প্রাসাদকথন পর্ব-১০

0
64

#প্রাসাদকথন
পর্বঃ১০
#সুলতানা_তানি

ছোট-বড় প্রদীপের লেলিহান শিখায় আলোকিত বাহার রাজপ্রাসাদ। ঘনকালো মেঘও যেনো আঁধার কে’টে আলোকিত হবে এমন দীপশিখার সান্নিধ্যে এলে। প্রাসাদের সকল আঁধার ঘুচতে পারলেও এসব দীপশিখা আঁধার ঘুচতে পারে নি দু’রাজকন্যার হৃদয় থেকে। লেলিহান শিখার মতোই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে তাদের হৃদয়ে চুপিসারে। এ অগ্নিশিখা ভস্মীভূত করতে চায় নওশাদকে। আজকের সাঁঝে হৃদয়ের সুপ্ত ব্যথার কথা জানাচ্ছে দু’বোন গোপনে। শাহ্জাদী নওরা করুন সুরে মলিন বদনে বড়বোন নেহেরিনকে বলছে–“জানেন নেহেরিন আপু, নওশাদ ভাই যখন আপনাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেছিলো তখন আব্বা চাইলে ওনার বিচার করতে পারতো! উল্টো ওনার আবদারে আব্বা আমায় বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো!”

নেহেরিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীর কণ্ঠে জবাব দিয়েছে–“নওশাদ ভাই আমাদের রাজ্যের একমাত্র রাজপুত্র। আব্বা চাচ্ছেন আমাদের বংশের হাতেই রাজ সিংহাসন থাকুক। আব্বার পরে নওশাদ ভাই ছাড়া তো আমাদের বংশে আর কোনো পুরুষও নেই। তাই আব্বা ওনার
সকল আবদার মেনে নিয়েছে। আব্বা আমাদের চেয়েও সিংহাসনকেই বেশি ভালোবাসে নওরা।”

“তার জন্য আপনার বেঈমান প্রেমিকের সাথে আমায় বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যাবে! নওশাদ ভাইয়ের অবাধ্য,এলোমেলো জীবন তো আব্বা প্রতিনিয়ত দেখে যাচ্ছে। শুধু বংশীয় রাজত্ব ধরে রাখার চিন্তায় আব্বা নওশাদ ভাইয়ের হাতে আমায় কো’রবানি দিতে চাচ্ছে। এটা কিন্তু আমার সাথে চরম অন্যায় করা হচ্ছে আপু!”(আফসোসের সুরে)

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সমঝদারের মতো করে নেহেরিন বলছে–“শোন নওরা, আমাদের তিন বোনকে ভীনদেশী রাজপুত্রদের সাথে বিয়ে দিতে পারতো! সেক্ষেত্রে এই বাহার রাজ্যে আমাদের প্রভাব কমে যেতো। আব্বা এমনটা চান নি। আব্বা চেয়েছেন অন্তত তার এক মেয়ের বিয়ে হোক ভবিষ্যত রাজা নওশাদের সাথে! রানী হলে তার মেয়ের হাতেও বিশেষ কিছু ক্ষমতা থাকবে।”

“আমি ক্ষমতা চাই না নেহেরিন আপু।”

“এসব বলে কি লাভ হবে নওরা! সিংহাসন,রাজ্য,রাজনীতিতে ক্ষমতাই সবকিছু রে! আমাদের হৃদয়ের গোপন কথাগুলো প্রাসাদকথন হয়ে প্রাসাদের অন্দরেই থেকে যাবে।”(ভারী কণ্ঠে)

“আব্বার পরে আপনি বাহার রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করতে পারবেন না আপু? তাহলে নওশাদ ভাইয়ের আর কোনো প্রয়োজন ছিলো না।”

“তুই এখনো অনেক কিছু বুঝিস না রে নওরা! আমি শাসক হতে গেলে নওশাদ ভাই প্রজাদের নিয়ে বিদ্রোহ করবে।”

“আমরা নওশাদ ভাইকে মে’রে ফেলবো নেহেরিন আপু! তখন প্রজাদেরকে নিয়ে কেউ বিদ্রোহ করতে আসতে পারবে না। আপনি সহজেই সিংহাসনে বসে রাজকার্য পরিচালনা করতে পারবেন!”

