প্রিয়অপ্রিয়ের সংসার পর্ব-১০+১১+১২

0
29

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১০(এলার্ট পর্ব বোনাস)

“এই নাসমার মা শুনো গত রাতের আগের দিন পিল খাইছিলা?”

রূপালি বেগম আঁতকে উঠলেন। তিনি ভুলে গিয়ে ছিলেন নাসমার বাবার দেওয়া ওষুধটার কথা। তবুও তার চেহারার দিকে কিছুটা ভয়ভীতি নিয়ে তাকান। ভালো মন মানসিকে থাকলে সত্য বলবেন যদি মন্দ দেখেন মিথ্যে বলবেন। ঢোক গিলে কিঞ্চিৎ মুহূর্ত অব্দি চেহারাটা অবলোকন করলেন। নাছির উদ্দিন নিজ স্ত্রীকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্তির সহিতে জিজ্ঞেস করলেন।

“কী হইলো কথার‌ জবাব না দিয়ে চাইয়া আছো কেন? আমার মুখে কী উত্তর লিখা আছে যে চাইয়া জবাব দেওয়ার অপেক্ষা করছো?”

রূপালি বেগম আমতা আমতা করে ভয় কে কাবু করে হাত কচলাতে থেকে বলেন,

“আসলে আমার দ্বারা ভুল হইয়া গেছে নাসমার বাপ। আপনার রাখা পিলটা আমি ভুলে ফেলাই দিছিলাম। কসম আমি খেয়াল করি নাই। খেয়াল করলে খাইয়া ফেলতাম।”

নাছির উদ্দিন শুনে গম্ভীর চেহারা নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান। তার সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়ান। রূপালি বেগম কেঁপে উঠলেন। নাছির উদ্দিন স্ত্রীর মুখ বরাবর মুখ এনে বলেন,

“যাও মাফ করলাম। আজ আমার খুশির দিন দেইখা তোমারে কিছু কইলাম না। পরে কিন্তু ভুল হতে পারব না।”

রূপালি বেগম স্বস্তি ভরা জোরালো শ্বাস টেনে ছাড়লেন। নাছির উদ্দিন লুঙ্গির ভেতর প্যান্ট পরে পরণে শার্ট জড়ানোর সময় আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। রূপালি বেগম জানেন তার স্বামী এখন দোকানে যাবেন। তার ব্যবসার মূল সূত্র সেই দোকান। তবে দোকানের নামটা রূপালি বেগমের কাছে অদ্ভুত লাগে। তিনি যতবার নামটা স্মরণ করেন ততবার তিনি নামটা রাখার কারণ জানতে চাইলে লোকটা জবাব দেন না। তখন তার চেহারায় এক অসহায় করুন চাহনী ভেসে উঠে। সেই কারণটা কী রূপালি বেগম এত বছর সংসার করেও জানতে পারলেন না। নাছির উদ্দিন লুঙ্গিটা রূপালি বেগমের হাতে ধরিয়ে শার্ট প্যান্ট টান টান করে ভদ্রলোকের বেশে বেরিয়ে গেলেন। রূপালি বেগম পিছু ডেকে আজ পুনরায় কথাটা আওড়ে নিতে চান। তবে এতে যদি তিনি চটে যান। সেই ভয়ে ডাকলেন না।
মনে মনে পুনরায় নামটি নিলেন ‘পুষ্পরীন’। নামটার সঙ্গে তিনি কারো মিলও খুঁজে পান না। তবে কী হতে পারে? হঠাৎ কারো ডাকে চমকে পিছু তাকায় সে। নাসমা ঘুম ঘুম চোখে মায়ের কাছে এলো। নাসমাকে দশটায় জেগে উঠতে দেখে মুচকি হেসে বলেন,

“কী গো মা জেগে গেলে কেনো? আরেকটু ঘুমাতে। এখনো ত্রিশ মিনিট ছিলো আমি ডেকে দিতাম। আজ বন্ধ পেলে স্কুল। ছুটিতে ঘুমাবে প্রচুর বুঝলে?”

নাসমা চোখ কচলে ঘুম ঘুম কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠল।

“আমরা যদি ঘুমাতে পারি তাহলে আপা কেনো পারে না? আপাকে কেনো ফজরের নামাজের পর থেকে ডেকে তুলে দাও? আপা তো না‌ ঘুমানোর কারণে তার চোখের নিচে কালি জমছে। দেখতে খারাপ লাগে না বুঝি। আজকে থেকে আমিও আপার সাথে জেগে যাবো। আপা কোথায় আমাকেও ডাকল না।”

রূপালি বেগম মাথা নিচু করে অন্য দিক মুখ ফিরিয়ে চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে বলেন,

“তোমার আপা এখন ভার্সিটিতে। তাদের বন্ধ দেয়নি। তোমাদের প্রতিষ্ঠানে সাময়িক সমস্যার জন্য চারদিন শুধু বন্ধ দিলো। সমস্যা তোমাদের প্রতিষ্ঠানে হয়েছে কিন্তু তোমার আপুদের ভার্সিটিতে সমস্যা হয় নাই‌। তাই বন্ধ নাই ওর বুঝছো?”

নাসমার মুখ উদাসীন হয়ে গেল। ছোট মেয়ের মধ্যে বড় বোনের প্রতি লাঘব সম্পর্ক দেখে মনে স্বস্তি পান তিনি। তবে বড় ছেলেটা গম্ভীর থাকে। কেনো থাকে আদৌ জানেন না তিনি। নাসমুর এমুহুর্তে খেলার মাঠে হবে। তাই ছেলের আগমনের পূর্বেই তিনি ছেলের জন্য নাস্তা বানাতে গেলেন। নাসমাকে এখন নাস্তা দেবেন কি-না জিজ্ঞেস করলেন তিনি। নাসমা বায়না ধরল সে তার ভাইয়ের সাথে বসে খাবে। এতে রূপালি বেগম হাতে সময় পেলেন আলুর পরোটা বানানোর। আজকে একটু বেশি বানিয়ে রাখবেন বলে ভেবে নিলেন তিনি। নাসমার বাবার অগোচরে তা হট বক্সে ভরে রাখবেন বড় মেয়ের জন্য। মেয়েটার পেটে গতকাল দানাপানি পড়েনি জেনে তিনিও মুখে কোনো খাবার তুলতে পারেননি। শুধু নাসমার বাবাকে দেখানোর ভান করে ভাত তরকারি নিয়ে তা রেখে দিয়ে ছিলেন। রাত হতেই তিনি লুকিয়ে ভাত তরকারি মাখানো বাটিটি রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে উঠানের নিয়ে যান। উঠানের বাহিরে পথ পেরুলেই একটা গরিব শুয়ে ঘুমোয় থাকে রাস্তায়। তার পাশে বাটি ভর্তি ভাত তরকারি একটা পলিথিনের ভেতর নিয়ে পলিথিনটি সেখানে রেখে চলে আসেন। মা তো মেয়ে খায়নি তিনিও কেমনে মুখে খাবার তুলবেন? মায়ের অন্তর তার সব সন্তানদের জন্যেই সমান।

