প্রাসাদকথন পর্ব-০৯

0
60

#প্রাসাদকথন
পর্বঃ৯
#সুলতানা_তানি

রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক ঊষা। গতকাল কুয়াশায় নিশ্চুপ ছিলো রবি। আজ যেনো একটু বেশিই তেজ ছড়াতে চাচ্ছে। বাহার রাজপ্রাসাদে প্রাতরাশ শেষ হয়েছে। পুরো রাজপরিবার একসাথে ভোজে অংশগ্রহণ করে। ভোজনবিলাসে নওশাদ মধ্যমনি হয়ে থাকে। শাহ্জাদী নেহেরিন আর নওরা অনুপস্থিত থাকে পারিবারিক ভোজনপর্বে। নওশাদ যেনো দু’রাজকন্যার হৃদয়েই কণ্টক হয়ে রয়েছে। সুকৌশলে নওশাদকে এড়ানোর জন্যই ওরা পারিবারিক ভোজন পর্ব এড়িয়ে যায়। নেহেরিনের কক্ষে দু’বোন একসাথে ভোজনবিলাসী হয়। আজও একত্রেই প্রাতরাশ সেরেছে। তারপর থেকেই দুজন মগ্ন রয়েছে সুখ-দুঃখের আলাপে। কত শত কথা দুজনার! ঘণ্টাখানেক ধরেই তো নানা রঙের ভাবনায় মগ্ন দুজন! হঠাৎ একজন দাসী খট খট শব্দে কড়া নেড়েছে কক্ষে। নেহেরিনের অনুমতি সাপেক্ষে দাসী কক্ষে প্রবেশ করেছে। ধীর পায়ে কাছে এসে নওরাকে বলছে–“শাহ্জাদা নওশাদ আনোয়ার তার মায়ের কক্ষে আছেন। আপনাকে স্মরণ করেছেন তিনি।”
নওরার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ প্রগাঢ়। শাহ্জাদী ভাবছে মধ্যরাতে রাকিনের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারটা নওশাদ জেনে গেলো কিনা! নওরার অমলিন বদনখানি মলিন হলো যেনো ক্ষণিকেই। নেহেরিনের আদেশে দাসী কক্ষত্যাগ করেছে। ছোটবোনকে অভয় দিয়ে নেহেরিন বলেছে–“নওশাদ ভাইকে ভয় পাস না নওরা! ওনার সামনে গিয়ে হাসি মুখে কথা বলবি। আর আমি এখনই আম্মিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোকে কিছু বললে আম্মি প্রতিবাদ করবে।”

বোনের নিকট থেকে অভয় পেয়ে নওরা ধীর কদমে ছুটছে নওশাদের মায়ের কক্ষে। প্রয়োজনে ঐ কক্ষে ডেকে নিয়েই নওরার সাথে সাক্ষাৎ করে নওশাদ। নওশাদের মা বসে রয়েছে বিছানার পাশে। নওরাকে ইশারায় বসার আদেশ দিয়েছে শাহ্জাদা নওশাদ। রাজকীয় চেয়ারে বসেই গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করেছে–“হঠাৎ করেই ইদানিং এতো খুশি খুশি দেখাচ্ছে কেনো তোকে?”
“খুশি থাকাই তো ভালো।”(মুখের উপরে জবাব নওরার)

“আরশান তোকে কিছু বলেছে?”