“না রে! আমায় শুধু রানী করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। নওশাদ ভাইকে রাজকার্য পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। রাজকীয় অভিজ্ঞতাও আছে ওনার। আমার কোনো প্রশিক্ষণ,অভিজ্ঞতা কিছুই নেই। আমি শাসনভার গ্রহণ করলে শাসনকার্যে ত্রুটি হতে পারে। সেক্ষেত্রে শত্রুরা আক্রমণ করে সহজেই বাহার রাজ্য দখল করে নিয়ে যাবে।তাছাড়া নওশাদ ভাইকে মে’রে ফেললে আমাদের বংশের রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে। নিজ বংশের তো ক্ষতি আমরা করতে পারি না!”

“আপনিও তো দেখছি শুধু রাজ্যের কথাই ভাবছেন। আমার কথা তো একটুও ভাবছেন না। নওশাদ ভাইকেই আমায় স্বামী হিসেবে মেনে নিতে বলছেন নাকি?”

“না, ওনাকে সাজা দেবো, কঠিন কোনো সাজা।”

“ঠিক আছে। আমি আসছি!”

” শোন, রাত-বিরাতে রাকিনের সাথে দেখা করতে হবে না তোকে। মহব্বত শুধু মনের ব্যাপার নওরা, দেহের নয়।”

নওরা প্রতিবাদী স্বরে সচকিত ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছে–“আমাদের মহব্বত মনেরই মহব্বত নেহেরিন আপু।”

“ওহ্।”
“আচ্ছা নেহেরিন আপু, আমি যে রাতে শাহ্জাদার সাথে সাক্ষাত করেছি এটা আম্মিকে জানিয়ে দিয়েছেন?”(উৎকণ্ঠিত ভঙ্গিতে)

“না,জানাই নি। আম্মি জানলে তোকে তিরস্কার করতো!”

“তাহলে সকালে যে নওশাদ ভাইয়ের ওখানে আম্মিকে পাঠিয়েছেন!”

“নওশাদ ভাই আম্মিকে ভয় পায়। তোকে যেনো কোনো কারণে উনি বকা দিতে না পারেন,সেই উদ্দেশ্যেই আম্মিকে পাঠিয়েছিলাম। ”

নওরা অনুরোধের সুরে উদ্বেগের সাথে নেহেরিনকে বলছে–“শাহ্জাদা রাকিনের সাথে মধ্যরাতে মোলাকাতের ব্যাপারটা আম্মিকে বলে দিয়েন না আপু! আরশান তো চিঠিতে কয়েকজনকে কো’রবানি করার হু’মকি দিয়েছে। আর একবার,শুধু আরেকবার মোলাকাত করে শাহ্জাদাকে সবকিছু জানাতে চাই।”
………….

