প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-০৭

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৭
লেখনীতে:আইশা তানভি

দুই মগ কফি ট্রেতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো ইরজা। সোলায়মান রান্নাঘরের খুঁটিনাটি কাজ করছে। বাড়িময় শীতল একটা পরিবেশ। ইরজা যখন ইরহার রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, থমকে গেল সে। দুপুরের পর থেকে বোনকে আর দেখেনি। রুম থেকেই বের হয়নি ইরহা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইরজা। বোনটা তার সুখে নেই।

রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আলমির। এক পা রেলিং এর ফাঁকে ঢোকানো। ট্রে হাতে এসে দাঁড়াল ইরজা। আলমির তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে নমনীয় চোখে তাকাল। ইরজা মৃদু হেসে বলল–

“কফি?”

“তুমি বানিয়েছ?”

“উহু, আমার ভূতে।”

“ভূতের হাতের কফি কোনোদিন খাইনি।”

“আজ খেয়ে দেখুন।”

আলমির পুরোপুরি ফিরে তাকাল। রেলিং এর সাথে পিঠ ঠেকাল। ইরজা কফি এগিয়ে দিলো। এক চুমুক বসাতেই একটা তৃপ্তিকর অনুভূতিতে জুড়িয়ে গেল আলমিরের মন। সে হাস্যোজ্জ্বল গলায় প্রশংসা করে বলল—

“চমৎকার হয়েছে।”

“থ্যাংকস।”

ইরজার নীরবতাকে ইঙ্গিত করে বলল—

“কোনো কারণে মন খারাপ? মায়ের বিষয়টা নিয়ে? নাকি বুড়ো বর নিয়ে এখনো চিন্তিত?”

মলিন মুখে জোরপূর্বক হাসল ইরজা। বলল—

“আনটি কী আগে থেকেই এমন? ”

“কেমন?”

“এই যে কিছু হলেই রেগে যান।”

“বরাবরই।”

“আপুর সাথেও কী সবসময় এমন করে?”

“আমার চোখের সামনে তো কখনো পড়েনি।”

“আহিল ভাই…. আহিল ভাই কী আপুর গায়ে হাত তুলতে পারে?”

কফির মগ থেকে ঠোঁট সরিয়ে ফেলল আলমির। ঝোঁক গলায় বলল—

“এই প্রশ্ন কেন করছ? কিছু হয়েছে?”

আহিলের গায়ে হাত তোলার বিষয়টা চেপে গেল ইরজা। এখন আর সে কোনো ঝামেলা পাকাতে চায় না। নিজের অহং, অবুঝ রাগ আর ছেলেমানুষির দরুন ইতিমধ্যেই সে অসংখ্য ভুল করে ফেলেছে। এবার নিজেকে গুছাতে চায়। আচানক এক স্বার্থনেষী চিন্তা উদয় হলো তার মস্তিষ্কে। রয়ে সয়ে কিছুটা সময় নিয়ে সে বলল—

“একটা কথা বলব আপনাকে?”

“বলো।”

“আমি ভার্সিটিতে যেতে পারব?”

“পারবে না কেন?”

“কেউ কিছু বলবে না তো?”

“আমার বউকে কে কী বলবে?”

‘আমার বউ’… শব্দটায় আলমিরের কোনো সংকোচ না থাকলেও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল ইরজা। চোখ জোড়াতে লাজুকতা ভর করল। লাজ রাঙা হাসিতে ঠোঁট রাঙাল। আলমির তৎক্ষণাৎ বলে উঠে—

“কাল তোমার বাবা-মা আসবেন। ”

ভ্রূ উঁচিয়ে শঙ্কিত দৃষ্টি ছুড়ল ইরজা। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আলমির বলল—

“কাল কোনো ঝামেলা কোরো না। কালকের জন্য রাগকে বলো এসির হাওয়া খেতে।”

কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠে ইরজা—

“আমি শুধু রাগই করি তাই না?”

“ঝগড়াতেও কিন্তু দারুন এক্সপার্ট তুমি।”

“আপনার মাথা।”

“তোমার মুন্ড।”

“বুইড়া খা টাশ!”

