প্রাসাদকথন পর্ব-১৪

0
25

#প্রাসাদকথন
পর্বঃ১৪
#সুলতানা_তানি

প্রণয় নদে স্রোত এসেছিলো বিকেলেই। স্রোত নেই এখন আর। স্রোতের দোলায় জলও আর ছলছল করছে না। রাত আটটার মতো বাজে এখন। শামস্ এসে পৌঁছেছে প্রণয় নদের উত্তর তীরে। শাহ্জাদা রাকিন সমস্ত ঘটনা ভাইকে অবগত করেছে। সব শুনে শামস্ও ঘাটের নিম্নস্থ দেয়ালের ফাঁকা দিয়ে সুড়ঙ্গের বহির্মুখে প্রবেশ করেছে। এবার আর বাইরে থেকে মশাল প্রজ্জ্বলিত করে প্রবেশ করে নি ওরা। রাতে মশাল প্রজ্জ্বলিত করলে দূর থেকে সে আলো দৃশ্যমান হতে পারে। অগোচরে কেউ দেখে ফেলতে পারে ওদেরকে। তাই মশাল নিভিয়ে কৌশলী হতে হয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করে পাথর ঘষে আগুন জ্বেলে যথারীতি মশাল প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে। সৈন্যও সাথে রয়েছে কয়েকজন। সবকিছু আবারও পর্যবেক্ষণ করেছে দু’ভাই। সুড়ঙ্গমুখের পাথরে খাঁজ কে’টে শূলগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে, যেনো কেউ ভেতরে প্রবেশ করলে সহসাই সাক্ষাৎ মৃ’ত্যুর মুখ দেখতে পারে। এমন কৌশল দেখে শামস্ ভীষণ বিস্মিত। কিছু শূল বিকেলে সরানো হয়েছিলো। বাকি শূলগুলো এবার সরানো হচ্ছে। সবচেয়ে বড় পাথরটি রেখে বাকি পাথরগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। জায়গাটি মোটামুটি নিরাপদ এখন। সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে নৌকায় চলে এসেছে দু’ভাই। নৌকাগুলোকে ভাগ করে দুজন দায়িত্ব নিয়েছে। রাকিন জানিয়েছে চূড়ান্ত আক্রমণ মধ্যরাতের কিছু আগে শুরু করবে। আক্রমণের সময় হলে নিজ নৌকায় মশাল প্রজ্জ্বলিত করবে সে। মশাল দেখে সব নৌকাকে তার নৌকার সন্নিকটে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নৌকাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে এখন। শামসের নৌকাটি যদিও বেশি দূরে গমন করে নি। একশো হাতের মতো দূরত্বে ছিলো। রাত দশটা নাগাদ ঘটলো এক আজব ঘটনা। দৈনন্দিন প্রহরার অংশ হিসেবে বাহার রাজ্যের কিছু সৈন্য অশ্বারোহী হয়ে চলে এসেছে নদের তীরবর্তী এ জঙ্গলে। সেখান থেকেই মশাল দিয়ে নদীতে নজরদারি করছে। ভীনরাজ্যের কোনো নৌবহরের সমাবেশ ঘটেছে কিনা সেটাই পর্যবেক্ষণ করছে ওরা। ওরাও জানে না প্রাসাদ সুড়ঙ্গের খবর। তবে রাজার নির্দেশ রয়েছে রোজ রাতেই একবার এসে এ তীরের অবস্থা দেখে যেতে হবে। কুয়াশায় বেশি দূরের কিছু নয়নগোচর হয় না। রাকিনরা তো ছিলো তীর থেকে সামান্য দূরে বিচ্ছিন্নভাবে। প্রগাঢ় আঁধার আর কুয়াশার কারণে সব নৌকা দৃষ্টিগোচর হয় নি ওদের। তাই সন্দিহান না হয়েই সৈন্যরা ফিরে গেছে। রাকিন জোরে জোরে গান গেয়ে শামসকে কাছে ডেকেছে। আজ যুদ্ধের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে শামস্। ভাইয়ের নিকট থেকে কালি ও কাগজ নিয়ে প্রজ্জ্বলিত মশালের শিখায় রাকিন লিখতে বসেছে–