প্রগাঢ় আঁধারের মাঝে জ্বলজ্বল করছে বাহার রাজপ্রাসাদ। নিঝুম মধ্যরাত নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। রাজপুত্র রাকিনের নিকট থেকে চুপিসারে চিঠির জবাব আসে নি। তাই মোলাকাতের বাসনায় ব্যাকুল না হয়েই নিদ্রিত হয়েছে নওরা।শাহজাদী কি জানতো যে রাকিন আসবে! জবাব না পেয়ে নিরবচ্ছিন্ন নিদ্রায় মগ্ন সে। রাকিন এসেছে প্রাসাদের অদূরে। নিশির তমসা তার আগমনকে নিবৃত্ত করতে পারে নি। অদূরে থেকেই বাঁশি বাজাচ্ছে শাহ্জাদা বারংবার। শাহ্জাদী তো গভীর নিদ্রায় মগ্ন। বাঁশির সুর ছুঁতে পারে নি ঘুমন্ত রাজকুমারীর হৃদয়কে। আজ একাকী আসে নি রাকিন। সাথে রয়েছে দুজন দেহরক্ষী। বহুক্ষণ ধরে ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষমান রয়েছে শাহ্জাদা। মধ্যরাতও পেরিয়ে যাচ্ছে আপন ছন্দে। নিজ রাজ্যে ফিরে যাবে শাহ্জাদা! নাহ্, এক দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো শাহ্জাদার খেয়ালী মনে। রহস্যেঘেরা ভঙ্গিতে ফি’স’ফিসিয়ে খানিক আলাপ হলো দেহরক্ষীদের সাথে। ওরা সন্তর্পনে প্রাসাদের নিকটবর্তী গাছে আরোহণ করেছে। চুপটি করে লুকিয়েছে নিজেদেরকে গাছের শাখার আড়ালে। সেখানে লুকায়িত হয়েই বাহার রাজপ্রাসাদের লৌহ দরজায় দু’বার তীর ছুঁড়েছে। তীর বি’দ্ধ হয় নি লৌহদ্বারে। কিন্তু ঝনঝন আওয়াজ হলো লৌহদ্বার কাঁপিয়ে। সকল প্রহরী তটস্থ হয়ে ছুঁটে গেছে সেথায়। প্রাসাদের পশ্চাৎ ক্ষণিকেই হলো প্রহরীশূন্য আর নিরাপত্তাহীন। রাকিন সেই অংশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করেছে প্রাসাদে। প্রেয়সীকে দেখার বাসনায় অতৃপ্ত হৃদয় আজ ভীষণ ব্যাকুল। বাতায়ন বেয়ে দোতলার বারান্দায় উঠে গেছে শাহ্জাদা। ভীষণ উল্লাসে উল্লসিত হৃদয় নিয়ে কড়া নেড়েছে নওরার দরোজায়। গোপনে বেজেছে সে কড়া চুপিসারে। নিদ্রিত শাহ্জাদীর নিদ কে’টে গেছে কড়ার খট খট শব্দে। তন্দ্রার ঘোর কিন্তু এখনো পুরোপুরি কা’টে নি। তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসু স্বরে শাহ্জাদী শুধিয়েছে–“কে? কে ওখানে?”

হৃদয়ে জড়ানো অনুভূতিকে সঙ্গী করে ফি’স’ফিসিয়ে জবাব দিয়েছে শাহ্জাদা–“আমি রাকিন!”

লাফিয়ে উঠেছে শাহ্জাদী শয্যা ছেড়ে। ভয়,সংশয় আর শিহরণে মগ্ম হৃদয় ভীষণ কম্পমান। চরম হতবাক চিত্তে দৃঢ় হাতে দোর খুলে দিয়েছে শাহ্জাদী। প্রেম প্রেম নেশার মনরাঙা খুশিতে কক্ষে প্রবেশ করেছে রাকিন। অসীম বিস্ময় এখনো নওরার বদনে। ভয় আর সংশয় জড়ানো উদাস কণ্ঠে প্রশ্ন করেছে–“আপনি!”

“তুমিই তো মোলাকাত করতে চেয়েছো!”–মৃদু পায়ে শয্যার দিকে এগোতে এগোতে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই বিব্রত ভঙ্গিতে হতবাকের সুরে শাহ্জাদী বলছে–“তার জন্য একদম আমার কক্ষে চলে আসবেন!”

শাহ্জাদীর প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে রাকিন ধপাস করে শুয়ে পড়েছে মখমলের বিছানায়। নওরা চমকে গিয়ে বিস্ময়সূচক ভঙ্গিতে বলছে–” আপনি আমার বিছানায় শুয়ে পড়লেন কেনো?”

