প্রাসাদকথন পর্ব-১১

0
50

#প্রাসাদকথন
পর্বঃ১১
#সুলতানা_তানি

আচানক আবার একটি পায়রার আগমন ঘটেছে বাতায়নে। এ পায়রা তো রাকিনেরই সেই প্রেম পায়রা! কি বার্তা এনেছে পায়রা সযত্নে ওষ্ঠে বহন করে! শাহ্জাদী চিরকুট হাতে নিয়ে খুলেছে সন্তর্পণে। সেথায় লেখা রয়েছে—

প্রেয়সী নওরা,

চাঁদ-তারা ভরা এক রাতে, রইবো না আর তফাতে। সানাইয়ের সুরে মিলনের বাঁশি বাজিয়ে হারাবো দুজন দুজনাতে। ভাগ্যে কি সইবে এসব! বড় নিষ্ঠুর নিয়তি যে আমার! তুমিও তো বিছিয়েছো ইন্দ্রজাল। হৃদমাঝারে থেকেও কেনো রয়েছো এতো দূরে! হৃদয়ের আয়নায় দেখে,স্বপ্নের আল্পনায় এঁকেও কেনো ছুঁতে পারি না তোমায়! যদি পাখি হতাম আমি, উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে দেখে যেতাম তোমায়! জানি না কেনো নিশিদিন তোমায় ভাবে আমার এ অবাধ্য মন! ভীরু ভীরু লাজে তোমার এই চুপিচুপি মোলাকাত পা’গল করেছে আমায়। এ চুপিচুপি মোলাকাত,এ ভীরু ভীরু লাজ আর এ দিবানিশি প্রতীক্ষার কবে হবে অবসান? এক নদী দূরত্ব তোমার আমার, তবু কেনো মনে হয় আলিঙ্গনেই রয়েছো তুমি আমার!
ইতি,
তোমার মেহবুব
রাকিন মুনতাসীর

আজ আর প্রেমের পরশ নেই নওরার হৃদয়ে। আরশানের দেয়া ব্যভিচারের ব’দনাম হৃদয়ের সুপ্ত ক্রো’ধানলে যেনো নাড়া দিয়েছে গুপ্তভাবে। ক্রো’ধের অনলে দ’গ্ধ হয়ে প্রেমরঙ যেনো বিবর্ণ হয়েছে গোপনে। রাকিনকে চিঠি লিখতে গিয়ে বারবার ভাষা হারিয়েছে নওরা। অবশেষে তড়িঘড়ি করে শক্ত হাতে নিমিষেই লিখে দিয়েছে–

