#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৯
লেখনীতে:আইশা তানভি
আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে ইরজা। ভেজা চুল দু’পাশ থেকে মুখের আধেকটা ঢেকে রেখেছে। টপটপ করে চিকুরের শীর্ষ বেয়ে জল পড়ছে। কিছুক্ষণ সেভাবে নিজেকে প্রত্যক্ষ করল মেয়েটি। তারপর পুরো চুল একপাশে এনে একটু নুইয়ে জোরালো ঘর্ষণে তোয়ালে দিয়ে মুছতে লাগল। চুল মোছা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে মেলে দিলো।
বিছানায় রাখা গহনা আর শাড়িতে পরম আদরে হাত বুলাতে থাকে ইরজা। সহসা তার চক্ষু দর্পণের সামনে ভেসে ওঠে এই শাড়ি আর গহনা পরিহিত প্রিয়তা। মেয়েটা চকিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভয়ে চোখের পাতা প্রশস্ত হলো। অবিশ্বাস্য, বিস্ফোরিত দৃষ্টি। প্রিয়তা হাসছে। কী মিষ্টি আর মায়াবী হৃদয়ভেজা হাসি!
দুধের আলতা রঙ, সুদীর্ঘ কৃষ্ণ অরণ্য সদৃশ ঝরঝরে চিকুর যা দোল খায় পিষ্ঠদেশ ছাড়িয়ে। কৃষ্ণ ভোমরের মতো বঙ্কিম ভ্রূদ্বয়, তার নিচে যেন বিধাতার সমস্ত মায়া ঢেলে দেওয়া দুটো ঘন পাঁপড়িতে আবৃত চোখ! ইরজা অবাক বনে যায়। এত সুন্দর মনোহারী আঁখি সে আগে দেখেনি। ছোট্ট নাসিকার অগ্রভাগ সামান্য তীক্ষ্ম। সরু, পাতলা যেন তুলিতে আঁকা নিঁখুত ভাঁজের ওষ্ঠাধর। মুখবিবরে কোথাও কোনো দাগ নেই। পেলব, মসৃণ, মোমের মতো ত্বক। প্রিয়তার প্রতিবিম্ব কী সত্যি নাকি শুধু ভ্রম!
কয়েক পলে মিলিয়ে গেল সব। কণ্ঠরোধ হয়ে থাকা শ্বাসটা ফেলল ইরজা। মোবাইল ফোনটা খুঁজে নিয়ে কল করল আলমিরকে।
আলমির একটা জরুরি মিটিং এ ব্যস্ত। কল কেটে দিলো সে। নাছোড়বান্দা ইরজা আবার কল করল। পাঁচবার এমন হওয়ার পর ম্যাসেজ করল সে।
” কল কাটছেন কেন আমার?”
আলমির সবার দৃষ্টি লুকিয়ে রিপ্লাই করল—
” মিটিং এ আছি।”
“কথা আছে। কল রিসিভ করুন।”
“কী কথা লেখো। এখন ব্যস্ত।”
“বললাম তো কথা আছে। আপনি আমাকে এখন রাগাচ্ছেন।”
আলমির তপ্ত শ্বাস ফেলল। উপস্থিত ক্লাইন্টদের থেকে ক্ষমা চেয়ে দুই মিনিট সময় নিলো সে। আহিলের বুঝতে বাকি রইল না কে ফোন করেছে। ইরজা সাংঘাতিক মেয়ে! ও প্রিয়তার মতো একদম নয়। আহিল কিছুটা মিইয়ে গেল। ইরজার প্রতি তার যে কুপ্রবৃতি কাজ করছিল সেটা চরিতার্থ করা আদৌ সম্ভব কিনা জানা নেই। তবে এভাবে চলতে থাকলে তারা সবাই এতদিন যে প্ল্যান করেছিল তার সমস্তটাই ভেস্তে যাবে। না, না, এ কিছুতেই হতে পারে না।
আলমির করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
“বলো।”
“কখন আসবেন আপনি।”
“মিটিং আছে। তারপর আমাকে একটা সাইট ভিজিটে যেতে হবে।”
“তারমানে আপনি আসবেন না?”
“চেষ্টা করব।”
“আপনি না এলে আমি রুম থেকে বের হবো না।”
“এটা কেমন কথা?”
“এটাই কথা।”
“আসব।”
“প্রমিজ?”
