#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৪
লেখনীতে:আইশা তানভি
আলমিরের ছন্দের সুর ইরজাকে শান্ত করতে পারল না। অভিমান, ক্ষোভ আর রোষের সংমিশ্রণে থম মে রে রইল সে। আলমির হালকা গলায় বলল—
“বুড়ো জামাই নিয়ে তোমার খুব রাগ তাই না?”
দীপ্ত চোখে সরোষে তাকাল ইরজা। ইরজার রাগের পারদ বাড়াতেই ফিক করে হেসে ফেলল আলমির।
“আপনার কী লজ্জা শরম নেই?”
“কোন বিষয়ে?”
ইরজা দাঁড়াল। তার অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠল কাঠিন্যতা। আক্রোশ ভরা দৃষ্টি। তবে জবাব দিলো না সে। আলমির ফের জিজ্ঞেস করল—
“বললে না কোন বিষয়ে?”
“ইচ্ছে হচ্ছে না। যান এখান থেকে।”
“কোথায় যাবো?”
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল ইরজা। আলমির খুব তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল। ফিচেল গলায় বলল—
“বাকি ঝগড়া কাল। ঘুমাও এখন। লাইটটা অফ করো তো।”
ফোঁস করে উঠল ইরজা। চোখ-মুখ খিঁচে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
“আপনি এখানে ঘুমালে আমি কোথায় ঘুমাব?”
“এখানে।”
আলমির তার পাশের খালি জায়গাটুকু দেখিয়ে বলল। ইরজার যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই লোকটা তাকে পাশের শোবার জন্য আহ্বান করছে! আলমির ইরজার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে উঠে বসল। আসন দিয়ে বসে বলল—
“দেখো ইরজা, নিজেকে যতই কচি আর ছোটো বলে সবাইকে বিশ্বাস করাতে চাও, তুমি আসলে ততটাও ছোটো না। একুশের অর্ধেক শেষ করে ফেলেছ অলরেডি। আর ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমার বয়স বত্রিশ না চৌত্রিশ। যদিও অনেকেই সেটা জানে না।”
আলমির থামল। তবে একটা পৈচাশিক, আনন্দ সুখ তাকে খুব করে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ইরজার যেন মাথায় হাত! এই লোক বলে কী? চৌত্রিশ! আরও দুই বছর বেশি! ইরজারে..তোর সোনার যৌবন গেল জলে ভেসে!
আলমির আরও বলতে লাগল—
“পুরুষ মানুষের বয়সের পাশে চল্লিশ বছর পর্যন্ত যুবক লেখা থাকে। তাই বলা চলে, আমার যুবা বয়স আরও ছয় বছর পাবে। সো এসব বুইড়া বুইড়া বলা বাদ দাও। আর বয়স তোমার চেয়ে বেশি হলেও, তোমার পাশে আমাকে আহিলের চেয়ে ছোটো মনে হয়। এটা কিন্তু তোমাকে মানতেই হবে।”
ইরজা ক্যাটক্যাটে স্বরে বলে উঠে—
“শখ দেখে আর বাঁচি না। খাইশটা বুইড়া! বলে কী না আহিল ভাইয়ের চেয়ে ছোটো মনে হয় ওনাকে।!”
আলমির পায়ের ভাঁজ খুলল। দু হাতের ভর বিছানায় ঠেকিয়ে দেহ হেলিয়ে বসে বলল—
“তোমার মুখে বুইড়া শুনতে খারাপ লাগে না আমার। তবে বাইরের মানুষের সামনে আমাকে বুইড়া বললে আমার সম্মান যতটুকু ক্ষুণ্ণ হবে তারচেয়ে বেশি তোমার….।”
“আমার কী?”
খ্যাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল ইরজা। আলমির স্মিত হেসে বলল—
“ওই যে মুশতাক – তিশাকে কী যেন বলে না…. ওই যে সেদিন কে যেন বলল তিশা কনসিভ করেছে, সেটা শুনে কে যেন বলল….।”
“কী বলল?”
আলমির কপট রাগ ছুড়ে বলল—
“তুমি তো এমন ভাব নিচ্ছ যে তুমি কিছুই জানো না। দেখো, এত নাটক করে লাভ নেই। এখন যদি আমি সব খুলেই বলি, তখন আমাকেই দোষ দেবে। বলবে, বুইড়ার রস কমে না। তোমার ভাষায় আরকি!”
