#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১১
লেখনীতে:আইশা তানভি
অবাক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন দুই চোখ! ফোন কল কেটে দিলো আলমির। নরম হাসল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ইরজা বলল–
“আসুন।”
আলমির বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ইরজার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। আলমিরের চাহনিতে বিস্ময়, বিভ্রম। আলমির ইতিউতি করে বলল—
” আ…. আ…তোমার… মা-বাবা এসেছে?”
ইরজা লাজুক গলায় প্রত্যুক্তি করে—
“জি।”
নত মুখ। লজ্জাবতীর লাজ রাঙা মুখবিবরে এক অকৃত্রিম সৌন্দর্য ! আলমির ছোট্ট করে হেসে গাঢ় কণ্ঠে বলল—
“কথামালা,
লজ্জারা লুকিয়ে যাক তোমার মায়ায়!”
“চলুন।”
আলমির হাঁটতে শুরু করলে ইরজা বলল—
“ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার বাড়ছি।”
আলমির পেছনে ফিরল। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল—
“আমি খেয়ে এসেছি।”
অকস্মাৎ ইরজার মুখটা কালো হয়ে গেল। গুমোট রাগে মন ভরে উঠল। তীক্ষ্ম স্বরে রাগ ঝেড়ে বলল—
“খেয়েই যখন ফেলেছেন, তাহলে এসেছেন কেন?”
ইরজা জানে না তার কী হলো। লোচন জোড়াতে পানি জমে গেল। এত দ্রুত ঘটল সব যে, সে চেয়েও লোনা জলের ধারা লুকাতে পারল না। রাখে, দুঃখে, অভিমানে গা কেঁপে উঠল তার। আলমিরকে রেখেই দপদপ করে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। কারো তোয়াক্কা করল না। মাথার ঘোমটা কাঁধে নেমে গেছে। তার এই প্রস্থান খাবার টেবিলের সবার নজর কাড়ল। রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল ইরজা। ধীরেসুস্থে উপরে উঠে এলো আলমির। মীর হাসনাত তাকে দেখে উঠতে গেলে বলল—
“উঠবেন না। খেতে বসেছেন, তাই সালাম দিলাম না। ভালো আছেন আপনারা?”
“জি। তুমি ভালো আছ?”
“জি, আলহামদুলিল্লাহ্। আপনার কী অবস্থা আম্মা?”
উর্মিলা যেন লজ্জা পেলেন। দুইদিন আগেও তাকে খালাম্মা বলে ডাকত আলমির। অধরে মুচকি হাসি রেখে বললেন—
“আল্লাহ্ ভালো রেখেছেন।”
আমেনা নাক ফোলালেন। তীব্র আক্রোশ নিয়ে বললেন—
“বিয়ের দুইদিন হয়নি, আম্মা বলতে তো সময় নিলি না? তোর বউ তো আমাকে ডাকেই না।”
“ডাকবেই তো।”
তিরস্কারপূর্ণ কণ্ঠে বলল শশী। উর্মিলা অপমানিত বোধ করলেন। মীর হাসনাত নীরব রইলেন। আলমির হাস্য বদনে জিজ্ঞেস করল—
“কখন এসেছিস?”
“সকালে।”
মুখ গোমড়া করে জবাব দিলো শশী। আলমির তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। ততক্ষণে রিনি দৌড়ে এসেছে মামার কাছে। আলমির হাঁটু ভেঙে বসল। রিনির নাক টেনে বলল—
“আম্মাজান, কী খবর আপনার?”
“ভালো মামা।”
রিনি আলমিরকে হাতের ইশারায় ডাকল। আলমির তার কান এগিয়ে দিলো। রিনি কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—
“তোমার বউটা খুব রাগী!”
“আর?”
“আর কিউটও। একদম প্রিয়তা মামীর মতো।”
আলমির নরম হয়ে গেল। প্রিয়তার কথা মনে হলেই কেমন এলোমেলো অনুভূতির স্বীকার হয় সে। কাউকে বোঝাতে পারে না। মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে আলমির—
“বাবা আসেনি?”
রিনি আবারও আলমিরকে হাতের ইশারায় কান এগিয়ে দিতে বলল।
“পাপার সাথে মাম্মির ঝগড়া হয়েছে। তুমি আবার মাম্মিকে বলো না। বকবে আমাকে।”
“বলব না।”
আলমির উঠে দাঁড়াল। ইরজার মা- বাবাকে বলল—
“আপনারা বসে আছেন কেন? খেতে থাকুন। আমি আসছি।”
আলমির যেতে যেতে আহিলকে দেখল। পুরোটা সময় আহিল মূর্তির মতো বসে ছিল।
,
,
,
রাগের চোটে পানি আসা চোখ দুটো বারংবার মুছতে লাগল ইরজা। কী বিদঘুটে রাগ হচ্ছে তার!
আলমির রুমের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল, গায়ের গহনা সব এক এক করে খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলছে ইরজা। নাক টানছে। চোখের জল, নাকের জল সব একাকার হয়ে যাচ্ছে!
আলমির গায়ের স্যুট খুলতে খুলতে বলল—
“খেয়ে এসেছি, খাব না, সেটাতো বলিনি।”
ইরজা থমকে গেল। আলমিরের দিকে তাকাল। চেঁচিয়ে উঠে বলল—
“আপনি একটা অসহ্য!”
ব্লেজারের হাতা খুলে স্যুটটা হাতে নিল আলমির। গা দুলিয়ে হেসে উঠল।
“হাসছেন আপনি?”
হাত ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল—
“শাড়িতে চমৎকার লাগে তোমায়!”