শাহ্জাদা রাকিন,

আজ এবং আজই মোলাকাত করবেন আমার সাথে। আমি প্রাসাদেই থাকবো।
ইতি,
নওরা নানজিবা

চিরকুট নিয়ে পায়রা উড়ে গেছে পাখা ঝাপটিয়ে।

…………..
প্রাতরাশ শেষে রাকিন ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছিলো নিজ কক্ষে এসে। সহসাই কক্ষের উন্মুক্ত বাতায়নে প্রেম পায়রার উপস্থিতি ঘটেছে। রিমঝিম বর্ষার ছন্দের মতো সুখের ছন্দ এসেছে শাহ্জাদার হৃদয়ে। চিঠি রেখে উড়ে গেছে পায়রা পত পত করে। বাঁধভাঙা প্রেমের অনুভূতি নিয়ে চিরকুট খুলেছে শাহ্জাদা। আবারও মোলাকাতের আহ্বান করেছে শাহ্জাদী! শাহ্জাদা রাকিন ভাবছে এমন রসকষহীন চিঠি কেনো এলো! আরশান কি আজও চিরকুট পাঠিয়েছে বাহার রাজ্যে! চিরকুট কি নওশাদের হাতে পড়েছে! নওশাদ আবার ঝংকার তুলে যুদ্ধের দামামা বাজাবে না তো! দু’রাজ্যের মাঝে যুদ্ধ হলে সেক্ষেত্রে আরশানও সমানভাবে দায়ী থাকবে। চুপিচুপি গতিবিধি পর্যবেক্ষণে আরশানের পেছনে গুপ্তচর নিযুক্ত করা হয়েছে। ওর ভবিষ্যত উদ্দেশ্য সম্পর্কেও ভালোভাবে জানা উচিত। এসব ভেবে ধীর চিত্তে শাহ্জাদা ডেকেছে এক বিশেষ রাজ সভাসদকে। প্রতিটি রাজসভায় সভাসদ হিসেবে যেমন মন্ত্রী, সেনাপতি থাকেন তেমনি কবি, সাহিত্যিক,জ্যোতিষী,চিকিৎসক,দোভাষী,কবিরাজও উপস্থিত থাকেন। ভীষণ উদ্বেগে উদ্বিগ্ন রাকিন আজ ডেকেছে রাজসভার জ্যোতিষীকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে অপেক্ষমান রয়েছে শাহ্জাদা। বৃদ্ধ জ্যোতিষী শাহ্জাদার কক্ষে প্রবেশ করেছে উৎকণ্ঠিত বদনে। শাহ্জাদা বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে বসার অনুরোধ করে জ্যোতিষীকে বলছে– “জ্যোতিষ বাবা, আমি একটি বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত।”

“বলুন শাহজাদা।”

“আমার সৎভাই আরশান সম্পর্কে জানতে চাই। ওর কারণে কি রাজ্য কিংবা রাজপরিবারের কোনো ক্ষতি হতে পারে?”

জ্যোতিষী মাথা নিচু করে অপারগতার সুরে বলেছে–“আমায় মার্জনা করবেন শাহজাদা! আমি এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারবো না!”

“কেনো জানাবেন না জ্যোতিষ বাবা? আপনি কি রাজ্যের মঙ্গল চান না?”

“আপনি আমায় ক্ষমা করুন শাহ্জাদা। বয়সে আপনি আমার পুত্রের মতো। দয়া করে আমার অপরাধ নেবেন না।”

“কি এমন সমস্যা জ্যোতিষ বাবা? কেন বলছেন না আরশান সম্পর্কে? রাজ্যের মঙ্গলের জন্যই তো আপনাকে নিযুক্ত করা হয়েছে!”–বিরক্তির সুরে।

“আপনি যথার্থই বলেছেন শাহ্জাদা। তবে আমি নিরুপায়। কারণ আরশান আপনার চেয়ে বয়সে এক বছর কয়েক মাসের ছোট। তাই শৈশবের একটি দুর্ঘটনা সম্পর্কে হয়তো আপনি অবগত নন।”

রাকিন কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসুস্বরে প্রশ্ন করেছে–“শৈশবের কোন দুর্ঘটনা জ্যোতিষ বাবা?”
জ্যোতিষী মলিন বদনে করুন কণ্ঠে বলছে–“আপনার বাবার রাজসভায় একজন জ্যোতিষী ছিলেন, যিনি অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যতের অনেক গোপন কথা বলতে পারতেন। শৈশবে যেদিন আরশানকে প্রথমবার প্রাসাদের বাইরে বের করা হয় সেদিন জ্যোতিষী কিছু কথা বলেছিলেন। আপনার বাবা মহারাজ তারিক মুনতাসিরকেই কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। রাজপুত্র আরশানকে নিয়ে অপ্রিয় কথা বলায় আপনার বাবা হ’ত্যা করেছিলেন সেই জ্যোতিষীকে। আমি চাই না আমার জীবনেও ঐরকম কোনো ঘটনা ঘটুক!”

“আপনার কোনো ভয় নেই জ্যোতিষ বাবা। নির্ভয়ে সব বলুন আমায়! আরশান সম্পর্কে কি বলেছিলো সেই জ্যোতিষী যে আব্বা তাকে হ’ত্যা করলো!”