“তুমি এখনো একবারও কিন্তু বসতে বলো নি। আমি ভাবলাম বসতে না বললে হয়তো শুতেই বলবে। তাই শুয়েই পড়লাম!”–দুষ্ট স্বরে মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে শাহ্জাদা।

শাহ্জাদার বদনে আড়চোখে চেয়ে ধীর পায়ে আলমারির নিকট এগিয়ে গিয়েছে নওরা। বইয়ের ভাঁজ খুলে হাতে নিয়ে এসেছে আরশানের চিঠি। হাত বাড়িয়ে শাহ্জাদাকে চিঠি এগিয়ে দিচ্ছিলো সযত্নে। তীব্র শীতে বহুক্ষণ বাইরে অপেক্ষমান থেকে শীতল হয়ে গিয়েছে রাকিন। নওরার হাত ছুঁয়ে শীতল পরশ বুলিয়ে দিতে চেয়েছিলো শাহ্জাদা। হঠাৎ দ্বিধার ঘোরে শাহ্জাদী সরে যাচ্ছিলো পশ্চাতে। রাকিনও হাত ধরে কাছে রাখতে চেয়েছে শাহ্জাদীকে। আচানক হ্যাঁচকা টানে যেনো স্রোতের ন্যায় নওরা এসে আছড়ে পড়েছে শাহ্জাদার বুকে। ভালোলাগার পরশে রাকিন ক্ষণিকেই জড়িয়ে নিয়েছে প্রেয়সীকে বাহুডোরে। সহসা আলিঙ্গনে কিছু ভয় আর কিছু খুশির নতুন অনুভূতি এসেছে মনের গহীনে। যেনো তুলতুলে নরম এক পরশে ছুঁয়ে গেছে হৃদয়। সেইসব অনুভূতিকে হেলায় পাশ কাটিয়ে শাহ্জাদী মৃদু রাগান্বিত কণ্ঠে বলছে–“এই, কি করছেন? ছাড়ুন! ছাড়ুন আমায়!”
“এ বুকে মেহমান হয়ে এসেছো এখন! থাকো না আরো কিছুক্ষণ!”–ফি’সফিসিয়ে আদুরে কণ্ঠে জবাব দিয়েছে শাহ্জাদা। নওরার হৃদয় যেনো দুলছে এখন রঙধনুর রঙিন দোলায়। শাহ্জাদার বুক থেকে উঠে যাবার অভিপ্রায়ে মেয়েটি বলছে–“এই চিঠিটা আপনাকে দেখাতেই আজ মোলাকাত করতে চেয়েছি। আগে আরশানের এই চিঠিটা পড়ুন না!”

“কার চিঠি?”–বিস্ময়সূচক কণ্ঠে প্রশ্ন করে রাকিন বাহুডোর থেকে মুক্ত করে দিয়েছে নওরাকে। গম্ভীর ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠে বসেছে বিছানায়। চিঠির ভাঁজ খুলে চোখ বুলাতেই তীব্র ক্ষো”ভ আর বিরক্তির ছাপ এলো চেহারায়। বিড়বিড় করে ক্রোধান্বিত স্বরে বলছে–“এতোটা হুশিয়ার করা সত্ত্বেও আমার মেহবুবার পেছনেই লেগে আছিস! তুই আমায় কো’রবানিও করতে চাস আরশান!”

শাহ্জাদীর বোধগম্য হয় নি এ বিড়বিড় কথন। কৌতূহলী কণ্ঠে অনুরোধের সুরে প্রশ্ন করেছে–“কি বললেন? বুঝি নি।”

“পরে একদিন কথা বলবো। আজ তাহলে আসি!”–বলেই শাহ্জাদা মলিন বদনে প্রস্থান করছিলো দ্রুত পায়ে। এক আকাশ ক্ষো’ভের আঘাতে ক্ষু’ব্ধ তার বদন।

“আরেকটু থাকুন না!”– হৃদয় ছোঁয়া আবদারের সুরে অনুরোধ করেছে শাহ্জাদী।

“ভালো লাগছে না কিছু আমার! আরশানের মুখোমুখি হতে চাই।”–কদম থমকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাহ্জাদা জবাব দিয়েছে।