___
“শেহরীনা এসব আমরা কী দেখলাম? সারোয়ার স্যার তোর গালে চুমু চুমু খাইছে। বাপরে শেষমেশ এই দেখার ছিল?”

ইপশিতার কথায় লজ্জায় মাথা নামিয়ে টেবিলে মাথা ঠেকে আছে শেহরীনা। ফারদিন স্বাভাবিক নয়নে চেয়ে আছে। ইপশিতা বার কয়েক ফারদিনের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না। ফারদিন শেহরীনার পিঠে ধুমধাম চাপড় মেরে বলে,

“তাহলে আপনিই সেই সুপুত্রী যে কি-না আমার ভাইকে রিজেক্ট করেছেন। মাই ডেয়ার হবু ভাবী প্লিজ একসেপ্ট দ্যা প্রপোজাল। হি ইজ সাচ এ‌্যা কাইন্ড এন্ড লাভলী পার্সন।”

শেহরীনা বন্ধুমহলের কথায় বিরক্তির স্বরে বলে,

“ধ্যাঁত তোরা না মেসেজ করে আসবি না বলছিলি। হুট করে আকাশ থেকে টপকায় পড়লি কেনো‌ হুম? এসে থেকে কী শুরু করেছিস। ভাই বাদ দেয় না চোখের দেখা সবসময় সত্য হয় না।”

ফারদিন,জাফরান আর ইপশিতা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাহা করে হেসে উঠল। শেহরীনা ব্যাগটা কাঁধে জড়িয়ে নিয়ে তাদের মাঝখান থেকে বেরিয়ে ক্লাসের দিকে আগাল। তার বন্ধুমহল হৈ হৈ করে তার পিছু নেয়। আড়াল থেকে একজোড়া চোখ শেহরীনার যাওয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সারোয়ার চেয়ারম্যান এর হাতে বন্দোবস্ততার টাকা সঁপে দিয়ে বলে,

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমার কথাটুকু রাখলেন। আপনারা চাইলে স্টুডেন্টদের খাওয়ার পর আলোচনা সভা শুরু করতে পারেন। তবে একটা অনুরোধ একটায় শেষ করে ছেড়ে দিয়েন। আমি আজ শেহরীনাকে নিয়ে যেতে চাই।”

সারোয়ার এর কথায় অর্ধবয়স্ক চেয়ারম্যান তার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বলেন,

“ওকে ইয়াংম্যান। তোমার কথা রাখব না তা কেমনে হবে? তুমি বলেছো বুঝো সেটা হয়েই গেল। এখন যায় নাহয় আবার সবাই ক্লাসে ঢুকে পড়বে।”

সারোয়ার মাথা নেড়ে সায় দিল। তিনি আর সারোয়ার একসাথে কেবিন থেকে বের হতেই শেহরীনাদের দেখতে পেল। চেয়ারম্যান কে দেখে তারা থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে যায়। কেননা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সামনে পড়ায় তারা মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। সারোয়ার একদৃষ্টিতে লাজুক শেহরীনার দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম তার মনে হচ্ছে সে তার হবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির স্বাদ পাচ্ছে। প্রথম অনুভূতি, প্রথম অনুভব কারো মুগ্ধতার জোয়ারে ভাসা সে প্রথম আহাট পেয়ে আপ্লুত হচ্ছে। ফারদিন তার কাজিন ভাই সারোয়ার এর দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় পলকে শেহরীনার দিকে তাকিয়ে গলা ঝেড়ে ‘আহেম আহেম’ শব্দ বের করে মুখ দিয়ে। এতে হকচকিত চোখে সারোয়ার এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা চুল নেড়েচেড়ে বলে,

“আসলে স্যার আমার কোর্টে কাজ‌ আছে। একজনের সাথে দেখা করতে হবে। তার সাথে কথা বলে বের হয়। আপনি তাহলে যান। আর তোমরা ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? আজকে আর ক্লাস হবে না ভুলে গেছো?”

ফারদিনরা খুশি হয়ে গেল। শেহরীনা খানিকক্ষণ এর জন্য ভুলে গিয়ে ছিল যে, আজ ক্লাস হবে না। এ মুহূর্তে তার মনে আসায় সেও আরাম বোধ করল। বন্ধুমহলের সাথে থেকে আড্ডা দেবে সেটাই তার জন্য আনন্দময়।
হঠাৎ দারোয়ান এসে ‘শেহরীনা কে এখানে’ বলে উঠল! তার প্রশ্নে ফারদিন ভ্রু কুঁচকে শেহরীনাকে দেখিয়ে বলে,
‘এতো এই শেহরীনা কিন্তু কেনো?’
দারোয়ান শেহরীনার আপাতমস্তক পরখ করে বলে,
‘আপনার খুঁজে আপনার বাবা আইছেন। গেইটের দৌড়ারে দাঁড়িয়ে আছেন উনি।’

শেহরীনা ‘বাবা আসছে’ শুনে থমকে গেল। তার কোন বাবা আসল? তার নিজের আপন র*ক্তের বাবা? তার ধারণায় সে উৎফুল্ল হয়ে সবাইকে ফেলে গেইটের দিকে ছুটল। সারোয়ার ও পিছু যায়। তার ও জানার আগ্রহ শেহরীনার আসল বাবা কে? শেহরীনা গেইটের কাছে হাসিমাখা মুখে আসলেও তার কদম গেইটের থেকে কিছুটা দূরেই থেমে যায়। মুখের হাসি মিলিয়ে মলিনতা ছড়িয়ে পড়ল। নাছির উদ্দিন ভদ্রলোকের বেশে গেইটের মধ্যে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরপর ঘড়ি দেখছেন আর গেইটের দিকে তাকাচ্ছেন।‌ বোধ হয় শেহরীনার অপেক্ষায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। ফারদিনরা শেহরীনার সৎ বাবাকে কখনো দেখেনি। আজ দেখে তারাও কিছুটা অবাক। ভদ্রলোকের বেশভূষায় মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী লাগছে নাছির উদ্দিন কে। ইপশিতা শেহরীনার কাঁধে হাত রাখল। হুঁশ আসে তার। ফারদিনরা মাথা নেড়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করে। সারোয়ার তার মত স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। শেহরীনা তপ্ত শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। নাছির উদ্দিন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন,

“ভাবছিলাম একদিন না খাইয়া মরে গেছো। তাই দেখতে আছিলাম। নাহলে ঘরের মধ্যে তোর মায়ে তার কুৎসিত রূপধারী মেয়ের মৃত্যুর কারণ বোঝা হিসেবে ঠেলে দিতো। এই নেহ্ ধর একশ টাকা। নাস্তা পানি গিলে আমাকে উদ্ধার কর। তোর মত কুৎসিত মেয়েরে পালি এই তোর জন্য শোকরকর।”

“আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন। আপনি কার সাথে কেমনে কথা বলছেন। মেয়েটা কোনো রাস্তার অসহায় ভিখারি না। সে আপনার স্ত্রীর প্রথম পক্ষের প্রথম সন্তান। সেই হিসেবে তারও সবোর্চ্চ হক আপনার পরিবারের উপর এবং আপনাদের জমিজমার উপর বরাদ্দ আছে।”

নাছির উদ্দিন চমকে গেলেন আকস্মিক সারোয়ারকে অর্থাৎ হবু পাত্র কে গেইটের মধ্যে দেখে। তিনি চোরা চোখে একপলক রগ্ন হয়ে তাকান শেহরীনার দিকে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)এতেই শেহরীনার সামনে সারোয়ার এসে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। শেহরীনা অবাকের পর অবাক হচ্ছে যুবকের কাণ্ডে। নাছির উদ্দিন এর কদম দুপা পিছিয়ে গেল। সারোয়ার কপাল চুলকে পরণের কোর্টি টান টান করে চেহারায় এক চিলতে হাসি এনে বলে,

