প্রাসাদকথন পর্ব-১৩

0
16

#প্রাসাদকথন
পর্বঃ১৩
#সুলতানা_তানি

আচানক যেনো মেঘের ছায়া নেমে এলো রাকিনের হৃদয় অম্বরে। নানীর এ চিঠি তীরের মতো বি’দ্ধ হলো সেথায়। আজ বুধবার। শুক্রবারই নওরার বিয়ে! কি করবে এখন শাহ্জাদা! ভীষণ বিষণ্নতা নিয়ে আবারও ছুটে এসেছে পিতার কক্ষে। মাথা নিচু করে বিনয়ের সাথে রাজাধিরাজ পিতাকে হস্তান্তর করেছে চিঠিটি। রাজা চিঠি পড়ে নিয়েছেন। এখন পড়ছেন তার মুকুট রাজকুমারের চেহারার গোপন কথাগুলো। গম্ভীর বদনে শীতল কণ্ঠে পুত্রকে বলেছেন–“কেনো যে এমন ভুল কাউকে মহব্বত করতে গিয়েছো!”

“আমি ভুল করি নি আব্বা। নওরা পরিস্থিতির শিকার। নওশাদের বিয়ের কথা ছিলো জ্যেষ্ঠ রাজকুমারী নেহেরিন আপুর সাথে। মহব্বতও ছিলো নেহেরিন আপুর সাথেই। ওনাকে ঠকিয়েছে নওশাদ। একরকম জোরপূর্বক নওরাকে বিয়ে দেবার জন্য রাজার নিকট থেকে ওয়াদা আদায় করেছে। নওরার চোখের সামনে নিত্য ব্যভিচারে লি’প্ত থাকে শাহ্জাদা নওশাদ।”—শীতল স্বরে মলিন বদনে বাবাকে জবাব দিয়েছে রাকিন।

“তাই নাকি!”

“জ্বী আব্বা।”

“আচ্ছা,তোমার ভাইদেরকে আর শাহ্জাদী নাবিহাকে ডাকার ব্যবস্থা করো তো!”(আদেশের সুরে)

তৎক্ষনাৎ তলব করা হয়েছে সবাইকে। রাকিন বিষণ্ণ চিত্তে চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছিলো পিতার কক্ষেই। খানিক বাদে বাকি রাজপুত্রদের সাথে নাবিহাও হাজির হয়েছে মহারাজের কক্ষে। নাবিহার নিকট থেকে নেহেরিন আর নওশাদের সব কাহিনী শুনেছেন রাজা। নওশাদ কর্তৃক বড়বোনকে ঠকিয়ে ছোটজনকে বিয়ে করার বাসনা সম্পর্কেও জেনেছেন। সব শুনে রাজা এখন রাকিনের প্রতি ইষৎ নমনীয়। তার এই মুকুট রাজপুত্রকে কৌতূহলী ভঙ্গিতে শুধিয়েছেন–“কি করতে চাও তুমি এখন শাহ্জাদা?”

“বাহাররাজ নওশাদকে ওয়াদা দিয়েছেন। উনি নিজে থেকে আমার সাথে নওরার বিয়ে দেবেন না। তবুও বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই। প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে তবেই যুদ্ধের ঘোষণা দেবো।”–রাকিন একশ্বাসে জবাব দিয়েছে পিতাকে।

“হুম। প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে আমরা বলতে পারবো বাহার রাজ স্বেচ্ছায় রাজকন্যা বিয়ে দিতে রাজি হয় নি। তাই আমরা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছি।”–রাজা সম্মোহনী সুরে জানাচ্ছেন পুত্রকে।

“জ্বী আব্বা।”

রাজা স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন শাহ্জাদা শামসের বদনে। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশের সুরে শাহ্জাদাকে বলেছেন–“পরশু দিনই তো শুক্রবার! আমাদের হাতে সময় কিন্তু খুব কম শামস্। তুমি আজ এবং এখনই রাকিনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাহার রাজ্যে যাবে।”

“জ্বী আব্বা।”

“প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পরপরই আমরা যুদ্ধের ঘোষণা দেবো। বিয়ের প্রস্তাব দিতে এখনই রওয়ানা হয়ে যাও বাহার রাজ্যে।”

নিজ রাজ্যের বিরুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের কথা শুনে নাবিহার শরীর যেনো বরফশীতল হয়ে গেছে। এ কেমন সম্পর্ক হতে যাচ্ছে নিজ পরিবারের সাথে! স্বামী তাসকিনকে ইশারা দিয়ে নাবিহা প্রস্থান করেছে রাজার কক্ষ থেকে। নিজ কক্ষে এসে স্বামীকে অনুরোধ করেছে কোনোভাবেই যেনো এ যুদ্ধ না হয়! তাহলে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে পিতার রাজ্যের সাথে। তাসকিন ধীরচিত্তে প্রতিবাদী কণ্ঠে নাবিহাকে বলেছে–“তাহলে রাকিন-নওরার মহব্বতের কি হবে?”