“জ্বী, বলেছে।”

“কি বলেছে? কখন বলেছে? আমি তো আরশানকে নজরদারিতে রেখেছিলাম যেনো তোর ধারেকাছে আগাতে না পারে।”

“আপনার আবার নজরদারি! নজরদারিতে নিয়োজিত থাকা আপনার বন্ধুগুলোও আপনার মতোই! ওরা আপনার সাথে সুরা পান করে মাতাল হয়ে থেকেছে। ঘোড়ার ডিমের নজরদারি করেছে ওরা! আর আপনি নিজে তো সন্ধ্যা থেকে মজে থাকেন নর্তকীদের সাথে। তারপরে সুরা পান করে ওদের একজনকে রেখে তার বুকেই শুয়ে পড়েন। ঘুম থেকেও তো উঠেন সেই দুপুরের আগে! ”

“চুপ, একদম চুপ! আমি নর্তকীর বুকে ঘুমাবো নাকি অন্য কোথাও ঘুমাবো এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসব নিয়ে কখনো মুখ খুলবি না। তোকে শাদী করে রানীর মর্যাদা দেবো। তুই আমায় রাজপুত্র,রাজকন্যা উপহার দিবি। এই রাজ্যের ভবিষ্যত রাজা আমি। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনো কোনো কথা থাকতে পারবে না তোর মুখে। বুঝেছিস?”–বজ্রের মতো হুংকার দিয়ে শাহ্জাদীকে বলেছে নওশাদ।

“জ্বী।”–ভীষণ বিষণ্ণ বদনে জবাব দিয়েছে নওরা। মেঘমলিন বদন বেয়ে যেনো বৃষ্টি নামার পালা। নওশাদ ক্ষু’ব্ধস্বরে প্রশ্ন করেছে–“এবার বল আরশান তোকে কি বলেছে?”

“আরশান নাকি রাজা হবে। আর আমায় তার রানী করতে চায়।”

“আমায় জানাস নি কেনো এসব?”

“আপনাকে কেনো জানাতে হবে! আমি নিজেই তো জবাব দিয়ে দিয়েছি।”(কাতর কণ্ঠে)

“কি জবাব দিয়েছিস তুই?”

“আরশানকে বলেছি আপনাকে তো রাজপুত্রের মতোই দেখায় না। রাজা হবেন কি করে! আর কখনো আমায় বিরক্ত করবেন না!”

শাহ্জাদীর কথা শুনে হো হো শব্দে হেসে উঠেছে নওশাদ। রাগ যেনো পানি হলো মুহূর্তেই। হেসে হেসে নওরাকে বলছে–“বিশাল প্রতিবাদ করে ফেলছিস দেখি!”
“হুম।”
“আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। দরবারে যেতে হবে। আর কোনো কথা নেই এখন তোর সাথে। যা এবার!”

নওরা কক্ষত্যাগ করছিলো দ্রুত পায়ে। প্রস্থানকালে নওশাদের মা থামিয়েছে শাহ্জাদীকে। কণ্ঠে ঝুলানো চেইনের লকেটে হাত দিয়ে ইতস্তত বোধ করে বলছে–“এ লকেটখানা কোথায় যেনো দেখেছি! ভীষণ পরিচিত লাগছে।”

“ঠিক ধরেছেন ভাবী। এটা ওর ফুফুর লকেট। ঐ রাজ্যে অতিথি হয়ে যাবার পরে নাবিহাকে এটা দিয়েছে সম্ভার রাজ পরিবার থেকে। নওরা শখ করে পরেছে ফুফুর লকেট। নাবিহা মন ভোলা তো, ভুল করে নিয়ে যায় নি।”–রানী হাজির হয়েই এসব জানিয়েছে নওশাদের মা’কে। আর কোনো সংশয় নেই ওদের লকেট নিয়ে। শাহ্জাদী সে কক্ষত্যাগ করে চলে এসেছে নিজ কক্ষে। ভাবছে রাজ্যের প্রয়োজনে রাজারা সব করতে পারে। নিজ রাজ্যে অন্য কোনো বংশের পুরুষের কাছে হস্তান্তর করতে চায় না তার বাবা। শুধু রাজ্য রক্ষার্থেই নওশাদের মতো এমন এক ব’দমাশের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে তার। এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ বড্ড অচেনা একটি পায়রা উপস্থিত হয়েছে বাতায়নে। চিরকুট আটাকানো সে পায়রাটির ঠোঁটে। হয়তো রাকিনেরই চিরকুট। শাহ্জাদীর মনে যেনো আচানক খুশির হিল্লোল বইছে। পায়রা চিরকুট রেখে গাছের ডালে অবস্থান নিয়েছে। ভীষণ উল্লাসের সাথে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে চিরকুট উন্মুক্ত করেছে নওরা।