শেষের লাইনকুটু শুনে অকস্মাৎ গা দুলিয়ে সশব্দে হেসে উঠল ইরজা। রূমঝুম সেই হাসির শব্দে চিত্ত জুড়ে এক প্রশান্তির হিমেল হাওয়া বয়ে গেল আলমিরের। সে মন্ত্রমুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল কলহাস্যে বিভোর অঙ্গনার পানে। কয়েক মুহুর্ত যেতেই সংবিৎ ফিরে পেল ইরজা। চট করে হাসি থামিয়ে ফেলল। গম্ভীর করে ফেলল মুখখানি। ঠ্যাটানো স্বরে বলল—
“একদম আমার সাথে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমি এত সহজে আপনাকে ক্ষমা করছি না।”
“ক্ষমার প্রশ্ন কেন আসছে?”
“আসবে না? আপনি একটা কূটনা। আমার সহজ সরল বোনটাকে নিজের ভালো মানুষি দেখিয়ে পটিয়েছেন। পরে আমার ওই বোকাসোকা বোনটা মা আর বাবাকে কী না কী বলেছে, ওমনি একটা দামড়া ব্যাটার সাথে আমার বিয়ে দিতে রাজী হয়ে গেল!”
“কূটনা কী?”
“যার মাথায় আপনার মতো কূট বুদ্ধি থাকে। চৌত্রিশ বছরের বুইড়া হয়ে একুশ বছরের কচি মেয়ে বিয়ে করতে চায়।”
“ধুর! কী তখন থেকে কচি কচি লাগিয়ে রেখেছ! তুমি কী ভেবেছ আমি কিচ্ছু জানি না? কয়েক মাস আগে যে দুই বাচ্চার বাবার জন্য তোমার সম্বন্ধ এসেছিল, সেটা কী আমি জানি না? শোকর করো আমি এখনো সিঙ্গেল।”
“ওরে আমার সিঙ্গেল! বউ মরে ভূত আবার সিঙ্গেল দাবি করে নিজেকে।”
মুখ ভ্যাঙচায় ইরজা। আলমির কেমন চুপ হয়ে যায়। সহসা প্রিয়তার স্মৃতি তাকে নাড়া দেয়। সে গাঢ় স্বরে বলল–
“আজ আমাদের বাসর রাত। এই রাত কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা নিশ্চয়ই জানো? আমি কিন্তু তোমার কথা ভেবেই চুপ আছি। বিয়েটা যেহেতু তুমি মন থেকে মানতে পারোনি, তাই আমি তোমাকে এই সম্পর্কে বাঁধতে জোর করব না। তবে ছেড়েও দেবো সেটাও ভেবো না। সময় নাও। বুঝবে এই বিয়েটা কতটা জরুরি ছিল। গুডনাইট! লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। বিশ্বাস করতে পারো। মানুষ হিসেবে আমি ততটাও খারাপ নই।”
আলমির মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল। ইরজা দাঁড়িয়ে রইল। তার ঝগড়ার মুড এখনো যায়নি। সে ভাবতে লাগল। কী করবে সে? সে কী ওই লোকটার পাশে সত্যিই শুয়ে পড়বে? যদি কিছু করে বসে? পরমুহুর্তেই দেখল, একটা ফুলদানি রাখা বেড সাইড টেবিলের ওপর। ঠাওর করে রাখল। যদি খারাপ কিছু ঘটে, তাহলে এই ফুলদানি সোজা গিয়ে ভাঙবে ওই বুইড়ার মাথায়। একদম তালু ফাটিয়ে ফেলবে! এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে গুটি গুটি পায়ে গিয়ে লাইট অফ করল ইরজা। বিছানার কাছে এসে দ্বিধাগ্রস্ত মনে ধীরগতিতে বিছানায় বসল। আলমিরের উপস্থিতি সর্প দংশনের মতো লাগছে। তবুও বুকে অনেকটা সাহস নিয়ে শুয়ে পড়ল ইরজা। ধীরে শ্বাস পড়তে লাগল। কেমন অদ্ভুত অনুভূতিতে বুকটা ভার হয়ে উঠল মেয়েটির!
,
,
,
একটা দীর্ঘ গভীর ঘুম! হঠাৎই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল ইরজা। চোখটা এখনো ঘুমের দখলে। তার শাড়ির অবস্থা বেহাল। ইরজা চড়ুই পাখির মতো এদিক ওদিক তাকাল। আলমিরকে না দেখে বদ্ধ শ্বাসটা ফেলল। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে বসল। সাজানো রুমটা দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো গলা চিরে। আফসোসের শ্বাস ফেলল। ঠিক তৎক্ষণাৎ ইরজার কর্ণগোচর হলো সেই কণ্ঠ, যেই কণ্ঠে তার এত সুন্দর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আমেনা আশরাফ চেঁচাচ্ছেন। ইরজার চোখ গেল দেওয়াল গড়িতে। বেলা এগারোটা! চোখ বড়ো হয়ে যায় আপনাতেই। ঢোক গিলে ফেলল। এত দেরি হলো কী করে? এত ঘুম?