“গোল্লায় যাক ওদের মহব্বত! ওদের কারণে আমি আমার বাপের পরিবার আর শ্বশুরের পরিবারের মাঝে যুদ্ধ হতে দেবো না।”
………………

দুপুরের প্রখর সূর্যতাপে ঝিলমিল করছে নদের জল। শীতকালে নদের পানি যেনো একটু বেশি স্বচ্ছ থাকে। রোদের আলোয় ভালো লাগে স্বচ্ছ নদের এ দৃশ্য। রাকিন সকাল থেকেই ব্যাকুল চিত্তে বসে রয়েছে প্রণয় নদের তীরে। শাহ্জাদা শামস্ তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছে বাহার রাজ্যে। কখন আসবে শামস্! সেই অপেক্ষায় চাতক পাখি হয়ে পথ চেয়ে রয়েছে শাহ্জাদা রাকিন। অপেক্ষার প্রহর যে এবার শেষ হবার পালা! দূরে তাদের রাজকীয় নৌযানটি দেখা যাচ্ছে। নদের বুক চি’ড়ে নৌযানটি যেনো সগৌরবে ফিরে এসেছে। কোনো সুখবর নিশ্চয়ই আসে নি! বাহাররাজ তো কন্যাকে নওশাদের সাথে বিয়ে দিয়ে নিজ পরিবারের ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছেন। রাজকন্যাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। হয়তো বিয়ের প্রস্তাবও অনায়াসেই প্রত্যাখান করেছেন! যুদ্ধই হয়তো শেষ সমাধান হবে! রাকিনের এসব বিষম ভাবনার মাঝেই রাজতরী ভীড়েছে তীরে। হৃদয়জ উত্তেজনা কিন্তু থেমে নেই তার। ধীর কদমে শামস্ তরী থেকে নেমে এসেছে বিষণ্ণ বদনে। ভাইয়ের কাছে এসে বিষণ্ণভাবেই বলছে–“কোনো কাজ হয় নি রে! নওশাদের সাথেই শুক্রবার কনিষ্ঠ রাজকন্যার বিয়ে হবে। দু’রাজকন্যাকেই বন্দী করে রাখা হয়েছে। তোকে চিঠি প্রেরণের অপরাধে বুড়ি নানীকেও বন্দী করেছে ।”

শাহ্জাদা রাকিন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করেছে–“ওখানে যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি দেখেছিস শামস্?”

“পুরো বাহার রাজ্যের তীর ঘেরাও করে রেখেছে সৈন্যরা। রাজপ্রাসাদও ঘেরাও করে রাখা হয়েছে সৈন্যদের দিয়ে। হাজার হাজার সৈন্য প্রহরায় মগ্ন। সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে আমাদের আগেই বাহার রাজ্য সমর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।”

রাকিন আর কোনো আলাপ করে নি এ হৃদয়জ বিষম ব্যথার ক্ষণে। অশ্বারোহী হয়ে প্রাসাদে ফিরে এসেছে দু’রাজপুত্র। সম্ভার রাজ ভীষণ ব্যস্ত রাজ রাজকার্যে। দরবারে হাজির প্রজাদের ফরিয়াদ না শুনে ফিরিয়ে দেবেন না তিনি। যুদ্ধ নিয়েও আলোচনা করেছেন রাজা সভাসদদের সাথে। মলিন বদনে রাকিন এসে দাঁড়িয়েছে পিতার সম্মুখে। সম্ভার রাজও কৌতূহলী। বাহার রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে রাকিন সবকিছু অবগত করেছে পিতাকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে রাজা আশ্বস্ত করেছেন পুত্রকে–“তোমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে রাকিন। প্রজারা দরবার থেকে ফিরে গেলেই আমি সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।”

“দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আব্বা!”
“একটু তো ধৈর্য্য ধরবে!”

বাহার রাজ্য কর্তৃক বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে সকালেই। নিশ্চিন্তে পিতাকে ভরসা করে রাকিনও ত্যাগ করেছে রাজ দরবার। যমজ ভাই শামসকে নিয়ে নিজ কক্ষে এসে বিভিন্ন সমর কৌশল সংক্রান্ত আলোচনা করছে রাকিন। একইসাথে যুদ্ধবিদ্যা শিখেছে ওরা দুজন। সমরজ্ঞানও প্রায় একই রকম। কে কোনদিকে সৈন্য নিয়ে অবস্থান করবে সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হচ্ছে। চুপিচুপি বিকেল এসে গেছে ওদের এসব আলাপচারিতার মাঝে। সম্ভার রাজ নিজ কক্ষে ডেকেছেন পুত্রদেরকে। সবাই উপস্থিত হয়েছে রাজার কক্ষে। রাকিনের উদ্দেশ্যে গম্ভীর কণ্ঠে রাজা বলছেন–“শাহ্জাদা তাসকিন এবং শাহ্জাদা আরশান যুদ্ধে অসম্মতি জানিয়েছে। শুধুমাত্র শাহ্জাদা শামস্ই তোমার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত রয়েছে। অন্য দুজন শাহ্জাদার মতকে অগ্রাহ্য করে আমি তোমার জন্য যুদ্ধের ঘোষণা দিতে পারি না।”

“সকালেই তো বলেছিলেন বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। এখন এসব আপনি কি বলছেন আব্বা!”

