#প্রিয়ঙ্গনা
#বোনাস পর্ব
লেখনীতে:আইশা তানভি
ইরজা খুঁজে খুঁজে কিছু কাগজপত্র, ছবি, অ্যালবাম বের করল। কাগজগুলো তেমন কাজের নয়। অ্যালবামে আলমিরের ছোটোবেলার ছবি। ছোট্ট গলুমলু ফর্সা ছেলেটিকে কোলে নেওয়া নারীটির গায়ের রঙ একদম মলিন। চাপা শ্যামবর্ণ। তাকে চিনতে পারল না ইরজা।
আলমির ফিরল রাতে। অনেক ক্লান্ত। তাই শুয়ে রইল বিছানায়। অ্যালবামটি নিয়ে তার পাশে বসল ইরজা। আলমিরকে ডেকে ছবির নারীটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল।
“উনি কে?”
“আমার মা।”
“আপনার মা?”
আলমির আলতো হেসে বলল–
“বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“না মানে…!”
“মায়ের রঙ শ্যামলা ছিল। আমি বাবার রঙ পেয়েছি।”
ইরজার ভাবুক মনে আচানক উদয় হলো, এই কারণেই কী শরীফ আশরাফ আমেনাকে বিয়ে করেছেন? আর এই কারণেই কী দরিদ্র পিতার মেয়ে প্রিয়তা এই বাড়ির বউ হয়েছিল? তাদের দুজনের পরিণতি এক কেন? কেন অকাল মৃত্যু?
“আপনার বাবা কী উনাকে পছন্দ করতেন না?”
আলমির প্রশ্নাত্মক চোখে তাকাল। নির্মল দৃষ্টি। বলল—
“জানি না। আজকাল এত উদ্ভট প্রশ্ন করো কেন?”
ইরজা জবাব দিলো না। কেন সে উদ্ভট প্রশ্ন করে। এই বাড়িতে থেকেও আলমির অনেক কিছু জানে না। আচ্ছা, আলমির ফিরে আসার পর কেন প্রিয়তা তাকে সব খুলে বলেনি? কেন?
ইরহার কাছ থেকে ইরজা জানতে পেরেছিল প্রিয়তার মৃত্যু কী ভাবে হয়েছে।
আহ! নিষ্পাপ মেয়েটি!
,
,
,
পরদিন চমৎকার ঘটনা ঘটল। আহিল ইরজার জন্য কিছু গিফ্ট এনেছে। ইরজা বেশ খুশি হয়েছে।
“কীসের জন্য গিফ্ট?”
আহিল হেসে জবাব দিলো–
“ইরহার খেয়াল রাখার জন্য। আমাকে আমার ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।”
“ওকে। নেক্সট টাইম যেন এমন ভুল না হয়। সব ভুল ক্ষমার যোগ্য হয় না।”
আহিল নেশায় ডুবেছিল। হতাশা তাকে ঘিরে ধরেছিল। আলমিরের প্রশংসায় কোথায় যেন নিজেকে খুব নগন্য মনে হতো আহিলের। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান বলে সমস্ত সম্পত্তির সিংহভাগ আলমিরের নামে। আত্ম অহং, লোভী পুরুষটি তখন কূল কিনারা না পেয়ে অসৎ সঙ্গে পড়ে। তাকে ফিরিয়ে আনারও কেউ ছিল না। প্রশ্ন করারও নয়। ইরহা শুধু স্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। ভয়, কুণ্ঠায় কখনো প্রশ্ন করার সাহস করেনি। এক মোমের পুতুলের মতো চিরায়ত নারীদের অনুসরণ করত সে। হতাশাগ্রস্ত আহিলের পরিচয় হয় লিনার সাথে। যার সাথে নেশার জগতে প্রবেশ করে সে। সবকিছু রঙিন রঙিন। চিন্তাহীন, ভাবনাহীন। কোনো হতাশা নেই। ঘোরের বসে, নেশায় মেতে ভুলের সায়রে হাবুডুবু খেতে খেতে তীরে ভিড়ল আহিল।
আহিল পেলব হেসে সম্মতি দিলো। ইরজা কুণ্ঠিত চিত্তে প্রশ্ন ছুড়ল—
“তোমরা কোথাও যাচ্ছ?”