“সে জ্যোতিষী আমাকে কিছু বলে নি। আপনার আব্বাকে বলেছিলো। তবে রাজপুত্র আরশানকে নিয়েই কোনো এক অপ্রিয় সত্য কথা বলেছিলো। আমি ঠিক কারণটা জানি না।”

শাহ্জাদা রাকিন অনুধাবন করতে পেরেছে যে রাজ জ্যোতিষী কিছু বলতে ইচ্ছুক নন। ভীষণ ভয়ে ভীত জ্যোতিষীকে বিদায় দিয়েছেন শাহ্জাদা।
……………
আকাশের চাঁদ-তারা আজ লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত। আলোর আভাস নেই ধরণীর বিস্তৃত বক্ষে। জেঁকে বসা শীতে নিঝুম মাঝরাতে প্রকৃতিও যেনো নিদ্রিত হয়ে রয়েছে। সারি সারি বৃক্ষরাজিও যেনো অনড় আজ শীতের প্রকোপে। বাহার রাজপুরীতে ঘুমপরী এসেছে অনেক আগেই। ইন্দ্রজালের খেলায় ঘুম পাড়িয়েছে সবাইকে। নেশাধরা নিদে হয়তো নিদ্রিত সবাই। কিন্তু নিদ নেই শাহ্জাদী নওরার নয়নে। তার মেহবুব রাজকুমার আসবে রাতের আঁধার কে’টে। চুপিসারে প্রেমিক আজ প্রাসাদেই আসবে প্রণয়ের আহ্বানে। নিঝুম রাতের নীরব আবহে প্রিয়তমর প্রতীক্ষায় ব্যাকুল হয়ে রয়েছে নওরা। আজ প্রিয়তম রাকিনকে আগমনের অনুরোধ করতোই না নওরা। কিন্তু আরশান যদি নওশাদের উদ্দেশ্যে আবার চিরকুট প্রেরণ করে! তবে নওশাদ যেকোনো সময় নিভিয়ে দিতে পারে দুজনের ঘরবাঁধার স্বপ্ন প্রদীপ। এ গোপন পত্রপ্রেমের যবনিকাপাতও ঘটবে চুপিসারেই। এসব ভেবে প্রণয় বাঁশির সুর বেসুরো হবার আগেই মোলাকাতের আহ্বান করেছে রাকিনকে। ভীষণ ভাবনার ঘোরে মগ্ন হওয়ার ক্ষণেই কানে বাজলো লৌহদ্বারের ঝনঝন আওয়াজ। তবে কি রাকিনের রক্ষীরাই তীর ছুঁ’ড়ছে সবার অগোচরে! আজও বারন্দা থেকে কড়ার আওয়াজ হলো চুপিসারে। ইষৎ লাজেরাঙা আদুরে কণ্ঠে শাহ্জাদী শুধিয়েছে–“কে?”
“শাহ্জাদা রাকিন মুনতাসির।”–আওয়াজ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই দোর উন্মুক্ত করে দিয়েছে শাহ্জাদী শক্ত হাতে। জোর কদমে কক্ষে প্রবেশ করেই শাহ্জাদা নিঃশব্দে বন্ধ করেছে কক্ষদ্বার। রহস্যময় বদনে মৃদু হেসে নওরাকে আলিঙ্গন করেছে পরম খুশিতে। কপালে চু’মু খেয়ে ফি’সফিসিয়ে বলেছে–“গতকালই তো এলাম! আজ কেনো আবার আসতে অনুরোধ করেছো?”

প্রেমিকের বাহুডোরে থেকেই হাত উঁচিয়ে আরশানের চিঠিটি দিয়েছে নওরা। শাহ্জাদীকে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে রাকিন মনোযোগ দিয়েছে চিরকুটে। পত্রপাঠ শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মলিন বদনে বলতে শুরু করেছে–“আরশান ভীষণ অবিশ্বাসী। কসম দিয়েছে ও আর আমাদের মাঝে ঝামেলা করবে না। তারপরেও তোমার পিছু ছাড়লো না!”

