#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৯ (প্রথম অংশ)
“কায়েসাম ভাইয়া আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন। আপনাকে আমি কতবার প্রত্যাখ্যান করেছি তবুও আপনি আপনার কাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন না। আজকে আমায় একলা এ রুমে ডেকে আনার অর্থ কী? আপনাকে দেখে তো চরিত্র দোষী মনে হয় না। তবে কেনো আপনি আমাকে এমনটা ভাবতে বাধ্য করছেন হুম?”
কায়েসাম নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শেহরীনার মুখপানে তাকিয়ে আছে। যতই মেয়েটা প্রণয় হতে পিছু হটে যাক সে তো পাক্কা প্রেমিক। হয়ত প্রেমের গল্পে ব্যর্থ প্রেমিক সে। তবুও তার প্রণয়ে খুঁত নেই। অথচ মেয়েটা কত সহজেই না নিজের ব্যাপারে খুঁত খুঁজে বেড়াচ্ছে। বৃথা ভরা হৃদয়ে মলিন শ্বাস ফেলে মৃদু হাসল। হাতজোড়া বুকে আবদ্ধ ছিল তার। টেবিল ঠেসে দাঁড়িয়ে একধ্যানে শেহরীনার কটুক্তি সহ্য করছিল। দরজার বাহিরে পাহারায় আছে তার সাঙ্গপাঙ্গরা। বিধেয় ফারদিনদের ঢোকতে দিচ্ছে না কেউ। মূলত ফাঁকা রুমে ডেকে আনা হয়েছে শেহরীনাকে। সে বিচলিত না হয়ে চলেও এসেছে। তার পিছু ধরে ফারদিনরা এলেও ভেতরে ঢুকতে পারেনি। কায়েসাম তার আত্মসম্মান কে শেহরীনার নিকট বিলিয়ে হাঁটু গেড়ে হাতের মুঠোয় থাকা বড়সরো গোলাপ ফুলের বুকি তার দিকে এগিয়ে দিল। হতভম্ব হয়ে গেল শেহরীনা। আপনাআপনি দুকদম পিছিয়ে যায় সে। কায়েসাম অবাক হয় না বরং সে তার কুমারিনীর কাছ থেকে আশ্চর্য হওয়াটা আশা করছিল। সে শেষবার আজই চাইবে পরে হার মেনে ব্যর্থ হৃদয় নিয়ে এ শহর, এ জেলা ছেড়ে অদূরে ভিন্ন জেলায় পাড়ি জমাবে। তার বুকের ভেতরের যন্ত্রণা বুঝছে না শেহরীনা। কায়েসাম পাগলাটে হেসে বলে,
“ভয় পেয়ো না কুমারিনী। গত কয়েকমাসে তোমার কাছ থেকে দূর দূর ভাব পেয়ে হৃদয়ের আবেগটা না পিছলে গিয়েছে। সে শেষবার চাইবে পরের বার প্রত্যাখ্যান করে ফিরে চলে যাবে পিছু মোড়ে আর চাইবে না প্রমিজ! উইল ইউ ম্যারি মি মাই কুমারিনী?”
শেহরীনা স্তদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটা ভার্সিটি এলেই তাকে বিরক্ত করতো। ভাবনা ছিল সে বখাটে ধরনের তাই উত্যক্ত করা তার স্বভাব। তবে এই যে প্রণয় সেই শব্দের গভীরতা আজ বিহীন ধরতেই পারেনি সে। ছলছল চোখে পিছু মোড়ে যায় সে। তার মন অনুতাপে পুড়ছে। তার কারণে আজ এক প্রেমিকের হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হবে। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? জোরে সরে দম ফেলে সে তার চোখের সামনে সাদা টার্চবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ম্লান গলায় আওড়ায়।
“আইম সরি ভাইয়া আই ক্যান্ট। আমি….।”
“তোমাকে কিছু বলতে হবে না কুমারিনী। দোয়া করি তোমার আগাম জীবন সুখের হোক তোমার প্রিয় মানবের সাথে। আমার মত হতভাগা প্রেমিককে মনে রেখো। তার উপর কোনো মনখারাপি রেখো না। আজ থেকে তুমি কায়েসাম নামে কাউকে সামনে পাবে না।”
শেহরীনা ইতস্তত বোধ করছে। আমতা আমতা করে বলে,
‘ভুল বুঝছেন। আপনি আপনার সম্মান রক্ষার্থে আপনার দায়িত্ব রক্ষার্থে অবশ্য ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার হতে পারেন। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। বরং আমার ভালো লাগবে। এই দেখে যে, আপনি আপনার দায়িত্ব বোধে এগিয়ে যাচ্ছেন।’