“বয়স তো কম হলো না আপনার আঙ্কেল। ছাড়েন না এসব কুটনামি। একদিন না একদিন পর আপনাদের বাড়িতে সম্বন্ধ আসবেই আবার। তখন তো আপনার মুখে চিরজীবনের জন্য তারা লেগে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা মেয়ে সৎ সন্তান হোক বা আপন। সেই সন্তান আল্লাহরই দান। আল্লাহর কারণে শেহরীনা পৃথিবীর আলো দেখেছে। তার কাছে কোনো যোগ্যতা নেই আপনার এত তাচ্ছিল্য সহ্য করা ছাড়া এই না ভাবেন? যদি আমি বলি সে আজ থেকে নিজ হাতে নিজের শ্রম উপার্জন করবে তখন? তখন আপনি কোন ভিত্তিতে তাকে অন্যায় কুৎসিত কথা শোনাবেন?”

নাছির উদ্দিন সারোয়ার এর কথায় চুপসে গেল। তবুও তিনি ভেতরে রেগে আছেন প্রচুর। শান্ত গলায় সারোয়ার কে জবাব দিলেন।

“দেখো ছেলে শেহরীনা আমার ঘরের মেয়ে। তার বাবা যেই হোক তার উপর এখন অধিকার আমার বেশি। সৎ বাবা হলেও বাবা নামের তর্কমা আমার কপালে আসছে শেহরীনার কারণে। তোমাকে পাত্র হিসেবে আমাদের ঘরের পাত্রীর জন্য দেখেছিলাম। চরিত্রের দিক থেকে ভালো ভেবে ছিলাম। কিন্তু তুমি তো বড্ড বেয়াদব। মুরব্বিদের সাথে কেমনে কথা বলতে হয় তাই জানো না দেখছি। তোমার হাতে আমাদের ঘরের পাত্রী দেওয়া যাবে না। দরকার পড়লে শেহরীনাকে বিয়েই দেবো না, ঘরকুনো করে দেবো তাকে। তোমার মত বেয়াদব ছেলে জন্য কখনো মেয়ে দেবো না আমি।”

সারোয়ার মুচকি হেসে বলে,’কিছুক্ষণ আগেও আপনি শেহরীনাকে উঁচুনিচু কথা বলছিলেন। সৎ বাবার অটল পরিচয় ক্ষেপন করছিলেন। থাক মুরব্বি মানুষ ধরে নিয়ে আপনার কথাকে এড়িয়ে নিলাম। তবে বিয়ের ব্যাপারটা আপনার নয় মেয়ের উপর নির্ভর করে। বিয়ে নিয়ে একটাই শর্ত ছেলে মেয়ে উভয়ের নিজেদের কে জেনেশুনে মতামত দেওয়া উত্তম। সেখানে শেহরীনা নিজেই বুদ্ধিমান।”

নাছির উদ্দিন শেহরীনার বন্ধুমহলের সামনে আর সারোয়ার এর নজরে অপমানিত হয়ে থরথরিয়ে রেগে গেইটের মধ্যে দাঁড়ানো রিকশায় নিজেই বসে চলে গেলেন। শেহরীনা স্তদ্ধ। কী হলো, কেনো হলো, আদৌ তা হওয়া উচিৎ ছিল কী? তার কারণে কোনো ভাবে তার মায়ের উপর নির্যাতন চলবে না তো! শেহরীনাকে অন্যমনস্ক দেখে সারোয়ার গলা ঝেড়ে উদ্যোগময় কণ্ঠে বলে,

“শুনো মেয়ে তোমার বাবাকে উঁচুনিচু কথা বলে অপমান করিনী শুধু তার এতদিনকার দম্ভ ভেঙ্গেছি। দেখবে আজ থেকে তোমার সাথে সে রূপ কটু ব্যবহার করবে না। আর রইল শ্রম বিনিয়োগ এর ব্যাপারে। তুমি আইন নিয়ে পড়েছো তার মানে এই নয় তুমি কলেজ স্কুলের পড়াশোনা খেয়ে ফেলেছো। আমি জানি তোমার অবশ্য জ্ঞান আছে পূর্বের পড়াশোনার উপরে। তুমি চাইলেই দু তিনটা টিউশনি ধরতে পারো।”

সারোয়ার এর কথায় জাফরান কৌতুহলী কণ্ঠে বলে,

“আরে হ্যাঁ শেহু বোন আমার সত্যি মনে ছিল না। নাহলে তোকে গত রাতেই জানিয়ে দিতাম। আরে তুই বলছিলি না টিউশনি খুঁজে দিতে। আমার চাচাতো বোন এবার নাইনে তাকে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত মানে দুবছর পড়াতে হবে। চার বিষয়ের উপর পড়াবি টাকাও পাবি পাঁচ হাজার টাকা। সময় তুই কথা বলে ঠিক করে নিস।”

“গ্রেট ব্রো এতো দেখলে রিযিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তুমি দুশ্চিন্তায় না থেকে সুরাহা খুঁজো দেখবে পথ আপনাআপনি বেরিয়ে আসবে। বাই দ্যা ওয়ে আমি এখন যায় তোমরা এঞ্জয় করো গাইস। আল্লাহ হাফেজ।”

ফারদিনরা সারোয়ার কে বিদায় জানিয়ে আস্তেধীরে ভেতরে চলে গেল। সারোয়ার গাড়ির দরজায় হাত ছুঁয়েও ফিরিয়ে নেয়। পিছু মোড়ে একপলক দেখল। শেহরীনা গেইটের পাশেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সারোয়ার অবাক হলেও তার বিভীষিকাময় জীবনে পুনরায় মুগ্ধতা ফিরল। চমৎকার এক হাসি উপহার দিলো শেহরীনাকে। শেহরীনার লজ্জা লাগল। কেমন হ্যাবলার মত চোয়াল ফাঁকা করে তাকিয়ে ছিল সে। মাথা নামিয়ে চলে যেতে পা বাড়ালে ‘শেহরীনা’ নরম মোহনীয় কণ্ঠে তার নাম ডেকে উঠে কেউ। শক্ত হাতে বোরকা চেপে ধরল শেহরীনা। সারোয়ার পা বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে এসে মেয়েটার পেছন বরাবর এসে তার থেকে খানিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। কিছুটা ঝুঁকে শেহরীনার কানের কাছে মুখ এনে টানময় শ্বাস ছেড়ে বলে,

“আমার জন্য আজ দুপুর একটায় নামাজের পর অপেক্ষা করবেন গেইটে।”

“যদি না করি।”

চট করে সারোয়ার এর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় সে। তার মুখশ্রীতে হতাশা ফুটল না। বরং চমৎকার সূক্ষ্ম হাসির তীর বসে আছে সেই ঠোঁটের কোণায়। মৃদু গলায় শুধু বলল।
‘আমি জানি আপনি অপেক্ষা করবেন।’
এই বলে এক পা দুপা তিন পা চার পা করে শেহরীনার দিকে তাকিয়ে থেকে পিছিয়ে তৎক্ষণাৎ শরীর বাঁকিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে বসে পড়ল। শেহরীনা বিস্মিত, তার স্তদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার দিন আজ।

চলবে…..