আব্বা,

আপনার যমজ রাজপুত্রদ্বয় রণাঙ্গণের সম্মুখে রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এমন মুহূর্তে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মতো মূর্খ আপনি নন। আমি নিশ্চিত যে আপনি সৈন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতিও হয়তো নিয়ে ফেলেছেন। র’ক্তপাতের মাধ্যম সম্মুখ যু’দ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ বিজয়ের পথ আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি। ইনশাআল্লাহ্ আপনার সহায়তা ছাড়ই আমরা বিজয় অর্জন করতে পারবো। তবে বাহার রাজ্য জয়ের পরে আমাদের দখলে রাখতে হবে। তার জন্য হাজার খানেক সৈন্যের প্রয়োজন। এই চিঠি পাওয়া মাত্র বাহার রাজ্যের তীরে আমাদের সৈন্য প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রাসাদ দখল করে বাহার রাজ্যের সৈন্যদেরকে আমরা অস্ত্র বিরতিতে বাধ্য করবো। তারপরেই প্রণয় নদের তীর থেকে আমাদের সম্ভার রাজসেনারা যেন বাহার রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে যায়! ইনশাআল্লাহ্ সৈন্য আগমনের পূর্বেই আমরা বাহার রাজপ্রাসাদ দখল করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবো। আর একটা কথা না বললেই নয়। জানেন তো, আপনার পুত্র আরশান হচ্ছে বাহার রাজকুমার নওশাদের গোপন মিত্র। ভুল করেও আজকের এ অভিযাত্রার খবর আরশানকে জানাবেন না।

ইতি,

আপনার পুত্র,
রাকিন মুনতাসীর

একটি নৌকায় দুজন সৈন্যকে দিয়ে রাজার নিকট চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে রাকিন। সে নৌকার খানিক পেছনে গুপ্তচর হিসেবে রেখেছে আরেকটি নৌকা, যেনো প্রথমটি নৌপথে কোনোভাবে বিপদের কবলে পড়লে বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় নৌকাটি সম্ভার রাজ্যে গমন করতে পারে। দ্বিতীয় নৌকায়ও একই চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে সম্ভার রাজের জন্য। নিজের নৌকা পাশে রেখে শামস্ উঠে এসেছিলো ভাইয়ের নৌকায়। হিম হিম বাতাসে এখন রাতের আহারে ব্যস্ত দু’ভাই। কিছু খাবার রাজপ্রাসাদ থেকেই প্রস্তুত করে নিয়ে এসেছিলো শামস্। সে খাবার গ্রহণের মাধ্যমে সৈন্যরা আগেই নৈশভোজ সেরেছে। রাকিন দেরি করেছে নৈশভোজে। বিভিন্ন পরিকল্পনা হচ্ছে এখন দু’ভাইয়ের মাঝে। আলাপচারিতার মাঝেই শেষ হয়ে গেছে নৈশভোজ। রাকিন মেয়েজামাই হবে বাহার রাজের। তাই নিজে দরকষাকষি করতে চায় না রাজার সাথে। প্রাসাদ আক্রমণের পরে রাজার মুখোমুখি হবার দায়িত্বটা শামসকেই দিয়েছে সে। সব পরিকল্পনা শেষে শামস্ নিজ নৌকায় উঠে গেছে। প্রণয় নদ আজ রাতেও খানিক নিস্তরঙ্গ। চারদিকে শুধু তমসা আর কুয়াশা। হিম বাতাস শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে চায়। নদের এলোমেলো দোলায় মন দুলেছে নব অভিযাত্রার ভাবনায়। এরই মাঝে সময়ও বয়ে গেছে বহুদূরে। এখন রাত এগারোটা। রাকিন মশাল প্রজ্বলিত করেছে নিজ তরীতে। ধীরে ধীরে কাছে এসেছে সকল নৌকা। ঘাটের খানিক কাছে এসে নদীর মাঝে থেকেই মশাল নিভিয়ে নিয়েছে ওরা। আঁধারে নৌকাগুলো ঘাটের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে। জেলের বেশ ছেড়ে দিয়েছে সবাই। এখন ধারণ করেছে যোদ্ধার বেশ। নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে অস্ত্র নিয়ে সবাই নেমে পড়েছে ঘাটের কাছে। শামসের দেহরক্ষী কাঁধে ঝোলানো পুঁটলিতে রাজকীয় কিছু জিনিসও বহন করছে। প্রয়োজনে শামসকে সরবরাহ করবে এসব। মাটির কলস ভর্তি করে পানি নিয়েছে সৈনিকরা। শুকনো খাবারও সাথে আছে। সন্ধ্যায় প্রাসাদ থেকে শামস্ নিয়ে এসেছে এসব খাবার। সবকিছু নিয়ে দেয়ালের নিচ থেকে একজন একজন করে সবাই ঢুকে গেছে সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গের ভেতরটা যেনো ভূগর্ভস্থ এক আঁধার রাজ্য। গা ছমছম করা পরিবেশ। সৈন্যরা পাথর ঘষে মশাল প্রজ্বলিত করে নিয়েছে ইতোমধ্যে। সুড়ঙ্গের ভেতরকার সবচেয়ে বড় পাথরটিকে আগেই প্রস্তুত করে রেখে গিয়েছিলো ওরা। কয়েকজন সৈনিক বন্ধুসহ রাকিন আর শামস সে বিশাল পাথরটিকে উত্তোলন করেছে। ভীষণ ভারী এটা। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সে পাথর নিক্ষেপ করেছে সুড়ঙ্গের ফটকে। পাথরের আঘাতে ফটকটি তৎক্ষনাৎ দেয়াল থেকে খসে পড়েছে। মশাল নিয়ে কয়েকজন সৈন্য অগ্রভাগে চলে গেছে। আরও কয়েকজন সৈন্য বিশাল পাথরটিকে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সম্মুখে। প্রাসাদ পর্যন্ত যেতে নিশ্চয়ই আরও ফটক রয়েছে এ সুড়ঙ্গে। সেগুলোও তো ভেঙে ফেলতে হবে এ পাথর দিয়েই। দুই রাজপুত্র সুড়ঙ্গ অতিক্রম করছে পূর্ণ তেজে। সম্মুখের অংশ থেকে মশালের আলোয় কয়েকটি সাপ মে’রেছে সৈন্যরা। সুড়ঙ্গের ভেতরে বসতি গড়েছিলো ওরা।