কায়েসাম শুনে হুহু করে হেসে উঠল। তার কুমারিনীর বোকা বোকা কথাগুলো তার বড্ড প্রিয়। নিমিত্তে তার উদাসীন মনকে নেড়ে দেয়। সে ফুলের বুকিটি হাতে আঁকড়ে রেখে দরজার নিকট এগিয়ে যায়। বন্ধ দরজা খুলে বাহিরে কয়েক জোড়া অপেক্ষিত চোখজোড়া দেখতে পেল। সে পেছন মোড়ে একপলক শেহরীনার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। শেহরীনা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছেলেটার চোখের মধ্যে অজস্র জলরেখা ভীড় করেছে তবুও সে হাসল এই হাসি যে শান্ত্বনার। কায়েসাম ধুপধাপ পা মেলে চলে গেল। তাকে গম্ভীর দেখে তার পিছু পিছু তার সাঙ্গপাঙ্গরা চলে যায়।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)ফারদিনরা তড়িঘড়ি ভেতরে গিয়ে ঝাপ্টে ধরে শেহরীনাকে। ইপশিতা তো কেঁদে দেওয়ার মত অবস্থা। একে একে জিজ্ঞেস করছে ঘটনা কী? শেহরীনা তাদের শান্ত করে ভার্সিটির পেছনের দিকে পুকুর পাড়ে যাওয়ার অনুরোধ করে। তারাও রাজি মন নিয়ে চলে যায়।
শেহরীনা ঘটনা খুলে বলে। ফারদিন শুনে বুকে হাত দিয়ে জোরালো শ্বাস ফেলে বলে,
“ভাগ্যিস ছেলেটার বুদ্ধি হয়েছে। নাহলে সারোয়ার ভাই তো তাকে ৪৫৬ দফায় জেলে পুরে দিতো।”
‘সারোয়ার’ এর নাম শুনে শেহরীনার মুখের হাসি বিলিন হয়ে গেল। আজ প্রায় এক সপ্তাহ যাবত সে তার সঙ্গে কথা বলছে না। কেনো বলছে না সেটা শেহরীনা প্রকাশ ও করছে না। তাই বোধহয় মানুষটা বিরক্ত হয়ে পিছু হটে গেল। মনের মাঝে কথাটা ভাবনা হয়ে এলেই শেহরীনার হৃদয়ে যন্ত্রণা হয়ে উঠে। ইপশিতাও হেসে শেহরীনার কাঁধ জড়িয়ে তার পাশে বসে যায়। তারা সিটের উপর বসে আছে। ফারদিন হঠাৎ করে তার সৎ বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। শেহরীনা অনুনয় গলায় বলে,
“তিনি মোটেও সুস্থ নয়। সেদিন চিকিৎসা করানো হয়নি দেখে বিছানায় প্যারালাইজ ব্যক্তির মত শুয়ে থাকেন। খুব দূর দশা চলছে ঘরে। মাঝে মাঝে মনে হয় কারো কাছে বুঝি আমাদের সুখ সহে না।”
ফারদিন তার কাঁধে শান্ত্বনার ন্যায় হাত রাখল। ইপশিতা ‘আ’ ময় শব্দ মুখ থেকে বের করার মুহুর্তেই চুপ হয়ে যায়। তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল সে নিজের বাবা-মাকে এ প্রথম ভার্সিটির মধ্যে আসতে দেখছে। শেহরীনা সহ তারা ইপশিতার চুপচাপ নিরব চেহারা দেখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন তাকায়। ইপশিতার বাবা-মাকে ফারদিন আর শেহরীনা দেখেছে অনেকবার। তবে জাফরান কখনো দেখেনি এ প্রথম দেখছে। ফারদিন বন্ধুদের অগোচরে চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে চুল সেট করে ভদ্রভাবে সাজ দিয়ে ইপশিতার পাশে দাঁড়ায়। ইপশিতার মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে আছেন। ইপশিতার বাবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। তিনি খোশমেজাজ পূর্ণ গলায় শেহরীনাকে জিজ্ঞেস করেন।
“কী মা কেমন আছো তোমরা সবাই?”
তারা সালাম দেয় বিনিময়ে ইপশিতার বাবা-মাও সালামের জবাব দিয়ে মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। ফারদিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। শেহরীনা মৃদু হেসে বলে,
“আঙ্কেল হঠাৎ মিষ্টি কিসের খুশিতে?”
ইপশিতার বাবা ইপশিতাকে ধরে আগলে রেখে বলেন,’আমার আম্মার বিয়ে পাক্কা হয়ছে মা’।
উক্ত কথা শুনতে শেহরীনারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফারদিন যেনো বধির, বোবা হয়ে গেল। তার দৃষ্টিকোণ গিয়ে ঠেকে ইপশিতার মুখপানে। মেয়েটার চেহারায় আশ্চর্যতা লক্ষ্য করে আমতাময় কণ্ঠে শোধায়।
‘সত্যিই কী এবার তুই মজা করছিস না?’
ইপশিতার নিজের কানেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার বাবা মা তবে এই কারণে এতটা উৎফুল্ল হয়ে ছিল গতরাত থেকে। কিন্তু সে তো বিয়েতে নাকচ করেছিল বহু দিন আগেও। উত্তপ্ত মনে মিষ্টির প্যাকেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে সিটের উপর রেখে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আব্বু আপনি কী বলছেন এসব? আমি না বিয়েতে নাকচ করেছি। তাহলে আবার কিসের বিয়ে পাক্কা পাক্কি হ্যাঁ!”