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১১

নাছির উদ্দিন রেগেমেগে রুমের ভেতর পায়চারী করছেন। রূপালি বেগম স্বামীকে অত্যাধিক রাগান্বিত দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। রুমে যেতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। তবুও স্বামী বাড়ি ফিরেছেন। দেখা না করেও পাচ্ছেন না। তৎক্ষণাৎ রান্নাঘরে গিয়ে গ্লাসে পাউডার দুধ, দই আর তরল দুধ মিশিয়ে সেখানে বরফ দুটো দিয়ে লাচ্ছি বানিয়ে রুমের দিকে চলে আসলেন। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। নাছির উদ্দিন এর চেহারা অমাবস্যার‌ ন্যায় কালো বর্ণে ছেয়ে আছে।
রূপালি বেগম হাত এগিয়ে গ্লাসটা দিলেন। নাছির উদ্দিন দেখে ছুঁ মেরে গ্লাসটি নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে ফেললেন। বরফ দুটো গ্লাসের মধ্যে গলিয়ে গিয়েছে। ছোট অংশ বিদ্যমান। তিনি চোখ বুঁজে জোরালো শ্বাস ফেলে বিছানায় লম্বা হয়ে টান টান করে শুইয়ে পড়লেন। রূপালি বেগম অবাক হচ্ছেন। আজ প্রথম স্বামীকে রেগে এসে শান্তভাবে শুয়ে পড়তে দেখলেন। তিনি ইতস্তত বোধ করছে প্রশ্ন করতে। কিন্তু মনে সাহস জুগিয়ে তিনি স্বামীর পাশে ঘেঁষে বসলেন। নাছির উদ্দিন উল্টো দিক মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যথাসাধ্য নিজ স্ত্রীকে এড়িয়ে যাওয়ার দিক প্রকাশ পেয়েছে নাছির উদ্দিন এর কাণ্ডে। রূপালি বেগম হাত এগিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন না। শুধু মৃদু গলায় শোনান।

“আপনার কী হয়েছে জানি না। তবে যা হয়েছে উচিৎ সময়ের শিক্ষা ভেবে সামনে থেকে ভুল সংশোধন করে ফেলেন।”

নাছির উদ্দিন শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। পিনপতন নীরবতা বিদ্যমান। রূপালি বেগম পুনরায় সাহস করে আংশিক মনের ভাব প্রকাশ করেন।

“আমি এটুকু জানি আপনি সামনাসামনি শেহরীনাকে মানসিক অত্যাচার করে তৃপ্তি পেতে চান। এতে আপনি নিজেও অতৃপ্তি পান। কারণ আপনি জানেন সে আপনারও অংশ। আপনার রক্ত ও তার শরীরের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে। এটা মানি আমি যে, তার আপন বাবা মা মেয়েকে মাঝ পথে ফেলে চলে গেলে। সেই মা অসহায় হয়ে বাড়ি ফেরে আসে। তখন সেই মায়ের বাবা অন্যায় রাস্তা বেছে আপনার মত গুণ মান্য পুরুষের গলায় বিয়ের তর্কমা পড়িয়ে দিলেন। আপনাকে বিয়ের আগে বলার চেষ্টা করলেও তারা আমায় বন্দি করে রাখে। আপনিও পরোয়া না করে আমায় অত্যাচার করলেন। করেও যাচ্ছেন তাও আমি কিছু বলছি না। কারণ এই আমার সহনশীল হয়ে গিয়েছে। শেহরীনা গাঁয়ে পিঠে বড় হয়েছে কিন্তু জ্ঞান বুদ্ধির ক্ষেত্রে সে এখনো অবুঝ। আমাদের মা মেয়ের সাথে আপনার ওমন ব্যবহারের কারণ একটাই আপনার অমতে বিয়ে পড়ানো। সেটার জন্য আমি দীর্ঘ কয়েক বছর মুখে কুলুপ এঁটে সংসার করেই যাচ্ছি। অথচ আমিও প্রেমে পড়েছিলাম একজনের , আপনিও পড়েছিলেন তেমনি একজনের প্রেমে। প্রেম বড্ড বিষাদময়।”

রূপালি বেগম এর চোখে তার প্রথম ভালোবাসার মানুষটার ছবি ভেসে উঠে। তার সাথে কাটানো রঙিন সোনালী মুহূর্ত স্মৃতি হয়ে তার মনের কেন্দ্রে ভেসে উঠল। দৃশ্যপটে রূপালি বেগম এর ষোল বছরের কিশোরী আবেগের জোয়ার প্রবল থাকে। সেসময় বিশ বছরের এক যুবক তার হাতে এক বক্স আইসক্রিম ধরিয়ে বলে,’এটা আমার সুন্দরী রূপকন্যার জন্য।’ যুবকের আদুরীয় ভঙ্গিতে বলায় রুপালি লাজুক লতার ন্যায় মিইয়ে উঠল। বক্সটি হাতে নিতেই যুবকটা তার হাতে চামচ ও দিলো। রূপালি খোশমনে এক চামচ আইসক্রিম নিয়ে প্রথম মুখ পান করাল তার প্রেমিক পুরুষকে। সেই প্রেমিক পুরুষ পরবর্তীতে তার আবেগপূর্ণ প্রেমিকাকে খাইয়ে দিলো। প্রচণ্ড গরমের মাঝে শীতল হয়ে আইসক্রিম খাওয়ার ব্যাপারটা দারুন।

“আমি প্রেম করে ছিলাম কী না তুমি জানো নাকি?”

আচমকা নাছির উদ্দিন এর করা প্রশ্নে ধ্যান চ্যুত হলো রূপালি বেগম এর। তিনি চোখ ফিরিয়ে দেখেন নাছির উদ্দিন তখনো মুখ ফিরিয়ে আছেন। এ সুযোগে তিনি নিজের চোখের অবাঞ্ছিত জল মুছে নিলেন। অবাঞ্ছিত জল বলে আখ্যায়িত করায় তিনি প্রচণ্ডভাবে হৃদয়ে কম্পন অনুভব করলেন। অবাঞ্ছিত জল যেই জলের কোনো অনুভূতি নেই, যেই জল মুছে আগলে নেওয়ার মত কারো স্পর্শ নেই, যেই জলে সন্দেহের বীজ রোপণ হয়, যেই জল সংসার জীবনে অতীত মনে করিয়ে দিতে সক্ষম। সেই জল অস্তিত্ব হীন বটে।

“হুম বলো শুনো নাই আমার কথা?”

স্বামীর কথায় হকচক করে তিনি আঁচল দিয়ে মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বলেন,

“আপনার হাবভাব দেখে অনুমান করলাম।”

“মানুষের হাবভাব দেখলে কী বোঝা যায়? আমি প্রেম করে ছিলাম?”