বিশাল সুড়ঙ্গ এটা। পথ যেনো শেষই হচ্ছে না। শীতকাল না হলে সৈন্যরা হয়তো অনেক বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়তো! প্রায় ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পরে ওরা পৌঁছে গেছে সুড়ঙ্গের প্রাসাদ ফটকে। পেছনে আরও দুটো ফটক ওভাবেই পাথর দিয়ে ভাঙতে হয়েছে। সৈন্যরা শেষবারের মতো সাথে করে নিয়ে আসা পানি এবং শুকনো খাবার খেয়ে নিয়েছে। সম্মুখের এ প্রাসাদ ফটক ভীষণ মজবুত। রাকিন আর শামস্ সৈনিক বন্ধুদের নিয়ে বিশাল পাথরটি নিক্ষেপ করেছে এ ফটকেও। একবার পাথর নিক্ষেপে কিছুই হয় নি এ ফটকের। দু’দুবার পাথর নিক্ষেপের পরেই দেয়াল থেকে ধ্বসে পড়েছে ফটক। প্রাসাদ ফটকে পাথর নিক্ষেপ করায় গগণবিদারী আওয়াজও হয়েছে। সে আওয়াজে প্রাসাদের ভেতর-বাহির সবই যেনো কেঁপে উঠেছে। প্রাসাদের বাইরে অবস্থান নেয়া সৈন্যরা কোন দিক থেকে আওয়াজ এসেছে,সেই উৎস উদঘাটনে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ওরা তো আর জানে না এ গোপন প্রাসাদ সুড়ঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে! সাধারণত রাতে প্রাসাদের অন্দরমহলে তেমন কোনো সৈন্য কিংবা প্রহরীও উপস্থিত থাকে না। প্রাসাদ ভবনের প্রধান ফটক রয়েছে ভেতর থেকে আটকানো। বাইরে উপস্থিত সৈন্যরা ভেতরেও প্রবেশ করতে পারছে না। শ’খানেক সৈন্য নিয়ে পুরো অন্দরমহলের দখল নিয়ে নিয়েছে রাকিনরা। বিকট আওয়াজ রাজার কর্ণেও প্রবেশ করেছে। আ’তঙ্কিত রাজা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভঙ্গিতে মাত্রই বের হয়েছেন নিজ কক্ষ থেকে। রাজার ব্যাপারে শামসকে আগেই দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলো রাকিন। শামস রাজাকে ধরে নিজ কক্ষেই বন্দী করে রেখেছে। রাত পেরোলেই তো নওরার সাথে নওশাদের বিয়ে হবার কথা! অথচ আজ রাতেও সুরা পান করে নর্তকীর বুকেই নিশিযাপন করছে নওশাদ। বিকট আওয়াজ শুনে নর্তকী উঠে কাপড় পরিধান করে নিয়েছে। মদ্যপ নওশাদ তো গভীর ঘুমেই মগ্ন। নর্তকী মাত্রই দরজা খুলেছে নওশাদের কক্ষের। রাকিনকে দেখেই আবার দরজা এঁটে দিচ্ছিলো। রাকিন তড়িৎ দরজায় ধাক্কা দিয়েছে। নর্তকী আর দরজার কপাট এঁটে দিতে পারে নি। নর্তকীকে কক্ষত্যাগের আদেশ দিয়ে ঘুমন্ত নওশাদকে কাছি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে রাকিন। টেনে-হিঁচড়ে নওশাদকে নিচে নামাতেই ঘুম ভেঙেছে বেচারার। মাতাল কণ্ঠেই কৌতূহলী ভঙ্গিতে রাকিনকে প্রশ্ন করেছে–“আ..মায় বেঁ’..ধেছিস কেন রে?”