ইরহাও ছিল সাথে। সে ঠোঁটে খুশি ঝুলিয়ে বলল—
“ডাক্তারের কাছে।”
“ও, আচ্ছা। শোনো আপু, ডাক্তারকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে, ছেলে না মেয়ে বাবু?”
“এটা অপরাধ ইরজা।”
আহিল কপট গম্ভীর হয়ে বলল। ইরজা খেয়ালি হেসে বলল—
“ধুর! ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, আমরা সবেতেই খুশি।”
“আল্লাহ্ পাক শুধু ওকে সুস্থ রাখুক।”
ইরহা আকাঙ্ক্ষীত কণ্ঠে বলল।
“হুম। আহিল ভাইয়া, একটা কথা ছিল।”
“বলো।”
“সামনের সপ্তাহে নাকি শশী আপার অ্যানিভার্সেরি? আপাকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?”
“যেমন?”
আহিল উৎসুক। প্রশ্নাত্মক চাহনি। ইরজা খুশ মেজাজে বলল—
“আমরা সবাই হুট করে গিয়ে তাকে চমকে দেবো।”
“করা যায়। আচ্ছা, হসপিটাল থেকে ফিরে এসে প্ল্যান করব কী করা যায়। সিরিয়াল দিয়েছি। দেরি হয়ে যাবে।”
“সাবধানে যেয়ো।”
আহিলরা চলে যাওয়ার পর রুম থেকে বেরিয়ে এলেন আমেনা। তার সংক্ষুব্ধ দৃষ্টি। ইরজাকে চোখে চোখে রাখেন। ও বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনতেই কেমন ভয় হতে লাগল তার।
,
,
,
ইরজা অনেক খুঁজল। কিন্তু তার হাতে কিছুই লাগল না। প্রিয়তা ডায়েরি লেখা কেন বন্ধ করল?
হঠাৎ ইরজার চোখ গেলে ওয়াশরুমের ওপরে কাঠের বাক্সটাইপ জায়গাটায়। অপ্রয়োজনীয় জিনিস ওটার ভেতরে রাখা হয় । একবার কী ওখানে দেখব? নিজেকে প্রশ্ন করে ইরজা। সে চটজলদি স্টিলের মইটা নিয়ে আসে। মই বেয়ে উঠে দরজাটা খুলে। অন্ধকার! নেমে এসে মোবাইল ফোন নিয়ে আবার ওঠে। ফ্ল্যাশ লাইট অন করে। অগোছালো করে রাখা কিছু জিনিস। ধূলো আর মাকড়সার জাল। ইরজা আরেক ধাপ উপরে উঠল। পাতলা শরীরটা নিয়ে ভেতরেই ঢুকে পড়ল। এটা ওটা হাতিয়ে দেখতে লাগল। একটা বস্তা পেল সে। মুখ বাঁধা। বাইরে থেকে চেপেচুপে দেখে মনে হলো, বই রাখা। ইরজা মুখ বাঁকাল।
“ধুর! শুধু শুধু উঠলাম!”