রাকিনের কথা শেষ হবার পূর্বেই নওরার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। রানী ডাকছেন তার রাজকন্যাকে। কি করবে এখন নওরা! প্রাসাদের লৌহদ্বারে তীরের ঝনঝন আওয়াজে নিদ কে’টে গিয়েছে রানীর। দু’রাজকন্যার খোঁজ নিতে তিনি বের হয়েছিলেন ধীর পায়ে। রাজা তো রয়েছেন গভীর নিদে। রানী কক্ষ থেকে বের হতেই সাক্ষাৎ হয় বৃদ্ধা ফুফু শাশুড়ির সাথে। ইনি হচ্ছেন সেই বৃদ্ধা যিনি নওরাদের সাথে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন সম্ভার রাজ্যে। তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের অভিপ্রায়ে জাগ্রত হয়েছিলেন বৃদ্ধা। সালাত শেষে হঠাৎ ঝনঝন আওয়াজ হলো প্রাসাদ তোরণে। বৃদ্ধা থাকেন প্রাসাদের পশ্চাতের একটি কক্ষে। প্রহরীরা পশ্চাত থেকে প্রাসাদের সম্মুখে ছুটে গিয়েছিলো। বৃদ্ধা পর্দার আড়াল হতে চুপিচুপি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন প্রাসাদের পশ্চাতে। রাকিনকে দেখেই তার দৃষ্টি থমকে যায় অজানা দুর্ঘটনার পূর্বাভাসে। নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলে বৃদ্ধার সাক্ষাৎ হয় রানীর সাথে। ফি’স’ফিসিয়ে রানীকে সব অবগত করেছেন বৃদ্ধা। নওরার কক্ষদ্বারে দুজনই এসেছেন একসাথে। মৃদু আওয়াজে কড়া নেড়ে যাচ্ছেন রাজকুমারীর দরজায়। নওরার ভয়ার্ত হৃদয় ভয়ে দিশেহারা। উদ্বিগ্ন বদনে কাতর কণ্ঠে ফি’সফিসিয়ে শাহ্জাদাকে আদেশ করেছে–“আপনি পালিয়ে যান শাহ্জাদা, এক্ষুনি পালিয়ে যান আপনি।”

“ধরা তো আজ পড়েই গেছি। পালাবো কেনো? মুখোমুখি হতে চাই সবার।”–শাহ্জাদীকে যথোপযুক্ত জবাব দিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে রাকিন। অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে ক্ষুব্ধ বদনে কক্ষে প্রবেশ করেছে রানী আর সেই দাদী। বাকহীন রাকিন নির্বিকারই রয়েছে। তীব্র ক্ষোভে ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছেন রানী। র’ক্তিম নয়ন দুটো যেনো বেরিয়ে আসতে চায় কোটর থেকে। কক্ষদ্বার বন্ধ করে রানী মৃদু আওয়াজে রাকিনকে বলছেন–“বাহ্ শাহ্জাদা বাহ্! কোনো শিক্ষাই পাও নি রাজপরিবার থেকে? মধ্যরাতে ভীনরাজ্যের শাহ্জাদীর কক্ষে আসতে লজ্জা করলো না?”

“দুঃখিত মামী! আমি কোনো অশুভ উদ্দেশ্যে শাহ্জাদীর কক্ষে আসি নি।”

“তো! কেনো এসেছো? তুমি জানো শাহ্জাদা নওশাদ জানলে তোমায় এক্ষুনি ব’ন্দী করবে!”

“ডাকুন শাহ্জাদা নওশাদকে। ব’ন্দী করতে বলুন আমায়! আমিও মুখোমুখি হতে চাই শাহ্জাদা নওশাদের।”

রানীর ঝড়ো আওয়াজ যেনো হঠাৎ থমকে গেছে রাকিনের অবাধ্য জবাবে। ঝড়ের পূর্বাভাসে অশ্রুসজল হয়ে রয়েছে নওরার বদন। ধীর হাতে মা’কে চিরকুট বাড়িয়ে দিতে দিতে শাহ্জাদী করুন সুরে বলেছে –“এই চিরকুট আরশান পাঠিয়েছে নওশাদ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। আমি চিরকুটটা দেখাতেই শাহ্জাদা রাকিনকে মধ্যরাতে আসার অনুরোধ করেছি।”

চিরকুট হাতে নিতে নিতে বিতৃষ্ণার সাথে রানী মেয়েকে বলেছে–“দিনে আসতে বলতে পারতি না!”