“এই রাতে তো আর আরশানের মুখোমুখি হবেন না! আরো কিছুক্ষণ থাকুন না এখানে!”–মোহনীয় বদনে মনোহর সুরে থাকার অনুরোধ করছে প্রেয়সী। হঠাৎ যেনো এক মধুর মহব্বতের মায়া এসেছে শাহ্জাদার হৃদয়ে। নয়নের ক্ষোভ আর বদনের বিতৃষ্ণা ক্ষণিকেই হারিয়েছে দূরে। শাহ্জাদা মৃদু পায়ে সচকিত ভঙ্গিতে এসে বসেছে বিছানার পাশে। শাহ্জাদীও চুপটি করে বসে পড়েছে নিকটেই। ক্ষণিকের নীরবতায় নিস্তব্ধ হয়ে আছে পুরো কক্ষ। নীরবতা ভেঙে প্রণয়ের ছন্দ ফেরাতে চায় শাহ্জাদী। তাই শীতল কণ্ঠে আহ্লাদী সুরে নওরা শুধিয়েছে–“আমি আপনার মন খা’রাপ করে দিলাম! তাই না?”

খেয়ালী মনে বেখেয়ালি দৃষ্টিতে শাহ্জাদা চেয়েছে প্রেয়সীর বদনে। বাকহীন বদন, স্থির চাহনি তার। নওরা মৃদু লাজে দুষ্টস্বরে প্রশ্ন করেছে–“মহব্বতের মোলাকাতে এসে চুপ হয়ে থাকলে হবে?”

“আজ তুমিই বলো না! আমি শুধু শুনবো।” (উদাসীন ভঙ্গিতে)

“আমার চিঠির জবাব দেন নি কেনো আপনি?”(অভিমানী সুরে)
“সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো তো! চিঠি পাঠালে পায়রা পথ ভুলে গন্তব্য হারিয়ে ফেলতে পারতো!”
“চিঠির জবাব দেন নি। আপনার এখন সাজা হওয়া উচিত।”
“আমার সাজা তো হয়ে গেছে!”
“কিভাবে?”
“এই শৈতী হাওয়ায় অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছো। কতভাবে বাঁশি বাজালাম। একবার সাড়াও তো দাও নি। এর চেয়ে বেশি আর কি সাজা আছে বলো!”
“দুঃখিত, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তো! তাই বাঁশির সুর শুনতে পাই নি।”
“এবার আপনারই সাজা হওয়া উচিত মহারানী!”
“কি সাজা দিতে চান জাহাপনা?”
“এই যে আমি ভীষণ শীতল হয়ে আছি। আমায় ঊষ্ণ আলিঙ্গন করতে হবে আপনাকে।”
“ইশশ্, বিশাল আবদার নিয়ে এসেছেন!”

“আবদারই তো! এটা আমার বাপ,ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি। বলতে গেলে আমার নিজেরও অঘোষিত শ্বশুর বাড়ি। আমি এ বাড়ির অঘোষিত জামাই হয়ে রয়েছি। এবার আপনি জামাই আদর করুন তো! বেশি বেশি মহব্বতও করুন।”
“আমি ওসব করতে জানি না। আপনার এসব আবদার-টাবদার নিয়ে আপনি চলে যান তো এখন!”
“চলেই তো যেতে চেয়েছিলাম! জোর করে আপনি রেখে দিলেন! এখন বেশি বেশি মহব্বত না করলে তো যাবো না।”

“মহা মুসিবতে পড়লাম তো!”
“আমায় আদর করে মুসিবত মুক্ত হয়ে যান না তাড়াতাড়ি!”
“নওশাদ ভাই টের পেলে আমাদের দুজনকেই মে’রে ফেলবে।”
“নওশাদ ভাই আমাদের দুজনের মাঝে আসতে পারবে না।”–গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিয়েছে রাকিন।

শাহ্জাদী ভীষণ উৎসাহী ভঙ্গিতে আগ্রহের সাথে বলেছে–“জানেন, আজ সকালে নওশাদ ভাই আমায় ডেকে নিয়েছিলো। আমায় জিজ্ঞেস করেছিলো আমি এতো খুশি খুশি হয়ে থাকি কেনো?”