“জিজ্ঞেস করে দেখো তোমার ভাইদেরকে। ওরা তো এখানেই উপস্থিত রয়েছে। শাহ্জাদা তাসকিন তার শ্বশুরের রাজ্যের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক নয়। শাহ্জাদা আরশানের মতে রাজ্যে প্রজাদের এখন অনেক অভাব, অনেক কষ্ট। এ দুঃসময়ে আরশান যুদ্ধকে সমর্থন করবে না। দুজন শাহ্জাদার মতকে অগ্রাহ্য করে,প্রজাদেরকে কষ্ট দিয়ে আমি তোমার মেহবুবার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি না। তাছাড়া সেনাপতি উদয় বেগও যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। শুক্রবার ওখানে বিয়ে। এতো স্বল্প সময়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সেনাপতি।”

“আমি আপনাকে ভরসা করেই ভুল করেছিলাম আব্বা!”

বিদীর্ণ হৃদয়ে মলিন বদনে রাকিন প্রস্থান করেছে পিতার কক্ষ থেকে। যমজ ভাই শামস্ তার কাঁধে হাত রেখে বলছে–“বুঝলি রাকিন, আমরা যখন প্রাসাদে ছিলাম না তখন কু’চক্রী আরশান বুদ্ধি দিয়েছে। ওর বুদ্ধিতেই আব্বা মত পরিবর্তন করেছে।”

“সেটা তো বুঝেছি! কিন্তু তাসকিন ভাই কি করে পারলো আমার বিরুদ্ধাচারণ করতে!”
“যে যাই করুক, আমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোর সাথেই থাকবো।”

খানিক থেমে রাকিন ভাইকে বলছে–“আব্বা সম্মুখ যুদ্ধের জন্য সৈন্য দেবেন না আমায়! আমাদের বাহার রাজ্যে গোপন আক্রমণ চালাতে হবে। যদি ঐ রাজপ্রাসাদের সুড়ঙ্গের অবস্থানটা জানতে পারতাম!”

“চল, আমরা নাবিহা ভাবীর কক্ষে যাই! ওনার কাছে জিজ্ঞেস করবো সুড়ঙ্গের কথা। “(শামস্)

“চল।”
………

সুড়ঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে জানতে রাকিন আর শামস্ এসেছে নাবিহার কক্ষে। তাসকিন,নাবিহা দুজনই কক্ষে। ধীর স্বরে কৌতূহলী ভঙ্গিতে রাকিন নাবিহাকে বলছে–“আমি নিশ্চিত যে আপনিই আমার বড় ভাইকে যুদ্ধে সমর্থন করতে দেন নি। এতোটা বিভাজন আমাদের ভাইদের মাঝে আগে কখনো ছিলো না। আপনি কি আপনার ছোটবোনের ভালো চাচ্ছেন না?”

“ভালো চাই, তবে পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট করে নয়।”

“যুদ্ধ চাচ্ছেন না, এই তো?”

“হুম।”

“আমার জানামতে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাজপ্রাসাদেই একটি করে গোপন সুড়ঙ্গ থাকে। বহিঃশত্রুর আক্রমণে রাজারা পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান সুড়ঙ্গ দিয়ে। আপনাদের প্রাসাদেও নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গ আছে!”

“হুম, প্রাসাদের কোথায় যেনো একটা সুড়ঙ্গ আছে।”

“দয়া করে সুড়ঙ্গের বহির্মুখ সম্পর্কে আমায় বলে দিন। কোনো র’ক্তপাত ছাড়াই আমি আপনার বোনকে মুক্ত করে নিয়ে আসবো। কোনো যুদ্ধও হবে না।”

নাবিহা চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলছে–“সুড়ঙ্গের বহির্মুখ যে কোন জায়গায় আছে, আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। তবে সুড়ঙ্গ দিয়ে আক্রমণ করলেই ভালো হবে। সহজেই নওরাকে নিয়ে আসা যাবে।”

তাসকিন বিরক্তির সাথে প্রশ্ন করেছে নাবিহাকে–“সুড়ঙ্গ তো রাজপরিবারের পালাবার পথ। সে পথের ব্যাপারটাও ভুলে গেছো?”

“আমার কি দোষ! যুদ্ধের টেনশনেই তো আমি সব ভুলে গেছি!”–নাবিহার সোজাসাপটা জবাব।

“তোমার বাবার নাম আর স্বামীর নাম মনে আছে তো?”–রাগে তাসকিন পাল্টা প্রশ্ন করেছে বউকে।

“স্বামীর নাম তাসকিন মুনতাসীর। আর বাবার নাম..বাবার নাম… বাবার নামটা যেনো কি!”

চিন্তিত ভঙ্গিতে নাবিহা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাবার নাম স্মরণ করার চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে শামস্ দুষ্ট স্বরে তাসকিনকে বলছে–“ভাই, এটা আপনি কি করলেন? ভাবীর বাপের নামও ভুলিয়ে দিলেন! শুধু আপনার নামটাই তো এখন বলতে পারে!”
……….