“নওশাদ ভাই দেখে ফেললে!”

চিরকুটের ভাঁজ খুলে রানী চোখ বুলিয়েছে দৃঢ় চিত্তে। পাঠ শেষে ইষৎ অনুতপ্ত ভঙ্গি এসেছে রানীর বদনজুড়ে। রাকিনের বদনে চেয়ে আদেশের সুরে বলেছে–“তোমার সৎ ভাইকে সামলে রাখতে পারো না! না জেনে ব্যভিচারের ব’দনাম দিয়ে চিঠি পাঠায় কিভাবে!”

সৎ ভাইয়ের হঠকারিতার কথা ভেবে রাকিন নির্বাক রয়েছে। রানী শোভন ভঙ্গিতে আদেশের সুরে বলেছে–“শোনো বাবা, মধ্যরাতে চুপিচুপি আমার মেয়ের কক্ষে এসেছো, এই ঘটনা কাউকে জানালে তোমার সাথে আমার মেয়ের ইজ্জতও যাবে। তাই আজকের ঘটনা কাউকে জানালাম না। তবে এভাবে আর কখনো প্রাসাদে আসবে না।”

“জ্বী। আজ তাহলে আমি আসি! পরেরবার এলে প্রস্তুতি নিয়েই আসবো। আপনার মেয়েকে নিয়ে ফিরে যাবো।”

রাকিনের বীরোচিত জবাব পছন্দ হয়েছে রানীর। তিনিও মেয়ের জন্য এমনই বীরপুরুষের বন্দনা করতেন মনে মনে। হঠাৎ যেনো তার বেদনারা লুকিয়েছে ক্ষুরধার কথার ছলে। রাকিন কক্ষত্যাগে ব্যস্ত। ইষৎ মলিন বদনে একবার তাকিয়েছে অশ্রুসজল প্রেয়সীর বদনে। ধীর কদমে গ্লানি আর বেদনাকে সঙ্গী করেই কক্ষত্যাগে ব্যস্ত হয়েছিলো শাহ্জাদা। পেছন থেকে রানী ডেকেছে গম্ভীর স্বরে–“দাঁড়াও শাহ্জাদা!”

শাহ্জাদার ধীর কদম থমকে গেছে রানীর গম্ভীর আওয়াজে। পশ্চাতে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বিনয়ের সাথে শাহ্জাদা বলেছে–“জ্বী,বলুন!”

“আমার মেয়ের খুশিই কিন্তু আমার খুশি। তবে কান খুলে শুনে রাখো, যদি রাজ্য আর রাজকন্যা দুটোই জয় করতে চাও তাহলে আজই পিছু হটে যাও। ভুল করেও আমার মেয়েকে মহব্বতের ফাঁদে ফেলে বাহার রাজ্য জয়ের চিন্তা করো না। এই বাহার রাজ্য কেবল আমাদের রাজপরিবারের হাতেই থাকবে।”

“আমার এখনই অন্য রাজ্য আক্রমণ কিংবা জয় করার পরিকল্পনা নেই। তবে ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আপনাদের রাজ পরিবারের সিদ্ধান্তের উপর।”

“তুমি সব জেনেও নওশাদের মতো বাঘের ডেরায় এসেছো মহব্বতের বাসনায়। আমার মনে হয় যেকোনো অঘটন তুমি ঘটাতে পারবে।”
“ধন্যবাদ। কি করতে পারবো সেটা সময়ই বলে দেবে।”–জবাবটা দিয়েই শাহ্জাদা রাকিন জোরকদমে প্রস্থান করেছে কক্ষ। অপেক্ষমান দেহরক্ষীরা সেভাবেই তীর ছুঁ’ড়ে বিভ্রান্ত করেছে প্রহরীদেরকে। রাকিনও প্রাসাদ ছেড়েছে আশাহত হৃদয় নিয়ে। প্রেয়সীর সাথে সহসা আর হবে না মধুর মোলাকাত। রঙধনুর ন্যায় রঙিন স্বপ্নগুলো আজ নীরব হয়ে রয়েছে মনের গহীনে।
………………