“রাত পোহালেই তোর বিয়ে হওয়ার কথা! অথচ আজও শুয়েছিস অন্য নারীর সাথে। তোকে না বেঁ’ধে কাকে বাঁ’ধবো!”–দায়সারা জবাব রাকিনের।

“আ..রেহ, বিয়ে করলে কি হ.বে? বিয়ে করবো রাজপু..ত্র, রাজক..ন্যা জন্মদানের জন্য। বউয়ের সাথে কি ফূর্তি করবো নাকি! সিংহা…সনে আ..রোহন করবো আমি। এ জীবনে যা খু..শি তাই করবো।”–মদ্যপ অবস্থার ঘোর এখনো কা’টে নি। এলোমেলোভাবেই কথা বলছে নওশাদ।

“সিংহাসনের তো দরকার নেই তোর! তোর দরকার শুধু ফূর্তি!”–কথাটা বলেই
নওশাদকে বেঁধে তিন তলা থেকে নেমেছে রাকিন। এই দোতলায়ই নওরার কক্ষ। দোতলা থেকে নামার পূর্বে প্রেয়সীর কক্ষদ্বার খুলে দিয়েছে শাহ্জাদা। নওরা তৎক্ষণাৎ বের হয়েছে নিজ কক্ষ থেকে। ভীষণ উৎকণ্ঠার ছাপ শাহ্জাদীর বদনে। আটক নওশাদের বদনে একবার চেয়ে নেহেরিনের কক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছে শাহ্জাদী। তারপরেই উ’দ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে এসেছিলো পিতার কক্ষের নিকটে। নওরাকে দেখে শামস্ মৃদু হেসে রহস্যময় ভঙ্গিতে বলেছে–“আপনি যান। আমি এখনই খুলে দেবো।”

