#প্রাসাদকথন
পর্বঃ১৫
#সুলতানা_তানি
অমানিশা আর কুয়াশাকে সঙ্গী করে নিশা যাচ্ছে ঊষার পথে। ঊষার পথ এখনো বহুদূরে। শীতের রাত দীর্ঘ থাকে তো! এখনো মধ্যরাতই চলছে। নওশাদকে ব’ন্দী করে রাকিনরা রওয়ানা করেছে সম্ভার রাজ্যের উদ্দেশ্যে। ওদের হাজার সৈন্য রয়েছে বাহার রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গণেই। শাদী না হওয়া পর্যন্ত সৈন্যরা ওখানেই থাকবে। রাতের শেষ প্রহরে সম্ভার রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছেছে যমজ রাজপুত্রদ্বয়। নওশাদকে রাজ কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। যমজ পুত্রদ্বয় পিতার সম্মুখে এসে অবগত করেছে আজকের সকল ঘটনা। বাহার রাজ্যকে স্বাধীন ঘোষণা করে আসায় ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন সম্ভার রাজ। ক্ষোভের সাথে পুত্রদের তিরস্কার করে বলছেন–“বাহার রাজ্য জয় করার কথা শুনে ভেবেছিলাম আমার পুত্রদ্বয় বীর। আর এখন শুনছি সেখানে মহব্বতের নিশান উড়িয়ে দিয়ে চলে এসেছো তোমরা!”
“মহব্বতের জন্যই তো এমন অঘোষিত যুদ্ধ করেছিলাম আব্বা।”–গম্ভীর বদনে রাকিন মুখের উপরে জবাব দিয়েছে পিতার।
“তুমি তো রাজদর্শনই বোঝো না। রাজদর্শনে মহব্বত অনেক দূরের ব্যাপার। নতুন নতুন রাজ্য জয়ই রাজদর্শনের আদর্শ।”–রাজা আবারও কর্কশ কণ্ঠে তিরস্কার করছেন পুত্রকে।
রাকিনও মলিন বদনে অভিমানীসুরে জবাব দিয়েছে — “আব্বা, হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করা ছিলো বাহার রাজ্যে। কোনোভাবে ধরা পড়লেই আমাদেরকে হ’ত্যা করা হতো। আপনি কিন্তু জয়ে আমাদেরকে কোনো সাহায্যই করেন নি। তবে এটা সত্য, ভীনরাজ্যের রাজপ্রাসাদ দখল করলে সবাই রাজ্য জয়েরই ঘোষণা দেয়। এই বাহার রাজ্যটা কিন্তু আমাদের নানা বাড়ি। একটু কি ছাড় দিতে পারি না! জানেন, আম্মির ডায়েরি পড়েই আমরা ঐ রাজপ্রাসাদ জয় করেছি। অথচ আম্মি কিন্তু স্বাধীন বাহার রাজ্য নিয়ে গৌরব করেছিলেন। তবুও রাজদর্শন মেনে আমরা রাজ্য জয়ের ঘোষণাই দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত মহব্বতের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। মহব্বতের বড্ড অভাব ছিলো আমার জীবনে! জন্ম থেকেই তো আপনাকে ভীষণ ব্যস্ত দেখেছি আব্বা! পুত্রদেরকে মহব্বত করার মতো সময়ও আপনি পান নি। এ জীবনে কখনো কারো মহব্বতই আমি পাই নি! তাই মহব্বতের নিশানাই রেখে এসেছি বাহার রাজ্যে। আজ যদি আমার আম্মি জীবিত থাকতো, তবে আপনি কি পারতেন বাহার রাজ্যকে পরাধীন করে রেখে আসতে? আপনি নিজেও কিন্তু মহব্বতের কাছেই পরাজিত হতেন।”
পুত্রের কথায় সম্ভার রাজ নীরব হয়ে গেছেন। সত্যিই তার স্ত্রী জীবিত থাকলে তিনিও হয়তো পরাধীন করতে পারতেন না বাহার রাজ্যকে। স্ত্রীর মৃ’ত্যুর পরে এক চ’ক্রান্তের ফাঁদে পড়ে বিয়ে করেছিলেন নর্তকীকে। সে নর্তকীকে হ’ত্যা করেছিলেন নিজেই। আর বিয়ে করেন নি সম্ভার রাজ। তবে নর্তকীর স্থান নেই তার হৃদয়গহীনে। মন পিঞ্জিরায় লুকায়িত করে প্রথমা স্ত্রীকেই রেখেছেন বুকে। আজও স্ত্রীর কথা স্মরণ হতেই নিশ্চুপ নীরবতা ঘিরে ধরেছে সম্ভার রাজকে। ক্ষণিকের নীরবতা কে’টে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাজা মলিন বদনে বলছেন–“রাজ অভিধানে অন্য রাজ্যকে ছাড় দেয়ার মতো কোনো শব্দ নেই শাহ্জাদা। নানাবাড়ি,শ্বশুরবাড়ি বলতেও কিছু নেই রাজদর্শনে। নিজ রাজ্যকে ঠিক রেখে অন্য রাজ্য জয়ই রাজদর্শনের মূলনীতি। ”
পুত্রদ্বয় নিশ্চুপ হয়ে আছে নির্বাক বদনে। রাজা নিজেই আবার আলাপ শুরু করেছেন –“তোমাদের মনে আছে, আরশান বলেছিলো সময় মতো ওর পাওনা চেয়ে নিবে!”