“হুম প্রেমে আর যাই হোক প্রেম ত্যাগের চেয়ে প্রেম হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা চিরঞ্জীব।”

নাছির উদ্দিন পুনরায় কথা বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

“আজ শেহরীনা বাসায় এলে একসাথে খেতে বসব। তার না আসা অব্দি শুকনো তেল ছাড়া একটা রুটি দাও সাথে ফ্রিজে খুলে দেখো সেখানে গত রাতে খেজুর গুড় এর বোতল রেখেছিলাম। গুড় বের করে বাটিতে রাখো আমি আসতেছি মুখহাত ধুয়ে।”

রূপালি বেগম ‘হুম আচ্ছা’ বললেন। নাছির উদ্দিন শুয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমে গেলেন। রূপালি বেগম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। সামান্য অগোছালো হয়েছে। কাঁথা ঠিক করে বালিশ জায়গা মত রাখার সময় তিনি বালিশের কভার ধরে হতভম্ব হয়ে গেলেন। যেই বালিশে তার স্বামী মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন সেই বালিশের কভার ভিজে আছে। ভিজে অনুভব হওয়া অংশে বার কয়েক হাত চেপে গন্ধ শুঁকে নেয়। রূপালি বেগম এর অনুমান সত্য হলো। তার স্বামী তার অগোচরে কাঁদছিল। তবে কী তিনিও কষ্ট পেয়ে কেঁদে তৃপ্তি পান? না হয় কান্নার তো অন্য কারণ তিনি দেখছেন না। মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করলে লজ্জায় সামনে অব্দি আসবেন না তিনি। তখন পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হবে। বালিশের কাভারের ভেতর শক্ত পাথর রেখে সূর্য বরাবর রশ্নি পড়ে মত রাখতে তিনি চেয়ার এনে রাখেন। ভাবনা অনুযায়ী কাজ করে স্বামীর কথামত রান্নাঘরে গেলেন।

___
“ইপশু মা শোন তোর বাবার কথা কী রাখবি?”

ইপশিতা ফ্রক পরিহিত অবস্থায় হিজাব বাঁধছিল মাথায়। তখনি পেছন থেকে তার বাবা যুবুন মিয়া মেয়েকে দেখে আহ্লাদী কণ্ঠে কাছে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন। বাবার হঠাৎ করুন কণ্ঠস্বর শুনে থমথমে মুখে বাবার দিকে ফিরল সে। যুবুন মিয়া মেয়ের হাত ধরে বিছানায় বসলেন। রুমে তখন তিন মগ দুধের চা বানিয়ে ট্রে সমেত প্রবেশ করলেন ইপশিতার মা হেনিন ইয়াসমিন। মাকে দেখে ইপশিতা নিজেই মায়ের হাত থেকে ট্রে নিয়ে মিনি সাইজ টেবিলের উপর রাখল। যুবুন মিয়া একপলক নিজ স্ত্রীর দিকে তাকান। হেনিন ইয়াসমিন মাথা নেড়ে সাড়া দেন। বাবা-মায়ের হাবভাব সন্দেহজনক লাগছে ইপশিতার কাছে। ঢোক গিলে কোনোভাবে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুরাহা খুঁজতে লাগল মনে মনে। পরক্ষণে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী শেহরীনার কথা স্মরণে এলো তার। তার বন্ধুমহল নিশ্চিত এখনো ভার্সিটির মধ্যে থাকবে। কেননা সময়ই হয়েছে সবে বারোটা বিশ বাজে। ভার্সিটির প্রাঙ্গণ চারটা অব্দি খোলা থাকে। সে নিজেই জরুরি জিনিস কিনতে তাদের মাঝখান থেকে উঠে চলে গিয়ে ছিল। সুযোগ বুঝে শেহরীনাকে মেসেজ পাঠায়।
‘দোস্ত হেল্প কর। এখনি আমাকে কল দিয়ে বল দোস্ত বড় সমস্যা হয়ে গেছে ভার্সিটির মধ্যে। তোকে লাগবে এখনি চলে আয়। কথাটুকু বলতে ফোন কর এখনি প্লিজ!’
মেসেজ পাঠিয়ে স্বাভাবিক মুখ ভঙ্গি করে বাবা মায়ের দিকে তাকালো। তারা এখনো নিজেদের মাঝে সাহস সঞ্চার করছেন। হয়ত এমন কোনো কথা বলতে চাইছেন যা ইপশিতার মুখের রঙ উড়িয়ে দেবে। তবে ইপশিতা একটুও চাই না তার সুন্দর হাসির রঙ উড়ে গিয়ে ছ্যাঁকা খেয়ে বাঁকা হোক । ভ্রু নেড়ে আপনমনে শেহরীনার কলের অপেক্ষায় অস্থির হচ্ছে সে।
‘এই হারামী বেডি এখনো কল দিচ্ছে না। এর তো ঘাড় ভেঙ্গে দেবো।’
কথার বিড়বিড় এর মাঝে ইপশিতার বাবা যুবুন মিয়া কেশে মেয়ের মনো দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ইপশিতা স্বাভাবিক নজরে তাকাল।
হেনিন ইয়াসমিন স্বামীর হেঁয়ালিপূর্ণে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। মেয়ে হয়ে জন্মেছে সেহেতু বিয়ে সাদি করে পরের ঘরে যেতেই হবে এখানে এতো আহ্লাদ দেখানোর কী আছে তিনি বুঝেন না। দাঁতে দাঁত চেপে স্বামীকে চোখ রাঙানি দিলেন তিনি। এতে অসহায় মুখ করে যুবুন মিয়া ‘মা তুমি’ এটুকু বলার মাঝে ইপশিতার ফোন বিস্ফোরণ ঘটানোর ন্যায় শব্দ করে বেজে উঠল। অন্তিম মুহূর্তে সংযোগ পেয়ে মনে মনে উৎফুল্ল হলো সে। তবুও খোশমেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে ফোন ইচ্ছে করে লাউড স্পিকার দিয়ে উঠায়। শেহরীনাকে মেসেজ করা কথাটাই সে বলেছে। ইপশিতাও আতঙ্কিত ভাব করে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ে। হেনিন ইয়াসমিন মেয়ের যাওয়ার মাঝে থামাতে চাইলে যুবুন মিয়া স্ত্রীকে চেপে ধরে আঁটকে নিলেন। বিড়বিড় করে বলেন,

“থাক না এখন ইপশুর মা। মেয়ের জরুরি কাজ পড়ছে ভার্সিটির মধ্যে। গেলে যাক এখন। রাতেও তো সময় পাবো তাই না?”

“হ্যাঁ সময় পাবেন পাবেন বলে দামড়ি মেয়েকে মাথায় তুলেন আরো। দেখিয়েন মেয়ে আবার উচ্ছেন্নে না যায়। সময় থাকতে আমার কথার মূল্য দিন। নাহলে মেয়ে হাত ছাড়া হয়ে পড়বে হুহ।”

যুবুন মিয়া স্ত্রীর রাগে বলা কথা মনে নিলেন না বরং মুচকি হেসে চুপচাপ হজম করে নিলেন।

___
ইপশিতাকে পেয়ে চেপে বসে বন্ধুমহল। সে খোলাসা করে জানায়। ফারদিনের মুখে কিছুটা চিন্তিত ভাব দেখা গেল। যা শেহরীনাকে অবাকের মাঝে ফেলে দিল।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)ফারদিন ইপশিতার বাহু আলতো করে চেপে ধরে তার মুখোমুখি টেনে এনে বলে,

“তুই কী ভালো পাত্র পেলে বিয়ে করে ফেলবি?”