“তো কি বললেন?”
” আমি বলেছিলাম খুশি থাকাই তো ভালো। আমার লকেট নিয়েও ওনার মা প্রশ্ন তুলেছিলো। পরে আমি সব কা’টাতে পেরেছি।”
“খুব ভালো। যে ঘটনাই হোক সব বার্তা পায়রা দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। আসন্ন যেকোনো বিপদ সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ অবগত করবে।”
“ঠিক আছে।”
“আমার মহব্বত তোমার সাথে রয়েছে। ইনশাআল্লাহ কেউ কিছু করতে পারবে না।”
“আমার না ভয় হয় নওশাদ ভাইকে! নওশাদ ভাই যেকোনো ক্ষতি করে দিতে পারে!”
“এই মেয়ে এই, তোমার এই কলের গান থামাবে! কখন থেকে নওশাদ নওশাদ নামে গান গেয়েই যাচ্ছো!”–তীব্র মেজাজে ক্ষু’ব্ধ বদনে শাহ্জাদা ধ’মক দিয়েছে নওরাকে। সহসাই কক্ষ জুড়ে নেমে এলো নিস্তব্ধ নীরবতা। শাহ্জাদী শুকনো ঢোক গিলে নির্বাক রয়েছে অবনত দৃষ্টিতে। আচানক ক্ষোভের সুপ্ত তেজে শাহ্জাদা উঠে দাঁড়িয়েছে দৃঢ় ভঙ্গিতে। শাহ্জাদীর দৃষ্টি অভিমানী,নির্বিকার ভঙ্গি। শাহ্জাদা মৃদু হেসে আবেগঘন কণ্ঠে বলছে–” আমায় বিদায় দেবে না?”

অভিমানী দৃষ্টি নিয়েই শাহ্জাদী উঠে দাঁড়িয়েছে বিদায় দেবার অভিপ্রায়ে। প্রেয়সীর এ অভিমানী দৃষ্টি শাহ্জাদার হৃদয়ে প্রণয়ের উন্মাদনা এনে দিয়েছে। মখমলি অনুভূতিরাও হৃদয়জ উন্মাদনার সঙ্গী এখন। সুখের আবেশে ভালোবাসার পরশ দিতে উন্মুখ শাহ্জাদা। ধীর পায়ে নিকটে এসে নওরাকে আলিঙ্গন করেছে ভালোবাসার চাদরে। বাহুডোরে নিয়ে চু’ম্বন এঁকেছে লালাটে। হৃদয়ের সব ছন্দ আজ মিলেমিশে একাকার নতুন ভালোবাসার পরশে। আচানক ভালোবাসার ছোঁয়ায় সুখের রঙে লাজরাঙা হচ্ছে শাহ্জাদীর দু’কপোল। কপোল থেকে ওষ্ঠ সরিয়ে রাকিন ফি’সফিসিয়ে আবেগী কণ্ঠে বলছে–“আজ হৃদয়ের কথাগুলো শুনে রাখো না! আবার কবে মোলাকাত হয় আমাদের!”

“বারবার মোলাকাত হোক আপনার সাথে!”–ইষৎ লাজে লাজনম্র ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছে নওরা। সে লাজেই প্রেমিকের বাহুডোর থেকে মুক্ত হবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায়ও মগ্ন মেয়েটি। আলিঙ্গনে রাখা প্রেয়সীকে ধীরে ধীরে মুক্ত করে রাকিন মৃদু হেসে বলছে–“আজ তাহলে আসি! আবার মোলাকাত হবে।”

নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার মাঝে নির্ঘুম প্রহরায় মগ্ন প্রাসাদের প্রহরীরা। গাছের শাখার আড়ালে লুকায়িত হয়ে অপেক্ষমান ছিলো শাহ্জাদার দেহরক্ষীদ্বয়। প্রাসাদের আলোয় বারান্দায় শাহ্জাদার উপস্থিতি শনাক্ত করতে পেরেছে ওরা। কাঁধের পুঁটলি থেকে নতুন তীর নিয়ে আবারও ছুঁড়েছে প্রাসাদের লৌহদ্বারে। সেথায় ঝনঝন আওয়াজ হতেই প্রহরীরা ছুটে গেলো সেদিকে। এই সুযোগে রাকিন প্রাসাদ ছেড়েছে চুপিসারে।
………………
ছোট ছোট ভাবনার বিলাসী খুশির সাথে পেরিয়ে গেছে কয়েকদিন। রাকিন-নওরার ভালোবাসার লেনা-দেনা চলছে চুপিসারে। সুখের স্বপ্নগুলোও এখন নতুন ঠিকানার আশায় ব্যাকুল। ডানা মেলে উড়ছে স্বপ্নগুলো আকাশ ছোঁয়ার বর্ণিল বাসনায়। সকলের অলক্ষ্যে,অগোচরে পত্রপ্রেম চলছে নিভৃত যতনে। সেদিন বাহার রাজ্য থেকে ফিরে এসে কু’চক্রী,হিংসুটে সৎ ভাইকে ভীষণ তিরস্কার করেছিলো রাকিন। গুপ্তচরও নিযুক্ত করেছে আরশানের পেছনে। তবুও কখন,কিভাবে গোপনে রাকিনের ক্ষতি করবে সেই অভিপ্রায়ে ইদানিং পা’গলপ্রায় আরশান। আজকের এই সাঁঝে নাবিহা বারান্দায় বসেছিলো আনমনে। সম্ভার রাজপ্রাসাদের সুবিশাল বারান্দার সম্মুখভাগ এটি। নাবিহাকে দেখে আরশান এগিয়ে এসেছে হাস্যোজ্জ্বল বদনে। মনোযোগ আকর্ষণ করে এক প্রশ্ন ছুঁ’ড়েছে কৌতূহলী ভঙ্গিতে– “ভাবী, আপনার ছোটবোন নওরাকে কি শাহ্জাদা রাকিনের সাথেই বিয়ে দেবেন?”

“না তো! রাকিনের সাথে বিয়ে দেবো কেনো? নওরার তো বাগদান হয়ে আছে আমাদের শাহ্জাদার সাথে।”

“বাগদান হয়ে আছে মানে! কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে শাহ্জাদী নওরার?”

“আমার চাচাতো ভাই শাহ্জাদা নওশাদ আনোয়ারের সাথে।”

“কবে থেকে?”

“কয়েক বছর আগে থেকেই।”

“ওহ্,তাই!”

গোপন তথ্য উদঘারন করে আরশান বারান্দা থেকে প্রস্থান করেছে প্রফুল্লচিত্তে। মনে মনে ভাবছে নওশাদের সাথে হাত মেলাতে হবে। যদি আমি নওরাকে বিয়ে করতে না পারি তবে রাকিনকেও বিয়ে করতে দেবো না।
…………

নবপ্রভাতের নতুন প্রহরে পুলকিত নওরার হৃদয়। হৃদয়জ লেনা-দেনা জীবনে এনেছে নতুন উন্মাদনা। প্রভাত এলেও আজ রবিব দেখা নেই পুব আকাশে। তাই রোদেরও প্রকোপ নেই বাহার রাজপ্রাসাদের কাছে-দূরের কোনোখানে। বিষণ্ণতা কা’টিয়ে প্রণয় ছন্দে ছন্দিত নওরা এখন আর বসে থাকে না প্রাসাদকোনে। এই প্রভাতের প্রথম প্রহরেই তীর,ধনুক আর গুলতি নিয়ে প্রাসাদ ছেড়েছে নওরা। ধনুর্বিদ্যা আর গুলতি শিক্ষণে মগ্ন হয়েছে আনমনে। আচানক একটি পায়রার আগমন ঘটেছে প্রাসাদের বাইরে। সযত্নে ঠোঁটে আটকানো রয়েছে একটি চিরকুট। শিকারী দৃষ্টি তার। বাতায়ন থেকে বাতায়নে উড়ছে পায়রাটি। কাঙ্ক্ষিত প্রাপকের সন্ধান মেলাতে এখনো ব্যর্থ বার্তাবাহক পাখিটি। প্রাসাদের সব বাতায়ন উন্মুক্ত হয় নি এখনো। প্রাপকের সন্ধান না পেযে পায়রা অবস্থান নিয়েছে গাছের শাখায়। শাহ্জাদীর কেনো যেনো মনে হচ্ছে এ পায়রাটি নওশাদের কাছে এসেছে। কারণ ঘুমন্ত নওশাদের কক্ষের বাতায়নই এখনো উন্মুক্ত হয় নি। নওশাদ ভাইকে কে পাঠালো চিরকুট! কিছুটা সন্দিহান হয়েই নওরা গুলতি ছুঁ’ড়েছে পায়রাকে লক্ষ্য করে। গুলতির পাথরে আ’ঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষণিকেই পায়রা ভূপাতিত হয়েছে। চিরকুটটিও উড়ে উড়ে পতিত হচ্ছিলো ভূমিতে। নওরা দৌড়ে গিয়ে সে চিরকুট হস্তগত করেছে পরম যতনে। সেখানে লিখিত রয়েছে —