“জ্বী আব্বা। আপনি বলেছিলে আরশান যা চাইবে, তাই দিবেন।”–শামস্ সম্মোহনী সুরে তড়িৎ জবাব দিয়েছে পিতাকে।
“মনে আছে তাহলে! আজ তোমাদের যুদ্ধ জয়ের ঘটনা শোনার পরে আরশান ওর চূড়ান্ত আবদারের কথা জসনিয়েছে।”
“কি আবদার করেছে আরশান?”(রাকিন কৌতূহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছে পিতাকে)
রাজা গম্ভীর কণ্ঠে জানাচ্ছেন — “আরশান বলেছে এই সম্ভার রাজ্যের সিংহাসন ওকে দিতে হবে। তা নাহলে বাহার রাজকন্যা নওরাকে দিতে হবে।”
“মানে! এই সিংহাসনের উত্তরাধিকার আমি। আর রাজকন্যা নওরা তো আমার মেহবুবা। আমার প্রিয় জিনিস দুটোতেই কেন আবদার করতে হলো আরশানের!”–রাকিন বিস্মিত ভঙ্গিতে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জবাব দিয়েছে পিতাকে। আচানক যেনো রাকিনের হৃদয় আকাশে শুরু হয়েছে ব’জ্রপাত। দাউ দাউ করে সেথায় জ্বলছে অগ্নি। তীব্র কষ্ট আর যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়। কখন শেষ হবে এ হৃদয়জ যন্ত্রণার প্রহর! রাজা ধীর কণ্ঠে পুত্রকে বলছেন–“আমি ইচ্ছেপূরণের ওয়াদা দিয়েছিলাম আরশানকে। এখন আর এই দুটো একসাথে তোমাকে দেয়া যাবে না রাকিন। তুমিই বলো, সিংহাসন চাও নাকি নওরাকে চাও?”
“আমি দুটোই চাই। যদি একটাও হাতছাড়া হয় তবে আপনাকে এবং আপনার কু’চক্রী পুত্র আরশানকে আমি হ’ত্যা করবো।”–চরম হুশিয়ারি দিয়েছে রাকিন পিতাকে।
শামস্ ভাইকে টেনে নিয়ে বের হয়ে গেছে পিতার কক্ষ থেকে। মেহবুবাকে জয় করতে গিয়ে বিশাল অভিযান করতে হয়েছে আজ রাকিনকে। সব কিছু সেরে এসে এখন নিজ প্রাসাদেই ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হলো। হতাশায়,ব্যথায় বুক ভরে যাচ্ছে আজ। নিজ কক্ষে এসে নির্ঘুম বসে আছে রাকিন। যমজ ভাই শামস্ রয়েছে দুঃখ ভারাক্রান্ত রাকিনের পাশে। কি করবে ওরা এখন! সব ভেঙে চুরমার করে ফেলতে ইচ্ছে করছে রাকিনের! হঠাৎ কক্ষের সামনে এসে একজন কর্মচারী প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেছে। কোনো আওয়াজ নেই রাকিনের। শামসের নিকট থেকে অনুমতি পেয়ে লোকটি প্রবেশ করেছে কক্ষে। রাকিন মুখ তুলে একবার তাকিয়েছে লোকটির বদনে। আরশানের পেছনে কয়েকজন গুপ্তচর নিযুক্ত করেছিলো রাকিন। তারই একজন বিশ্বস্ত গুপ্তচর এ লোক। শাহ্জাদা মলিন বদনে লোকটিকে জিজ্ঞেস করছে–” কিছু বলতে চাচ্ছেন নাকি?”
গুপ্তচর অভয় পেয়ে ধীর কণ্ঠে রাকিনকে বলছে–“শাহ্জাদা, আপনি আরশানকে নজরদারিতে রাখতে বলেছিলেন। এই কয়েকদিনে আমি না একটা বিশেষ ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছি। শাহ্জাদা আরশান মাঝে মাঝেই রাতে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায়।”
“সেটা তো জানিই। ওর প্রেমিকাদের সাথে নিশিযাপন করতে যায়!”–শামসের সোজাসাপটা জবাব।
“শুধু প্রেমিকাদের কাছেই যায় না। আরও এক জাযগায় যায়।”
“কোথায়?”–রাকিন কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করেছে।
” প্রণয় নদ পেরিয়ে এক পাহাড়ে যায়।
সেখানে এক মধ্যবয়সী লোকের সাথে গোপনে পরামর্শ করে। আজ রাতেও শাহ্জাদা আরশান সেখানেই গিয়েছে। ব্যাপারটা কিন্তু সুবিধার মনে হচ্ছে না।”
“কি বলছো এসব! আমি তো এখন ভীষণ ক্লান্ত। নয়তো এখনই তোমার সাথে সে পাহাড়ে যেতাম! দেখে আসতাম সে লোককে!”–ক্লান্ত শরীরে হতাশ কণ্ঠে বলেছে রাকিন।
ভাইয়ের কথা শুনে শামস্ বলছে–“রাকিন, তুই আসলেই বেশ ক্লান্ত। সেই সকাল থেকে ঝামেলায় আছিস। এক কাজ কর, তুই একটু বিশ্রাম নে। গুপ্তচরের সাথে আমি যাচ্ছি পাহাড়ে!”
“ছদ্মবেশে যাইস শামস্। নয়তো আরশান তোকে চিনে ফেলতে পারে!”
………..