হতাশাদায়ক কণ্ঠে বলে ওঠে। নামার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এক পা বাইরে দিতেই মনে হলো, বইয়ের ব্যাগটা কী একবার খুলে দেখব? ইরজা আবারও ভেতরের দিকে গেল। মোবাইলটা পাশে রেখে, বস্তার গিঁট খুলল। বইপত্রগুলো একটা একটা করে বের করল। আলমিরের বই। সবগুলো দেখতে লাগল। কিছুই নেই। আবারও হতাশ হলো ইরজা। চলে আসতে গেলে আচানাক ঠাওর হলো, একটা বইয়ের ভেতর থেকে কতগুলো কাগজ বেরিয়ে আছে। পরীক্ষার নাকি? ইরজা বই খুলল। উহু, পরীক্ষার নয়। যা সে খুঁজছিল তাই। প্রিয়তার হাতের লেখা। মাত্র কয়েকটা কাগজ। ইরজা আরও খুঁজতে লাগল। গরমে ঘেমেনেয়ে একসার! তার কপাল, গলা, বুক, পিঠের বাঁক চুইয়ে লোনা জলের ধারা নামছে। ইরজা অনেকগুলো শিট খুঁজে পেল। সবগুলো জড়ো করে নেমে এলো সেখান থেকে। বিছানার উপরে বসল। তারিখ মিলিয়ে মিলিয়ে কাগজগুলো একসাথে করল। দম ফেলল ইরজা। প্রিয়তা ভুলে তার ডায়েরি বাড়িতে ফেলে এসেছিল। তাই কাগজে লিখেছে। হায়!
একটা ডায়েরি আনারও সুযোগ মেলেনি মেয়েটার!
চলবে,,,
#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৩৩
লেখনীতে: আইশা তানভি
শশী আর অপূর্বর ম্যারেজ অ্যানিভার্সেরি। সকাল দশটার আগেই চলে এসেছে ইরহা, ইরজা। আহিল, আলমির সন্ধ্যায় আসবে। আমেনা এলেন না। কী এক গুপ্ত রাগে আজকাল গম্ভীর হয়ে আছেন তিনি। শরীফ আশরাফও ইরজাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাচ্ছেন।
ছোট্ট একতলা বাড়ি। পুরোনো ধাঁচের হলেও বেশ পরিপাটি আর সুশীতল পরিবেশ। ড্রয়িং রুমসহ চারটা রুম। শশী মা’কে ফোন করে না আসার কারণ জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পায়নি। আজ সে ভীষণ আনন্দিত। এতকাল ধরে সে ঈর্ষা, ক্রোধ, পরশ্রীকাতরতা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল, তার জাল অনেকটাই ছিন্ন করেছে ইরজার আদুরে আচরণ কিংবা তার চণ্ডীরূপ।
দুপুরে কোনো ভারী আয়োজন হয়নি। হঠাৎ করে এসেছে বলে ইরজা বলল, বিশেষ রান্না সব রাতে হবে। দুপুরে ইরহার পছন্দের বেশি ঝাল দিয়ে চ্যাপা শুটকির ভর্তা, রসুন আর ভাজা শুকনো মরিচ দিয়ে কলমি শাক ভাজি। সবার জন্য পাতলা মসুরের ডাল আর কাতলা মাছ। দুপুরের খাবার সবাই তৃপ্তি করে খেল। খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে একটা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল ইরহা। ইরজা, রিনির সাথে ছাদে এসে কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করল। বিকেলে চায়ের পর্ব শেষ করে মূল কাজ শুরু করল তারা। গরুর গোশত, মুরগির মাংস, চিংড়ি মাছ, কাবাব, চিকেন ভেজিটেবল সালাদ, দই আর মিষ্টি। শশীর শশুর সকালেই সব বাজার করে নিয়ে এসেছেন।
রান্না শেষ করতে করতে রাত হয়ে গেল। এখন সাড়ে সাতটা। ড্রয়িং রুমে প্রোগ্রাম হবে। তাই শশী আর ইরজা মিলে ডেকোরেশন করছে। রিনিও সাহায্য করছে। শশীর শশুর সন্ধ্যায় বাইরে গেছেন। ইরহার সাথে রুম বসে গল্প করছেন শশীর শাশুড়ি।
ইরজা এই সুযোগটাই খুঁজছিল। সে রিনিকে তার দাদীর কাছে পাঠিয়ে দিলো। ইরজা রঙিন ফিতাগুলো কে টে কে টে টেবিলের উপর রাখছিল। নরম কণ্ঠে বলে উঠে—
“শশী আপা, বলুনতো একজন নারী সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসে, সন্তানকে না স্বামীকে?”