ইপশিতার মা মুহূর্তেই রেগে গেলেন। ঠাস করে মেয়ের গালে একটা লাগিয়ে বলেন,’চুপ বেয়াদব বাবার সাথে এভাবে কথা বলে কেউ? আর তোর বিয়ে হবে তুই মেয়ে হয়ে জম্মেছিস। এটা তোর কিসমতেই লিখা বিয়ে করতেই হবে। আর কোনো নাকচি শুনব না তোর। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করিস তাহলে তোর পড়ালেখা বন্ধ করে দেবো বলে দিলাম। এই যে আপনে মেয়েকে আদর দিয়া বান্দরনী বানিয়ে ফেললেন। দেখলে এভাবে শাসন না করলে মুখের উপরই কথা কইবো। আজ থেকে আমার কথায় ঠ্যাং মা*রবেন না আপনে বুঝলেন? আপনার মাইয়ারে বুইঝা দেন বিয়ে করতে হইবো মানে হইবো। বহু তপস্যার পর যাইয়া মেয়ের বিয়ে পাক্কা হয়ছে তাগো মত বড়ত পরিবারের মধ্যে। কত ধনী লোক জানিস নেহ খালি নোটাংকি আজ থেকে আমার কথা হুনবি। আর মা বাবা তোমরা মন খারাপ করো না মেয়েটার মাথায় গোবর ভরা। তোমরা মিষ্টি খাও কেমন! এই ইপশু ঠিক তিনটা বাজার সাথে সাথে যেনো তোকে ঘরের ভেতর পায়।’
ইপশিতার মা একপ্রকার হুকুম জারি করে দিয়ে নিজের স্বামীর সঙ্গে চলে গেলেন। অন্যথায় ইপশিতা স্তদ্ধ। তার মুখ দিয়ে কথা বেরুবার পথ যেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শেহরীনা তাকে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
“দোস্ত তুই মনখারাপ করিস না। আমরা কোনো না কোনো রাস্তা বের করে ফেলবো। তুই চিন্তা করিস না মোটেও।”
ফারদিন ও কাঁপা গলায় ইপশিতাকে বলে,’তুই কী কাউকে ভালোবাসিস?’
ইপশিতা করুন দৃষ্টিতে তাকায় তার মন পুরুষের দিকে। তার এমুহুর্তে চিৎকার করে কেঁদে বলতে মন চাইছে, ‘হ্যাঁ আপনাকে ভালোবাসি আমি ফারদিন আপনাকে’। তবে সে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। মনপুরুষ নিজেই নিরব সেখানে তার এক তরফা প্রণয়ে কোনোদিকে কল্যাণ নিহিত নয়। ফারদিন তাদের অগোচরে চোখের জল মুছে তৎক্ষণাৎ ইপশিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘চল বুচি আমরা বিয়ে করি। আমার মোটামুটি সামর্থ্য আছে। তোকে দেখে রাখতে পারব। কোনো দুঃখ কষ্ট তোকে ছুঁতে দেবো না ইন শা আল্লাহ। তুই প্লিজ চল আজকেই বিয়ে করে ফেলবো।’
ইপশিতার মুখ হা হয়ে গেল। আসলেই সত্য শুনতে পারছে না তার কানের ভুল শোনা যাচ্ছে? সে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। শেহরীনা আর জাফরান তো পলক ফেলতেই ভুলে গেল। শেহরীনা একপ্রকার খুশি হয়ে ঝাপটে ধরল ইপশিতাকে। অবশেষে ছেলেটা বিয়ের কথা তুলেছে। তবে পালিয়ে বিয়ে করাটা এমুহুর্তে অতিরিক্ত লাগছে। বিধেয় সে ফারদিন কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“হেই দোস্ত পালিয়ে বিয়ে করা কোনো সমাধান না। তুই না ইপশিতাকে ভালোবাসিস। তাহলে তুই তোর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে দেখ। তারা রাজি থাকলে তাদের নিয়ে ইপশিতার ঘরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেহ্। তার মধ্যে তোর খবরি কোনো লোকপেলে খবর লাগা পাত্র কে? তাকে পেলে তোদের প্রেমের কথা জানানো যাবে। কিন্তু তুই আগে বাসায় গিয়ে তোর বাবা-মা কী বলে সেটা আমাদের জানা।”
ইপশিতা স্বস্তির শ্বাস নিলো। শেহরীনার কথাটা মন্দ নয়। বিধেয় তারা সহমত পোষণ করে।
____
“শেহু মা রুমে আয় তো একটু।”
নাছির উদ্দিন শেহরীনাকে তার নিজের কাছে ডাকলেন। মেয়েটা ভার্সিটি থেকে এসে সোজা নিজের রুমে চলে যাচ্ছিল। সৎ বাবার ডাক শুনে তার কদম থেমে যায়। অর্ধ চিকিৎসার পর থেকে সে মোটামুটি দেখাশোনা করে। মিনি মিনি কণ্ঠে কয়েকবার অপারেশন করানোর জন্যে রাজি করাতে চেয়ে ছিল। তবে নাছির উদ্দিন সেই কণ্ঠস্বরের আবদার কৌশলে এড়িয়ে যেতেন। এখন তার ডাক শুনে ধীমি পায়ে হেঁটে নাছির উদ্দিন এর থেকে কিছুটা দূরে চেয়ার রাখা ছিল সেই চেয়ারে বসে পড়ে। তিনি স্বল্প গলায় প্রথমেই মেয়ের শরীর কেমন জিজ্ঞেস করেন। শেহরীনাও এ প্রথম সুন্দর সাবলীল গলায় জবাব দিলো। পূর্বে সেও তেমন ব্যবহার করতো যেমনটা নাছির উদ্দিন করতেন। নাছির উদ্দিন ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“শেহুমা তোমাকে আজ তোমার বাবার ব্যাপারে বলব। তোমার আসল পরিচয় সম্পর্কে জানাবো তোমাকে। তারপর তোমার যা মন চাইবে তাই হবে। হতে পারে তুমি এ বাড়ি অব্দি ছেড়ে যাবে।”