ফারদিনের প্রশ্নে ইপশিতার হৃদয়ে কামড় পড়ল। মাটি কামড়ে থাকার মত প্রবণতা তার হৃদয়ের মাঝে উত্তপ্ত হলো। ফারদিনের মুখে এ প্রশ্ন শোনা যেনো ইপশিতার হাতে চাঁদ পাওয়ার সমান। মোহের ঘোরে ‘না’ বলে দেয়। ফারদিন এতেই ফিক করে হেসে শেহরীনার পাশ ঘেঁষে বসে বলে,

“দেখলি এরে আমি ভালো করে চিনি। এই কী বিয়ে করবে? তোর মনে হয়? অন্য কেউ করুক আর না করুক এই মেয়ের বিয়ের নাম থেকেই এলার্জি দেখলি না অকপটে না বলে দিলো।”

একটু আগেও যেই খুশি বিরাজ করছিল ইপশিতার মনে তা আড়পলকে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ফারদিনের দিকে। তার হাসিমাখা মুখ দেখে ইপশিতার গলায় কান্না আটকে আসছে। তবুও সে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। মেকি হেসে সেও শেহরীনার অপরপাশে বসে তার হাত ধরে বলে,

“তোর বিয়ের পরপর আমিও বিয়ে করব। তার আগে না। আর যদি কখনো আমার আগে হয়ে যায় তাহলে তোরা আছিস আমার বিয়েতে বুঝলি?”

ফারদিন মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে ইপশিতার নাক টিপে বলে,

“তোর কখনো বিয়ে হতো না দেখিস ডাইনি একটা। ডাইনির কখনো বিয়ে হয় না।”

“হারামীর লেজ কোথাকার তোর কখনো বিয়ে হবে না মিলিয়ে নিস আমার কথা। তোকে তো যে বিয়ে করবে সেই তোকে পাগল বানিয়ে পাগলা গরাধে ফেলবে হুহ।”

রাগ দেখিয়ে কথা বলে মুখ লটকে বসল ইপশিতা। তখনি কারো গলা ঝাড়ার শব্দে সকলের দৃষ্টি পেছনের দিকে গেল। ব্যক্তিকে আচমকা দেখে ইপশিতা লজ্জা পেল। সারোয়ার কে দেখে চোয়াল ফাঁকা হলো শেহরীনার। সারোয়ার তার নিকটে এসে মোলায়েম গলায় বলে উঠে।

“তবে আমার আত্মবিশ্বাস জিতলো। আপনি আমার অপেক্ষায় না থাকতে চেয়েও থেকেই গেলেন। এতে হয়ত আমার অনুরোধের জয় হলো থ্যাংকিউ মিস।”

ফারদিন মিটমিটে হেসে বলে,’তাহলে ব্রো ফাইনালি ডেটে যাচ্ছো তাও কী না উগান্ডার বান্দরনীর সাথে তুমিও পারো ব্রো দুনিয়ায় এতো মেয়ে থাকতে শেষমেশ এই বান্দরনীকে ডেট করছো? আই হোপ এবার ডেট কনফার্ম লিখে রাখো তুমি।’

শেহরীনার রাগ পেলো। তারই বন্ধু কী না তার নামে কুটনামি করছে। রেগেমেগে বন্ধুর পায়ের উপর পা দিয়ে পাড়া দিল। বেচারা ‘উহ আহ আহ ডাইনি একটা দিলি তো মেরে’ এই বলে ফারদিন বসে পা মাটিতে ঘষতে লাগল। ইপশিতা কপাল চাপড়ে ফারদিন কে টেনে অন্যখানে নিয়ে যায়। জাফরান ইপশিতা আসার সময় চলে গিয়ে ছিল। তার বাসায় তার মা অসুস্থ এজন্য জলদি চলে গিয়েছে। শেহরীনা একা হয়ে পড়ল সারোয়ার এর সামনে। হাত কচলে তার সঙ্গে যাবে কী না তা নিয়ে দোটানায় ভোগছে। সারোয়ার দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,

“আসেন আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। ডেট যেদিন আপনার স্বাভাবিক মনে চাই সেদিন হবে।”

“আজকেই যায়!”

মুখ চেপে ধরল নিজের শেহরীনা। অতিরিক্ত উত্তেজনায় মুখ ফসকে সে কী বলে ফেলল? লজ্জা একরাশ তাকে ঘিরে ধরেছে। সারোয়ার জবাব দিল না চমৎকার হাসি দিলো। লোকটার গালে কোনো দাড়ি নেই আছে মোচ। কাঁটাময় মোচের মাঝে যেই হাসি দিল দন্তময় দাঁত দৃশ্যমান হলো। মুগ্ধ চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকল শেহরীনা। সারোয়ার মিটমিটে হেসে তার মুখের উপর তুড়ি বা*জা*ল। শেহরীনার হুঁশ আসতেই লজ্জার মাথা খেয়ে সে নিজেই দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়ল।

চলবে……

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১২

“শুনেন আজ বাহিরে যাইয়েন না। বাচ্চাদেরও স্কুল কলেজ বন্ধ। কারফিউ চলছে। আপনার দোকান কয়েকদিন বন্ধ রাখেন!”

“দেখো দোকানের টাকায় আমাদের পেট চলে। দোকান বন্ধ রাখিলে শেহরীনা ফিও দিতে পারব না। তার ফি নাসমা- নাজমুর এর চেয়েও বেশি। তাগো পরে দিলেও সমস্যা নাই। কিন্তু শেহরীনার পরে দিলে তার ভার্সিটির লোকেরা বহুত কথা হুনায়।”

রূপালি বেগম তপ্ত শ্বাস ফেললেন। প্রাকৃতিক ভাবে পরিবেশ দূযোগ মুক্ত থাকলেও প্রতিকূলে পড়েছে কিছু কীট জাতীয় লোকদের কারণে। মাঠঘাটে নেমেছে দুদল। এর দ্বারা চারপাশ জুড়ে যাকে হাতের নাগাল পাচ্ছে হয় স*ন্ত্রা*সী দাবি করে নিয়ে যাচ্ছে না হয় গু*লি*বিদ্ধ করে বুকটা ঝাঁজরা করে দিচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। রূপালি বেগম সময় দেখলেন। শেহরীনাকে ডেকে তুলতে তার রুমে গেলেন। মেয়েটার চোখমুখে আঁধার ছড়িয়ে আছে। কয়েকদিন ধরে বিষয়টা তিনি লক্ষ্য করছেন। তবে মুখ ফুটে মাকে না সে বলছে আর না তিনিও নিজ মুখে জিজ্ঞেস করতে পারছেন। মা-মেয়ের সম্পর্কটা এতটা জটিল কেনো তাদের? কেনো তিনি মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না করতে পারেন না? রূপালি বেগম এর কাঁধে কেউ হাত রাখায় চমকে পিছু মোড়লেন। নাজমুর মায়ের অশ্রুসিক্ত চোখে দেখে নরম হাতে সেই চোখের জল মুছে বলে,

“মা তুমি কেঁদো না প্লিজ! আপুর সাথে আমি কথা বলছি। তুমি কোনো চিন্তা করিও না।”

ছেলের কথায় রূপালি বেগম এর মুখে হাসি ফুটল। তিনি মাথা নেড়ে ছেলেকে যেতে ইশারা করে তিনি চটজলদি রান্নাঘরে গেলেন। ছেলে-মেয়ে দুটো কথা বলার মাঝক্ষণে তিনি স্যুপ বানিয়ে তাদের কাছে যাবেন। যাতে একটু হলেও তার মেয়েটা তার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে। নাজমুর হাসি হাসি মুখ করে তার বড় বোনের দরজায় কড়া নাড়ল। শেহরীনার ঘোর কাটল। হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে যায়। সে কপাল চাপড়ে ফোনটা নিয়ে একপলক দেখে বিছানায় রাখে। উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। সামনে নাজমুর কে দেখে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে।

“কী হলো ভাই কিছু লাগবে?”