নাবিহার কাছ থেকে সুড়ঙ্গের ব্যাপারে কোনো তথ্য না পেয়ে যমজ রাজপুত্রদ্বয় ফিরে এসেছে কক্ষে। শাহ্জাদা রাকিনের কক্ষ এটা। সারি সারি বই সাজানো রয়েছে শাহ্জাদার এ ব্যক্তিগত কক্ষটিতে। অধিকাংশ বই’ই যুদ্ধবিদ্যা আর রাজতন্ত্র সংক্রান্ত। যমজ ভাই শামসকে নিয়ে আজ কিছু যুদ্ধ জয়ের কাহিনী পড়তে চায় রাকিন। অল্প সৈন্য নিয়ে গোপন যুদ্ধ জয়ের কাহিনীগুলোই মূলত আজ পড়বে। বইয়ের তাকে হাত দিতেই রাকিন থমকে গেলো। আচানক নয়নগোচর হলো নীল মখমলের মোড়কে পেঁচানো দুটো ডায়েরিতে। আজ রাকিনের মনে পড়ছে দাদীর স্মৃতি। মহাপ্রয়ানের পূর্বে এ ডায়েরি দুটো রাকিনের হাতে দিয়ে দাদী বলেছিলেন–“দাদু ভাই, তুমিই তো এ রাজবংশের ভবিষ্যৎ রাজা। তাই এ দিনলিপি দুটো তোমার হাতেই দিলাম। এসব তোমার মায়ের জীবনী। যদি কখনো সময় পাও তবে পড়ে নিও। মায়ের কথাগুলো তো জানতে পারবে।”

বিভিন্ন ব্যস্ততায় রাকিনের কখনো পড়া হয়ে ওঠে নি মায়ের জীবনী। আজ এ ক্রান্তিলগ্নে নয়নগোচর হলো সেই ডায়েরি। দুটো ডায়েরির একটি শামসের হাতে দিয়েছে। অন্যটি নিজ হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেছে রাকিন। বাহার রাজ্যেরই তো রাজকন্যা ছিলেন ওদের মা। রাজ্যের অনেক তথ্যই থাকতে পারে ডায়েরিতে। এসব ভেবেই গভীর ধ্যানে পাঠমগ্ন হয়েছে দু শাহ্জাদা। সাঁঝ গিয়ে রাতও পেরিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। আজ রাজার সাথে নৈশভোজেও যায় নি যমজ রাজপুত্রদ্বয়। বিষম অভিমানে অভিমানী হয়েছে ওরা। মায়ের ডায়েরি পড়তে পড়তে আচানক শামসের দৃষ্টি আটকে গেলো একটি পৃষ্ঠায়। সেখানে মা লিখেছেন —

আমার বয়স তখন আট বছর। তিমির রাজ্যের সাথে এক যুদ্ধে আমাদের বাহার রাজ্য পরাজিত হলো। পুরো বাহার রাজপ্রাসাদ শত্রুরা ঘিরে রেখেছিলো। আমার আব্বাই ছিলেন তখন বাহার রাজ্যের রাজা। আমাদের রাজপ্রাসাদ থেকে কয়েক কিলোমিটারের একটি সুড়ঙ্গ আছে। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রণয় নদের জলসীমার উপরেই থাকে এ প্রাসাদ সুড়ঙ্গের বহির্মুখ। আমাদের পুরো রাজপরিবার সেদিন ফকিরের বেশে ডিঙি নৌকায় প্রণয় নদ পাড়ি দিয়েছিলো। একরাত একদিন নৌকায় থেকে আমাদেরকে নিয়ে আব্বা বসতি গড়েছিলেন এক পাহাড়ে। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে আব্বা বাহার রাজ্যে আসতেন। ভিখিরির বেশে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। ধীরে ধীরে প্রজাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন আব্বা। বছর খানেক পরে এক চাঁদ রাতে বিশাল রাজভোজ হয় বাহার রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গণে। হাজার হাজার প্রজা নিয়ে ভিখিরির বেশেই আব্বা সে রাজভোজে অংশ নিয়েছিলেন। প্রজারা ঘরোয়া অস্ত্র সাথে নিয়েছিলো। আমার চাচারা অপেক্ষমান ছিলেন প্রণয় নদের তীরে প্রাসাদ সুড়ঙ্গের বহির্মুখে। এসব প্রাসাদ সুড়ঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে কখনোই প্রজাদেরকে অবগত করা হয় না। সে রাতেও সুড়ঙ্গের বহির্মুখে কোনো প্রাজাকে রাখা হয় নি। আমাদের রাজ পরিবারের পুরুষ লোকেরাই ছিলেন সুড়ঙ্গমুখে। ঐদিকে রাজভোজ থেকেই প্রজাদের নিয়ে অতর্কিতে প্রাসাদ আক্রমণ করেন আব্বা। কোনো প্রস্তুতি না থাকায় ক্ষমতাসীন রাজা পরাজিত হন। সে ক্ষমতাসীন রাজা সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় আমার চাচারা বন্দী করেন তাকে। সেদিনই আবার রাজত্ব ফিরে পায় আমাদের রাজ পরিবার। এক বছরের ব্যবধানে বাহার রাজ্যের সিংহাসনে আবার আরোহন করেন আমার আব্বা। এখনো অমলিন রয়েছে আমাদের রাজবংশের গৌরব,আমাদের রাজত্ব। বাহার রাজপ্রাসাদও সগৌরবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের রাজ পরিবারকে নিয়ে। রণকৌশল আর জয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকলে কখনো কেউ পরাজিত হয় না।

মায়ের ডায়েরীর এই লেখাটুকু পাঠের পরেই শাহ্জাদা শামস্ এক ডিগবাজি দিয়েছে মেঝেতে। এমন চরম দুঃসময়ে যমজ ভাইয়ের এহেন আচরণে বিরক্ত রাকিন। শামস্ মেঝে থেকে উঠতে উঠতে মহানন্দে জানাচ্ছে–“সুড়ঙ্গ পেয়ে গেছি রাকিন। সুড়ঙ্গ পেয়ে গেছি।”