সকাল দশটার মতো বাজে এখন। ঝলমলে রোদের আলোয় আলোকিত সম্ভার রাজপ্রাসাদ। শাহ্জাদা রাকিন রয়েছে নিজ কক্ষে। পিতার প্রতি ভীষণ ক্ষিপ্ত হওয়ায় আজ দরবারেও যায় নি ছেলেটি। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো জিনিসের একটি হাতছাড়া হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে শাহ্জাদার। মনে হয় যেনো খঞ্জর বি’দ্ধ হয়ে আছে বুকে। হাহাকার করা এক অনুভূতি। সুখের হিল্লোল নেই এ বিষম অনুভূতিতে।। এরই মাঝে শামস্ ফিরে এসেছে কক্ষে। কক্ষদ্বার বন্ধ করে দৌড়ে এসে বসেছে রাকিনের পাশে। খুব আগ্রহের সাথে ফি’স’ফিসিয়ে বলছে– “জানিস রাকিন,যে লোকটার কাছে আরশান যায়, সে লোকটার চেহারার সাথে না ওর চেহারার কিছুটা মিল রয়েছে।”
রাকিন তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছে –“এটা কি করে সম্ভব! ওর নর্তকী মায়ের তো কোন ভাইও ছিলো না যে তার সাথে চেহারায় মিল হবে।”
” শুধু সেই লোকটার চেহারার সাথে নয়। আরও যেসব পুরুষ লোক আছে তাদের চেহারার সাথেও আরশানের চেহারার কোথায় যেন একটু মিল রয়েছে।”(শামস্)
“তাই নাকি!”–বলেই রাকিন তৎক্ষণাৎ উঠে বসেছে। একের পর এক চিন্তা যুক্ত হচ্ছে মস্তিষ্কে। এ যেনো পাহাড়সম দুশ্চিন্তা। তড়িঘড়ি করে একজন কর্মচারীর সাহায্যে রাজ চিত্রশিল্পীকে তলব করেছে। নিজেও কিছু খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে সে চিত্রশিল্পীকে নিয়ে দু’ভাই রওয়ানা করেছে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। প্রণয় নদ শান্তই ছিলো আজ। সকালের দিকটায় জোয়ার কমই আসে নদে। দুপুরের দিকে ওরা পৌঁছে গেছে পাহাড়ের নিকটে। নৌকা বেঁ’ধে নিয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা নদীতে। আগেরবার শামস্ এসে সে মধ্যবয়সী লোককে দেখে গেছে। রাকিন তো আর তাকে চেনে না! তাই শামসই এবার চিত্রশিল্পীকে নিয়ে পাহাড়ে উঠেছে। চিত্রশিল্পীকে তো দেখাতে হবে সে লোককে। হত দরিদ্রের ন্যায় পোশাক পরিধান করে ছদ্মবেশে শামস আর চিত্রশিল্পী উঠেছে পাহাড়ে। শাহ্জাদা রাকিন অসুস্থ রোগীর ন্যায় চাদর মুড়ি দিয়ে নৌকায় শুয়ে রয়েছে। খুব সকালে শামস্ লুকিয়ে দেখে গিয়েছিলো ৪৫-৫০ বছরের মধ্যবয়সী লোকটিকে। এখন দিনের বেলা। সবাই জাগ্রত। সকালের মতো ওভাবে লুকিয়ে তার মুখদর্শন করা যাবে না। ধরা পড়ে যাবার ভয় থাকবে। তাই চিত্রশিল্পীকে নিয়ে ফকিরের বেশেই শামস্ এসেছে। এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সে লোকের পাহাড়ী বসত ঘরের সম্মুখে। নৌকায় থাকা অসুস্থ রোগীর জন্য একটু বিশুদ্ধ খাবার ভিক্ষা চেয়েছে শামস্। মধ্যাহ্নভোজের সময় হওয়ায় সে মধ্যবয়সী লোকটিও বাড়িতেই ছিলেন। পাহাড়ের উপর থেকেই দেখেছেন নৌকায় রোগীর ছদ্মবেশে শুয়ে থাকা রাকিনকে। নৌকায় অসুস্থ রোগী থাকার ঘটনা বিশ্বাসও হয়েছে তার। তাই তো কলা পাতায় মুড়ে সামান্য খাবার ভিক্ষা দিয়েছেন রোগীর জন্য। শামসরা সে খাবারসহ ফিরে এসেছে নৌকায়। রাজ চিত্রশিল্পী তো ভালো করেই দেখে এসেছে লোকটির চেহারা।
………..
পাহাড়ের ওখান থেকে সম্ভার রাজ প্রাসাদে ফিরতে বিকেল হয়ে গেছে ওদের। চিত্রশিল্পীকে সে লোকটির ছবি দ্রুত আঁকার নির্দেশ দিয়েছে রাকিন। রাজ চিত্রশালায় বসে সে লোকের ছবি অঙ্কনে ব্যস্ত চিত্রশিল্পী। সম্ভার রাজও দরবার কার্য শেষে নিজ কক্ষে ফিরেছেন। অভিমানী রাকিন একবারও গমন করে নি পিতার কক্ষে। শামস্ গিয়ে পিতাকে আরশানের যাবতীয় ঘটনা অবগত করেছে। রাত দশটা নাগাদ রাজ চিত্রশিল্পী হাজির হয়েছে রাকিনের কক্ষে। পাহাড়ের সে মধ্যবয়সী লোকটির একটি নিঃখুঁত ছবি হস্তান্তর করেছে শাহ্জাদার কাছে। শামস্ও এ কক্ষেই ছিলো। ভীষণ বিস্মিত সে ছবি দেখে। এতোটা নিঃখুঁত ছবি কি করে অঙ্কন করা যায়! শামস্ গিয়ে রাজাধিরাজ পিতাকে ডেকে নিয়ে এসেছে রাকিনের কক্ষে। এসেই এ মধ্যবয়সী লোকের ছবি দেখে রাজা রীতিমতো চমকে গেছেন। যমজ রাজপুত্রদ্বয় একইসাথে কৌতূহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছে–“আব্বা, কে এই লোক?”
রাজা মলিন বদনে ধীর কন্ঠে বলছেন–“ওর নাম মোশতাক। তোমরা তো জানো যে আরশানের মা নর্তকী ছিলো!”
“সেটা জানি। কিন্তু এই মোশতাক কে?”
“বলছি, মোশতাকের কথাই বলছি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজমন্ত্রীর প্রেমিকা ছিলো আরশানের নর্তকী মা। ওরা দুজন গোপনে ব্য’ভিচারে লিপ্ত হতো। ধরা পড়ার পরে আমি একসাথে হ’ত্যা করেছিলাম ওদেরকে। বেঈমান মন্ত্রীর মৃ’ত্যুর পরে ওর ভাই আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো। আমিও ওদের পুরো ফ্যামিলিকে রাজ্যছাড়া করেছিলাম। এই মোশতাক লোকটাই হচ্ছে সেই মন্ত্রীর ভাই এবং আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী।”
“কি বলছেন আব্বা এসব! আরশানই ওনার সাথে কি করছে গোপনে! আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”–রাকিন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলছে।
রাজা চিন্তিত ভঙ্গিতে দ্বিধান্বিত স্বরে বলছেন–“আমিও বুঝতে পারছি না আরশান ওকে কোথায় খুঁজে পেলো! ওর সাথে আরশানের যোগাযোগের কারণটাই বা কি? কবে থেকে যোগাযোগ চলছে ওদের মাঝে?”