“কথামালা,
বিশ্বাস হোক ভালোবাসার আরেক নাম।”
ইরজা লাজুক হেসে বলল—
“আমি অপেক্ষা করব। রাখছি।”
ফোনখানা বিছানায় ছুড়ে ফেলল ইরজা। কী এক আঁছোয়া আদরে সারা অঙ্গে শাড়িটা জড়িয়ে নিলো সে। জড়োয়ার হারটার সাথে সীতাহারটা বেশ মানিয়েছে বলে সেটিও পরে নিলো। কানের দুলটাও বেশ বড়োসড়ো। এক হাতে চূড় আর অন্য হাতে দুটো বালার মাঝে কয়েকটা পাতলা চুড়ি পরল। সোনা রঙে সারা অঙ্গ ঝলমলাতে লাগল ইরজার। শাড়ির আঁচল কাঁধে ফেলে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। ইশ! লজ্জায় মিইয়ে গেল ইরজা। সে ধীর হাতে শাড়ির আঁচলটা টেনে নিয়ে মাথায় চড়াল। তাকে কেমন বউ বউ লাগছে!
,
,
,
মীর হাসনাত আর উর্মিলা এসেছেন। দরজা খুলেছে সোলায়মান। লম্বা একটা সালাম ঠুকল সে।
“আসসালামু আলাইকুম।”
মীর হাসনাত হাসি মুখ জবাব দিলেন—
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছ তুমি?”
“জি ভালো। আপানারা ভালো আছেন?”
“আলহাদুলিল্লাহ ভালো। বাড়িতে কেউ নেই?”
“আছেন। সাহেব আর ম্যাডাম বাড়িতেই আছেন। স্যাররা অফিসে।”
হাতের জিনিপত্রগুলো হাতে হাতে ভেতরে নিয়ে এলো সোলায়মান। তাকে সাহায্য করল ড্রাইভার লতিফ। সে ভেতরে এলো না। দরজা থেকে চলে গেল।
সোলায়মান গলা উচিয়ে ডাকল—
“সাহেব, মেহমান চলে এসেছে।”
ওপর তলার রেলিং থেকে মাথা বের করল ইরহা। মা- বাবাকে দেখে ছুটে এলো। সিঁড়ি বেয়ে নামল চঞ্চলা ফড়িং এর মতো। মা’কে ঝাপটে ধরে বলল—
“কেমন আছ আম্মু?”
“ভালো। তুই কেমন আছিস।”
মায়ের বুক থেকে সরে জবাব দিলো–
“খুব ভালো।”
বাবার দিকে এগিয়ে গেল ইরহা।
“কেমন আছ আব্বু?”
বাবার বুকের একপাশ যেন সারাজীবনের জন্য তার মেয়েদের দখলে। তিনি একপাশে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথা হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—
“ভালো আসিস তো মা?”
“হ্যাঁ।”
মেয়ের মুখের সুখের হাসি তাদেরকে আপ্লুত করল। সিঁড়ি ভেঙ্গে নামছেন আমেনা। কী এক অভাবনীয় কঠোরতা তার মুখশ্রীতে। চার জোড়া চোখে বড়ই বিস্ময়! তিনি ধীরলয়ে নিচে নেমে এলেন। বিরাগ কণ্ঠে শুধালেন—
“কী অবস্থা আপনাদের?”
“ভালো।”
“ভালো তো হবেই। দস্যি একটা মেয়েকে আমাদের ঘাড়ে উঠিয়ে দিয়েছেন।”
হাসনাত আর উর্মিলা চোখে চোখে তাকালেন। নিশ্চয়ই ইরজাকে নিয়ে কিছু হয়েছে। তাই নিজ গরজেই উর্মিলা বললেন—
“ইরজা কিছু করেছে আপা? মনে কিছু করবেন না। ও ছোটো মানুষ আর একটু জেদি। বয়স আর পরিবেশের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ঠিক হবে না, আরও বেল্লাপনা করবে তা তো সময় বলে দেবে। তা মেয়েকে তো এক কাপড়ে পাঠিয়েছেন, এখন কী কী এনেছেন?”
আমেনা সোলায়মানকে ইঙ্গিত করলেন ব্যাগপত্রগুলো খুলতে। দুই ক্যারেট আম, পাঁচশত লিচু, দশ কেজি আপেল, দশ কেজি মালটাসহ বর্তমানে বাজারের প্রায় সব ফলই তারা এনেছেন। পঁচিশ কেজি মিষ্টি এনেছেন সাথে। পাঁচটা ছিল প্রকাণ্ড সাইজের কাঁঠাল। মুখ বাঁকিয়ে তীর্যক গলায় কটাক্ষ করে বললেন—
“আর কিছু পেলেন না? এসব আম, কাঁঠাল নিয়ে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন?”
