি মেয়েটি। নীরব হয়ে গেছে ক্ষণিকেই। শাহজাদাও নিশ্চুপ হয়েই রয়েছে। রাজ্যের দুশ্চিন্তা তার মাথায়। তবুও সময় তো বয়ে যাচ্ছে। নওরাকেও ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে প্রাসাদে। মহব্বতের আলাপই তো এখনো হলো না। এভাবে কি থাকা যায়! রাকিন কাছে এসেছে শাহ্জাদীর। মেজাজও শীতল। কানের কাছে মুখ এনে ফি’স’ফিসিয়ে বলেছে–“এ্যাই, রাগ করেছো নাকি?”
হাত দিয়ে শাহ্জাদার মুখখানি দূরে সরিয়ে দিয়েছে নওরা। অভিমানী সুরে বলেছে–“নিজের ভাই আরশানকে ধ’মকাতে পারে না, এসেছে আমাকে ধ’মকাতে। আগে আরশানকে ধ’মকিয়ে ঠিক করবেন। তারপরে…”
“একদম মু’ন্ডপাত করে ফেলবো এবার। এতোক্ষণ করেছে নওশাদ নওশাদ। এবার শুরু করেছে আরশানের নাম।” –ভীষণ রাগে জবাব দিয়েছে রাকিন।
নওরা বেশ মর্মাহত এবার। বারবার এমন ধ’মক মোটেও আশা করে নি। শাহ্জাদীর কি মান-সম্মান নেই! সে প্রতিবাদ করেছে ক্ষণিকেই–“কি ভেবেছেন আপনি! আমায় শুধু ধ’মকাবেন? আর একটা ধ’মক দিলে একদম খু’ন করে আপনাকে কুমিরের খাবার বানিয়ে রেখে যাবো। চেনেন আমায়? আমি বাহার রাজ্যের রাজকুমারী। আর আপনি এখনো এই বাহার রাজ্যের তীরেই আছেন। আপনার…।”
কথা শেষ করা হয় নি শাহ্জাদীর। আচানক নৌকার পাশ থেকে বড় আকারের কোনো প্রাণী লাফ দিয়েছে পানিতে। শাহ্জাদীও ভয়ে এক লাফে গিয়ে রাকিনের কোলে বসে পড়েছে। রাকিন ‘হো হো’ করে হেসে উঠেছে। কারণ মাত্রই তাকে কুমিরের ভয় দেখিয়েছে বেচারী। অথচ এখন ভয়ে একদম কোলে এসে বসেছে। শাহ্জাদা দুষ্ট স্বরে বলেছে–“এ্যাই, যখন তখন গায়ে পইড়ো না তো! এর আগেও কিন্তু দু’বার জড়িয়ে ধরেছিলে।”
“ভদ্রভাবে কথা বলুন!”
“আমি তো ভদ্রই আছি,তুমিই তো এসে লাফিয়ে লাফিয়ে গায়ে পড়ো।”–রহস্যময় কণ্ঠে।
“দেখুন, আপনি কিন্তু বেশি ফাজলামো করছেন!”
“সেটা না হয় করলাম! আপনি এবার নামবেন তো আমার কোল থেকে! এভাবে থাকলে মাতাল লাগবে কিন্তু।”
“দুঃখিত।”–বলে পাশে সরে বসেছে নওরা।
“কি,আমায় কুমিরের খাবার বানাবেন না?”–মৃদু হেসে।
শাহ্জাদীর বেশ রাগ হচ্ছে। নদের পানিতে হাত দিয়েছে। একটু পানি ছিটিয়ে দিতে চাচ্ছিলো প্রেমিকের বদনে। হঠাৎ রাকিন বলে উঠেছে–” আরেহ্, কু..মির কু….মির!”
নওরা এক লাফে এসে আবারও রাকিনের কোলে উঠে বসেছে। রাকিন এবার বাহুডোরে নিয়েছে শাহ্জাদীকে। পরম আদরে চু’মু খেয়েছে ললাটে। শাহ্জাদীর কোনো অনুভূতি নেই। সংকীর্ণ হয়ে আছে এখনো কুমিরের ভয়ে। রাকিন শীতল কণ্ঠে বলেছে–“এতো ভয় তোমার! তুমি,আমি ছাড়া আর কিছু নেই এখানে।”
“কু..কুমির চলে গেছে?”
“কুমির তো ছিলোই না।”
“আপনি না বলেছেন কুমির এসেছে।”
“আরেহ্ ধুর! আমি বললেই কি কুমির চলে আসবে নাকি!”
“একটু আগেই তো একটা কুমির লাফ দিলো!”
“ওটা শুশুক ছিলো। কুমির এভাবে লাফ দিতে পারে না। ”
শাহ্জাদী নিজের ঠোঁট কা’মড়ে বলছে–“ধুর! কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম!”
কালবিলম্ব না করে সরে গেছে রাকিনের কাছ থেকে। রাকিন এগিয়ে এসে ফি’সফি’সিয়ে বলছে–“চিঠিতে তো আমায় প্রিয়তম বলে ডেকেছো। এখন একবার ডাকো না!”