বাহার রাজ্যের শত শত সৈন্যের সম্মুখেই নওশাদকে বেঁ’ধে নিয়ে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়েছে রাকিন। বাহার রাজ্যের সৈন্যরা হতবিহবল। রাকিন নেমে এসেছে। শামস্ কি বসে থাকবে নাকি! শামস্ তরবারির মুখে বাহার রাজকে এ প্রাসাদ প্রাঙ্গণে নিয়ে এসেছে। রাজা এসে অস্ত্র বিরতির নির্দেশ দিয়েছেন নিজ রাজ্যের সৈন্যদেরকে। এ খবর পুরো রাজ্য জুড়ে পৌঁছে দেয়ারও আদেশ করেছেন। বাহার রাজ্যের সেনাপতির বাড়িতে এখনো রাজপ্রাসাদ দখলের খবর পৌঁছায় নি। সেনাপতি কিছু জানার পূর্বেই হয়ে গেলো কতো ঘটনা! বাহার রাজ্যের সৈন্যরা ঘোড়া ছুটিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অস্ত্র বিরতির খবর পৌঁছে দিয়েছে। প্রণয় নদের তীর থেকে বাহার রাজ্যের সৈন্যরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। অরক্ষিত প্রণয় নদের তীর দিয়ে খুব সহজেই সম্ভার রাজ্যের হাজার খানেক সৈন্য প্রবেশ করছে। বেশিক্ষণ লাগে নি ওদের। অশ্বারোহী সেনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনা বাধায় বাহার রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছেছে। সৈন্যদের নিকট থেকে পছন্দমতো একটি ঘোড়া বেছে নিয়েছে রাকিন। এখানকার রাজার সাথে দর কষাকষির যাবতীয় দায়িত্ব শামসকেই দেয়া হয়েছে। শামসের দেহরক্ষী রাজকীয় পোশাক এগিয়ে দিয়েছে শামসকে। শামস্ ব্যস্ত নিজেকে প্রস্তুত করতে। অতিথিশালায় গিয়ে রাজকীয় পোশাক পরিধান করছে সে। রাকিন ঘোড়ার সাথে নওশাদকে বেঁধে সৈন্যদের সহিত আলাপচারিতায় ব্যস্ত। এদিকে শামস্ রাজকীয় পোশাক পরিধান করে প্রাসাদ থেকে বের হয়েছে। একজন সৈনিক শামসের হাতে একটি নিশান এগিয়ে দিয়েছে। বাহার রাজ সম্মুখেই রয়েছেন। শাহ্জাদা শামস্ সম্ভার রাজ্যের নিশান উড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছে–“আমি সম্ভার রাজ্যের রাজপুত্র শামস্ মুনতাসীর। সম্ভার রাজ তারিক মুনতাসিরের পক্ষ থেকে আমি বাহার রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করছি। এই অঞ্চলটি আজ থেকে সম্ভার রাজ্যের অধীনস্ত অঞ্চল হয়ে থাকবে।”

ঘোষণা শেষ হবার মিনিট খানেক পার হয়েছে মাত্র। এরই মাঝে উ’ন্মাদের মতো দৌড়ে প্রাসাদ থেকে বের হয়েছে শাহ্জাদী নওরা। সেনাদের ভীড়ের মাঝে রাকিনকে দেখতে না পেয়ে শামসের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ভীষণ রা’গ আর ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করেছে–“আপনি এ ঘোষণা কেন দিয়েছেন শাহ্জাদা?”

নওরাকে কি জবাব দেবে সেটা ভেবে ব্যাকুল শামস্। দূর থেকে মেহবুবাকে দেখে হাস্যোজ্জ্বল বদনে রাকিন এগিয়ে এসে বলছে–“এসে গেছো তুমি! চলো আমার সাথে!”

“এমনটা কি করে ভাবলেন আপনি!”(গম্ভীর কণ্ঠে ভীষণ রাগে)

“মানে!”

“পরিবার,পরিচয়,রাজ্য আর রাজত্বকে পায়ের তলায় পিষে রেখে মধ্যরাতে আপনার সাথে চলে যাবো! আজব তো! আপনি হয়তো এখনই বলবেন যে মধ্যরাতে বারবার মোলাকাত করেছি আপনার সাথে! তবে ভুলে যাবেন না প্রতিটি মোলাকাতই ছিলো আপনাদের সম্ভার রাজ্য সংক্রান্ত প্রয়োজনে। আর আজ আপনারা এটা কি ঘোষণা দিয়ে দিলেন!”

“কি বলতে চাও তুমি শাহ্জাদী?”–কৌতূহলী কণ্ঠে বিস্মিত বদনে রাকিন প্রশ্ন করেছে।

“আপনাদের ঘোষণা প্রত্যাখান করুন।”(নওরা)

“কেন?”

“শাহ্জাদা রাকিন, আপনি হয়তো আমার জন্যই আজ যুদ্ধে নেমেছিলেন। তাই না?”