“না আপু তুমি সকালে নাস্তা করে সেই যে দরজা লাগিয়ে বসে আছো। কারণ কী? তোমাকে খুব অস্বাভাবিক লাগছে কেনো?”

শেহরীনা তার মনো যন্ত্রণা লুকিয়ে কৃত্রিম হেসে বলে,

“কই কোথায় লুকিয়েছি? এতো আছি ঠিকাছি আমি।”

“সত্যি তো আপু?”

শেহরীনা হ্যাঁ বোধময় মাথা নাড়ে। নাজমুর হাত ভেতরের দিকে দেখিয়ে বলে,
‘আসতে পারব কী?’

“আরে সরি এটা আবার বলতে হয় নাকি? আয় ভেতরে আয়। বস একসাথে গল্প করি।”

নাজমুর আঁটসাঁট হয়ে উৎফুল্ল মুখে বসল বোনের বিছানায়। শেহরীনা ফোনটা তৎক্ষণাৎ চার্জে লাগিয়ে অস্বাভাবিক হাসল। নাজমুর খেয়াল করলেও দমিয়ে রাখল মনে। শেহরীনা ভাইয়ের কাছে বসলে নাজমু্র হুট করে বলে,

“সারোয়ার ভাইয়া মিছিলে যোগ দিয়েছে। শুনেছিলে আপু?”

থমকে গেল শেহরীনা। চমকানো চেহারা করে ভাইয়ের দিকে তাকাল সে। নাজমুর তার পকেট হাতড়ে তার নিজের ফোন বের করে ফেসবুক এ ঢুকল। শেহরীনা নির্জীব ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। নাজমুর এর সঙ্গে সারোয়ার এর মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।

“তোর সাথে সারোয়ার কখন থেকে এড আছে-রে? মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখাচ্ছে কেনো তোর আইডিতে?”

নাজমুর থমথমে মুখে বলে,’আরে কয়েকদিন আগেই এড হয়ছেন উনি। কথাবার্তায় চিনলাম উনিই সেই যাকে তুমি রিজেক্ট করেছিলে।’
ভাইয়ের কথায় শেহরীনা‌ কিছুটি বলল না। সন্দেহটা নিভে গেল তার মন থেকে। তার একটু হলেও সন্দেহ হয়েছিল তবে কী তার ভাইয়ের সাথে সারোয়ার এর কথা হয়? এমনটা সন্দেহের ভিত্তিতে প্রশ্ন করে শেহরীনা। নেতিবাচক উত্তর পেয়ে আর ঘাঁটল না ব্যাপারটা। নাজমুর সারোয়ার এর প্রোফাইলে ঢুকে কিছু শেয়ারকৃত পোস্ট দেখাল।
‘সারোয়ার ভাইয়া আন্দোলনে যেমন যোগ দিয়েছে তেমন পোস্ট করে এখনকার ট্রেন্ডের হিসেবে সেভ_বাংলাদেশি_স্টুডেন্টস লিখে যত পারছেন শেয়ার কমেন্ট করতছেন। ভাইয়ার এই নেতৃত্বাধীন আর মানবতা দেখে আমি মুগ্ধ।’

শেহরীনার মুখটা মলিন হয়ে গেল। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে।

“আন্দোলনের মধ্যে আঘাত পেয়েছে কোনো?”

“এখনো কোনো খবর পায়নি। তবে মনে হচ্ছে পায়নি।”

“শুন তোর তো এখন কোনো কাজ নেই। যাহ তো বাহিরে কিছু ধান রাখা আছে। সেগুলো ঝেড়ে ঝেড়ে ভালো করে চাল বের করে নেহ্। এক বস্তার মত হবে। গতকাল আমার বান্ধবীর বাবা পাঠিয়েছে ধানগুলো।”

নাজমুর এরও বাসায় সময় কাটছিল না। আন্দোলনের কারণে বাহিরের দিকে যাওয়ার সুযোগ তার হচ্ছিল না মায়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে। বিধেয় সে বোনের কথায় দুপায়ে রাজি হয়ে চলে গেল। শেহরীনা ঠোঁট কামড়ে ফোন হাতে নিল। সারোয়ার এর আইডির মেসেঞ্জারে ঢুকে মেসেজ করার চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু সাহসে কুলোয় পাচ্ছে না সে। পরক্ষণে বাহিরের অবস্থা ভেবে মেসেজ করল।
‘নিজের খেয়াল রাখিয়েন। মনে রাখবেন আপনার প্রতিক্ষার কথা।’
মেসেজটা পাঠিয়ে চট করে ডাটা বন্ধ করে দিল। হঠাৎ জোরালো শব্দ শুনে জানালার বাহিরে তাকাতে গেল শেহরীনা। তখনি রূপালি বেগম তাকে টেনে জানালা লাগিয়ে দিল। ফিসফিসিয়ে বলে,’একটুও জানালা খুলিস না মা।’
এই বলে তিনি দৌড়ে বাহিরে গিয়ে দরজা খুললেন। নাজমুর কে এদিক ওদিক ভালো মত খোঁজ করলেন। তাকে না পেয়ে উদগ্রীব হয়ে ঘরের ভেতর এলেন। শেহরীনার মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। নাজমুর কে সে বাহিরে যেতে বলেছে এখন তাকেই খোঁজে পেলো না তার মা। শেহরীনা দৌড়ে বাহিরে যেতে নিল রূপালি বেগম তাকে দেখে চেঁচিয়ে বলেন,

“একপাও যদি ঘরের বাহিরে দিস তাহলে আর কখনো আমার মুখ দেখবি না বলে দিলাম।”

শেহরীনার পা ঘরের চৌকাঠে এসে থেমে যায়। ছলছলে মায়ের দিকে তাকায়। রূপালি বেগম গম্ভীর হয়ে শেহরীনার বাহু ধরে তাকে তার রুমে টেনে নিয়ে গেল। তাকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দরজা লাগিয়ে দিলেন রূপালি বেগম। শেহরীনা চিৎকার দিয়ে দরজা খুলতে বলছে।
‘মা ওমা আমাকে বাহিরে যেতে দাও। নাজমুর বিপদে মা। ওমা আমাকে বের হতে দাও না। আমার ছোট ভাইটা বিপদে আছে মা। তাকে মে*রে দেবে তারা। প্লিজ মা আমাকে যেতে দাও না!’
রূপালি বেগম নিস্তেজ রূপে ঘরের চৌকাঠ ঘেঁষে বসে পড়লেন। তিনি নাজমুর কে বাহিরে যেতে দেখে তখনি থামাতে চেয়ে ছিলেন। তবে ছেলের মনোভাব দেখে তিনি অবাক। ছেলে তার অধিকারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাধারণ শিক্ষার্থীর অসীম প্রেম দেশের মায়ায় প্রতিফলিত। নাজমুর কে থামাতে পারেননি রূপালি বেগম। ছেলে তাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল আর কখনো ফিরবে না সে। রূপালি বেগম এর চোখে থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। শেহরীনা গুটিয়ে আছে দরজার পাশ ঘেঁষে। ছোট ভাইটার জন্য তার হৃদয় ফ্যাল ফ্যাল করে কাঁপছে। তৎক্ষণাৎ সময় বিলম্ব না করে ফোন হাতে নিয়ে সারোয়ার কে কল দিল।
সারোয়ার তার হাতের ক্ষত মুছে ব্যান্ডেজ করেছে। হা*মলা*য় সেও একটুখানি আহত। গুরুতর আহত দু-তিন জন হয়েছে সারোয়ারদের দলেও। তবে শত্রুদল তাদের সাথে পারেনি। তাদের প্রায় কয়েকজন নিহত হয়েছে।
হঠাৎ ফোনটা শব্দ করে উঠায় সারোয়ার এর ধ্যান গিয়ে পড়ল ফোনের উপরে। স্ক্রিনে শেহরীনা নামটা ভেসে উঠতে দেখে তার মুখে উৎফুল্ল তা ছড়িয়ে গেল। খোশমনে ফোন উঠাতেই শেহরীনার কান্না শুনে স্তদ্ধ হয়ে গেল। চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘কী হলো শেহরীনা আপনি কাঁদছেন কেনো? কী হয়েছে আমাকে বলুন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসতে।’