শামস্ আত্মবিশ্বাসী সুরে পিতাকে বলছে–“জানেন আব্বা, এই লোকটার চেহারার সাথে না আরশানের চেহারার কিঞ্চিৎ মিল রয়েছে। এই যে দ্যাখেন ছবিতেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আপনার সাথে তো আরশানের কোনো মিলই নেই।”
শামসের কথা শুনে যেন মেঘমলিন হলো রাজার বদনখানি। আফসোসের সুরে মলিন বদনে রাজা বলছে–“কিছু জানি না বাপ! কিছু জানি না! তোর দাদী তোদের মায়ের অভাব পূরণ করতে চেয়ে আমায় নর্তকী বিয়ে করিয়ে দিয়েছিলো। নর্তকীর গর্ভের পুত্র আরশান। জানি না আমায় কত শত ধোঁকা দিয়ে গেছে সে নর্তকী ডা’ইনীটা। তবে…!”
রাজা কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করেছেন। দুই পুত্র কৌতূহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছে –“তবে কি আব্বা?”
“এক রাজ জ্যোতিষী ছিলো আমার সভাসদ। সে জ্যোতিষী আমায় বলেছিলো আরশান নাকি রাজপুত্র নয়। তার বিবেচনায় নর্তকীর গর্ভে নাকি কোনো রাজ সন্তান আসে নি। রাজপুত্র আরশানের জন্ম নিয়ে অপ্রিয় কথা বলায় আমি তৎক্ষনাৎ হ’ত্যা করেছিলাম সে জ্যোতিষীকে।”
রাকিন চিন্তিত ভঙ্গিতে হতাশার সুরে রাজাকে বলেছে–“জানেন আব্বা, আমাদের বর্তমান রাজ জ্যোতিষীও আরশানের বিষয়টা কিভাবে যেনো এড়িয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আরশানকে নিয়ে কোথাও কোনো একটা ঝামেলা আছে।”
“জানি না রে বাপ!”
“আরশানের ছোটবেলায় কি ওর চেহারা দেখে আপনার কখনো সন্দেহ হয় নি?”
রাজার আওয়াজ ভারী হয়েছে আজ অজানা বেদনার ভারে। সে ভারী কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাকিনকে জবাব দিয়েছে–” না রে! ছোটবেলায় চেহারার এতো কিছু বোঝা যায় না! তাছাড়া ওর নর্তকী মায়ের সাথেই বেশি মিল রয়েছে আরশানের। এখন তো আমার শত্রুর সাথে গোপন যোগাযোগ রেখেছে ছেলেটা। জানি না কি কি ষ’ড়যন্ত্র করছে ওরা। আজ কেন যেনো মনে হচ্ছে আরশান সত্যিই আমার পুত্র নয়। তবে আর কোনোভাবেই গোপন যোগাযোগের সুযোগ দেয়া যাবে না ওদেরকে। এখনই বন্দী করতে হবে আরশানকে।”
কয়েক মিনিটের মাথায় আরশানকে নিজ কক্ষ থেকে ব’ন্দী করা হয়। বাহার রাজ্যের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে সম্ভার রাজসেনারা তৈরি ছিলো। সেনাপতি উদয় বেগকে রাতের মধ্যে সেই পাহাড় আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন সম্ভার রাজ। এখন রাত প্রায় বারোটা। বিশাল নৌবহর নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে সম্ভার রাজ সেনারা। সেনাপতি উদয় বেগের সাথে যমজ রাজপুত্রদ্বয় রয়েছে। সাবেক রাজমন্ত্রীর ভাই মোশতাককে বন্দী করা হবে। আরশানের গোপন যোগাযোগ সংক্রান্ত তথ্যও উদঘাটন করা হবে। প্রণয় নদ আজ স্রোত সংকুল। স্রোতের দোলায় দোলায় ওরা চলে এসেছে বাহার রাজ্যের একটি তীরের নিকটে। এ তীরের উল্টো দিকে তিমির রাজ্য। সে রাজ্যের প্রান্ত ঘেঁষে থাকা পাহাড়েই রয়েছে মন্ত্রীর সে ভাই। নদী স্রোত সংকুল হওয়ায় রাত দুটোর মাঝেই ওরা পৌঁছে গেছে পাহাড়ে। পুরো পাহাড় ঘিরে রাখা হয়েছে সৈন্য দিয়ে। পাহাড়ের লোকজন এখন নিদ্রিত। অতর্কিত আক্রমণ করা হয়েছে। প্রায় দু’ঘন্টার চেষ্টায় রাত চারটা নাগাদ ব’ন্দী করা হয়েছে মোশতাকসহ সকল কু’চক্রীদের। ব’ন্দীদেরকে নিয়ে আবার প্রণয় নদ পাড়ি দেয়া হচ্ছে। স্রোতের দাপট কমে গেছে এখন নদে। রাজকীয় নৌবহর ধীরে ধীরে পাড়ি দিচ্ছে। ফজরের আযানের পরে বাহার রাজ্যের তীর অতিক্রম করছিলো নৌবহর। নৌবহরে সেনাপতি উদয় বেগ রয়েছেন। শাহ্জাদা শামসও রয়েছে। তাই রাকিন ওদের হাতে ব’ন্দীদের দ্বায়িত্ব দিয়ে নিজে বাহার রাজ্যে গমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাহার রাজ্যে অবস্থানরত হাজার সৈন্যের খোঁজ নিতে হবে। মেহবুবার সাথেও একটু মোলাকাতের বাসনা রয়েছে। অসীম কুয়াশার মাঝেই ঘোড়া ছুটিয়ে শাহ্জাদার আগমন ঘটেছে বাহার রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গনে। সৈন্যদের নিদ কে’টেছে আরো আগে। তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে রাকিন। শারীরিক,মানসিক অবস্থার কথা জেনে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। সৈনিকদের সাথে আলাপচারিতা শেষে বাহার রাজপ্রাসাদে আগমন ঘটেছে রাকিনের। শাহ্জাদাকে দেখে নিজের পুত্র না থাকার জন্য আজও আফসোস করছেন বাহার রাজ। রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে রাকিন বলছে–“আপনার রাজপুত্র নেই বলে মোটেও আফসোস করবেন না। আপনার তিন রাজকন্যাই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। মনভোলা শাহ্জাদী নাবিহাও কিন্তু যু’দ্ধের বিরোধিতা করেছে। তাসকিন ভাইকে যু’দ্ধে সম্মতি দেয়া থেকে বিরত রেখেছে। শাহ্জাদী নেহেরিনও প্রতিবাদী। শাহ্জাদী নওরা আমাদেরকে রাজঘোষণা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে। আপনাদের রাজসম্মান ফিরিয়ে নিয়েছে মাত্র কয়েক মিনিটের বুদ্ধিদীপ্ত বাক প্রয়োগে। যদি নওশাদের মতো একজন রাজপুত্র হতো আপনার! রাজ্যের ক্রান্তিকালেও যদি ফূর্তিতে মগ্ন থাকতো! তবে আপনার জীবনে অশান্তি আরো বেশি হতো।”
বাহার রাজ সন্তুষ্ট হয়েছেন রাকিনের সান্ত্বনায়। নওরার সাথে এখনো সাক্ষাৎ হয় নি শাহ্জাদার। প্রাসাদে থেকেই রাকিন দেখেছে নওরা রয়েছে ফুলবাগানে। বাগানের একপাশে লক্ষ্য ঠিক করে বারবার তীর ছুঁড়ছে শাহ্জাদী। রাকিন বের হয়ে এসেছে প্রাসাদ থেকে। ফুলবাগানে এসে পেছন থেকে ডেকেছে শাহ্জাদীকে–“কি অবস্থা মহারানী!”