“হুম।”

“অথচ আমার এই মহব্বতের কারণে আমাদের পরিবার আজ রাজত্ব হারাচ্ছে। আমাদের রাজ্যও বিলুপ্ত হচ্ছে।”

“তোমাদের রাজপ্রাসাদে নিত্য ব্যভিচারে লিপ্ত হতে নওশাদ। নওশাদকে প্রতিবাদও করা হয় নি পরিবার থেকে। এমন রাজ পরিবারগুলো ব্যভিচারের পা’পেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। ধরে নাও, এ সময়টাই তোমাদের বিলুপ্তির সময়!”

“সে যাইহোক, আমার মহব্বতের কারণেই আমার রাজপরিবার,আমাদের রাজ্য আজ সকল গৌরব হারালো। পুরোপুরি পরাধীন হয়ে গেলাম আমরা। এ রাজ্যের সব মর্যাদা ধ্বংস করেছি আমি। আমার আসলে আ’ত্মাহুতি দেয়া উচিত।”–ভীষণ অনুতাপের সুরে কথাগুলো বলেই দৌড়ে প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছিলো শাহ্জাদী।

“দাঁড়াও শাহ্জাদী! কথা শেষ করে যাও!”–পেছন থেকে গম্ভীর বদনে রাশভারি কণ্ঠে রাকিন ডেকেছে।

ভীষণ অভিমানে মলিন বদনে পেছন ফিরেছে নওরা। রাকিন শীতল কণ্ঠে কৌতূহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছে–“কি চাও তুমি?”

ধীর কদমে নিঃশব্দে কাছে এগিয়ে এসেছে নওরা। তারপরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে নিজের দাবি জানিয়েছে–“এই বাহার রাজ্য স্বাধীন থাকবে এবং রাজত্ব আমাদের বংশের হাতেই থাকবে। যদি আমাদের বাহার রাজ্যের সম্মান অক্ষুন্ন রেখে শাদীর প্রস্তাব পাঠাতে পারেন তবেই আপনার সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক তৈরি হবে। ”

“এটা হয় না শাহ্জাদী! এটা রাজদর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা তো বাহার রাজ্য জয় করেছি। ” –শামস্ প্রতিবাদ করেছে নওরাকে।

“আসলে কিছুই জয় করতে পারেন নি আপনারা। পুরোপুরি পরাজিত হয়েছেন। কারণ আমাকে জয় করতে এসেও আপনারা কিন্তু জয় করতে পারেন নি!”–নওরা ক্ষুরধার কণ্ঠে জবাব দিয়েছে শামসকে।

রাকিন বিমর্ষ বদনে তাকিয়েছে শামসের মুখপানে। নওরা আরও গম্ভীর কণ্ঠে রাকিনকে বলেছে–“নওশাদ ভাইকে বন্দী করেছেন ভালো কথা। ওনাকে হ’ত্যা করবেন না। উনিই আমাদের রাজবংশের একমাত্র ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার। ওনাকে হ’ত্যা করলে আমাদের রাজবংশ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”

“নওশাদ তো নিজ পরিবারের মেয়েদের সাথেই বে’ঈমানী করেছে! যার হাতে নিজ পরিবার,পরিবারের মেয়েরা নিরাপদ নয় তার হাতে রাজ্য কি করে নিরাপদ হবে!”–রাকিন বিষম বিরক্তির অসম সুরে জবাব দিয়েছে নওরাকে।

“জানি না। তবে নওশাদ ভাইয়ের জীবন,আমার পিতার রাজত্ব এবং আমাদের রাজ্যের স্বাধীনতা যদি অক্ষুণ্ণ থাকে তবেই আপনাকে আমি শাদী করবো। অন্যথায় এই রণাঙ্গণেই আমার মহব্বত আমি কোরবানি দিয়ে গেলাম।”

রাকিনকে কথাগুলো বলেই অদূরে দাঁড়ানো পিতার নিকটে চলে গেছে নওরা। চুপিচুপি খানিক আলাপ হলো পিতা আর কন্যার মাঝে। অতঃপর পিতার হাত ধরে প্রাসাদে ফিরে গেছে রাজকন্যা। রাকিন বিদীর্ণ হৃদয়ে মলিন বদনে শামসের মুখপানে চেয়ে বলছে–“এ শাহ্জাদীর জন্যই তো যুদ্ধ করলাম! যদি ওকেই না পাই!”