শেহরীনা‌ ভরসা পেল। কান্না মিশ্রিত গলায় বলে,
‘আআমার ভাই নাজমুর বাহিরে চলে গেছে। এখানে মি*ছিল লাগছে আবারো। অনেক গু*লাগু*লির শব্দ হচ্ছে। একটু আমার ভাইকে বাঁচিয়ে আনুন প্লিজ! আপনি তাকে এনে দিলে আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।’

শেহরীনার কথা শুনে সারোয়ার চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে যায়। সঙ্গেই মুখ থেকে ‘আহ’ শব্দ বেরিয়ে আসে তার। শেহরীনার কানে শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়। সে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।

“আপনার কী হয়েছে? আপনি কী আঘাত পেয়েছেন?”

সারোয়ার জবাব দিতে চেয়েও দিল না মুচকি হেসে বলে,’না যদি আমার জন্য দোয়া স্ত্রীর অন্তরে থাকে। তাহলে আমি আঘাত পাবো না ইন শা আল্লাহ।’
শেহরীনা চিন্তিত ভাব তখনো কাটেনি। তবুও সারোয়ার এর জবাব শুনে তার অন্তর ভেদ করে মুখ থেকেও বেরিয়ে এলো ‘ইন শা আল্লাহ’। সারোয়ার শুনে চোখ বুঁজে তৃপ্তির শ্বাস নিল।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)মেয়েটা একটু হলেও তাকে তার মনে জায়গা দিয়েছে এই যেনো ঢের। সময় বিলম্ব না করে সে শেহরীনাকে বলে,

“দেখুন নিজের আর আন্টির খেয়াল রাখুন। আঙ্কেল কেও চলে আসতে বলুন। ছোট নাসমাও যেনো বাহিরে না যায়। আমি আসছি নাজমুর কে খোঁজার বন্দোব্যবস্থা করছি।”

শেহরীনা কল কাটতে গিয়েও থেমে মৃদু গলায় বলে,’নিজের খেয়াল রাখবেন প্লিজ!’
সারোয়ার জবাবে নিশ্চয়তা দিতে পারল না তবে সেও মৃদু গলায় বলে, ‘হুম ইন শা আল্লাহ আল্লাহ ভরসা’।
কল কেটে গেল দু পক্ষের।

___
নাছির উদ্দিন দোকানের ভেতর বসে আছেন। দোকান খুললেও মি*ছিলের কারণে দোকানপাট বন্ধ করতে হয়েছে। তিনিও এখন দোকানে আটকে পড়ে আছেন। যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় ততক্ষণ অব্দি তিনি দোকান খুলতে পারবেন না। তার পাশ্ববর্তী দোকানপাটের লোকদের ও একই অবস্থা। ক্যাশ কাউন্টারে বসে তিনি প্রহর গুনছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার।
অন্যত্রে ধুপির দোকানে মোঃ আবু সিদ্দিক আটকা পড়েছেন। তিনি একদুয়েক কোট ধুপির দোকানে দিয়ে ছিলেন। তা নিতে এসেছিলেন আজ। চলে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে গেল। তিনি অসহায়ত্ব আপন করে নিয়ে বেঞ্চে গাঁ হেলিয়ে দিলেন। ফোন হাতে নিয়ে ছেলে সারোয়ারের নাম্বারে কল লাগালেন। ছেলের ফোন বন্ধ পেয়ে বুঝছেন ছেলে অবশ্য কোনো কাজে ব্যস্ত। তিনি কল লিস্টের মধ্যে থাকা তার নিজের স্ত্রীর নাম্বারটা নজরে এলো। তিনি শতভাগ স্ত্রীর খেয়ালে মগ্ন হয়ে যান প্রতিবার প্রতি ক্ষণে। কী করবেন ভালো যে বাসেন প্রচুর। ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে একঝলক বিয়ের ছবি বের করেন। সেখানে মলিন চেহারায় পূর্ণ বিবাহিত বধুর বেশে দাঁড়িয়ে থেকে কাপল পিক তুলেছিলেন তারা। এর পর থেকে কাছাকাছি আসার গল্প , কাছে এসেও দূরত্ব এর আভাস কেনো যেনো তিনি অনুভব করতেন। সন্তান এলো পৃথিবীতে তিনি বাবা হলেন তবুও অনুভবে আদৌ চিন্তা করেন তার স্ত্রী কী তাকে মন থেকে আপন করে ছিল? এই এক প্রশ্নের উত্তর একটাই হোক সেই আকাঙ্ক্ষার রেশ ধরে এতটা বছর তিনি আশাবুন্ধে বসে আছেন। স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি হট্টগোল শুনতে পেলেন। জোরালো গু*লিবি*দ্ধ শব্দ শুনে তিনি দাঁড়িয়ে যান। ধুপিওয়ালা ভয়ে গুটিয়ে গেল। দোকান বন্ধ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছে সেও। কিন্তু একজন সৎ প্রফেসর হিসেবে মায়া প্রেম তার হৃদয়ে অটল। তিনি তৎক্ষণাৎ বাহিরে যাওয়ার কথা ভাবলেন। তখনি তার ফোনে টুং করে শব্দ হলো। তিনি ফোন চোখের সামনে ধরলেন। ফেসবুকে নোটিফিকেশন আসছে। এ দেখে তিনি ফেসবুক চালু করতেই দেখতে পেলেন অহরহ কোটা বিষয় নিয়ে পোস্ট হচ্ছে। এসব দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ ছেলের ফোনে লাগাতার কল দিতে লাগলেন।

____
নাছির উদ্দিন অস্থির হয়ে বসে কান পেতেছেন দোকানের সাটারে। গু*লিবিদ্ধ মা*রপি*ট স্লোগানের মধ্যেই আরম্ভ হচ্ছে। তবে হঠাৎ তার দোকানে কেউ জোরালো ভাবে হাত পেটাতে আরম্ভ করলো। তিনি অবাক ভয়ভীতি নিয়ে গুটিয়ে গেলেন। দোকানের সাটার তুলবে না বলেই পণ করে রেখেছেন তিনি।

চলবে……..
(ভুল হলে সবাই ক্ষমা করবেন।)