“আরেহ্ শাহ্জাদা, আপনি!”
“আমার মহারানীর খোঁজ নিতে চলে এলাম!”
“তাই! এসেছেন ভালো করেছেন। জানেন, আপনাদের সৈনিকদের মুখ থেকে আমাদের প্রাসাদে এক গুজব এসেছে। গুজবটা আরশানের ব’ন্দী হওয়ার গুজব! রাতে আপনাদের রাজ্য থেকে সৈনিকদের যারা খাবার সরবরাহ করেছে তারাই নাকি জানিয়েছে!”
“হুম। সত্যিই ব’ন্দী করেছি আরশানকে।”
“যাক, আমাদের পথের কাঁটা তো দূর হয়ে গেলো!”
“আমার এ গোলাপের পাশে এখন আর কোনো কাঁটা নেই। এ গোলাপ এখন নিশিদিন আমার হৃদয় বাগানেই দুলবে।”
“এ গোলাপকে কবে নিচ্ছেন আপনার হৃদয় বাগানে?”
“গোলাপ তো আমার হৃদয় বাগানেই রয়েছে। তবে ফুল হয়ে নয়, ফুলকলি হয়ে। হৃদয়ে বসন্তের লগ্নও কিন্তু এসে গেছে। এখন যেকোনো দিন গোলাপ প্রস্ফুটিত হবার পালা।”
“প্রস্ফূটিত হবার পরে যদি এ গোলাপ কখনো শুকিয়ে যায়!”
“তখন আমিও শুকিয়ে যাবো। একসাথে ঝরে দুজন মিশে যেতে চাই মাটিতে।”
“দেখা যাক!”
“দেইখো!”
“আচ্ছা, আমায় মহব্বতের বার্তা পাঠান নি কেন?” (অভিমানী সুরে,নওরা)
“সময় পাই নি। আর মহব্বতের বার্তা দিতে নিজেই তো চলে এসেছি।”
“তো দিচ্ছেন না কেন?”
“আমার বাহুডোরে এসো! বুকে কান পেতে শুনে যাও মহব্বতের কথা।”
“থাক, ওসব বিয়ের পরেই শুনবো!”
“ঠিক আছে, মহব্বতও জমিয়ে রাখলাম!”
” রাজা হয়ে আবার আমায় মহব্বত করতে ভুলে যাবেন কিন্তু!”
“আমি মহব্বতের রাজা হবো।”
“কি! মহব্বতের রাজা হবেন মানে! জীবনে কয়জনকে মহব্বত করে মহব্বতের রাজা হতে চান?”
“শুধু আমার রানীকেই মহব্বত করতে চাই। এতো এতো মহব্বত করবো যেনো আমার নাম মহব্বতের রাজা হয়ে যায়!”
নওরা মৃদু হেসে হাতে তীর নিয়েছে। নিক্ষেপ করেছে ক্ষণিকেই। আজও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে তীর। রাকিনের বদনে চেয়ে বলছে–“আজও তো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো আমার তীর। আজ আমায় ধনুর্বিদ্যা শিখিয়ে দিতে আসছেন না যে!”
“না, শেখাতে চাই না।”
“কেন?”
“তোমায় কিন্তু অবলা-সরলা ভেবেছিলাম। যা খেলা দেখিয়েছো! রাজঘোষণা প্রত্যাহার করিয়ে ছেড়েছো! নিঃখুঁত ধনুর্বিদ্যা শেখালে না জানি প্রথম তীরটা আমার বুকেই বি’দ্ধ করো!”
হি হি শব্দে হেসে উঠেছে নওরা। হাস্যোজ্জ্বল বদনে আড়চোখে চেয়ে বলেছে–“হায়হায়, বলে কি!”
“আড়াল থেকে যেদিন প্রথমবার তাকিয়েছো আমার পানে সেদিনই ঘায়েল করেছো আমায়! তীরের মতো এ বুককে বি’দ্ধ করেছিলো তোমার সে দৃষ্টি। তবে কষ্টের তীর নয়, মহব্বতের তীর সেদিনই বি’দ্ধ হয়েছিলো এ বুকে।”
“শুনুন, মহব্বতের গল্প পরে করবো। এখন কিন্তু দিনের বেলা। প্রহরীরা লক্ষ্য করছে আমাদের দুজনকে। আপনি বরং প্রাসাদে চলে যান!”
“আমি প্রাসাদ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি। আমাদের সম্ভার রাজ্যে ফিরে যাবো। সেখানে বিচার হবে আরশানসহ সকল ব’ন্দীদের।
………………..