“দেখ রাকিন, তোর ভবিষ্যৎ স্ত্রী হিসেবে শাহ্জাদীকে আমার পছন্দ হয়েছে। সম্ভার রাজ্যের রানী হবার মতো যোগ্যতাও আছে শাহ্জাদীর মাঝে। কিন্তু আমরা যদি বাহার রাজ্য মুক্ত করে দেই তাহলে সম্ভার রাজসেনাদের মধ্যে চরম হতাশা তৈরি হবে। প্রজাদের কাছে আমরা দোষী হবো।”

“ভাই শামস্, গতকালও কিন্তু এ বাহার রাজ্য আমাদের হাতে ছিলো না। শাহ্জাদী নওরাকেই জয় করতে চেয়েছি আমি। রাজদর্শন আমাদের সম্পর্কের মাঝে টানতে চাই না !”(হতাশ কণ্ঠে শামসকে জবাব দিয়েছে রাকিন)

“নওরাকে এখন বন্দী করে নিয়ে যাবো আমরা। সম্ভার রাজ্যে নিয়ে বিয়ে দেবো তোর সাথে।”

রাকিনও শামসকে জবাব দিয়েছে বুদ্ধিদীপ্তভাবে– “জোর করে নিয়ে গেলে নওরার সাথে আমার মহব্বত থাকবে না। সারাজীবন শুধু মানসিক যুদ্ধ লেগে থাকবে।”

“বুঝেছি। বিয়ে না করতেই বউয়ের কাছে পরাজিত হয়ে গেছিস তুই!”(খোঁচা দিয়ে)

“না রে! আমি মহব্বতের কাছে পরাজিত হয়েছি।”

“বাহার রাজ্য হাতছাড়া করে গেলে আব্বা কিন্তু কোনোভাবেই এটা মেনে নেবে না।”(শামস্ হুশিয়ার করে বলছে)

“জানি,আব্বা মেনে নিতে চাইবেন না। তবে আব্বা আমায় বিজয়ের পথ দেখান নি। আমাদের আম্মি দেখিয়েছেন। আম্মির ডায়েরি পড়েই আমি বিজয়ের পথে এসেছি। অথচ আম্মি কিন্তু সেই লেখায় স্বাধীন বাহার রাজ্য নিয়ে গর্ব করেছেন। আর আমরা সে রাজ্য পরাধীন করে দিলাম! শাহ্জাদী আজ মহব্বতের কো’রবানি দিয়ে গেলো! আম্মি বেঁচে থাকলেও হয়তো আব্বার সাথে আজ এমনটাই করতো!”–হতাশ কণ্ঠে ধীরে ধীরে শামসকে বলছে রাকিন।

দু’ভাইয়ের মাঝে বাহার রাজ্যের পক্ষে-বিপক্ষে আলাপচারিতা চলেছে কিছুক্ষণ। তারপর শাহ্জাদা রাকিন গিয়ে সম্ভার রাজ্যের নিশানা নামিয়ে ফেলেছে। শাহ্জাদা শামস্ আবারও দাঁড়িয়ে বাজখাঁই কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছে–“আমি সম্ভার রাজ্যের রাজপুত্র শামস্ মুনতাসীর। আমি আমার পূর্ব ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিলাম! এ বাহার রাজ্য স্বাধীনই রইলো। আমার মামা রাজা মুনাওয়ার মোর্শেদ এ রাজ্যের সিংহাসনে ছিলেন এবং এখনো তিনিই রয়েছেন। তবে বাহার রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গণে সম্ভার রাজসেনা থাকবে। সম্ভার রাজপুত্র রাকিন মুনতাসিরের সাথে শীঘ্রই বাহার রাজকন্যা নওরা নানজিবার শাদী হবে। শাদীর উৎসবে অংশগ্রহণ শেষে আমাদের সেনারা সম্ভার রাজ্যে ফিরে যাবে। আর যদি শাদীর ফয়সালা না হয় তাহলে আমাদের সেনারা এই প্রাঙ্গন থেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।”

ঘোষণা শেষে রাকিন এবং শামস্ দ্রুত প্রাসাদের অন্দরমহলে গিয়েছে। রাজা মুনাওয়ার নিজ কক্ষে বসে কাঁদছিলেন। রাকিন আর শামস্ সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছে–“মামা, আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমরা দুঃখিত। দয়া করে আমাদের অপরাধ নেবেন না!”