শেহরীনার অবাক লাগছে তার বাবার পরিচয় জেনে কী হবে যাতে যে সে এই ঘর অব্দি ছেড়ে দেবে। তার প্রশ্নাতীত চেহারার দিকে তাকিয়ে নাছির উদ্দিন তপ্ত শ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন।
অতীত”তোমার বাবার নাম হচ্ছে শোয়াইব মিলদাজ। পেশায় ছিলেন শিক্ষিত কৃষক। তার বংশকে সেকালে খুব নামডাক ছিল। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্য। তিনি কৃষি করেই জীবনাবসান করতেন। তবে হ্যাঁ তার জোঁক ছিল বিদেশে পাড়ি জমানোর। তাই তিনি এ নিয়ে শলা পরামর্শ করেন তোমার মায়ের নানার সঙ্গে। তোমার নানা কোনো মধ্যবিত্ত লোক ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন জমিদারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন। গ্রামে চেয়ারম্যান পদে কারো ভোট বেশি থাকলে সেটা থাকতো জমিদারের। তোমার নানার সাথে কৃষি বিষয়ক কথাবার্তার ছলে সে প্রায়শ তোমার মায়ের বাড়িতে যেতো। সেই সুবাধে তোমার মায়ের সাথে পরিচয় ঘটে তার। তবে তাও শুধু নাস্তা পানি দেওয়ার সময়ই তোমার মা রূপালি কে চোরা চোখে দেখতো সে। তখন তোমার মায়ের আবেগি বয়স চলে। শোয়াইব এরও বিয়ের বয়স হয়েছিল। তবে তার মাথায় লোভ ছিল বিদেশ যাওয়ার সেখানকার পাত্রি বিয়ে করে লাখ টাকার রাজা হওয়ার। এখন তুমি বলতে পারো এসবের মাঝে আমি কেমনে আসলাম? সেটাও শুনো।
তোমার বাবা কৃষিচাষ করার জমি যেখানে ছিল তার অন্যপাশে ছিল আমার খামারের কারখানা। আমি পড়াশুনার পাশাপাশি খামার করতাম। এখন বয়স হতে না হতে সেই কারখানা মধ্যবিত্ত হওয়ায় ধনী লোক একজনে হাতিয়ে নেয়। আমিও নিরুপায় হয়ে মুদির দোকান দেয়। মুদির দোকানে প্রায়শ তোমার মা এটা ওটা কিনতে আসতো। তাকে একটু একটু দেখতাম তবে তার জন্য আমার মনে প্রেম নয় স্নেহ ছিল। কেনো জানো? কারণ তোমার মা রূপের বান্ধবী পদ্মিতা কে আমি পছন্দ করতাম। তাকে ছোট নামে পুষ্পিকা বলে ডাকতাম। আমাদের আলাপ যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পদ্মিতা। সব ঠিকঠাক চলছিল দুয়েক বছর পর তোমার মা রূপ বিচলিত হয়ে আমার কাছে আছে। আমি দেখে অবাক হয়ে যায়। তার এ আচরণের কারণ মোটেও ধরতে পারিনী। সে আমার দোকানে এসেই চিৎকার করে কেঁদে আমাকে সহায়তা করতে বলে। শোয়াইবকে নাকি ফোনে পাচ্ছে না। কেননা মাঝে তোমার বাবা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রূপকে আপন করে নেয়। যার সূত্র ধরে তোমার আগমন এ পৃথিবীতে। তোমাকে তোমার মায়ের গর্ভে দিয়েই শোয়াইব বিদেশে পাড়ি জমায়। তার নোংরা মন মানসিকতা তোমার মা ধরতে পারেনি। তোমার মা ভয়ে থাকতো। আমার কাছে এসে এসে প্রতিদিন একবার করে শোয়াইব এর বিদেশি নাম্বারে কল দেওয়াত। আমি বিরক্ত হলেও রূপের গর্ভকালীন রূপ দেখে মায়া ও বোধ করতাম। তাকে যেমন সহায়তা করতাম তেমনি সেও আমাকে আমার পদ্মিতার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতো, কথা বলিয়ে দিতো। তবে রূপের সাথে একদিন নদীর পাড়ে বসে পদ্মিতার ব্যাপারে কথা বলছিলাম। আর সেদিনটাই আমার জন্য কাল হয়ে যায়। আমি তখন থেকেই একটু একটু ঘৃণা করতে থাকি রূপালি কে আর তোমাকে। অথচ তুমি ছিলে নিষ্পাপ। কিন্তু কোথাও একটু আমার মনে তোমার প্রতি স্নেহ বোধ জাগ্রত হতো তার ফলে তোমার ভরণপোষণের দায়িত্বে আমি পিছপা হতাম না।”