“ইশ! এইটা শোনার জন্যই মন আকুপাকু করছিল। অবশেষে শান্তি পেলাম।”

“আপনি আসলেই একটা অসহ্য।”

ট্রে আর কফির মগ নিয়ে রুমে ঢুকে পড়ল ইরজা। মেজাজ পুরোই “হট কফি”। আলমির গা দুলিয়ে হাসল। নিশ্চিন্তে, খুব আরামদায়ক ভঙ্গিতে কফি পান করতে লাগল। বেড সাইড টেবিলের ওপর ট্রে আর কফির মগ রেখে ধুম করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।
,
,
,
ভোরের মিষ্টি বার্তা নিয়ে দিনের রোশনাই জেগে উঠেছে। প্রকৃতিতে এখনও বিরাজ করছে শান্ত, শীতলতা। নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করে মহান আল্লাহ্ পাকের কাছে নিজের স্বামীর জন্য দোআ করল ইরহা। স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে যেন বাকি জীবন কাটাতে পারে সেই প্রার্থনা করল। সন্তান… একটা সন্তান খুব করে চাইছে ইরহা। তাদের বিয়ের বছর পেরিয়েছে সে কবেই। এখনো সন্তানের মুখ দেখতে পেল না মেয়েটি। তাই তো রোজ নামাজ শেষে আল্লাহ্ পাকের কাছে সন্তান ভিক্ষা চায় সে। যেন মহান আল্লাহর একটু রহমত নাজিল হয়।

আহিল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মুখখানি কী নিষ্পাপ! ইরহা সশব্দে শ্বাস ফেলে। স্বামীকে অপরিমেয় শ্রদ্ধা, সম্মান করে সে। ভালোবাসায়ও কমতি নেই। আহিল যে তাকে ভালোবাসে না তেমনটা নয়। শুধু মাথাটা একটু গরম। মেজাজ খারাপ হলে কী করে কিচ্ছু মাথায় থাকে না। এই তো রাতভোর তাকে জড়িয়ে ধরেছিল পরম আদরে! ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছিল। তবে মাঝে মাঝে কী যেন হয়ে যায়!

রুম থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে যায় ইরহা। তাকে দেখে রান্নাঘর ছাড়ে সোলায়মান। ভীষণরকম বাধ্য আর ভদ্র ছেলে সোলায়মান। অতিরিক্ত উঁকিঝুঁকি, কথা বলা কিংবা কোনো অসভ্য আচরণ আজ পর্যন্ত করেনি সে। নিয়মানুযায়ী নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।

ফ্রিজ থেকে একবাটি খাসির মাংস বের করে পানিতে ভেজালো ইরহা। ঝাল ঝাল খাসির মাংস ভুনা আর রুটি বানাবে আজ। দুপুরে কী রান্না করবে তা ভাবতে লাগল।

মাংস রান্না শেষ করে রুটির জন্য ডো তৈরি করে রাখল ইরহা। সোলায়মান বাইরে কী যেন করছে। তাকে ডিঙিয়ে এলো ইরজা।

“আপু!”

চকিতে তাকাল ইরহা। বোনকে দেখে পূনরায় কাজে মন দিলো। ইরজা দ্রুত কাছে এসে দাঁড়াল। আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—

“তুমি আমার ওপর রাগ করেছ আপু?”

ইরহা জবাব দিলো না। সে রুটির একটা ডো নিয়ে পিঁড়িতে রাখল। খপ করে তার হাত চেপে ধরল ইরজা। ইরহা গমগমে চোখে তাকাল।

“হাত ছাড়, আমার।”

“তুমি আমার সাথে কথা বলছ না কেন?”

“তোর সাথে কোনো কথা নেই আমার। যে মানুষ আমার স্বামীকে অপমান করে তার সাথে আমার কথা নেই।”

ইরহার গালের সেই দাগ এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। চমকে প্রশ্ন করল ইরজা—

“আহিল ভাইয়া তোমাকে মেরেছে?”

হাত সরাল ইরহা। তেজ ঢেলে বলল—

“আমার স্বামী আমাকে মারু ক, কাটু ক যা ইচ্ছে করুক, তাতে তোর কী? তুই কে বলার?”

“তুমি এমন করে কথা বলছ কেন?”

“আমার সুখের ঘরে আ গুন লাগাতে এসেছিস তাই না?”

“কী বলছ এসব?”