শশী কিছুটা কালক্ষেপন করে বলল—
“স্বামীকে হয়তো। তবে সন্তানের প্রতি আলাদা এক টান থাকে মায়ের, যতক্ষণ না সেই সন্তান স্বাবলম্বী হয়।”
“তাহলে বাচ্চা ছোটো থাকলে, তার প্রতি মায়ের নিশ্চয়ই খুব মায়া থাকে?”
“অবশ্যই। কারণ, তখন মা’ই তার সবচেয়ে আপন, কাছের জন।”
“আর সন্তান অনাগত হলে?”
শশীর কেমন উদ্ভট লাগল এই প্রশ্ন। সে হাতের কাজ রেখে বলল—-
“এসব কেন বলছিস?”
“যখন সন্তানের প্রতি এত মায়া, তাহলে প্রিয়তার সন্তানকে তার গর্ভেই কেন মে রে ফেললেন?”
শশী আঁতকে ওঠে। মাথা ঘুরে উঠে তার। দিকভ্রষ্ট দৃষ্টি। শ্বাসের গতি বাড়ে।
“এইসব কী বলছিস? কী সব ফালতু কথা!”
“সত্য। আপনি, আপনিই প্রিয়তার বাচ্চাকে মে রে ফেলেছন। কী খাইয়ে ছিলেন ওকে? কেন ওর মিসক্যারেজ হয়েছিল?”
শশীর বুক ধড়ফড় করে। শরীর কাঁপে। ভয়ে হাত, পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে বলে—
“মিথ্যে। তুই মিথ্যে বলছিস। এমন কিছুই হয়নি। ও সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়।”
“আমি ওর সেই সন্তানের কথা বলছি যাকে আপনি ওর দেড় মাসের প্রেগন্যান্সিতে মে রে ফেলছেন। যার কথা কাউকে জানতে দেননি।”
শশী বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলতে থাকে। সে এদিক ওদিক তাকায়। ইরজার হাতটা চেপে ধরে শোবার কক্ষে নিয়ে যায়। দরজা বন্ধ করে বলে—
“তোকে এসব কথা কে বলেছে?”
“প্রিয়তা।”
এক সেকেণ্ডের জন্য নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল শশী। তার মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে। তাপ বেরোচ্ছে ঘার্মাক্ত কায়া থেকে। চাহনিতে অবিশ্বাস। সে জোর গলায় বলল—
“এসব মিথ্যে। আমি কাউকে মা রিনি। প্রিয়তা তোকে এসব কী করে বলবে? তুই ইচ্ছে করে বানিয়ে বলছিস। আমাকে ফাঁসাতে চাস? কেন? আলমিরের কাছে আমাকে দোষী বানাবি?”
“আমি মিথ্যে বলছি না আপা।”
আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়চিত্তে বলল ইরজা। শশীর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আজ এত বছর পর এই গোপন সত্য কী করে বাইরে এলো। কে বলেছে ইরজাকে? কে ওই গুপ্ত শত্রু?
“আমি বিশ্বাস করি না। প্রিয়তা তুই আসার পাঁচ বছর আগেই মা রা গেছে। আর তুই বলছিস, এসব তোকে প্রিয়তা বলেছে?”