আওয়াজ নেই শাহ্জাদীর কণ্ঠে। হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে অজানা ছন্দে। শাহ্জাদা পেছন থেকে কাঁধে হাত রেখেছে প্রেয়সীর। হৃদয়জ অনুভূতিরা যেনো সুখের তীরে আছড়ে পড়ছে। সুখের বাঁধ ভেঙেছে যেনো দিশেহারা হয়ে। রাকিন শান্ত কণ্ঠে বলছে–“এ জীবনপথে আমি ছিলাম এক নিঃসঙ্গ পথিক। সঙ্গী হয়েছো আমার এ নিঃসঙ্গ যাত্রার! এ পথে আসুক ঝড়,আসুক আঁধার! কভু ছেড়ো না হাত আমার!”
“হাত কিন্তু এখনো ধরি নি, ধরার আশায় রয়েছি। সঙ্গী করুন আমায়!”
“করবো, ইনশাআল্লাহ্।”
প্রণয় নদে হিমেল হাওয়া বইছে। শীতও জেঁকে বসে আছে। কুয়াশা আর শিশিরের ছোঁয়ায় শাহ্জাদী যেনো কাঁপছে। হৃদয়ও আজ বেসামাল। তবুও ফিরে যেতে হবে প্রাসাদে। ফজরের সময়ই রাজা,রানী শয্যা ত্যাগ করবে। তার পূর্বেই ফিরতে হবে রাজকন্যাকে। নিজেও ফজরের নামাজ পড়বে সে। তাই ধীরস্বরে শাহ্জাদাকে অনুরোধ করছে–“আমায় ফিরিয়ে দিয়ে আসুন। ফজরের আযানের আগেই ফিরতে হবে।”
“তুমি নামাজ পড়ো?”
“জ্বী। আপনি পড়েন না?”
“না।”
“কেনো?”
“আল্লাহ্ আমার কথার জবাব দেয় না।”
“কি কথা বলেছিলেন আল্লাহকে?”
“এক প্রশ্ন করেছিলাম। ছোটবেলা থেকে বারবার,হাজারবার।”
“কি প্রশ্ন করেছিলেন?”
“আমার মা’কে কেনো নিয়ে গিয়েছে? হাজারবার প্রশ্ন করেও জবাব পাই নি।”
“হয়তো পেয়েছেন কিন্তু বুঝতে পারেন নি। মায়ের অভাব বোধ করেন?”
“ভীষণ, ভীষণ অভাব বোধ করেছি। জন্ম থেকেই তো নিঃসঙ্গ ছিলাম।”
রাকিনের আওয়াজে ঝরে পড়ছে বিষণ্ণতা। শাহ্জাদীও নিশ্চুপ। আচানক যেনো এক অসীম নীরবতা ঘিরে ধরেছে দুজনকে। নদও এখন যেনো নিস্তব্ধ। ঘোর কে’টেছে রাকিনের। কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে আবদারের সুরে বলেছে–“একবার প্রিয়তম বলে ডাকো না! তারপরেই দিয়ে আসবো।”
“পরে ডাকবো।”–আদুরী কণ্ঠে।
“তাহলে আজ এখানেই থাকবো। প্রাসাদে ফিরিয়ে দেবো না তোমায়!”
“নৌকাটা তীরে নিয়ে যান, তারপরে বলে দেবো।”
“ঠিক আছে।”–বলেই বৈঠা লাগিয়েছে রাকিন। পানি কে’টে কে’টে তরী চলে এসেছে তীরে। শাহ্জাদী নেমে গেছে। রাকিন নেমে কাঁধে হাত রেখে বলছে–“চলো,ঘোড়ার কাছে।”
দুজনই অশ্বারোহণ করেছে। ঘোড়া ছুটছে রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে। সুখময় অনুভূতি। দুষ্ট-মিষ্টি কিছু কথা। এসবের মাঝেই ওরা ফিরে এসেছে প্রাসাদের নিকটে। দুজনই নেমেছে ঘোড়া থেকে। শাহ্জাদীর হাত ধরে রাকিন গম্ভীর কণ্ঠে বলেছে–“শোনো, রাকিন নামটা এখন থেকে হৃদয়ে গেঁথে নিও। আর যেনো কারো নাম বারবার না শুনি!”
“ঠিক আছে।”
” বিপদ-আপদ যাই হোক না কেনো, পায়রা দিয়ে আমায় বার্তা পাঠাবে।”
ফেরার আগে ‘আল্লাহ হাফেজ প্রিয়তম’ বলে দৌড় দিয়েছে শাহ্জাদী। খানিক দূরেই অপেক্ষমান ছিলো সেই দাসী দুজন আর একজন বয়োবৃদ্ধ দাসী। ওদের সাথেই দাসীর বেশে শাহ্জাদী ফিরে গেছে প্রাসাদে। ফজরের আগে দাসীরা মাঝে মাঝেই প্রাসাদে আগমন করে। নামাজের আগে এসে ওজু,গোসলের পানি গরম করে রাখে। অন্যান্য কাজেরও প্রস্তুতি নেয়। আজও বোরকা পরে দাসীরাই এসেছে,এমনটা ভেবে প্রহরীরা কোনো বাঁধা দেয় নি নওরাকে। শাহ্জাদী নিশ্চিন্তে প্রবেশ করেছে প্রাসাদে ।
চলবে