প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-০৮

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৮
লেখনীতে:আইশা তানভি

লাইট লেমন কালারের শার্টের সাথে অফ হোয়াইট কালারের স্যুট পরেছে আলমির। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে। বিছানায় মন খারাপ করে বসে আছে ইরজা। বিষণ্ণতার করুন আর্তনাদ হৃদ গহীনে। আলমির সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল—

“নাশতা করবে না?”

“না।”

খুবই কর্কশ স্বরে প্রত্যুক্তি করে ইরজা। হতাশ শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় আলমির।

নাশতার টেবিলে থমথমে ভাব। আলমির বসতেই আমেনা খরখরে স্বরে বললেন—

“তোর বউয়ের ঘুম ভাঙেনি এখনো?”

আলমির শান্ত স্বরেই জবাব দিলো—

“হ্যাঁ।”

“এই ঘরের সব কাজকর্ম কী একা ছোটো বউমাই করবে, ও বসে বসে খাবে?”

আলমির তার মায়ের দিকে তাকাল না। ইরহার দিকে তাকাল। বড়ো ভাইয়ের মতো ভাসুরের চাহনি তার ওপর পড়তেই মাথা নত করে ফেলল ইরহা। মাথায় ঘোমটা টানা। সংকীর্ণ কণ্ঠে বলল—

“ইরজা ছিল আমার সাথে। ও বলল, ওর মাথা ব্যথা করছে। তাই আমি চলে যেতে বলেছি। ততক্ষণে আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে।”

খাবার মুখে দিলো আলমির। নত দৃষ্টি রেখেই বলল—

“আজ তোমার বাবা- মা আসবে।”

“কেন আসবে?”

প্রশ্নটা কঠিন স্বরেই ছুড়লেন আমেনা। তার অভিব্যক্তিতে একরাশ বিরক্তি ফুটে উঠল। আলমির বলল—

“কেন আবার, ওদের দুই বোনকে দেখতে আসবে।”

শরীফ আশরাফ কোনো এক কারণে আমেনা আশরাফকে চূড়ান্ত পর্যায়ের ভয় পান। তাই যখন আমেনা কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি খুব হিসেব করে কথা বলেন। আমেনা বললেন—

“আসার কী দরকার… আপদ তো বিদাই করে বেঁচেছেন।”

মুখ বাঁকালেন তিনি। আলমির কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। শুধু ইরহার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় বলল—

“ইরজাকে বলো তোমাকে হেল্প করতে। কিছু লাগলে সোলায়মানকে বলো এনে দেবে।”

ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলো ইরহা। ক্রোধে ফুলে উঠছে আহিল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ হজম করছে। আলমির ফের তাকাল ইরহার দিকে। অনুনয়ের স্বরে বলল—

“ইরজা হয়তো কিছু খায়নি। ওকে একটু কষ্ট করে খাবারটা দিয়ে আসবে?”

“আমার বউ কারো চাকর নয়।”

আলমিরের অনুরোধে ইরহা খুব তাড়ায় বাটিতে মাংস তুলতে গিয়েও আহিলের কড়া কণ্ঠে থেমে যায়। ভয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
আলমির অধর কোণে হাসে। বাটিতে মাংস তুলে নিলো। অন্য বাটিতে তিনটা রুটি তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বলতে থাকে—

“কোনো একসময় এই বাড়ির সমস্ত কাজ প্রিয়তা একা করত। তখন ওকে কেউ চাকর বলার ভুল করেনি। যদি করত, তাহলে আজ প্রিয়তা আমাদের ছেড়ে যেত না।”

আলমির খাবার নিয়ে নিজের রুমে দিকে হাঁটা ধরল। আমেনা আক্রোশ ভরা ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ল শরীফের দিকে। শরীফ দৃষ্টি লুকিয়ে ফেলল। আহিল কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল—

“তুমি খেয়েছ?”

“না।”

“খেয়ে নাও।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় আহিল। আমেনা বিরাগপূর্ণ দৃষ্টিতে উঠে গেলেন। শরীফ আশরাফ পূর্বে করা ভুলের স্মৃতির অতলে হারালেন।
,
,
,
খাবার নিয়ে রুমে ঢুকল আলমির। বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখল।

“খেয়ে নাও।”

“ইচ্ছে করছে না।”

“না খেয়ে থাকলে আবার ঝগড়া করতে ইচ্ছে হবে তোমার।”

আলমিরের দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে চাইল ইরজা। যেন এখনই চিবিয়ে খাবে! আলমির হেসে ফেলে। ইরজা বলল—

“আপু খেয়েছে?”

“হয়তো না।”

“খাবে কী করে? আপনাদের বাড়িতে তো পুরুষদের আগে নারীদের খেতে নেই। কী জঘন্য নিয়ম!”

আলমির জবাব দেয় না। কিছু প্রশ্নের জবাব হয় না। সমাজ সিদ্ধ কিছু অহেতুক নিয়মের বেড়াজালে আজও নারীকূল বন্দি। তাদের উত্তরণের পথ জটিল।

আলমির ধীরপায়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেল। কাবার্ডের দরজা খুলে কিছু গয়নার বাক্স বের করল। সেগুলো বিছানার ওপর রাখল ভাঁজে ভাঁজে। ইরজা বিছানা থেকে উঠে এসে এদিকটায় দাঁড়াল। আলমিরের কর্মকাণ্ড বোধগম্য হচ্ছে না তার। কিছু শাড়ি আর ড্রেসও আছে কাবার্ডের হ্যাঙ্গারে ঝোলানো। আলমির বলল—

“এখানে কিছু গহনা আছে। এগুলো প্রিয়তার। বিয়ের সময় দশ ভরি দিয়েছিল বাবা। আর বাকি পাঁচ ভরি বিয়ের পর আমি কিনে দিয়েছিলাম। আর এখানে ওর কিছু শাড়ি আর জামা আছে। তোমার যেটা ইচ্ছে পরে নিয়ো।”

ইরজা বিস্মাবিষ্ট কণ্ঠে বলল—

“এগুলো তো আপনার বউয়ের, আমাকে কেন দিচ্ছেন?”