লম্বা শাওয়ার শেষে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো ইরজা। তার পরনে জলপাই রঙা সুতি শাড়ি। বেগুনি পাড়ের পাশে সরু জরির লাইন। কালো ভেজা চুল মুছতে মুছতে আরশির সম্মুখে এসে দাঁড়াল সে। আচম্বিতে তার চোখ গেল ড্রেসিং টেবিলের ওপরে থাকা একটি সাদা কাগজের টুকরোতে। তোয়ালেটা কাঁধে রেখে কাগজের টুকরোটি হাতে নিলো। চটপট খুলে ফেলল। গোটা গোটা হাতে লেখা,
“কথামালা,
রাগের পারদ শীতল রেখো।”
ঠোঁট জোড়া এপাশ ওপাশ করল। অস্ফুট স্বরে আওড়াল—
“ঢঙ!”
,
,
,
“কী বেয়াদব মেয়েরে বাবা! বলি কোন বাড়ির বউ এত সকাল পর্যন্ত ঘুমায়? বাড়ির পুরুষরা সব কাজে বেরিয়ে গেছে, আর মহারানির এখনো ঘুম ভাঙেনি! বলি, তার বাপ কয়টা চাকরানি পাঠিয়েছে তার সাথে? কাজকর্ম কী নেই? ”
ভয়ে কাঁপছে ইরহা। গলা শুকিয়ে এসেছে। কখন না জানি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে! আমেনা ইরহাকে দেখতে পেয়েই পূনরায় খেঁকিয়ে উঠে বললেন—
“তোমার বোন কোথাকার নবাবজাদী? এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে! আমাদের কী বিয়ে শাদী হয়নি, আমরা কী শ্বশুরবাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসিনি! ”
ইরহা কোনো কথা বলল না। ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আমেনা শাসিয়ে বললেন—
“কাল থেকে যদি ও সকাল সকাল না ওঠে, তাহলে এই বাড়িতে ওর ঠাঁই হবে না বলে দিলাম। শুধু তোমার বোন বলে ওকে আজ কিছু বললাম না। বলে দিয়ো ওই অসভ্য মেয়েকে।”
“জি আম্মা।”
ঘাড় নাড়াল ইরহা। আমেনা নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। মিনিট দেড়েক বাদে সেখানে এসে দাঁড়াল ইরজা। উৎসুক গলায় জানতে চাইল—
“তোমার শাশুড়ি এভাবে চিল্লাচিল্লি করছিল কেন?”
“কেন আবার…তুই এত দেরিতে উঠলি কেন?”
“তাতে কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে মানে? এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়?”
“সেটা বাদ দাও। আগে বলো, তোমার ওই ভাসুরের সত্যিকারের বয়স কত?”
“তুই এখনো বয়স নিয়ে পড়ে আছিস? তোর মাথায় কী আর কিচ্ছু আসে না?”
“আসবে কেন? কেন আসবে? শোনো আপু এজ গ্যাপ খুব জটিল একটা বিষয়। আমার বান্ধবী অপর্ণার বরের বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ। বিয়ের এক বছরের মাথায় ডিভোর্স। বুঝছ?”
ইরহার বিরক্তি এলো। তার বোনটা এমন কেন? ইরজা ফের বলল—
“তোমার ভাসুরের বয়স চৌত্রিশ বছর। আর তুমি বলেছ বত্রিশ। কী সাংঘাতিক ধোঁকা!”
ইরজা মুচকি হেসে বলল—
“তোকে কে বলেছ?”
“কে আবার, বুইড়াটা নিজেই বলেছে।”
ইরহা হাসি থামিয়ে বলল—
“মজা করেছে ভাইয়া।”
“যদি সত্যি হয়?”
“আরে না। গতবছরই তো তার একত্রিশ তম জন্মদিন গেল। আমি তোকে বলেছিলাম না, ভাইয়া তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমাদের সবার জন্য গিফ্ট পাঠিয়েছিল।”
“ও হ্যাঁ। কী মিথ্যুক রে বাবা!”
“তোকে খেঁপাতে বলছে হয়তো।”
“অসহ্য লোক!”
চলবে,,,