শাহ্জাদা নওশাদ,

আপনার বাগদত্তা নওরা নানজিবা গোপনে প্রেম করছে শাহ্জাদা রাকিনের সাথে। রাত নয়,দিন নয় ওরা দুজন মিলিত হচ্ছে গোপনে। আপনার বাগদত্তাকে সামলে রাখুন। সমাপ্ত হোক এ ব্যভিচার! আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি আপনার মঙ্গল কামনা করছি।

ইতি,

আরশান মুনতাসির,
শাহ্জাদা,সম্ভার রাজ্য।

রাকিনের সাথে গোপনে পত্রপ্রেম চলছে শাহ্জাদীর। এখানে ব্যভিচার হলো কোথায়! মাত্র দু’বারই তো গোপন মোলাকাত হলো! আরশান কি করে পারলো নওশাদকে এতোটা জঘন্য পত্র প্রেরণ করতে! রাগ আর ক্ষো’ভ অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ন্যায় দ’গ্ধ করছে শাহ্জাদীর হৃদয়কে। অসীম ক্রো’ধে আগুনরঙা বদনে নওরা এসেছে নেহেরিনের কক্ষে। নেহরিন মগ্ন ছিলো আরশিতে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে হতাশার সুরে নওরা বোনকে বলছে–“জানেন নেহেরিন আপু, আরশান চিঠি পাঠিয়েছে নওশাদ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। শ’য়’তানটা এক জনমের ক’লঙ্কের কালিমা দিয়েছে আমার চরিত্রে।”

“তুই রাকিনকে বার্তা পাঠিয়ে দে।”

“এই যে আরশানের চিঠি নওশাদ ভাইয়ের পরিবর্তে আমার হস্তগত হলো! শাহ্জাদা রাকিনকে চিঠিতে এসব লিখলে সে চিঠিও যদি অন্যের হস্তগত হয়!” (ইতস্ততভাবে)

“তো কি করতে চাস?”

“একটাই উপায়, সাক্ষাৎ করা।”

“জানি না, কি করবি!”

“আপনারও কিন্তু একটা দায়িত্ব আছে নেহেরিন আপু। যখনই চিরকুট মুখে কোনো পায়রাকে প্রাসাদে দেখবেন তখনই গুলতি মে’রে ভূপাতিত করবেন। আর নতুন চিরকুট আমার হাতে এনে দেবেন!”

“ঠিক আছে।”

বোনের জবাবে তৃপ্ত নওরা দ্রুত পায়ে প্রস্তান করেছে সে কক্ষ থেকে। চিরকুটটি বইয়ের ভাঁজে গোপন রেখে মগ্ন হয়েছে দুশ্চিন্তায়। আরশান তাহলে নওশাদের ঘটনাও জেনে গেছে! গোপন শত্রুতার সীমা অতিক্রম করেছে রাকিনের সাথে। এসব ভাবনার ঘোরে রাকিনকেও ভেবে যাচ্ছিলো শাহ্জাদী। স্বপ্নের ঝিলমিল প্রজাপতিও উড়ে এসেছিলো মনের গহীনে। আচানক আবার একটি পায়রার আগমন ঘটেছে বাতায়নে। এ তো রাকিনেরই সেই প্রেম পায়রা! কি বার্তা এনেছে পায়রা সযত্নে ওষ্ঠে বহন করে!

চলবে