প্রিয় নওরা,

হয় তুমি আমার রানী হবে, নাহয় বেশ কয়েকজন কোরবানি হবে। এমনকি তোমার ভালোবাসাও কোরবানি হতে পারে। এটাই আমার শেষ কথা। ভেবেচিন্তে জবাব পাঠাও।

ইতি,

আরশান মুনতাসির

চিরকুট পাঠে দ্রোহের উদগীরণ হচ্ছে শাহজাদীর হৃদয়ে। প্রতিবাদের ভাষাগুলোও যেনো আরও প্রতিবাদী ছন্দ পেয়েছে। আজ আর নীরবতা নয়। শাহ্জাদী জবাব লিখতে বসেছে শক্ত হাতে-

শাহ্জাদা আরশান,

শে’য়ালের হু’মকিতে বাঘ,সিংহ কখনো গর্তে লুকায় না। কুচক্রী শে’য়ালই বাঘ, সিংহের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। আপনার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবুন। চিঠি পাঠিয়ে আমায় আর কখনো বিরক্ত করবেন না। আপনার হু’মকির ভয়ে আমি মোটেও ভীত নই। আল্লাহ্ হাফেজ!

ইতি,

নওরা নানজিবা
…………………

মধ্যদুপুর। রাজদরবার আজ লোকে লোকারণ্য। রাজা গিয়েছেন মধ্যাহ্নভোজে। রাজপুত্ররাও ভোজনবিলাস করছে। রাজকীয় আলাপচারিতায় মুখরিত হয়ে আছে কক্ষ। রাজা তারিক জ্যেষ্ঠপুত্র তাসকিনের নিকট থেকে শ্বশুরবাড়ির খোঁজ নিচ্ছেন। তাসকিন ভীষণ উৎসাহে শোনাচ্ছে শ্বশুরবাড়ির গল্প। সুখময় কিছু গল্পে হাসিখুশির বাহারে শেষ হয়ে গেলো ভোজনবিলাস। রাজা নিজ কক্ষে গিয়েছেন দরবারে গমনের জন্য তৈরি হতে। হঠাৎ করেই আটঘাট বেঁ’ধে পুত্র রাকিন এবং শামস্ হাজির হয়েছে পিতার কক্ষে। রাজা আদুরেস্বরে কৌতূহলী ভঙ্গিতে শুধিয়েছে–“শাহ্জাদারা, কিছু বলতে চাও তোমরা?

রাকিন জিজ্ঞাসুস্বরে প্রশ্ন করেছে রাজাকে–“আব্বু,আমার দাদা বিয়ে করেছিলো কত বছর বয়সে?”

“কেনো? আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি আমার আব্বা বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। আর আমি বিয়ে করেছি তেইশ বছর বয়সে।”

“আব্বা, আমাদের যমজ দুজনেরও কিন্তু বয়স এখন তেইশ বছর।”–মাথা নিচু করে গম্ভীরস্বরে জবাব দিয়েছে রাকিন।

আচানক এমন কথা শুনে রাজা যেনো বরফশীতল হয়ে গেছেন। বাকহারা হয়ে নীরব থেকেছেন কিয়দক্ষণ। শাহ্জাদী নওরার সাথে রাকিনের মহব্বত থাকার ব্যাপারটিও ভেবে যাচ্ছেন সম্ভাররাজ তারিক। নওরার কণ্ঠে তারই স্ত্রীর লকেট দেখে অনেক কিছু আন্দাজ করেছিলেন তিনি। হয়তো ভীষণ ভালোবাসা এসেছে পুত্রের জীবনে। নীরবতা ভেঙে খানিক বাদেই রাজা প্রশ্ন করেছেন–“তোমরা কী এখনই বিয়ে করতে চাও নাকি?”