বর্তমান,
হঠাৎ নাছির উদ্দিন কথার মাঝে কেশে উঠলেন। শেহরীনা ঘোরের মাঝে শুনছিল সৎ বাবাকে কাশতে দেখে তড়িঘড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে রেখে পান করিয়ে দেয়। এ প্রথম সে তার সৎ বাবার জন্য কিছু করেছে। নাছির উদ্দিন এ দৃশ্যে আবেগ আপ্লুত হলেন। তিনি শেহরীনাকে বলেন,
“একটু তোমার আম্মারে ডাকো। আমি বাথরুমে যামু।”
শেহরীনা তার মাকে ডেকে আনে। তিনি আজ মোটেও তাদের রুমের সামনে আসতে চাননি। পিছে তার মেয়ে যদি তার প্রতি অনিহা দেখায় সেই অনিহা তিনি জীবিত দশায় সহ্য করতে পারবেন না। তবে রুমে না এসেও উপায় নেই দেখে মলিন মুখ করে স্বামীকে ওয়াশরুম অব্দি নিয়ে গেলেন। শেহরীনা নিজেও ফ্রেশ হতে গেল। তার সৎ বাবার কাজ শেষ হতে হতে সেও ফ্রেশ হয়ে পুনরায় রুমে আসবে।
চলবে……
#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২০ (দ্বিতীয় অংশ সত্য উম্মোচন)
“তোমার বাবা শোয়াইব মিলদাজ হলেও সে কথা মজলিশের সামনে বসা পঞ্চায়েত এর কেউ বিশ্বাস করেনি। কেননা সকলের চোখে আমি দোষী। রূপ কে প্রতিবার আমার দোকানে আসা যাওয়া করতে দেখায় তোমার মামা মোঃ আবু সিদ্দিক ভুল বুঝে যায়। রূপ কেঁদে কেটে সবাইকে বুঝাতে চাইলেও কেউ এক মেয়ের চিৎকারে মন দেয়নি। সেকালে এখনকার মত ন্যায়বিচার ছিল না। সবটা পঞ্চায়েতের হাতে থাকতো। তারা যোগ্য প্রমাণ দেখেই সোজা বিচার করে দিতো। সেদিন আমি আর রূপ পদ্মিতার ব্যাপারে কথা বলছিলাম। রূপ গর্ভবতী সেটা কেউ জানতো না। সে তার গর্ভত্ব লুকিয়ে রাখতো বড় বড় সাইজের মোটাসোটা গোলগাল কামিজ পরে। সবাই ভাবতো সে মোটা হয়ে গিয়েছে আসল ঘটনা আমি, রূপ আর পদ্মিতা জানতাম। সেদিন পাড়ের ধারে বসাটাই কাল হয়ে যায় আমাদের জন্য। রূপ বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় হঠাৎ পেটে ব্যথা অনুভব করে। যার ফলে সে পড়ে যাচ্ছিল তখন আমি ধরে বসিয়ে দেয় মাটির উপর। রূপ আলতো হেসে বলে তার বাচ্চা একটু আধটু লাথ মারছে। ব্যাপারটা আমিও খুব উপভোগ করলাম। পদ্মিতার সাথে যখন আমার সংসার হবে সেও গর্ভবতী হওয়ার পর তাকেও ঠিক বাচ্চা এভাবে আঘাত করবে। সেই দৃশ্য কল্পনায় এঁকে ভুলবশত রূপের কথার দ্বারে আমিও ভুলে বলি, একটু ছুঁয়ে দেখি। রূপ বারণ করেনি বরং দেখতে উৎসাহিত করে। আমি যুবক মানুষ তবে মন মানসিকতা নিচু নয় তোমার বাবার মত। কাঁপা হাতে যেই একটু ছুঁতে গেলাম তখন চিৎকার করে আমায় ধরে মা*রতে লাগে রূপের ভাই মোঃ আবু সিদ্দিক। তার সাথে আমার কোনো পরিচয়তা ছিল না , না কোনো শত্রুতা ছিল। তাকে আমি খুব সম্মান করতাম কেননা গ্রামে জমিদারের ছেলে হিসেবে পঞ্চায়েত সদস্যদের মধ্যে তিনিও একজন। কথাবার্তায় খাতির থাকলে তিনি আমাদের সহযোগিতা করতেন। সেদিন তিনি সালিশ বসান বোনের সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য। আমি খুব করে বললাম এ কাজ শোয়াইব মিলদাজ এর তবে কেউ বিশ্বাস করে না। রূপও বলে তাকেও কেউ বিশ্বাস করেনি। ফলশ্রুতিতে আমি কঠিন গলায় বাচ্চা হওয়ার পর তার ডিএনএ টেস্ট করানোর অনুরোধ করি। যা মোটেও পছন্দ হয়নি রূপ আর তার ভাইয়ের। স্বাভাবিক রূপের পছন্দ নাই হতে পারে কারণ সে মা। কিন্তু তার ভাইয়ের অপছন্দ হলো কেনো বুঝেনি। আমার কথায় সকলে সাড়া দিলেও মোঃ আবু সিদ্দিক যোগ্য প্রমাণ রুপে নানান কালো সাদা ছবি বের করে দেখায়। যেখানে রূপকে আমার দোকানে আসা যাওয়া, রূপের হাতে খাবার খেতে, রূপকে ফুল দিতে, রূপের হাতে দামি জিনিস কিনে গিফট করে দিতে। সেগুলো দেখে সবটা আমার উপর পড়ে যায় দোষ। কেউ তখন শোয়াইব কে দোষী ভাবেনি। আমিই প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে দোষী হয়ে গেলাম। কিন্তু বলতে পারবে মামুনি আমার দোষ কোথায় ছিল?”
