#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১০
লেখনীতে: আইশা তানভি
আমেনার খুশি আকাশ ছোঁয়া। দৃক যুগল অকস্মাৎ নমনীয় হয়ে এলো। ঠোঁট ভরা জ্বলজ্বলে হাসি খেলছে। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল—
“আমার সোনা পাখি! আমার বুবুজান! কবে আসলে তুমি?”
রিনি তার দুই ঝুঁটি তিড়িংবিড়িং করে দুলিয়ে দৌড়ে ছুটে এলো নানীর কাছে। ঝাপটে ধরল অতলান্তিক ভালোবাসায়। এ যেন অন্য এক আমেনা। দুই হাতে নাতিনকে আঁকড়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন–
“এতদিনে বুবুজানের কথা মনে পড়ল?”
চটপটে, চঞ্চলা পাখিটি নানীর বুক থেকে মাথা তুলে বলল—
“মনে তো সব সময় পড়ে। কিন্তু মনে পড়লেই কী আসা যায়? ”
“তুমি একা আসছ? মা কোথায় তোমার?”
“মাম্মি আসছে।”
“এই যে আমি।”
সকলের বিস্ময়ভরা দৃষ্টি গিয়ে পূনরায় ঠেকল সদর দরজায়। বিশাল এক ট্রলি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শশী। সাথে আরও কিছু আছে। আমেনা আশরাফ যেন হাতে চাঁদ পেলেন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললেন—
“আল্লাহ্ রে, আমার আম্মায় আসছে!”
তার চোখে জল চিকচিক করছে। খুশির জল। সোলায়মান এগিয়ে গিয়ে ব্যাগপত্র সামলে নিলো। আমেনা এক প্রকার দৌড়ে ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে। বুকে আঁকড়ে ধরে প্রায় কেঁদেই ফেললেন।
“এতদিনে মনে পড়ল মায়ের কথা?”
শশী মা’কে কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে বলল—
“এখন তো এসেছি। এখন কেন কাঁদছ?”
আমেনা মেয়ের বুক থেকে আলগা হয়ে বললেন—
“কাঁদি কী সাধে! তুই ছাড়া আর কে আছে আমার? ”
উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে গেল। আমেনার এই দ্বিমুখী ব্যবহারে তারা সবাই আশ্চর্যচকিত!
“আয়, আয়, ভেতরে আয়।”
ইরহা প্রশস্ত হেসে এগিয়ে গিয়ে শশীকে আলিঙ্গন করল। জিজ্ঞেস করল—
“কেমন আছেন আপা?”
“ভালো। তুই কেমন আছিস?”
“আলহাদুলিল্লাহ্ ভালো। রিনি কবে এসেছে?”
“আমি গতকাল এসেছি মামী। ”
ছোট্ট রিনি ভীষণ আদুরে! দেখলেই আদর আদর লাগে। আর কথা…. সে তো যেন পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ! সবার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে রিনি। অপরিচিত মুখগুলো তাকে ভাবাচ্ছে।
“ওনারা কারা?”
মীর হাসনাত আর উর্মিলাকে উদ্দেশ্যে করে প্রশ্ন করল রিনি। ইরহা বলল—
“আমার আব্বু- আম্মু।”
“আর উনি?”
“আমার বোন।”
“তোমার বোনের কী আজ বিয়ে?”
ইরহা এক চোট হেসে বলল—
“না তো।”
“তাহলে এত সেজেছে কেন?”
মিষ্টি, ভীষণ চটপটে, খুব আদুরে বাচ্চাটিকে গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছে হলো ইরজার। রিনি তার সামনে এসে দাঁড়াল। উৎসুক, সূক্ষ্ম চাহনিতে ইরজাকে আপাদমস্তক পরখ করতে লাগল। রিনির কপালের ওপর ছোটো করে কাটা চুল। চোখগুলোও সরু, লম্বাটে। ছোট্ট নাকটি হালকা করে বোচা। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। রিনিকে দেখতে কিছুটা জাপানিজ বাচ্চাদের মতো লাগে! যদিও তার এই চেহারার কারণ কারো জানা নেই। ইরজা হাত বাড়ালো। করমর্দন করার প্রয়াসে বলল—
“হাই!’
রিনিও হাত বাড়াল।
“হ্যালো!
তোমার নাম কী?”
“ইরজা। আর তোমার?”
“রিনি।”
কী মিষ্টি কণ্ঠে বলল রিনি! ইরজার মনটা আচমকাই ভালো হয়ে গেল। রিনি বলল—
“তুমি বুঝি মামীর বোন? তোমাকে আমি কী বলে ডাকব?”