কুয়াশার চাদরে ঢেকে প্রভাত এসেছে। শীত বুড়ি যেনো সবাইকে শীতল করেই রাখতে চায়। শীত বুড়িকে তুড়ি মে’রে আজ সকালে শামস্ গিয়েছে ফুফুর বাড়ি। মহাবীর সেনাপতি উদয় বেগের বাড়ি এটা। সেনাপতি সম্পর্কে ফুফা শামসদের। সম্ভার রাজপ্রাসাদের নিকটেই এই সুবিশাল বাড়িটি। ফুফু যে সকালেই রাজপ্রাসাদে চলে এসেছে, এই ব্যাপারটি শাহ্জাদার অজানা। সেনাপতি ফুফাও রাজসভার উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করেছেন। শামস্ এ বাড়িতে এসে কোনো আপনজনের সাক্ষাৎ পায় নি। কর্মচারীদের কাছ থেকে জেনেছে মাহিরা ঘুমোচ্ছে, অন্যরা রাজপ্রাসাদে রয়েছে। সকাল হয়েছে অনেক আগেই অথচ মাহিরা এখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। শামস্ বরাবরই দুষ্ট। শাহ্জাদা ভেবেছে মাহিরাকে বকা খাওয়াবো সবাইকে দিয়ে। এহেন অভিপ্রায়ে দেহরক্ষীদের নিয়ে খাটসহ মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেছে রাজপ্রাসাদে। বাবা মহারাজ তারিক একমাত্র বোনকে নিয়ে দিবসের প্রথম ভোজনবিলাসে ব্যস্ত ছিলেন। রাজপরিবারের অন্যরাও মগ্ন ছিলো প্রাতরাশেই। মাহিরাকে খাটসহ এনে সবার সামনে রাখা হয়েছে। মাহিরা এখনো অনড়ভাবে সুখনিদ্রায় মগ্ন রয়েছে। যেনো কোনো হুশ নেই মেয়েটির। শামস্ খুব আফসোসের সাথে সবার উদ্দেশ্যে বলেছে–“রাজপ্রাসাদের কাছেই যদি এমন অলস মানুষ থাকে তবে রাজ্যের উন্নতি কিভাবে হবে? কয়েক ঘণ্টা আগে সকাল হয়েছে অথচ এই অলস মেয়ে এখনো ঘুমোচ্ছে! ”

মাহিরা নড়েচড়ে দ্বিগুণ তেজ নিয়ে উঠে বসেছে শয্যায়। সুশ্রী বদনখানিতে যেনো ঈদের খুশি ঝরে পড়ছে। রহস্যের হাসি দিয়ে মৃদু লাজে সবাইকে বলছে–“আমাদের বাড়িতে গিয়ে শামস্ ভাই আমায় বিছানায় শুয়ে থাকার আদেশ দিয়েছে। উনি বলেছে তোকে এখন খাটসহ উঠিয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবো। তাহলে সবাই বুঝতে পারবে যে আমাদের মাঝে মহব্বত রয়েছে। তারপরে তাড়াতাড়ি আমাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দেবে।”

মাহিরার মুখে মহব্বতের কথা শুনে রাজাসহ উপস্থিত সবাই চোরাদৃষ্টি নিয়ে শামসের বদনে চেয়েছে। বেচারা শামসের দুষ্টুমি তার নিজেকেই দোষী বানিয়ে ছেড়েছে। স্বপ্নপূরণের কথা মুরব্বিদের জানাতে পেরে মাহিরা তো এখন স্বপ্নপুরীতে উড়ছে। আর শামস্ বেচারা শখের নারীর কূটকৌশলে বেয়াক্কেল হয়ে কক্ষত্যাগ করেছে।

চলবে