কথাটা শেহরীনার বুকে তীরের মত বিঁধে। রূপালি বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন। তিনিও স্বামীর পাশে বসে অতীত হাঁতড়ে যাচ্ছেন। আজ প্রথম তারা অতীতকে সামনে এনে দোষী আর নিদোর্ষের খোঁজ চালাচ্ছেন। তবে এতে কী হবে? এত বছরের গড়া সংসার কী আদৌ ভাঙ্গা যাবে? শেহরীনা ঢোক গিলে ভাবনাটা গিলে নিলো। রূপালি বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে কান্নামাখা কণ্ঠে আওড়ান।
“মামুনি তোমার কোনো দোষ না থাকলেও তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতো শুধু তোমার বাবার জন্য। তাই তার নাম আজ পর্যন্ত এই ঘরের কোনো কোণেও নেওয়া হতো না। তোমার এই বাবার হার্টে ব্যথা করতো ঐ কুনাম শুনলে। তখন তিনি পাগল পাগল হয়ে আমার উপর মা*রধর করতেন। আজ সব সত্য তুমি জেনে যাবা তোমার যুবতী বয়স এখন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মত বুদ্ধি তোমার আছে। দোষ আর নিদোর্ষ কে বেরুলেও বলা যায় সংসার এখন আমাদেরই। আমরা এ সংসার ছেড়ে কখনো প্রাক্তনের কাছে ফিরবো না। যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তারা সব পারে।”
নাছির উদ্দিন রূপালি বেগম কে থামিয়ে পুনরায় শেহরীনাকে বলে,
“পঞ্চায়েত এর সামনে আমার থেকে বাধ্য হয়ে রূপকে স্ত্রী রুপে গ্রহণ করতে হলো। সেদিন রূপকে আমি ঘৃণার অতলে রাখি। বাচ্চা হওয়ার আগ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সেবাযত্ন দেয়। বাচ্চা হওয়ার পরপর তার ডিএনএ টেস্ট করিয়ে সকলকে দেখায়। ততদিনে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। সকলে অনুরোধ করে বিয়েটা, সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। নাহলে রূপের জীবন শেষ হয়ে যাবে। কেউ তখন আমার হৃদয়ের ভেতরে গোমরে মরে যাওয়াটা লক্ষ্য করেনি। সবার নজর শেহরীনার উপর ছিল। কারণ ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মুখ থেকে নূরনূর ছড়াচ্ছিল আশপাশ জুড়ে। সেখানে আমার হাহাকার চাপা পড়ে যায়। বাধ্যতা দূর করে তোমার লালনপালনের দায়িত্ব খুব সুন্দর ভাবে করতে থাকি। জানো এসবের মাঝে পদ্মিতার কোনো খোঁজ পায়নি। তবে হ্যাঁ এটা শুনে ছিলাম তোমার মামা মোঃ আবু সিদ্দিক এর সাথে পদ্মিতার বিয়ে হবে। শুনে প্রতিক্রিয়া করার মত মুখ ছিল না। পদ্মিতাও ভাবতো আমি রূপকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি। তবে সত্য জানার পর তার আর খবর রাখিনি বলতে পারো একপ্রকারে। মোঃ আবু সিদ্দিক সেদিন বাড়িতে এসেছিল শুনে তোমার মায়ের উপর পুরোনো রাগ ঝরে পড়তে চেয়েছিল তবে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বাহিরে চলে যায়। একরাত পুরো নাসমার দাদীর কবরের সামনে শুয়ে কাটিয়ে দেয়। নাহলে আমার আঘাতে রূপ জর্জরিত হয়ে যেতো। আর জানো