রাকিন বিস্ময়ের সহিত এগিয়ে গেছে শামসের পঠিত পৃষ্ঠাটি পড়তে। লেখাটায় চোখ বুলাতেই যেনো খুশির ঝিলিক ফুটে উঠেছে শাহ্জাদার বদনে। স্বর্গবাসী মা লিখে রেখে গিয়েছিলেন তার জীবনী। এ লেখাই হয়তো মায়ের আশীর্বাদ হয়ে এলো। এটুকু লেখাই কি জয়ের পথে এগিয়ে নেবে পুত্রদ্বয়কে! তবুও দুশ্চিন্তা যেনো সঙ্গী হয়েই রয়েছে। এখানে কোথাও উল্লেখ নেই সুড়ঙ্গের নির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে। প্রণয় নদ তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে বাহার রাজ্যকে। রাজ্য সংলগ্ন তীরও বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে। কিন্তু ঠিক কোন দিকের তীরে রয়েছে সুড়ঙ্গটি! সুড়ঙ্গের অবস্থান জানতে পুরো ডায়েরি পড়ে শেষ করেছে যমজ ভ্রাতৃদ্বয়। রাত পেরিয়ে মধ্যরাত এসেছে ওদের অগোচরে। কিন্তু ডায়েরিতে খুঁজে পাওয়া যায় নি সুড়ঙ্গের অবস্থান সম্পর্কিত কোনো বিশেষ তথ্য। যমজ রাজপুত্রদ্বয় নৈশভোজ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছে যার যার কক্ষে। রাকিনের নিদ এসেছে চুপটি করে। অনেক স্বপ্নেরাও এসেছে লুকায়িত গোপনে। ফজরের পরপরই উঠে গেছে শাহ্জাদা। আজ নামাজও পড়েছে। গোপন যুদ্ধে যেতে হবে তাকে! কতো কাজ! রাজাধিরাজ পিতা সৈন্য দিয়ে সহায়তা করবেন না। নিজ দেহরক্ষী এবং বন্ধুদেরকে একত্রিত করতে হবে। রাজকীয় সৈন্য হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে কয়েকজন বন্ধু। ওরা যুদ্ধবিদ্যা জানে। ওদেরকেই একত্রিত করতে হবে। এ শেষ রাত থেকেই যমজ ভাই শামসকে নিয়ে সব গুছিয়ে নিচ্ছে শাহ্জাদা।

শিশির আর কুয়াশা সঙ্গী হয়েছে এ হিমশীতল প্রভাতের। আজ বৃহস্পতিবার। যমজ শাহ্জাদারা তাদের অনুগত লোকদের নিয়ে প্রণয় নদের তীরে। শ’খানেক লোক হয়েছে সব মিলে। জেলেপাড়া থেকে জাল ধার করে আনা হয়েছে। জেলের বেশে কয়েকটি ছোট ছোট নৌকায় লোকদের নিয়ে উঠে পড়েছে রাকিন। সাথে নিয়েছে কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। শামসকে পাঠিয়ে দেয়া হবে সম্ভার রাজপ্রাসাদে। শাহ্জাদা আরশানকে কঠোর নজরদারিতে রাখার সময় এখন। প্রাসাদেও যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে অবিশ্বাসী ছেলেটি। যমজ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছে শামস্। আর মাথায় কাপড় বেঁ’ধে জেলের ন্যায় ডিঙি নৌকায় বসে জাল ফেলছে রাকিন। আশেপাশের নৌকাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। প্রতিটি নৌকা অস্ত্রবাহী। অস্ত্র রাখা হয়েছে নৌকার পাটাতনের নিচে। সকালের এ প্রণয় নদ বেশ শান্ত। রোদের দাপটে হিমশীতল হাওয়া তার হিম বিসর্জনে ব্যস্ত। নিস্তরঙ্গ নদ পাড়ি দিয়ে বাহার রাজ্যের তীর অভিমুখী হচ্ছে নৌকাগুলো। আগামীকালই তো নওরার বিয়ে। যা করার আজই করতে হবে। রাজাধিরাজ পিতা তেমন কোনো সাহায্যই করছেন না তার মুকুট রাজপুত্রকে। কু’চক্রী আরশানের কু’চক্রে পড়েছেন রাজা। আর তাসকিনও বউয়ের বুদ্ধিতে বিরোধিতা করেছেন যুদ্ধের। নিরুপায় রাকিন শেষ আশা হিসেবে যাত্রা করেছে বাহার রাজপ্রাসাদের সুড়ঙ্গের বহির্মুখের খোঁজে। এতো কম লোকজন নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। তাই যেকোনোভাবে সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করতে হবে। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করতে হবে রাজপ্রাসাদে। দেখতে দেখতে সকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। রাকিনও দলবল নিয়ে চলে এসেছে বাহার রাজ্যের তীরে। সম্ভার রাজ্যের উল্টো দিকে থাকা তীর জুড়ে সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে বাহার রাজ। সম্ভার রাজ্য থেকে যেকোনো আক্রমণ যেনো শুরুতেই প্রতিহত করা যায়। রাকিনরা তো রয়েছে ছদ্মবেশে। জেলের বেশে ডিঙি নৌকা থেকেই সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে তীরে। সুড়ঙ্গের খোঁজ যে পেতেই হবে। তীরে সুসজ্জিত বাহার রাজ্যের সৈন্যরাও জানে না এ সুড়ঙ্গের অবস্থানের কথা। কারণ কোনো রাজ পরিবারই সুড়ঙ্গ সম্পর্কে প্রজাদের অবগত করে না। সুড়ঙ্গের ব্যাপারটি রাজ পরিবারের সদস্যদের মাঝেই গোপন রাখা হয়। এমনকি প্রাসাদের সুড়ঙ্গ খননও করা হয় বহু দূরের কোনো রাজ্য থেকে শ্রমিক এনে। রাতের আঁধারে গোপনে প্রসাদের কোন অংশের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ নির্মাণকাজ করা হয়। প্রাসাদে থাকা সাধারণ দাস-দাসীদেরও প্রবেশ থেকেও সংরক্ষণ করা হয় সুড়ঙ্গের সেই গুপ্ত অংশটি। আজ এ প্রণয় নদের তীরে নিয়োজিত সৈন্যরা কি করে জানবে এসব গোপন সুড়ঙ্গের খবর!