রাজা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে করুন কণ্ঠে বলেছেন–“তোমরা দুজনই বীরপুরুষ। তোমাদের কি অপরাধ! অপরাধ তো আমার ভাগ্যের! আমার যমজ বোন একসাথে দুজন রাজপুত্রের জন্ম দিয়ে পরপারে চলে গেলো! আজ আমারও যদি এমন একজন রাজপুত্র থাকতো! তবে নওশাদের হাতে আমি খেলনা হয়ে থাকতাম না। তোমাদের বিয়ের প্রস্তাব পাবার সাথে সাথেই নওরাকে বিয়ে দিয়ে দিতাম! রাজবংশ রক্ষা করতে গিয়ে নওশাদকে আমি প্রশ্রয় দিয়েছি। আমার রাজবংশের একমাত্র উত্তরাধিকার নওশাদ। ওর তো ক্ষতি আমি করতে পারি না! বহুবছর ধরেই আমি নওশাদের হাতে পরাধীন হয়ে আছি। তোমরাও পরাধীন করেই রেখে যাও আমায়। এখনও থাকি না পরাধীন হয়েই!”

“এখন থেকে স্বাধীনভাবেই রাজ্য পরিচালনা করুন। প্রয়োজন হলে ভাগ্নেদেরকে ডাকবেন। ওয়াদা দিলাম, আমরা আপনার রাজ্য কিংবা রাজত্ব কোনোটাতেই নাক গলাবো না।”–রাকিন ইষৎ সান্ত্বনা দিয়েছে রাজারূপী মামাকে। রাজা,রানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপর থেকে নেমে যাচ্ছে শাহ্জাদা। শামস্ও এখনই নামবে। বেচারা রাকিন-নওরার বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছে রাজা,রানীর সাথে। সিঁড়ি বেয়ে রাকিন নামার সময় হাসিমুখে দৌড়ে এসেছে নওরা। পেছন থেকে আহ্লাদী স্বরে ডেকে মিষ্টি হেসে বলেছে–“ধন্যবাদ শাহ্জাদা।”

রাকিন জবাব দেয় নি। ওভাবেই নেমে যাচ্ছিলো গম্ভীর বদনে। নওরা কয়েক ধাপ নেমে প্রশ্ন করেছে–“ভাব দেখাচ্ছেন আমার সাথে?”

“হুম।”–সিঁড়ি বেয়ে নামার গতি কমিয়েছে রাকিন। শাহ্জাদী কাছে এসে কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেছে–“কেন ভাব দেখাচ্ছেন?”
“একটু আগেই তো দফায় দফায় দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এখন থেকে ভাব না দেখালে ভবিষ্যতে দফায় দফায় দাবি বাড়তে থাকবে আপনার!”

“আমার সাথে ভাব দেখালে আপনার জীবনটাই দফারফা করে দেবো।”

“আমায় দফারফা করতে গিয়ে নিজের নামটাই ভুলে যান না যেনো!”
“মানে!”
“আপনি হয়তো বিয়ের পরে নিজের নামটাই ভুলে যেতে পারেন!”
“কখনো না!”

“আপনার বোন শাহ্জাদী নাবিহা কিন্তু ইতোমধ্যে বাপের নাম ভুলে গেছে।”

“কি বললেন! নাবিহা আপু আব্বার নাম ভুলে গেছে!”–ভীষণ দুঃখের সাথে বলছে নওরা।

ওদের আলাপের মাঝেই শামস্ এগিয়ে এসেছে। আলাপও আর দীর্ঘায়িত হয় নি। শাহ্জাদী উপরে ফিরে যাবার আগে আবদারের সুরে রাকিনকে বলে গেছে–“মহব্বতের বার্তা পাঠাবেন কিন্তু!”

খানিক বাদে ব”ন্দী নওশাদকে নিয়ে দু’ভাই রওয়ানা করেছে সম্ভার রাজ্যের উদ্দেশ্যে।

চলবে