মামুনি তোমার বিয়ে আমি মোঃ আবু সিদ্দিক এর ছেলে সারোয়ার এর সাথে কেনো দিতে চাইছি না। কারণ তাকে দেখলে আমার তোমার মামার করা কর্ম মনে পড়ে যায়। তবে হ্যাঁ তখনো আমি জানতাম না যেদিন তোমাকে পাত্রী রুপে দেখতে এসেছিল সারোয়ার সেদিন ও তার পিতা কে জানতাম না। ঘরের মধ্যে এসেছে শুনেই জানলাম। ততদিন ঠিক ছিল পাত্র হিসেবে মানতে বাধ্য ছিলাম তবে সত্য পরিচয় জানার পর থেকে নাকচ করতে থাকি মনে মনে। কিন্তু তুমি আমার মেয়ে না হলেও মেয়ের থেকেও কম কিছু নয়। তোমার কাছে আমার ব্যবহার এখন তিক্ত লাগতে পারে তবে তোমাকে আমি পুরো আঠারোটা বছর খুব আদর যত্নে আগলে রেখেছি। সেটা হয়ত তুমি ভুলে যেতে পারো আমি নয়। আমি তো বাবা বাবার কাঁধের উপর কী পরিমাণ চাপ থাকে তা তোমরা কখনো বুঝবে না। কারণ এক বাবা কখনো বুঝতে দেয় না এসব।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাছির উদ্দিন চোখের জল মুছে কাঁপা গলায় বলেন,
‘মামুনি এটা ভেবো না তুমি আর তোমার মাকে এখনো আমি ঘৃণা করি। না এটা আর হবে না। আমার মৃত্যুর দিনকালের সঙ্গি তোমার মা। তাকে প্রহার করলেও মলমও আমি দিতাম। এখন মামুনি তুমি চাইলে তোমার বাবার কাছে যেতে পারো। তোমার বাবা বর্তমানে খুলনা আছেন। আমি তোমাকে ওকিলাতি কেনো পড়াচ্ছি এবার বুঝছো? একদিন তুমিও ন্যায়বিচার করবে। কখনো অন্যায় কে ন্যায় আর ন্যায় কে অন্যায় বলে চালিয়ে দিও না। সেকালে এই দিকটা ব্যাপক প্রচালিত ছিল এখন তোমাদের হাতেই সব কিছু আছে। পারলে তোমার এই সৎ বাপকে ক্ষমা করে দিও পূর্বের কাজের জন্য।’
কথাটুকু বলে তিনি দম ফেলে সোজা বালিশের উপর মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে পড়েন। স্তদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে শেহরীনা। আসলে তার মুখের ভাষা ফুরিয়ে গেল। রূপালি বেগম স্বামীর কাঁধে সরিষার তেল মালিশ করতে লাগলেন। শেহরীনা আনমনা হয়ে উঠে নিজ রুমে চলে গেল। নাছির উদ্দিন নিভু চোখে মেয়ের যাওয়া দেখে আঁতকে উঠেন। রূপালি বেগম এর হাত ধরে বলেন,
‘এখনি মামুনির রুমে যাও। সে নাহয় ভুলে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে।’
তিনি চেয়েও উঠতে পারবেন না বিধেয় রূপালি বেগম দৌড়ে গেলেন মেয়ের রুমে। দরজায় বারে বারে কড়াঘাত করতে থাকেন। শেহরীনা ক্রোধে তার বাবার ছবি জোড়া বের করে মাটিতে ফেলছে। বাবার পাওয়া স্মৃতি কুড়ে সে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল সেই জঘন্য ব্যক্তিকে কেনো এতটা বছর আপন ভাবল সে? ছবিগুলো মাটিতে ফেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। রূপালি বেগম এর আর্তনাদ মূলক আওয়াজ শুনে শেহরীনা কান্না মিশ্রিত গলায় অনুরোধ করে।
‘মা আমায় আজ একটু একা ছাড়েন। আমি জীবনের হিসেব মেলাতে চাই প্লিজ মা প্লিজ!’