“আমারই ভুল হয়েছে। তুই তো ছোটোবেলা থেকেই এমন। যখন যা ইচ্ছে তাই করিস। খাল কেটে কুমির এনেছি আমি। তোর জন্য আমাকে অপমানিত হতে হয়। তুই আমার সুখ নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছিস!”

নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না ইরজা। তার বোন এসব কী বলছে?

ইরহার চোখে ঢল নেমেছে। সে হাতের উলটো পাশ দিয়ে জল মুছে নিলো। বলল—

“আজকের পর আমার কোনো বিষয়ে তুই নাক গলাবি না। তোর যদি এখানে ভালো না লাগে তুই চলে যা।”

“কোথায় যাব আমি?”

“যেখানে তোর খুশি। আমার ঘর নষ্ট করিস না দয়া করে।”

“কী স্বার্থপর তুমি আপু? নিজের কথাই ভাবলে, আমার কথা ভাবলে না? একটা ভুল করে ফেলেছিলাম বলে, সেই ভুলের দোহাই দিয়ে জোর করে নিজের ভাসুরের সাথে বিয়ে করিয়ে এই বাড়িতে আনলে। আর একদিনেই শ্বশুরবাড়ির এই স্বার্থন্বেষী মানুষদের জন্য নিজের আপন বোনকে পর করে দিলে?”

“কে বলেছে তুই আমার আপন বোন? আপন হলে এমন করতে পারতি তুই?”

ইরজা জবাব খুঁজে পেল না। কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে আসছে তার। সে কখনো ইরহাকে আপন বোন ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি। কিন্তু আজ একটা ছোট্ট ঘটনায় যে সত্যকে ইরজা সবসময় চোখের আড়াল করতে চেয়েছে, সেই সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ইরহা।

ইরহার ফুফাতো বোন ইরজা। ইরজার জন্মের পরপর ইন্টার্নাল ব্লিডিং বেশি হওয়ার দরুন তার মা মারা যান। ইরহার বয়স তখন আড়াই কী তিন। ইরজার বাবার পরিবার এত ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে তখন বিপাকে পড়লেন। সেই অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দিলেন মীর হাসনাত। বোনের মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। সেখানেই বড়ো হতে লাগল ইরজা। পাড়া পড়শীর গবেষণা থেকে একসময় এই সত্য কর্ণগোচর হয় ইরজার। তবে সেসবের তোয়াক্কা করল না সে। মামা মামী তাকে নিজ মেয়ের মতো বড়ো করেছেন। মামী উর্মিলা অমায়িক মানুষ। ইরজার এই দুষ্টুমি ভরা স্বভাবের একমাত্র হোতা তিনি। মায়ের কাছেই তার ছিল শত আবদার।

ইরজার চোখ জুড়ে নেমে ঘন বর্ষা। সে আর দাঁড়াতে পারল না। হু হু করে কেঁদে উঠল। ছুটে পালাল এখান থেকে। বোন যেতেই নিজের গালে চড় বসাল ইরহা। এসব সে কী বলে ফেলল?
,
,
,
আলমির উপুর হয়ে শুয়ে আছে। রুমে ঢুকেই বিছানায় গিয়ে বসল ইরজা। এত জোরে বসল যে, আলমির কেঁপে উঠল। ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। মাথাটা বালিশ থেকে উঠিয়ে ঘাড় ঘোরাল। ঘুম জড়ানো চোখে নিভু নিভু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—

“এত জোরে বসলে কেন তুমি, আরেকটু হলে তো আমি পড়ে যেতাম।”

“যেখানে খুশি যান। আমাকে আমার বাড়িতে দিয়ে আসুন।”

ঘুমে আচ্ছন্ন আঁখিদ্বয় জোর করে মেলে ধরে উঠে বসল আলমির। প্রশ্ন করল–

“কী হয়েছে তোমার?”

মেয়েটা কাঁদছে। পেছন থেকেই তা বোঝা যাচ্ছে। কান্নার শব্দরা বাইরে আসছে না।

“কী হলো, কাঁদছ কেন?”

কাঁদতেই থাকল ইরজা। আলমিরের ঘুম এখনো পুরোপুরি যায়নি। সে বলল—

“কথামালা,
কান্নার জলেরা তোমার দুঃখ ছুঁয়ে যাক।”

চলবে,,,