“জ্বী আব্বা, আপনার কি নাতি-নাতনী দেখতে ইচ্ছে করে না?”–শামসের সোজাসাপটা জবাব।
“হ্যাঁ, দেখতে ইচ্ছে করে। নাতি-নাতনীর জন্যই তো তাসকিনকে শাদী করিয়েছি।”

রাজা তারিক যে ক্ষণিকেই বিভ্রান্ত করে দিয়েছেন শামসকে। রাকিন বিভ্রান্তি কা’টিয়ে জবাব দিয়েছে দৃঢ়স্বরে– “তাসকিন ভাইয়ের একার আর কজন ছেলে-মেয়ে হবে আব্বা? আমরা চাই পুরো রাজপ্রাসাদ জুড়ে আপনার নাতি,নাতনী থাকুক!”

রাজা তারিক স্মিত হেসেছেন। পুত্রদের মনে যে বিয়ের বাজনা বাজতে চায় সেটা বোধগম্য হয়েছে মহারাজের। ধীরস্বরে দৃঢ় ভঙ্গিতে রাজা জবাব দিয়েছে–“আমি দরবারে যাচ্ছি। অবসরে এসব নিয়ে আলাপ করবো তোমাদের সাথে।”

রাজা প্রস্থান করেছেন দরবারের উদ্দেশ্যে। শাহ্জাদী নওরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছে রাকিন। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় শীঘ্রই। আজ প্রথমবার পিতার নিকট বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করতে পেরেছে শাহ্জাদা। অজানা সুখের উল্লাসে উল্লসিত হচ্ছে তার হৃদয়। এ যেনো এক বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মনরাঙা উল্লাস!
……….

শামসদের ফুফাতো বোন মাহিরা এসেছে সম্ভার রাজপ্রাসাদে। রাজা তারিক বিয়ের আলাপ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পুত্রদ্বয়কে। তাই আজই মাহিরার সাথে মন লেন-দেনের কিছু মধুর আলাপ করতে চায় শামস্। মুগ্ধকর কিছু অনুভূতিরা স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে শাহ্জাদার হৃদয়ে। খুশি খুশি উৎসব এসেছে সেথায়। নব পল্লবের মতো অমলিন এখনো শাহ্জাদার হৃদয়খানি। বিয়ের বাঁশি বাজতে চায় যে শীঘ্রই। মধ্যাহ্নভোজ শেষে অনেকেই মগ্ন হয়েছেন দ্বি-প্রহরের বিশ্রামে। রাজদরবার ব্যতীত পুরো প্রাসাদ নীরব। শাহ্জাদা শামস্ এসেছে অতিথিশালায়। মাহিরাকে তলব করে বসেছে মধ্যবর্তী কক্ষে। উত্তেজনার তোড়ে পানি পান করেছে দু’বার। আচানক যেনো হৃদয়জ উত্তেজনা বাড়ছেই। শামসের হৃদয় রহস্য জানতে মাহিরাও কৌতূহলী। খানিক বাদেই সেনাপতিকন্যা এসে বসেছে শাহ্জাদার মুখোমুখি। হাস্যোজ্জ্বল বদনে রহস্যের সুরে শামস্ প্রশ্ন করেছে মাহিরাকে–“এতো ঘন ঘন আমাদের বাড়িতে আসার দরকার কি?”

“এতো ঘন ঘন আমার খোঁজ নেয়ার মানে কি?”

“ধুর, বেয়াদব! তুই আমার একমাত্র ফুফাতো বোন বলেই তো খোঁজ নেই।”

“বুঝেছি! এখন বলুন, আমায় কেনো ডেকেছেন! কি বলতে চান আমায় শাহ্জাদা?”