ইরজা সবার দিকে একবার চোখ বোলাল। পরে রিনির দিকে চোখ রেখে হাসি মুখে বলল—
“আমার আরও একটা পরিচয় আছে। আমি তোমার আলমির মামার বউ।”
“সত্যি?”
উল্লাসপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল রিনি।
“হ্যাঁ।”
“ইয়াহ! বড়ো মামা বিয়ে করেছে? একদম ভালো করেছে। তোমাকে আমি কী বলে ডাকব বলো তো?”
“তোমার যা ইচ্ছে।”
“রাঙা বউ। তোমাকে আমি রাঙা বউ বলে ডাকব। তুমি অনেক সুন্দর! একদম প্রিয়তা মামীর মতো।”
ইরজা তার নিশ্চল আঁখি দুটো দিয়ে সবাইকে ফের দেখল।
“তুমি প্রিয়তাকে দেখেছ?”
“ছবিতে দেখেছি।”
“কোথায় ছবি?”
“মামার মোবাইলে।”
শশী বিরক্ত হয়ে গেল। মেয়েকে টেনে নিয়ে বলল—
“এত কথা কেন বলছ তুমি? কতবার বলেছি, বেশী কথা বলবে না।”
রিনি চুপ হয়ে গেল। তবে দুষ্ট হাসিটা সবাইকে লুকিয়ে ছুড়ল ইরজার দিকে। ইরজাকে পছন্দ হয়েছে রিনির। খুব।
শশী এবার ইরজা দিকে তাকাল। অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে কাষ্ঠ গলায় বলল—
“ননদ হই তোমার। বয়সেও বড়ো। সালাম দিতে হয়, সেটাও শেখায়নি বাবা-মা?”
শশীর এই অপমানজনক কথায় রুষিত হলো ইরজা। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে বলল—
“আসসালামু আলাইকুম।”
“পা ছুঁলে কী জাত চলে যাবে।”
“পা ছুঁয়েই সালাম করতে হবে এমন কোথাও লেখা নেই।”
“ও আচ্ছা। তার মানে যা যা লেখা থাকে সেটাই তুমি করো! বরের সাথে বেয়াদবি, শাশুড়ির মুখে মুখে তর্ক , শ্বশুরকে অসম্মান, বড়ো বোনের স্বামীর হাতে হাতে পর্যন্ত যুদ্ধ; এসব বুঝি তোমার ডিকশনারিতে লেখা?”
ইরজা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“লেখা তো আরও অনেক কিছুই আছে। সব প্রয়োগ করলে আপনাদের সহ্য হবে তো?”
শশী গিয়ে দাঁড়াল ইরজার সম্মুখে।
“ঠিক আছে। আমিও দেখব তুমি কী কী করতে পারো। এই গয়না তুমি কোথায় পেয়েছ? এগুলো তো প্রিয়তার।”
“আপনার ভাই পরতে দিয়েছে।”
“মা, এই জড়োয়ার হার তো আমাকে দেবে বলেছিলে। কই দিলে নাতো?”
আমেনা সরোষে বললেন—
“কোথ্থেকে দেবো আমি? প্রিয়তার স্মৃতি রাখবে বলে সব গয়না নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে। এখন নতুন বউকে পড়তে দেওয়া হচ্ছে।”
মুখ বাঁকালেন আমেনা। শশী হারটাতে হাত দিয়ে বলল—
“এটা আমাকে দাও।”
ইরজা যেন আকাশ থেকে পড়ল। রাগ উঠে এলো নাকের ডগায়। বজ্রকঠোর কণ্ঠে বলল—
“না। এটা আমার স্বামী আমাকে পরতে দিয়েছে। আমার কাছে এগুলো তার দেওয়া আমানত। আপনার যদি নিতেই হয়, আপনার ভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নেবেন।”
শশী ফুঁসে উঠল। খলবলিয়ে বলল—
“মা ঠিক ই বলেছেন, তুমি তো সাধারণ মেয়ে নও।”
“ও তাই তো বলি, সারাক্ষণ আপনার মা করেটা কী! নিশ্চয়ই বসে বসে ফোনে বউদের গুনগান শোনায় আপনাকে। আচ্ছা, উনি না হয় বয়স্ক মানুষ, তাই কাজকর্ম নেই। কিন্তু আপনি, এত সময় পান কোথায়? আপনার মায়ের এসব আজেবাজে কথা শোনার?”
“কী! আমি আজেবাজে কথা বলি?”