সূর্য এখন মধ্যগগণে। সকাল গড়িয়ে দুপুর এসেছে খানিক আগেই। উষ্ণ রোদের সহিত শীতের হিম হিম বাতাস মিলেমিশে একাকার। এখন আর শীতেরও নেই একচ্ছত্র দাপট। জেলের বেশে সম্ভার রাজ্যের উল্টো দিকে থাকা বাহার রাজ্যের তীরটি ঘুরে ঘুরে দেখেছে রাকিনরা। কোথাও সুড়ঙ্গের কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। মায়ের ডায়েরিতে লেখা ছিলো সুড়ঙ্গটি প্রণয় নদের জলসীমার উপরে। বাহার রাজ্যের এ তীরটি ভাঙনশীল। তবে কি সুড়ঙ্গটিও নদের ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে! নৌকায় বসে এসবই ভাবছে ক্লান্ত শ্রান্ত রাকিন। সুড়ঙ্গ না পেলে এতো এতো সৈন্য হটিয়ে কি করে আক্রমণ করবে বাহার রাজপ্রাসাদ! তবে কি আর জয় করা হবে না মেহবুবাকে! বিয়েটাও কি নওশাদের সাথেই হবে! এ যেনো এক সীমাহীন বেদনার ব্যথিত অনুভূতি। বিষম হৃদয়ের অসম চিন্তার অসীম আকুতি। প্রেয়সীকে হারানোর অজানা ভয়ে এখনই ভীত হলে চলবে না। মুকুট রাজকুমারকে এতো সহজে হাল ছাড়তে হয় না। বিষণ্ণ হৃদয়ে এলোমেলো ভাবনায় রাকিন ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলো তিমির রাজ্যের তীরের দিকে। খানিক বাদে মনে হলো মায়ের ডায়েরিতে লেখা ছিলো তিমির রাজ্য থেকে আক্রমণ হয়েছে বাহার রাজ্যে। তাহলে তো তিমির রাজ্যের উল্টো তীরেও তখন সৈন্য ছিলো। সেদিক দিয়ে তো আর রাজপরিবার সেদিন পালাতে পারে নি। সেদিকে গিয়ে আজ লাভও নেই। এই প্রণয় নদ তিন দিক থেকে বেষ্টন করে রেখেছে বাহার রাজ্যকে। সম্ভার রাজ্যের উল্টো দিকে একটি তীর, তিমির রাজ্যের উল্টো দিকে অন্য তীরটি। এ দুটো তীর বাদে আরও একটি তীর রয়েছে প্রণয় নদের সাথে। সেই তীরে তো এখনো গমন করা হয় নি রাকিনদের। শাহ্জাদা ভাবছে সেই তীরেও তো থাকতে পারে সুড়ঙ্গ। সেখানেই পৌঁছতে হবে তরী নিয়ে। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রণয় নদের ছলছল জল কে’টে ধীরে ধীরে চলছে তরী। বাকি তরীগুলোও রয়েছে কাছে-দূরেই। নদে জোয়ার আসবে খানিক বাদে। এখন স্বাভাবিক নিস্তরঙ্গই রয়েছে নদ। আজ দুপুরে অনুগত লোকদের সাথে বসে নৌকাতেই আহার সেরেছে রাকিন। মাটির চুলোয় রান্না হয়েছে। সকালে নৌযাত্রা করার সময় নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়েছিলো সাথে করে। মাটির চুলোও এনেছিলো। নদের হিম বাতাসে চুলো জ্বালাতে বেশ কষ্ট। কষ্টকে সঙ্গী করেই রাঁধতে হয়েছে আজ। নদ থেকে মাছ ধরে নিয়েছিলো জাল দিয়ে। সেসব মাছও ব্যবহৃত হয়েছে মধ্যাহ্নভোজে। এ যেনো এক নতুন জীবন, এক নব অভিযাত্রা! কখন শেষ হবে এ অনাকাঙ্ক্ষিত অভিযাত্রার! এখনো যে সবকিছুই ধরাছোঁয়ার বাইরে! ছোট-বড় লহরীর দোলায় দুলতে দুলতে তরী এসেছে বহুদূরে। প্রণয় নদের তৃতীয় তীরে এখন রাকিনদের তরীটি। বিকেলও হয়ে গেছে সময়ের নিরন্তর খেলায়। এ তীরে কোনো সৈন্য মোতায়েন করা হয় নি। সম্ভার রাজ্য তো অন্য তীরের উল্টো দিকে। সেদিকেই মোতায়েন করা হয়েছে সৈন্য। এদিকটা সম্পূর্ণই অরক্ষিত। তীরের নিকটবর্তী হয়ে নৌকায় ঘুরে ঘুরে ওরা খুঁজে যাচ্ছে সুড়ঙ্গ। সতর্ক দৃষ্টি সবার। বন-জঙ্গলে ঘেরা এই তীর। কোথাও নেই সুড়ঙ্গের চিহ্ন। কি করবে ওরা এখন! ফিরে যাবে সম্ভার রাজ্যে! ফিরে গেলে তো আর মেহবুবাকে পাওয়া যাবে না। খেয়ালি মনের এমন বেখেয়ালি ভাবনার মাঝে আচানক একটি পায়রা এসেছে রাকিনের নায়ে। ওদের রাজপ্রাসাদেরই পায়রা এটি। মুখে বয়ে আনা চিরকুটটি মুক্ত করেছে শাহ্জাদার সম্মুখে। কিসের বার্তা এলো এখন! চিরকুট খুলেছে শাহ্জাদা তড়িৎ হস্তে। শামস্ পাঠিয়েছে এ বৈকালিক বার্তা। কৃষ্ণ বর্ণের ছোট ছোট অক্ষরে লেখা রয়েছে–