“শোন উদ্বেগী,…।”

“আপনি আমায় উদ্বেগী বলবেন না শাহ্জাদা!”

“তোর বাপের নাম তো উদ্বেগ, তাই তোকে উদ্বেগী নামে ডাকি। এমন ক্ষে’পে যাচ্ছিস কেনো?”

“আমার বাবা সেনাপতি মহাবীর উদয় বেগ। আপনি কিন্তু উদ্বেগ ডেকে বাবাকে অসম্মান করছেন!”

“সামনে তো সম্মানই করি।”

“পেছনেও করবেন।”

“ঠিক আছে। তবে তোকে উদ্বেগী নামেই ডাকবো। এবার একটু চিন্তা করে বল তো, আমায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে কে?”

“আমি! আবার কে?”–বিস্ময়ের সাথে জবাব দিয়েছে মাহিরা।

“তাহলে আমার বাপ-ভাই ভালোবাসে না?”

“তারা আপনাকে বাপ,ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। আর আমি মেহবুবার মতো ভালোবাসি।”

“তুই কবে মেহবুবা হইলি আমার?”(মৃদু হেসে)
“জন্ম থেকেই।”
“ইশশ্! মহব্বতের মোহর নিয়ে জন্মেছিলি নাকি?”
“কি যে বলেন!”

“মহব্বত কি জিনিস সেটা আগে শিখে নিস। তারপরে মহব্বত করবো তোকে।”
” সত্যি? সত্যি মহব্বত করবেন?”
“আজ আসি।”–বলেই রহস্যময় হাসিতে শামস্ পা বাড়িয়েছে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে। আচানক লাফিয়ে শাহ্জাদার সামনে চলে এসেছে মাহিরা। দু’হাত প্রসারিত করে আবদারের সুরে বলছে–“আজ বলে যান না শাহ্জাদা!”
“কি বলবো?”
“যা, বলতে এসেছেন!”
“কিছু না!”

“যদি না বলেন তাহলে আমি কিন্তু জড়িয়ে ধরবো আপনাকে। তখন কেউ দেখে ফেললে আপনারই ব’দনাম হবে!”

” উদ্বেগী, তুই সরে যা আমার পথ থেকে।”

ধীর পায়ে একজন দাসী এগিয়ে এসেছিলো এদিকটায়। অবনত বদন দাসীর। মাহিরা এখনো হাত প্রসারিত করে রেখেছে সম্মুখে। দাসী দেখে ফেলতে পারে ভেবে শামস্ চোখ রাঙিয়েছে মাহিরাকে। মেয়েটির হাস্যোজ্জ্বল বদন মেঘমলিন হলো যেনো ক্ষণিকেই। ভীষণ অভিমান কেড়ে নিয়েছে হাসি। এমন মলিন বদন দেখে শামস্ ফি’স’ফিসিয়ে বলে গেছে–“এমন মলিন হয়ে থাকিস না রে! আর ক’ট দিন বাদেই শাদী করবো তোকে!”
……………

বিকেলের বিচিত্র রঙ ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতিতে। এ বিচিত্র রঙে শাহ্জাদীর মনও হয়েছে বৈচিত্র্যময়। আরশানের চিরকুটের বার্তাও জানাতে হবে রাকিনকে। চিরকুটে এতোসব গোপন কথা জানানো মুশকিল। যদি চিরকুট অন্য কারো হস্তগত হয়ে যায়! সাক্ষাতেই জানাতে হবে অন্তর-বাহিরের সকল খবর। তাই আরেকবার সাক্ষাৎ যে ভীষণ প্রয়োজন! প্রথম প্রেমের ছন্দে শাহ্জাদীর হৃদয়ও হয়ে আছে প্রেমাচ্ছন্ন। প্রেমের কথা শুরু হোক না এবার! সুখের হিল্লোল নিয়ে প্রেমপত্র লিখতে বসেছে শাহ্জাদী। আচানক মনে পড়েছে নওশাদের বহু নারী আসক্তির কথা। আজ রাকিনকে প্রেমপত্র লিখতে গিয়েও যেনো থমকে গেছে শাহ্জাদী। অবচেতন মন ভাবছে তার প্রিয়তমও যদি এমন বহুনারী আসক্ত হয়ে যায়! মখমলি সুখের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে শাহ্জাদী লিখছে–