ফুটফুটে সেই নূরময় কন্যাটি তার পরিচয় পর্ব জেনে হৃদয়বিদারক কান্নায় নেতিয়ে পড়েছে। বাবার ছবির সামনে অসহায় ভাবে হাঁটু গেড়ে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে।
____
সারোয়ার এর কোর্টের সালিশে কোনো মনোযোগ দিতে পারছে না। কোর্টে এসে অনেকক্ষন নিজের সালিশ জমানোর প্রতিক্রিয়া আপনমনে ব্যক্ত করছিল। তবে সে কোনো ভাবেও সেই কাজে মগ্ন হতে পারেনি। কোনো না কোনো একভাবে ব্যর্থ হচ্ছেই। প্রচণ্ড বিরক্তির চটে টেবিলে থাবা মেরে বসে পড়ল। সিলিং ফ্যানের শব্দে মাথায় হাত চেপে সারোয়ার চিন্তিত হয়ে আছে। তার মন প্রাণ ছটফট করছে অজানা কারণে। এমনটা হওয়ার কারণ কী সে জানে না! আনমনা হয়ে বসা হতে দাঁড়িয়ে জানালা অব্দি এগোয়। জানালার বাহির থেকে নানান লোককে দেখছে। অনেকের গাঁয়ে আইনজীবী ইউনিফর্ম। সেও পরিহিত তবে তার সঙ্গে কেউ নেই। মানুষ বলে বন্ধু বান্ধব থাকা নাকি সুভাগ্যময়। তাহলে তার কেনো কোনো বন্ধু হলো না সেই ভার্সিটির গণ্ডি হতে? তপ্ত শ্বাস ফেলে ফোন হাতে ফারদিন কে কল দিলো। সে চোরেচুপে ফারদিনের কাছ থেকেই শেহরীনার ব্যাপারে কথা বার্তা শুনে। ফারদিন তর্কে হাঁপিয়ে উঠেছে। তার বাবা মা প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার বাবা ফজলে হক বলেন,
“ওমন লো ক্লাস মেয়েকে তোর কেমনে পছন্দ হলো-রে বাপ? তোর মাকে দেখেছিস? সে সময়ে জমিদারের মেয়ে হওয়া করতো সে। আর কোথায় বস্তিতে থাকার মত মেয়েকে তোর মনে ধরল হুম? এমন মেয়ে কী এ আলিশান বাড়ির বউমা হওয়ার যোগ্যতা রাখে হ্যাঁ? আমি কত আশা নিয়ে ছিলাম তোর বিয়ে আমার বিজনেস পার্টনার শিল্পিত খান এর মেয়ের সাথে করবো। আর তুই এসে এক মেয়ে কে নিয়ে বাবা মার সাথে তর্ক করছিস।”
ফারদিন রেগে গেল। সেই কখন থেকে বাবা-মায়ের মুখ থেকে ইপশিতার ব্যাপারে উল্টাপাল্টা শুনছে। এবার যেনো অন্যায় হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“বাবা ভুলে যেও না দেশটা স্বাধীন আমরা করেছি। আর তুমি কার মেয়ের কথা বলছো? যে পা চাটা সঙ্গী ছিল? তাকে আমি হাতের কাছে পেলে পিছে ফেলব বলে জানিয়ে দিয়েন।”
ফজলে হক এর মুখখানা পানসে হয়ে যায়। ছেলে যে এত বড় কথা বলে ফেলবে বুঝতে পারেননি। তার স্ত্রী ও কিছুটা চুপসে গেছেন। তার দাদাও একজন পা চাটা সঙ্গী ছিলেন। এ কথা একটু আধটু হলেও ফারদিনের জানা। বিধেয় ঢোক গিলে নিজের সম্মান আর ছেলের প্রতি স্নেহ মনে রেখেই স্বামীকে বলেন,
“দেখেন ছেলের বয়স হয়েছে তার ঠিক-বেঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অধিকার তার নিজের আছে। আমার মনে হয় একবার দেখে আসা উচিৎ মেয়েকে।”
ফজলে হক এক নিমিত্তে রাজি হয়ে যান। আপাতত ছেলের মুখ থেকে কঠোর বাণী হতে বাঁচার দায়ে তিনি সুযোগ পথ আমলে নিলেন। ফারদিন বাবা-মায়ের আকস্মিক বদলে মিটমিটে হাসল। মনে মনে সে ভেবেই রেখেছিল তারা যদি একটা বলে দমানোর চেষ্টা করে। তাহলে সে তিনটা বলে একেবারে ভাগটুকু খেয়ে দেবে। হলোই তাই।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তার ধ্যানের মাঝে ফোনটা তীব্র আকারে শব্দ করে বেজে উঠে। বাবা-মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সে ফোন কানে ধরে ‘হ্যালো ব্রো কেমন আছিস?’ বলে উঠে।
সারোয়ার মনমরা হয়ে জবাব দেয়। এতে ফারদিন সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘কী হয়েছে তোকে উদাসীন কেনো লাগছে?’
‘শেহরীনা কোথায় আজ প্রায় এক সপ্তাহ দুদিন কেটে গেল মেয়েটা আমার সাথে কোনো বার্তায় জড়াচ্ছে না। ব্যাপার কী একটু বলতে পারবি? কিছু জানিস তার ব্যাপারে।’
ফারদিন ঠোঁট কামড়ে ভাবে হয়ত মেয়েটা সারোয়ারকে চিন্তায় ফেলতে চাইনি তাই বলেনি। তবে একটু হলেও জানাতো ছেলেটা তো তার আশায় বসে আছে।
‘হ্যালো ফারদিন শুনতে পারছিস?’
সারোয়ার এর কণ্ঠস্বর শুনে ফারদিন আমতার কণ্ঠে বলে,
“ভাই আমার মনে হয় শেহরীনা তোকে চিন্তিত করতে চাইনি। আসলে তার সৎ বাবা অসুস্থ খুব। সে জন্য কয়েকদিন ধরে তার মন ভালো নেই। তুই চিন্তা করিস না আমরা দেখে নেবো।”
“কী বললি তুই? শেহরীনা মেয়েটাও কত মন্দ কাজ করেছে সে একটু জানালো না অব্দি। থ্যাংকিউ ফারদিন জানানোর জন্য। আমি এখন কোর্টে। কাজ শেষ করে তার বাড়িতে যাবো।”
ফারদিন ‘আরে’ দিয়ে তার মনের বার্তা প্রকাশ করার আগমুহূর্তেই সারোয়ার কল কেটে দেয়। ফলস্বরূপ ফারদিনও তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
চলবে……