সুড়ঙ্গের খোঁজ পেয়েছিস রাকিন? সেনাপতি উদয় বেগকে প্রাসাদে রেখে আমি কিন্তু তোকে সাহায্য করতে চলে আসতে পারি। আমি কি আসবো? —শামস্

কাগজ আর কালি নিয়ে আসে নি রাকিন। কি করে জবাব দেবে ভাই কে? সেরকম কিছুর খোঁজও তো পাওয়া যায় নি। কিভাবে যে কি করবে? অগোছালো ভাবনার এলোমেলো দোলাচলে দুলছে হৃদয়। এরই মাঝে গোধূলিও নেমে এসেছে ধরায়। কোনো কিছুর কূলকিনারা হলো না এখনো। অথচ রাত পেরোলেই নওরার বিয়ে।

বার্তাবাহক পায়রাটি এখনো রয়েছে রাকিনের সাথেই। দাঁড় বেয়ে তীরের প্রান্ত ঘেঁষে নৌকা চালাচ্ছে রাকিন। সাঁঝ নামলে তো আর কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না! তীর্থের কাকের ন্যায় শেষ বারের মতো সুড়ঙ্গের সন্ধান করছে। তীরে নেমে কয়েকজন সৈন্য নিয়ে উপরের জঙ্গলে উঠার চেষ্টা করছে শাহ্জাদা। উঠতে গিয়ে সহসাই রাকিনের বোধগম্য হলো এ তীরটি বেশ উঁচু। উপরে উঠে তীরের নিকটবর্তী জঙ্গলে সুড়ঙ্গের সন্ধান করছে ওরা। জঙ্গল ধরে কিছুদূর গিয়ে নয়নগোচর হলো নতুন কিছু। নদের ভাঙন প্রতিরোধে বালু আর পাথরের বস্তা ফেলে সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে তীরটি। এ রাজ্যের আরও দুটো তীর রয়েছে প্রণয় নদে। সেসব তীরের তো কোনো যত্ন নেই। এ তীরের এভাবে যত্ন নিচ্ছে কেন রাজা! তবে কি এ সুরক্ষিত তীরেই রয়েছে সেই সুড়ঙ্গ! কিন্তু কোথাও তো দেখা যাচ্ছে না সুড়ঙ্গের মতো কোনো কিছু। ওরা স্থলেভাগে তীর ধরে এগোচ্ছে। আর নৌকাগুলো নিয়ে ছদ্মবেশী সৈন্যরা নদীর তীর ঘেঁষে এগোচ্ছে। নৌকায় থাকা সৈন্যরা নদী থেকে পাড়ে দৃষ্টিপাত করছে। দু’ভাবেই খোঁজা হচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে একটি পুরনো ঘাটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে নদের তীরে। ঘাটের সম্মুখেই অনেকগুলো কঙ্কাল ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এসব দেখলেই যেনো ভয়ে গা ছমছম করে। ঘাটটিও এমনই এবড়ো-থেবড়ো যেনো কোনো মানুষ স্বাভাবিকভাবে এখানে দাঁড়াতেও না পারে! ঘাটের পাশে নদীর তীরে মানুষের অনেকগুলো মাথার খুলি,হাত-পা সহ হাড্ডিও রয়েছে। এগুলো সব জলসীমার উপরে। আবার এদিকটায় জঙ্গলও বেশ ঘন। জঙ্গল হয়ে ঘাটে আসার কোনো রাস্তাও নেই। ঘাটের উপরে-নিচে,আশে-পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পাথর আর মানুষের মাথার খুলি। পুরো জায়গাটাই যেনো একটি ভোতিক জায়গা। এরইমাঝে গোধূলিও ফিরে গেছে। সন্ধ্যার কাছাকাছি সময় এখন। রাকিনের সাথে থাকা সৈন্যরা এ ভৌতিক জায়গায় থাকতে অস্বস্তি বোধ করছে। কোনো সুড়ঙ্গের খোঁজ না পেয়ে শাহ্জাদাও নেমে এসেছে নৌকায়। বিদীর্ণ হৃদয়ে সহসাই ফিরে যাচ্ছিলো নৌকা নিয়ে। আচানক একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে সে। আবারও দৃষ্টিগোচর হলো সে ভয়ানক ঘাটখানি। তীরটি উঁচু হওয়ায় ঘাটটি অনেক উঁচু থেকে নেমেছে। ঘাটের উপরের দিকের কয়েকটি সিঁড়ির নিচের অংশটা ফাঁকা। আর বাকি সিঁড়িগুলোর নিচের অংশে