কুয়াশার সাথে লুকোচুরি শেষে রোদ বেরিয়ে এসেছে। সোনালী রোদের আলোয় স্বর্ণাভ চারদিক। সকাল দশটা বাজে এখন। রাকিন ফিরে এসেছে সম্ভার রাজপ্রাসাদে। রাজ দরবার কক্ষে উপস্থিত রয়েছে সকল সভাসদ। বিচার শুরু হয়েছে আরশানসহ পাহাড় থেকে ধরে আনা ব’ন্দীদের। রাজপুত্র হলেও রাজা আরশানের বিচারই করতে চান সবার আগে। বিচার শুরু হয়েছে। রাজা গম্ভীর কণ্ঠে মোশতাককে বলছেন–“আরশানের সাথে তোমার পরিচয় হলো কিভাবে? আরশান কেন যেতো তোমার কাছে? আরশানের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? সব সত্য কথা বলবে। সত্য বললে তোমার সাজা কম হবে।”
মোশতাক করুনসুরে জানাচ্ছে–“আমি সব সত্য বলবো। দয়া করে আমায় ফাঁসি দেবেন না মহারাজ।”
“আগে সব বলো।”
মোশতাক মলিন বদনে করুনসুরে বলছে–“আমার মন্ত্রী ভাইয়ের প্রেমিকা ছিলো এক নর্তকী। আমার মন্ত্রী ভাই সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা করে তার সে প্রেমিকাকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। বিয়ের পরে নর্তকী হয়ে যায় সম্ভার রাজ্যের রানী। কিছুদিন পরে আপনার প্রথম পক্ষের যমজ পুত্রদ্বয়কে ধুতরা ফুলের বিষ দিয়ে হ’ত্যা করতে চেয়েছিলো সেই নর্তকী রানী। সেদিনই তো আপনি নর্তকীকে বনবাসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আপনার মনে আছে এসব মহারাজ?”
“সব মনে আছে।”
“আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন যে নর্তকী,বাইজিদের কাছে অনেক প্রাকৃতিক পদ্ধতি থাকে। ঐসব পদ্ধতি ব্যবহার করে ওরা সহজেই গর্ভধারণ এড়াতে পারে।”
“হুম, জানি।”
“আপনার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। নর্তকী আমার ভাইকে ভালোবাসতো বিধায় আপনার সন্তান কখনো গর্ভে ধারণ করে নি। মিলনের আগে-পরে বিভিন্ন পদ্ধতিতে গর্ভধারণ এড়িয়ে গেছে। বনবাসে পাঠানোর সময়ও নর্তকীর গর্ভে আপনার ঔরসজাত কোনো সন্তান ছিলো না।”
“তুমি কিভাবে জানলে! নর্তকীর গর্ভে সন্তান না থাকলে আরশান কোথা থেকে এলো?”–রাজা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেছে মোশতাককে।
“আমার মন্ত্রী ভাইয়ের সাথে আগে থেকেই নর্তকীর অবৈধ সম্পর্ক ছিলো।যেদিন আপনি নর্তকীকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন সেদিন রাতেই আমরা ভাইয়েরা মিলে সে বনে গমন করি। আমাদের মাঝে এক চ’ক্রান্ত হয় তখন। আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য নর্তকীর গর্ভে সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে রাতে আমরা নর্তকীকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন থেকে আমার ভাই নর্তকীর সাথে রোজ রাতে মিলিত হতো। কিছুদিনের মধ্যে নর্তকী গর্ভবতী হয়। আমার ভাই তখন নর্তকীকে আবার বনবাসে নিয়ে যায়। বনবাসে রেখে রাজপ্রাসাদে দায়িত্বে ফিরে আসে আমার ভাই। এসে আপনাকে জানায় যে আপনার নর্তকী রানী গর্ভধারণ করেছে। আপনার রাজ সন্তান তার গর্ভে। মূলত নর্তকীকে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনার জন্যই সেই গর্ভধারণ করা হয়। কারণ রাজসন্তানকে আপনি কখনোই বনে জন্মগ্রহণ করতে দেবেন না। আমার ভাই ভেবেছিলো নর্তকী প্রাসাদে ফিরলে সহজেই রাজপরিবার ধ্বংস করা যাবে। আপনিও আমার ভাইয়ের চ’ক্রান্তে পা দিয়ে গর্ভবতী নর্তকীকে প্রাসাদ নিয়ে এসেছিলেন। নর্তকীর সেই গর্ভধারণ থেকে জন্মলাভ করা পুত্র হচ্ছে আরশান। ও আমার মন্ত্রী ভাইয়ের পুত্র, আপনার পুত্র নয়।”
“আমি বিশ্বাস করি না তোমার কথা। কারণ আরশান তো গর্ভকালের হিসেব মতোই জন্মলাভ করেছে। “–রাজা প্রতিবাদ করেছে মোশতাককে।
“নর্তকীকে বিভিন্ন কবিরাজি ঔষধ সরবরাহ করেছিলো আমার ভাই যেনো সময়ের আগে সন্তানের জন্ম হয়! আপনি যেনো কোনোভাবেই বুঝতে না পারেন যে এ সন্তান আপনার নয়! নর্তকী কবিরাজি ঔষধ সেবনের কারণে সময়ের কয়েকদিন আগে জন্ম নেয় আরশান। বিশ্বাস না হলে আরশানের কপালটা দেখুন! অবিকল আমাদের ভাইদের কপালের মতোই মাঝখানটা সবসময় কুঁচকে থাকে। ওর ঠোঁট,কোমরের গঠন,নিচু কাঁধ আর হাতের পাঞ্জা দুটোও কিন্তু আমাদের পরিবারের পুরুষদের সাথে মিলে যায়! আমি তো ওর চাচা। আপনি এখনই আমার সাথে এসব মিলিয়ে দেখতে পারেন।”