প্রিয়তম রাকিন,

হাজার তারাদের ভীড়ে একখানি তারা হয়ে মিটিমিটি করে আমি জ্বলতে চাই না। আপনার হৃদয় আকাশে আমি একটাই চাঁদ হয়ে আলো ছড়াতে চাই। এ চাঁদে হতে পারে গ্রহণ, আপনার হৃদয় আকাশজুড়ে নেমে আসতে পারে ক্ষণিকের অমানিশা। সেইসব আঁধারের ক্ষণে হারানো যাবে না ভালোবাসার নেশা। ভীষণ ভালোবাসি আমি আপনাকে। আপনার প্রতিটি মোলাকাত যেনো মধুক্ষণ হয়ে আসে আমার কাছে। হাজার কথার ভীড়ে হারিয়ে যায় অনেক না বলা কথা। আজ হোক না আরেকবার মোলাকাত! হোক কিছু না বলা কথা!

ইতি,
আপনার মেহবুবা
নওরা নানজিবা

……………
দিনের বেলায় ভীষণ ব্যস্ত থাকে শাহ্জাদা রাকিন। সম্ভার রাজ সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার সে। পিতার রাজকীয় কার্য সচক্ষে দেখে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিজের দায়িত্বও রযেছে প্রচুর। ফুরসত নেবারও যেনো সুযোগ হয় না। কায়ায় ব্যস্ত সে রাজকার্যে কিন্তু হিয়ায় ব্যস্ত প্রেয়সীর ভাবনায়। এ অবাধ্য হিয়াকে বোঝানো বড় দায়। নিশিদিন ব্যাকুল হয়ে রয় শুধু মহব্বতের মধুর ভাবনায়। আরো দুরহ কিছু ভাবনা যুক্ত হলো গত রাতে। সৎ ভাই আরশান সর্বত্র বৈরীতার বি’ষবাষ্প ছড়াচ্ছে। আজকের প্রভাতেই রাকিন গুপ্তচর নিযুক্ত করেছে। আরশানের প্রতিটি পদক্ষেপ যেনো পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এই শেষ বিকেলেও দরবারে ব্যস্ত শাহ্জাদা রাকিন। হঠাৎ এক পায়রা এসেছে দরবারের বাইরের আঙ্গিনায়। পায়রার ঠোঁটে একটি চিরকুট। এ দৃশ্য দেখে রাকিন দরবার ত্যাগ করেছে মহব্বতের উচ্ছ্বাসে। শাহ্জাদাকে দেখে চিরকুট রেখে উড়ে গেছে পায়রা। এ যে তারই চিরকুট সেটা শাহ্জাদা উপলব্ধি করেছে ক্ষনিকেই। তড়িৎ হস্তে চিরকুট ঢুকিয়ে নিয়েছে পকেটে। পাঠের সুযোগ হয় নি। এখনো কয়েকজন ফরিয়াদী আছে দরবারে। তাদের ফরিয়াদ শুনে রাজাকে বিচারকার্যে সাহায্য করতে হবে। চিঠি পড়ার অবকাশ কোথায়!
………….

সাঁঝ এসেছে আঁধারের চাদর নিয়ে। প্রেয়সীর চিরকুট পাঠ করেছে রাকিন। জবাব কিছুই দেয়া হয় নি আজ। সাঁঝের পরে আঁধারে ঘনীভূত হয়। পায়রা পথ ভুলে গন্তব্য হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই জবাব প্রদান করা হয় নি আজ। শাহ্জাদী তো রবে প্রিয়তমর পথ চেয়ে।

চলবে