ফাঁক নেই। ফাঁকা থাকলে সবগুলোর নিচেই তো থাকা উচিত। কিন্তু উপরের সিঁড়িগুলোর নিচে ফাঁকা নেই কেন? ইষৎ সন্দিহান হলো রাকিন। আবার তরী ঘুরিয়েছে সে। ঘাটের নিকটে এসে শাহ্জাদা নেমেছে সন্তর্পণে। ঘাটের সেই উপরের সিঁড়ির নিম্নস্থ ফাঁকা অংশেই রয়েছে একটি দেয়াল। তার সামনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের খুলি আর পাথর। এ দেয়ালের নিচের অংশটি আবার ফাঁকা। কিন্তু সে দেড় হাত সমান ফাঁকা অংশের মুখ পাথর দিয়ে আটকানো। ভীষণ সন্দিহান শাহ্জাদা দুজন সৈন্যকে দিয়ে একটি পাথর সরিয়ে ফেলেছে। পাথর সরিয়ে ফেলায় ফাঁক তৈরি হয়েছে দেয়ালের নিচে। ফাঁকা অংশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েছে শাহ্জাদা। কিন্তু শূলের মতো কিছু একটা বি’দ্ধ হচ্ছিলো শরীরে। কিছুটা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে শাহ্জাদা বেরিয়ে এসেছে। প্রগাঢ় আঁধারে ভেতরের কিছুই দেখা যায় নি। বের হয়ে এসে ছোট ছোট পাথরের টুকরো ঘষে আগুন জ্বেলেছে শাহ্জাদা রাকিন। তার নির্দেশে তরী থেকে মশাল নিয়ে হাজির হয়েছে একজন সৈন্য। সেই মশালে আগুন জ্বেলে উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখে নিচ্ছে শাহ্জাদা। অনেক গুলো শূল রয়েছে ভেতরে। শূলগুলো পাথরের উপরে বসিয়ে তাক করে রাখা হয়েছে। অন্য প্রান্ত হয়তো শক্ত কোনো কিছুতে আটকানো। এমনভাবে রাখা হয়েছে শূলগুলো যেনো এ পথে কেউ প্রবেশের চেষ্টা করলেই শূলবিদ্ধ হয়ে মৃ’ত্যু পথযাত্রী হয়। রাকিন তো এখন আর আঁধারে নেই। সে আলোর ব্যবস্থা করে নিয়েছে। পাথরের উপর থেকে দুটো শূল নামিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে শাহ্জাদা। এটা ইট,সিমেন্টে তৈরি বিশাল একটি গোলাকার পাইপ। পাইপের ভেতরের দিকটা চিকন। খানিক এগোলেই একটি ফটক। এ ফটকের সাথে ঠেসে রয়েছে শূলগুলোর অন্য প্রান্ত। শূলের ভোঁতা প্রান্ত এটা। ফটকটি সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে আটকে রাখা। ফটকের ভেতর থেকে কেউ এলে সহজেই শূলের দন্ডের ভোঁতা প্রান্ত সরিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে। রাকিনের কেন যেন মনে হচ্ছে এটাই প্রাসাদ সুড়ঙ্গের সেই বহির্মুখ। এ সুড়ঙ্গ ধরে কয়েক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে বাহার রাজপ্রাসাদ। হয়তো এমন আরও কয়েকটি ফটক রয়েছে মাঝখানে। প্রজারা যেন সহসা ধারেকাছেও না আসে তার জন্যই ঘাটসহ পুরো জায়গাটা ওভাবে ভৌতিক করে রাখা হয়েছে। রাজপরিবার সফল তাদের এ ভয়ানক কৌশলে। এসব এলোমেলো ভাবনার দোলাচলে রাকিন ফিরে এসেছে নৌকায়। কালি আর কাগজ কিছুই তো নেই তার সাথে। শামসের সেই চিরকুটটি বের করে রেখেছে উরুর উপরে। তরবারি দিয়ে নিজের হাত ইষৎ কে’টে নিয়েছে। ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে র’ক্ত। শামসের লেখার উল্টোপিঠে র’ক্ত দিয়ে কৌশলী ভাষায় লিখেছে–“উত্তরে চলে আয়।”
র’ক্তে লেখা সে চিঠি নিয়ে উড়ে গেছে পায়রা।

চলবে