আমেনা ক্ষেপে উঠলেন। শশী তার হাত চেপে ধরে বলল—
” এসো মা। আলমির আসুক আগে। এসো রিনি।
মা আর মেয়েকে নিয়ে উপরে চলে গেল শশী। উর্মিলা এতক্ষণে মেয়েদের কাছে পেলেন। আদর করলেন। ইরজাকে দেখে বুকটা আনন্দে ভরে গেল তার। তবে তাকে সাবধানও করলেন। স্বামীর ঘরে মেয়েদের জোর গলায় বলতে নেই। সব কথার জবাব দিতে নেই। সব সময় ভালো খারাপের তফাৎ বোঝাতে নেই। কিছু অন্যায় সহ্য করতে হয়। কিছু ন্যায়কে অলক্ষ্যে রাখতে হয়। মায়ের কথায় ভোলে না ইরজা। তার প্রতিবাদী চেতনার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল সেই ছোট্ট বেলাতেই। আজ তা পূর্ণ প্রস্ফুটিত। তাকে বিনষ্ট করার দুঃসাহস সে কাউকে দেবে না। স্বয়ং নিজেকেও না।
,
,
,
খাবার খেতে বসেছে সবাই। শরীফ আশরাফের শরীরটা হঠাৎ করেই খারাপ করেছে। তাই রুমেই হালকা কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে শুয়ে আছেন। আহিল ফিরেছে অফিস থেকে। রিনির সাথে বেজায় ভাব তার। আগে জানলে ব্যাগভরতি করে ভাগনির জন্য কিছু নিয়ে আসত। ইরজা বারবার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আলমির এখনো আসেনি। মিষ্টি কালারের শাড়ি পরেছে ইরহা। তারও অনেক গহনা আছে। বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকেও অনেক গহনা পেয়েছে সে। তবে হালকা একটা হার আর ছোটো এক জোড়া দুল পরা থাকে সবসময়।
খাবার বেড়ে দিচ্ছে ইরহা। আজ ইরজাও হাত লাগালো। মায়ের পছন্দের খাবারগুলো পাতে তুলে দিচ্ছে। আমেনার নাখুশ চাহনি। আহিলের মন ভালো নেই। কেমন মনমরা আর চিন্তানিমগ্ন দৃষ্টি।
“আপনাকে মাছ দেবো?”
ইরহা প্রশ্নটা করল স্বামীকে। আহিল হাতের ইশারায় না করল। অফিসে কিছু একটা নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছে। তাই অফিস থেকে ফেরার পর থেকে কেমন থমথমে হয়ে আছে তার মুখ। ইরহা প্রশ্ন করার সাহস পায় না। আহিলের পাশে বসেছে রিনি। তার থালায় মুরগির মাংসের রান ছাড়া আর কিছুই দেওয়া গেল না। সে আর কিছু নেবে না। রিনি জেদ ধরল ডিম ভাজা খাবে। ইরহা যেতে চাইলে তাকে নিষেধ করে ইরজা। নিজেই রান্না ঘরে যায়।
রিনি তার মিঠে কণ্ঠে আহিলের কানে ফিসফিসিয়ে বলল—
“মামা, ওই রাঙা বউটা ভীষণ রাগী তাই না?”
আহিল তার শক্ত অভিব্যক্তি নিয়েই রান্নাঘরের দিকে তাকাল। কিছু সময় যেতেই ডিম ভাজার সুগন্ধ ভেসে আসতে লাগল। আহিল তাকিয়েই রইল। ইরজা যখন আসছে তখন তাকে দেখে কিছু একটা হলো আহিলের। তার চাহনিতে ঘোর লেগে এলো। ঝলমলে এক আলোক কন্যার প্রতিটি কদম যেন তার বুকের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। আহিলের ওই মুগ্ধ চাহনিকে এফোড়ওফোড় করে টেবিলের কাছে চলে এলো ইরজা। ঠিক তদ্দণ্ডে ডোর বেলের শব্দে কলিজা লাফিয়ে উঠল তার। খুশিতে ঢগমগিয়ে বলল—
“আমি যাচ্ছি।”
ইরজা ব্যস্তপায়ে ছুটল। হাঁপাতে লাগল সে। সোলায়মান অর্ধেক এসে থমকে গেল সিঁড়ির কাছেই। ইরজা জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। অবাধ্য খুশিতে মনটা উতলা হয়ে উঠল। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল একরাশ আশা নিয়ে। ওপাশের ব্যক্তিটি তখন ফোনে কথা বলছিল। সহসা ইরজার পানে পলক পড়তেই এক সুশোভিত অঙ্গনার এহেন অকল্পনীয় রূপে মোহিত হয়ে বিবশ হয়ে গেল সে। উদ্ভাসিত, বিস্ময়াভিভূত, চিত্তাকর্ষক চাহনিতে নির্নিমেষ চেয়ে রইল।
চলবে,,,