শামস্ আর রাকিন আরশানের নিকটে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সবকিছু। রাজা কিছু বলার পূর্বেই রাজ জ্যোতিষী উঠে দাঁড়িয়ে বলছে–“মহারাজ,আমায় মার্জনা করবেন। নারী যদি কয়েকদিন আগে-পরে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের সাথে মিলিত হয় তবে গর্ভজাত সন্তান যে কার ঔরসজাত সেটা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ সন্তান অনেক সময় আগে-পরে জন্ম হয়। আমাদের মতো কর্মচারীদের রাজপুত্রের জন্ম নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়, এমনটা ভেবে এতোবছর আমি চুপ করেছিলাম। তবে আমি প্রথম থেকেই বুঝতাম যে আরশান রাজপুত্র নয়। আমার গণনার ফলাফল সবসময়ই আমায় এমনটা জানিয়েছে। আপনাদের রাজ বংশের অতীত,বর্তমান সকল রাজপুত্রদের ছবি এ প্রাসাদে অঙ্কিত রয়েছে। সবারই প্রশস্ত উঁচু কাঁধ,বীরের মতো দীর্ঘকায় শরীর আর কপালে রাজচিহ্ন রয়েছে। কিন্তু আরশানের এরকম কিছু নেই। বিশ্বাস করুন মহারাজ,আমি বহুভাবে প্রমাণ করে দিতে পারবো আরশান রাজপুত্র নয়।”
রাজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছলছল নয়নে বলছেন– “গত বাইশ’টা বছর ধরে রাজপুত্র ভেবে আমি আরশানকে লালন-পালন করলাম! কত আদর-যত্ন করলাম! প্রথমবারই এক জ্যোতিষী বলেছিলো আরশান রাজপুত্র নয়। আমার সেই জ্যোতিষীর কথা বিশ্বাস করা উচিত ছিলো।”
আর কথা বলেন নি সম্ভার রাজ। এহেন প্রতারণার কথা শুনে তিনি থেমে গিয়েছেন বিষম ব্যথায়। ইষৎ মলিন হয়েছে তার গম্ভীর বদনখানি। খানিক বাদেই আবেগঘন কণ্ঠে প্রশ্ন করেছেন –“জানো মোশতাক, তোমার মন্ত্রী ভাইকে আমি অনেক ভালোবাসতাম! তোমার ভাই আমায় হ’ত্যা করতে চেয়েছে। আরশানকেও তো আমি অনেক ভালোবেসেছি। আরশানও কি আমায় হ’ত্যা করতে চেয়েছে?”
মোশতাক মলিন বদনে করুনসুরে জানাচ্ছে–“গত কয়েক বছর ধরেই আরশানের সাথে আমি যোগাযোগ করে যাচ্ছি। আমার আর আরশানের লক্ষ্য একই ছিলো। ভাই হ’ত্যার প্রতিশোধ নিয়ে রাজ্য দখলের ইচ্ছে ছিলো আমার। আর আরশান ওর প্রকৃত বাবা,মা হ’ত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। সিংহাসন দখল এবং পুরো রাজপরিবারকে হ’ত্যাই ছিলো আমাদের পরিকল্পনা।”
“ওর বাবা, মা’কে তা আমি বিনা দোষে হ’ত্যা করিনি। ওরা দুজনও আমাদের রাজ পরিবারকে ধবংস করতে চেয়েছিলো। যাইহোক,তুমি হয়তো আজ সত্য কথাই বলেছো মোশতাক! তোমাকে আমি মৃ’ত্যুদণ্ড দিলাম না। তবে আমৃ’ত্যু কয়েদী হয়ে বাঁচতে হবে তোমাকে।”
রাজার কথা শেষ হতেই কৌতূহলী ভঙ্গিতে রাকিন প্রশ্ন করেছে–“আরশানকে কি সাজা দিবেন আব্বা?”
রাজা ভারী কণ্ঠে অনুতাপের সুরে বলছেন–“বাইশ’টা বছর ধরে ওকে এ প্রাসাদে রাজপুত্রের মর্যাদা দিয়ে লালন-পালন করেছি। ও হয়তো আমায় হ’ত্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু আমি ওকে হ’ত্যা করতে পারবো না। ভীষণ কষ্টে বুক কাঁপবে আমার। আবার চোখের সামনে রাজ কারাগারে ব’ন্দী করে রাখলেও ওর জন্য আমার মায়া লাগবে। ওর মা যে বনে থেকে ওকে জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বনেই ওকে রেখে আয়। আজ থেকে বনবাসেই থাকবে আরশান।”
“কিন্তু আরশান যদি আবার ষ’ড়যন্ত্র করে!”–রাকিন জিজ্ঞাসু স্বরে প্রশ্ন করেছে পিতাকে।
“পারবে না। শক্তি কোথায় পাবে আরশান! সব বে’ঈমানকেই তো ব’ন্দী করেছি। তোরা ওকে নিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে।”
আরশান ভীষণ আকুতির সাথে কেঁদে কেঁদে বলছে–“আমি ভুল করেছি মহারাজ। আমায় ক্ষমা করে দিন। ওয়াদা দিলাম আমি আর আপনাদের কোনো ক্ষতি করবো না। আমায় এই প্রাসাদেই একটু জায়গা দিন!”
রাজাও ভীষণ ক্ষোভে বিষণ্ণ বদনে জবাব দিয়েছেন–“বাইশ বছর এই প্রাসাদে থেকেও আমাদের জন্য তোমার মায়া হলো না! আমাকে,আমার পুত্রদেরকে তুমি হ’ত্যা করতে চেয়েছো! তুমি তোমার বাবা-মায়ের মতোই হয়েছো! তোমাকে আর বিশ্বাস করে ভুল করতে চাই না।”
………….