ইরজা তেরছা হাসল। বলল—
“বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শুনুন, কেন অপূর্ব ভাইয়াকে মা দেখতে পারেন না? কেন উনাকে ওই বাড়িতে আসতে দিতেন না আপনি? কারণ, অপূর্ব ভাইয়া আপনাদের সব কীর্তি আলমিরকে ফোন করে জানিয়ে দিতো। ওই যে একবার, আপনারা বাইরে ছিলেন, তরকারিতে লবন হয়নি বলে সেই তরকারি প্রিয়তার পায়ে ছুড়ে ফেলেছিল আহিল ভাইয়া। গরম তরকারি! মেয়েটার পা জ্বলে উঠল। আপনারা কেউ ওকে একটু মলম লাগিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করেননি। পায়ের যন্ত্রণা নিয়ে মেয়েটা সারাদিন কাজ করত। অপূর্ব ভাইয়া ও বাড়িতে গিয়ে জানার পর আলমিরকে জানিয়ে দেয়। উনি ফোন করে রাগ দেখালে আপনারা ওকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে নেন, যে পায়ের ব্যথা সেরে গেছে। তার হাত থেকে গরম পানি পড়ে গেছিল।
একবার আলমির বিদেশ থেকে একটা হালকা ওজনের চেইন পাঠিয়ে ছিল প্রিয়তার জন্য। বাবা ওকে দিয়েছিল। কিন্তু একদিন প্রিয়তার গলায় দেখে সেটি আপনার পছন্দ হয়ে যায়। বেচারি প্রিয়তা কখনো আলমিরকে বলেনি যে, আপনি ওটা ওর গলা থেকে খুলে নিয়েছিলেন। ”
শশী এবার ঘাবড়ে যায়। মুখের ঘাম মুছে নেয়। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। অকস্মাৎ বলল—
“তোকে কে বলেছে এতসব? কী করে জানিস? অপূর্ব? চেইনের কথা তো ও জানে না।”
“প্রিয়তার ডায়েরি থেকে। আপনাদের সব কথা ওতে লেখা আছে। কী করেছেন আপনারা ওর সাথে। কীভাবে ওর সন্তানকে মেরে ছেন আপনি?”
আঙুল উঁচিয়ে ইঙ্গিত করল ইরজা। শশী অপ্রকৃতিস্থের মতো বলল–
“বিশ্বাস কর, আমি এমনটা করতে চাইনি। মা বলেছে, তাই।”
“কী বলেছেন উনি? কী এমন বলেছেন যে একজন মা হয়ে আরেকজন মায়ের বুক খালি করে ফেললেন?”
শশী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কী করেছে সে। আজ এত বছরেও একবারও তার এই নিয়ে কোনো অনুশোচনা হয়নি। এই একটু আগেও হয়নি। এখন হচ্ছে। এজন্যই বুঝি আল্লাহ্ তাকে শাস্তি দিলেন?রিনির হার্টে ছিদ্র। ডাক্তার বলেছে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে। তাই ঠিক করে রেখেছিল, আজ আলমির এলেই তার কাছে কিছু টাকা চাইবে। বিয়ের এত বছরে অনেকবার দ্বিতীয়বার মা হতে চেয়েও পারেনি শশী। এই শশীই একদিন বিয়ের আগের ভুল মনে করে রিনিকে এবোর্ট করতে চেয়েছিল।
শশী বিছানার উপরে বসল। স্মৃতি হাতড়ে নির্ভার, নিশ্চল গলায় বলল—
” আলমিরের নানা ধনশালী ছিলেন। এই কারণেই তাকে বাবা বিয়ে করেন। কিন্তু তার সাথে বনিবনা হয়নি। পরে আলমিরের মা অসুস্থ হয়ে মারা গেলে বাবা মা’কে বিয়ে করেন। ওই বাড়ি, কোম্পানির বেশিরভাগ আলমিরের নামে। ওর মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে। তাই মা বলল, যদি আলমিরের সন্তান হয়, তাহলে আমার রিনি কিছুই পাবে না। কারণ, আমার সাথে ওর রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। আলমির নিঃসন্তান থাকলে, সমস্ত সম্পত্তি পাবে আহিলের সন্তান। ও তো আমার আপন ভাই। ও আমার রিনিকে হক দেবেই।”