মীর হাসনাত অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের মানুষ। তিনি রাগলেন না। বললেন—
“এখন তো ফলের মৌসুম বেয়াইন সাহেবা। তাই।”
“মেয়েকে তো এক কাপড়ে পাঠিয়েছেন। বলি, আমাদের ছেলে কী গাঙ্গের জলে ভেসে এসেছে? ওর কী কোনো শখ আহ্লাদ নেই? মেয়েকে ফকিরের বেশে পাঠিয়ে দিলেন? কেমন মা- বাবা আপনারা?”
মীর হাসনাত এবার মনে বড়ো দুঃখ পেলেন। এলাকায় নাম ডাক আছে তার। সৎ উপার্জনে যা কামিয়েছিলেন তাই দিয়ে বড়ো মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছিলেন। পাঁচভরি স্বর্ণ, আসবাবপত্র ছাড়াও উত্তরার তিন কাঠা জমি তিনি আহিলের নামে লিখে দিয়েছিলেন বলেই ইরহার বিয়ে হয় এই বাড়িতে। সবকিছু দৃশ্যমান হলেও জমির ব্যাপারটা গোপনে রয়ে গেছে। এছাড়াও সময়ে সময়ে বছর জুড়ে নিয়মানুসারে সবকিছুই গাড়ি ভরে পাঠান মেয়ের বাড়িতে। আমেনা আশরাফ ত্যাদড় স্বভাবের। অল্পতে তার মন ভরে না। তাই মেয়ের খুশির জন্য দু হাত খুলে পাঠান মীর হাসনাত। এ সবকিছুর জন্য কিছু লোনও নিয়েছেন তিনি। তবে ইরজার বিয়েটা আচমকা হওয়াতে তিনি তেমন কিছুই দিতে পারেননি।
আমেনা যখন তার বিষ উড়রাচ্ছেন তখন সেখানে উপস্থিত হয় ইরজা। বাবা-মায়ের চোখ জোড়া আনন্দে নেচে ওঠে। কী অপরুপ লাগছে! ইরজা আজ খুবই শান্ত। বাবা-মা’কে সালাম করে তাদের আদর নিলো। ইরজার গা ভরতি গহনা দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লেন আমেনা। খিস্তি মে রে বললেন—
“এসব পড়ার অধিকার দিলো কে তোমাকে?”
ইরজা চেঁচাতেই যাবে। ঠিক তখন বোনের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল সে। চট করে তার আলমিরকে মনে পড়ল। শান্ত বহতা নদীর মতো মানুষটির মন ভেজানো স্বভাবটিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে বলল—
“আপনার ছেলে বলেছে পরতে।”
“তাই বলে তুমি পরে নেবে? এগুলো পরার যোগ্যতা আছে তোমার?”
“এই বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্যতা যেহেতু পেয়েছি, গহনা পরারও পারব। ”
“এসেছ তো ভিখিরির মতো। বলি, তোমার বাবা মাই কেমন, মেয়েকে এমন খালি হাতে পাঠিয়ে দেয়?”
“আমি না হয় ভিখিরি, কিন্তু যাকে আপনারা পছন্দ করে এই বাড়িতে এনেছেন, সেতো আমারই বোন। তো তখন ভিখিরির কথা মনে হয়নি?”
“আবার মুখে মুখে তর্ক শুরু করেছ?”
মীর হাসনাত লজ্জায় মাথা তুলতে পারছেন না। উর্মিলাও কেমন চুপসে গেলেন। ইরহা ভয় পাচ্ছে, পাছে বড়ো কোনো ঝামেলা না হয়ে যায়। নিজের রাগকে সংবরণ করা বহুত চেষ্টা করছে ইরজা। জানে না কতক্ষণ পারবে। আমেনা ফুঁসে যাচ্ছেন। আলমির গহনাগুলো প্রিয়তার স্মৃতি হিসেবে রাখবে বলে তার কাছ থেকে নিয়ে গেছিল। কিন্তু আজ সেগুলো এই মেয়েকে পড়তে দিয়েছে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে যাচ্ছেন। ডোর বেল বাজল। সবাই যার যার জায়গায় স্থির হয়ে রইল। সোলায়মান গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই সবাই দেখল, দশ কী এগারো বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেবি পিংক কালারের গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার জিন্স পরা মেয়েটির মাথায় দুটো ঝুঁটি করা। বুকের নিচে চলে গেছে সেই চুল। বাচ্চাটিকে দেখে আমেনার মুখটা আনন্দে আলোকিত হয়ে উঠল। ডেকে উঠল—
“রিনি!”
চলবে,,,