আধেক পথ পেরিয়ে সূর্য এখন মধ্যগগণে। প্রখর সূর্যের তীব্র আভায় উদ্ভাসিত ধরণীতল। এরই মাঝে মধ্যাহ্নভোজ শেষ হয়েছে সম্ভার রাজপ্রাসাদে। শাহ্জাদা রাকিন আর শামস্ যাবে আরশানকে বনবাসে রেখে আসতে। বাহার রাজ্যের তীর ধরেই যেতে হবে ওদেরকে। নাবিহা বায়না ধরেছে বাবার বাড়ি যাবার। দু’পরিবারের মাঝে থমথমে ভাব থাকায় ভীষণ উদ্বিগ্ন মেয়েটি। বাধ্য হয়ে বউ নিয়ে তাসকিনও রওয়ানা দিচ্ছে ওদের সাথে। প্রণয় নদ ধরে রাজকীয় বেশে চলছে রাজতরী। ছোট-বড় ঢেউ খেলা করছে নদে। অতিথি পাখিদেরও উল্লাসের শেষ নেই। আসরের পরে রাজতরী এসেছে বাহার রাজ্যের নিকটে। যমজ দুজন যাবে আরশানকে বনে পৌঁছে দিতে। তাসকিন তো যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। ঠিক শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, এমনটাও নয়। তাসকিন-নাবিহা বাহার রাজপ্রাসাদে কিছুক্ষণ থেকেই ফিরে আসবে রাজতরীতে। পুত্রকে এখানে নিশিযাপন করতে বারণ করেছেন সম্ভার রাজ। রাজতরী নিয়ে যমজ দুজন বনের দিকে যেতে পারতো! কিন্তু সেক্ষেত্রে তাসকিন-নাবিহা বাহার রাজপ্রাসাদ থেকে ফিরে এসে কোথায় থাকবে! মৃগী রোগী তাসকিনকে তো সাধারণ নৌকায় রাখা ঠিক নয়। একটু ভুল হলেই পানিতে পড়ে যেতে পারে। রাজতরী ভীড়েছে বাহার রাজ্যের তীরে। তাসকিনরা নেমে গেছে।রাজতরীও তীরেই রেখেছে যেনো খানিক বাদেই সস্ত্রীক তাসকিন এসে রাজতরীতে অবস্থান করতে পারে! এদিকে বেলাও বয়ে চলছে আপন গতিতে। চুপিচুপি সাঁঝ নামবে একটু পরেই। তাই আরশানকে নিয়ে যমজ রাজপুত্রদ্বয় ডিঙি নৌকায় উঠে গেছে। আজ আরশান রাজকীয় বেশে নেই। রাজপুত্র তো নয় সে! রাজ তরবারিও নেই তার সাথে। রাকিনদের দেহরক্ষীরা উঠেছে অন্য নৌকায়। রাজতরীব সাথে ছোট ছোট নৌকা থাকে। সে নৌকাই আজ ভরসা হলো ওদের। প্রণয় নদ এখন স্রোতসংকুল। স্রোতের দোলায় এসব দাঁড়বাহী নৌকা সহসাই বহুদূরে চলে যায়! রাকিনরা নদীর বাঁক পেরিয়ে গেছে। দেহরক্ষীদের নৌকাটি এখনো রয়েছে বাঁকের আড়ালে। আজ বৈঠা হাতে যমজ দু’ভাই নৌকা চালাচ্ছে। আরশান রয়েছে নৌকার মাঝখানে। আচানক সেই কুমিরটির দেখা মিললো নদে। আরশান কর্তৃক তীর বি’দ্ধ কুমির এটি। অজানা উদ্দেশ্যে কুমিরটি ওদের নৌকার একপার্শ্ব থেকে অন্যপার্শ্বে ঘুরে যাচ্ছে। এমনই ভঙ্গি যেনো সেই এ নদের রাজা। বৈঠা হাতে রাকিন উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে দেখছে কুমিরটিকে। অবুঝ প্রাণীটি সুস্থ হয়ে যাওয়ায় ভীষণ খুশি শাহ্জাদা। শামস্ তো খুশিতে হাত থেকে বৈঠা রেখে দেখছে কুমিরটির গতিবিধি। কু’চক্রী আরশান হঠাৎ শামসের ফেলে রাখা বৈঠা টেনে নিয়ে বারি মেরেছে রাকিনের পেছন থেকে। উল্টো হয়ে রাকিন পড়ে গেছে প্রণয় নদে। হঠাৎ আ’ঘাতে হাত ফসকে বৈঠা’টি পড়ে গেছে। স্রোতের টানে সে বৈঠা চলে গেছে বহুদূরে। উল্টোভাবে পতিত হওয়ায় শাহ্জাদার তরবারিটিও খোলস থেকে বের হয়ে গেছে। প্রশস্ত গভীর নদের কোথায় চলে গেছে সে তরবারি! কুমিরটিও তড়িৎ গতিতে এসেছে রাকিনকে গ্রাস করতে। ভাইকে কুমির গ্রাস করতে এসেছে দেখে শামস্ তো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য! কুমির আর রাকিন এখন একদম পাশাপাশি। উত্তাল নদে কুমিরের সম্মুখে সাক্ষাৎ মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করছে শাহ্জাদা। শামস্ নিজ তরবারি ছুঁ’ড়ে মে’রেছে কুমিরকে হ’ত্যা করতে। কিন্তু কুমির আর রাকিন তো ছিলো পাশাপাশি। খুব লক্ষ্যভেদী করে তরবারি ছুঁড়লে রাকিনও বি’দ্ধ হতে পারতো! তাই খুব জোরালোভাবে তরবারি ছুঁড়ে মা’রতে পারে নি শামস্। সহসাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে শামসের তরবারি। এ তরবারিও গভীর নদের স্রোতের দোলায় কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো! কুমিরটি এবার আরও আগ্রাসী হয়েছে রাকিনকে ভক্ষণে। সাথে থাকা দেহরক্ষীদের ডিঙি নৌকাটিও রয়েছে নয়নের অগোচরে। সে নৌকা এখানে পৌঁছাবার পূর্বেই রাকিনের মতো কয়েকজনকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে কুমিরটি। এদিকে আরশান বৈঠা হাতে এগিয়ে এসেছে শামসকে আ’ঘাত করতে। হাত থেকে বৈঠা রেখে শামস্ বড্ড ভুল করেছে। সে ভুলের মাশুল হিসেবেই মুকুট রাজকুমার রাকিন রয়েছে কুমিরের বিশাল গ্রাসের সম্মুখে। আর শ’য়তানি হাসিতে আরশান এবার শামসকেও আ’ঘাত করতে ম’রিয়া হয়েছে।
চলবে