ইরজা উপহাস করে বলল—
“হায়রে রক্ত! কে বলেছে আলমিরের সাথে আপনার রক্তের সম্পর্ক নেই? আপনার মা আপনাকে বোকা বানিয়েছে। নিজেদের অবৈধ সম্পর্ক লুকাতে আপনাকে মহড়া বানিয়েছে।”
শশী নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইল। ইরজা গাঢ় স্বরে বলল—
“আলমির আপনারই রক্ত। আহিল যেমন আপনার পিতার ঔরষজাত সন্তান, ঠিক তেমনি আপনিও মি. শরীফ আশরাফের ঔরষজাত সন্তান। আপনাদের তিনজনেরই বাবা এক। শুধু মা আলাদা। ”
“এসব কী বলছিস তুই? ”
“আমি ঠিকই বলছি।”
ইরজা ডিএনএ রিপোর্টের কথা জানায়। কী ভয়াবহ ভুল করেছে সে। শশীর কান্না বাঁধা মানে না। মায়ের সন্তান বলে আহিলকে আপন ভাই মানলেও কখনো আলমিরকে আপন ভাবতে পারেনি সে। তাই তো মায়ের প্ররোচনায় প্রিয়তাকে খাবারের সাথে ঔষধ মিশিয়ে খাইয়ে ছিল।
“আপনার মা যা করেছেন, নিজের স্বার্থে করেছেন। আলমির এমন পুরুষই নয়, যে কারো হক মে রে খাবে। শুধুমাত্র এক টুকরো সম্পত্তির জন্য ওই বাচ্চাটাকে আপনারা পৃথিবীর আলো দেখতে দেননি।”
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে শশী। তার পাপের সাজা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। রিনি দরজায় আঘাত করছে। ডাকছে। শশী সতর্ক হলো। ইরজার কাছে গিয়ে অনুনয় করল। সে যেন কাউকে এসব না বলে। আলমির জানলে রিনির অপারেশনের টাকা দেবে না। ইরজা বলল—
“আপনারা অনেক অন্যায় করেছেন প্রিয়তার সাথে। জানি না মেয়েটা কী করে সহ্য করেছিল। আলমিরকে জানতেই হবে এসব। উনার প্রিয়তা উনাকে ছেড়ে যায়নি। বরং আপনারা ওকে বাঁচতে দেননি।”
শশী ইরজাকে অনুনয়, বিনয় করতে লাগল। পায়ে পড়ে গেল। ইরজা শুধু বলল—
“প্রিয়তা ন্যায় বিচার ডিজার্ভ করে। আপনারা আলমিরকে ধোঁকায় রেখেছিলেন। উনি আজও ভাবে, তার জন্যই এসব হয়েছে। কিন্তু উনি জানেন না, যে মানুষগুলোকে উনি আপন ভেবেছেন, পরিবার ভেবেছেন, বিশ্বাস করেছেন, তারা কখনো তার ছিলই না। তারা শুধু তার টাকা চেয়েছিল।”
ইরজা দরজা খুলতে যায়। তাকে থামাতে চায় শশী। ইরজা বেরিয়ে এলো। তার পেছনে কান্নারত শশী। উপস্থিত সবাই হতবাক। ইরজা গিয়ে আলমিরের হাত ধরে বলল—
“চলুন আমার সাথে। আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
আলমির বিমূঢ় দৃষ্টিতে সবাইকে দেখে বলল—
“কী হয়েছে? শশী কাঁদছে কেন?”
“পরে বলছি। আহিল ভাইয়া, আপনি আপুকে নিয়ে আসুন।”
ইরজা দাঁড়ায় না। আহিল হতভম্ব, হতবাক। সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—
“কী হয়েছে রে আপা?”
শশী কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলল—
“আমার পাপ আমার সব কেড়ে নেবে, সব। ”
রিনি মায়ের কাছে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরল। অপূর্ব ভাবছে হয়তো রিনির অসুস্থতার জন্য কাঁদছে। তবে পাপ?
চলবে,,,