আলমির আলতো হেসে বলল—

“তুমিও তো আমার বউ। এই চাবিটা রাখো। আজ থেকে এসব তোমার। ”

আলমির চাবিটা ইরজার হাতে দিয়ে পা বাড়াল যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সহসা নীরবতা ভেঙে বলে উঠে ইরজা—

“এগুলো পরলে আপনি খুশি হবেন?”

আলমির থমকালো। ঈষৎ বাঁকা হয়ে তাকাল। বলল—

“উহু। যদি তুমি খুশি হয়ে পরো তাহলে আমি খুশি হবো। আসি, দেরি হচ্ছে আমার।”

“আপনি দুপুরে আসবেন না?”

আলমির এক কদম বাড়িয়ে আবার থামল। বলল—

“চেষ্টা করব।”

“তাহলে এসব কার জন্য পরব আমি?”

আলমির জবাব দিলো না। শুধু এক চিলতে মোহনীয় হাসির ঝলক খেলে গেল তার ঠোঁটের ভাঁজে। দরজার কাছে গিয়ে আবার পেছন ফিরল পুরুষটি। একপাশে হেঁলে দাঁড়িয়ে হাসিখুশি মুখে বলল—

“কথামালা,
রাগ নয়, ভালোবাসার ছন্দ হোক তোমার জীবন।”

ইরজা গাঢ় চোখে তাকিয়ে রইল। পুরুষটি হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠে উপদেশের মতো বলল–

“যদি কোনো প্রিয় মানুষ তোমার ওপর রাগ করে, তাহলে তার কাছে গিয়ে তাকে একটা টাইট হাগ দিয়ে ‘সরি’ বলে ফেলবে। দেখবে, তার রাগের পারদ আপনাতেই নেমে গেছে। সেই মানুষটি যদি সত্যিই কখনো তোমাকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে তোমার ওপর রাগ করে থাকতে পারবে না।”

“আপনি সত্যি বলছেন?”

‘ট্রাই করে দেখো। বাই।”

একটা হৃদয়ভেজা হাসি উপহার দিয়ে বিদায় নিলো আলমির। তার উপদেশটা মনে ধরল ইরজার। বিছানার ওপর থাকা গহনাগুলো ছুঁয়ে দেখার তীব্র অভিলাষ তাকে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। ইরজা হাতে নিলো একটা বাক্স। খুব আগ্রহের সাথে খুলল। তার চোখ চকচক করে উঠল।

“কী সুন্দর!”

স্বগতোক্তি করল ইরজা। সে চটজলদি বাকিগুলোও খুলে খুলে দেখতে লাগল। সবগুলো গহনা ভীষণ পছন্দ হলো তার। ইরজা কোনটা পরবে সেটা আলাদা করে রাখল। কাবার্ডে থাকা কয়েকটা শাড়ি বের করল। এর মধ্য থেকে সবুজ রঙের কাতান শাড়িটি নজর কাড়ল ইরজার। সে সিদ্ধান্ত নিলো এই শাড়িটিই সে পরবে। কিন্তু যার জন্য পরবে, সে আসবে তো?
,
,
,
“আপু!”

রান্নাঘরে ব্যস্ত ইরহা বোনের ডাকে ফিরে তাকাল। তাকে কোনো সময় না দিয়েই ঝপ করে জড়িয়ে ধরল ইরজা। মায়াভরা কণ্ঠে বলল—

“সরি আপু। ”

“আই এম অলসো সরি। রাগের মাথায় তোকে পঁচা পঁচা কথা বলে ফেলছি।”

“ইটস ওকে।”

বোনের বুক থেকে সরে একগাল হাসল ইরজা। খুশ মেজাজে বলল—

“খেয়েছ তুমি?”

“উহু।”

“চলো, একসাথে খাই। জানো, আম্মু- আব্বু আসবে?”

“ভাইয়া বলেছে।”

“কী রান্না করবে?”

“কী রান্না করব বলতো?”

“তোমার শ্বাশুড়ি আবার কিছু বলবে না তো?”

“আরে না।”

“তাহলে শোনো, আম্মু নারকেল বাটা দিয়ে কচু খুব পছন্দ করে। আর আব্বু দেশি মুরগি আলু দিয়ে। সাথে চিংড়ি মাছ ভুনা, গরুর গোশত, মাছের কোফতা। ডিম ওয়ালা টেংরা আছে? আব্বুর পছন্দ। কৈ মাছ ভাজা, হাঁসের মাংস। টক দই আছে? লাচ্ছি বানাব। আপু, ওই যে তুমি যে বানাও ওই চাইনিজ সবজিটা..ওটা বানিয়ো তোমার স্টাইলে। আমার খেতে খুব ইচ্ছে করছে। আর আর আর…।”

“থাম, থাম। এতকিছু কখন করবি?”

“করব, করব। তুমি আছো না?”

পলকেই আবারও বোনকে ঝাপটে ধরল ইরজা। অতলান্ত মমতায়। প্রগাঢ় ভালোবাসায়।

চলবে,,,