“প্রথমে রাগিয়ে, কাঁদিয়ে, চোখের জল, নাকের জল একসাথে করিয়ে, এখন প্রশংসা করা হচ্ছে!”
আলমিরের এক হাতের ওপর ব্লেজার রাখা। অন্য হাত পকেটে গুঁজে বলল—
“কথামালা,
অভিমানের ঝর্ণা, বয়ে আনুক তোমার জীবনে অজস্র খুশির বন্যা।”
ইরজার চোখের তেজ কমে না। আলমির বলল—
“তুমি যাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আর শোনো, এই অবস্থায় বাইরে যেয়ো না কথামালা, লোকে অন্যকিছু ভাবছে। দিন দুপুরে বেইজ্জতি !”
“আপনার মাথা! অসহ্য লোক!”
“আরে, বুইড়াটা এবার অসহ্য হয়ে গেল?”
ইরজা আদুরে রাগ ছুড়ে বলল—
“আপনাকে আমি…।”
“খু ন করে ফেলবে? পারবে না। বলে লাভ নেই। যাচ্ছি আমি।”
ব্লেজারটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে আলমির। ইরজার অধরোষ্ঠে পূর্বের হাসিটা ফিরে আসে। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।
মীর হাসনাত আর উর্মিলা ইরহার রুমে। ইরজাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মা যেন তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে যায়, সেই পরামর্শ দিচ্ছে ইরহা।
খেতে বসেছে আলমির। ইরজা খাচ্ছে না। শুধু পাশে দাঁড়িয়ে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আলমির বলল—
“তুমি খেয়েছ?”
“না। আপুর সাথে খাবো।”
“আচ্ছা।”
“আমি কিন্তু আজ ঝগড়া করিনি।”
“কোন ব্যাপারে?”
“এই যে, আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আপনার বোনের ওপর সেই নিষেধাজ্ঞা নেই।”
“এটা আমার বাপের বাড়ি। তোমার নয়। এভাবেই কান পড়া দাও আমার ভাইকে?”
শশীর কর্কশ কণ্ঠে আলমির মাথা তুলে তাকাল। তার দৃষ্টি নিরুত্তাপ। শশী তেড়ে এসে বলল–
“তোর বউ তাহলে এসব বলে বেড়ায়?”
“আপনি ভুল বুঝছেন।”
“একদম চুপ। একটা কথাও বলবে না। অসভ্য, বেয়াদব মেয়ে। আমার বাবার বাড়িতে আমি আগে খাবো না পরে খাবো, সেটা তুমি ঠিক করে দেবে?”
“আপনি কথা না বুঝে দোষারোপ করছেন?”
“আমি কথা বুঝছি না? আর আলমির, এই গয়না তো প্রিয়তার ছিল। আর এই জড়োয়ার হারটা মা আমাকে দেবে বলেছিল। ”
আলমির এবার মুখ খুলল। বলল—
“এগুলো বাবা বিয়েতে প্রিয়তাকে দিয়েছিল। প্রিয়তা আমার স্ত্রী ছিল। এখন এগুলোর মালিক আমার স্ত্রী হিসেবে ইরজার।”
“বাহ্! তুই কিন্তু বেশ বদলে গেছিস আলমির।”
“সময় মানুষকে বদলায়।”
ইরহার সাথে মীর হাসনাত আর উর্মিলাও বেরিয়ে এসেছেন। আমেনাও আছে মেয়ের সাথে। আহিল বাড়ির সম্মুখ বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের রাগ ঝাড়ছে।
শশী ইরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল—
“হারটা আমাকে দাও।”
“না।”
“তুমি শোনোনি আলমির কী বলেছে?”
“আপনি শোনেননি। উনি বলেছেন, এগুলো এখন থেকে আমার। আর আমার জিনিস, আমি কাউকে দেবো না।”
উর্মিলা মেয়েকে তর্ক না করার ইশারা করছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ইরজা তার সিদ্ধান্তে অনড়। শশী ক্ষেপে উঠল—
” একটা হারের লোভ সামলাতে পারো না? পারবে কীভাবে? দেখেছ কখনো এমন হার? এসেছ তো খালি হাতে। আরে এখন ফকিন্নির মেয়ের বিয়েতেও কমছে কম পাঁচ ভরি স্বর্ণ আর ফার্নিচার তো দেয়ই। তোমার বাবা- মা তো তোমাকে বিদায় করে উদ্ধার হয়েছেন।”
আলমির উৎকর্ণ হয়ে আছে ইরজার উত্তর শোনার জন্য। ইরজা গরম তেলে জল পরার মতো ছ্যাঁত করে উঠে বলল—
” আমি তো ফকিন্নি। জীবনে কখনো দেখিনি। তাই লোভ সামলাতে পারছি না। কিন্তু আপনি… আপনি তো বড়োলোক বাবার মেয়ে, আপনার স্বামীও নিশ্চয়ই ভীষণ ধনবান, তাহলে আপনার এত অন্যের জিনিসের ওপর লোভ কেন? নাকি আমি নামে ফকিন্নি হলে আপনার রক্তই ফকিন্নির? ”
“এই মেয়ে!”
শশীর রাগ আকাশ ছুঁল। ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য শশী ইরজাকে আ ঘাত করার জন্য হাত তুলল। সেই হাত শক্ত করে ধরে ফেলল ইরজা। তীর্যক হাসল। বলল–
“ভাই বোন সবার কী এক স্বভাব? কিছু হলেই গায়ে হাত তুলতে চলে আসেন?”
ইরজা আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল। তবে ইরহার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। আলমির নত মুখে হাসছে। প্রিয়তা নিশ্চয়ই আজ খুব খুশি হবে। খুব!
চলবে,,,