#প্রিয়ঙ্গনা
12+13
#পর্ব:১২
লেখনীতে:আইশা তানভি
“তোমার বাবা-মা চলে গেছেন?”
আলমির সাধারণ কণ্ঠে প্রশ্নটা করল। জবাবে ইরজা বলল—
“জি।”
আলমির বিছানার একপাশে বসল। বালিশটা ঠিক করে শুয়ে পড়ল। ললাটে হাত রেখে চোখ বুজে ফেলল। ঘুম নয়, কেমন অস্থিরতায় বুকটা ভার হয়ে যাচ্ছে আলমিরের। ইরজা বিছানার এপাশটায় এসে দাঁড়াল।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
আলমির ওই অবস্থায় অবিচল থেকে বলল—
“বলো।”
“আপনি কী রাগ করেছেন?”
“কোন বিষয়ে?”
“এই যে, শশী আপাকে আমি হারটা দেইনি বলে।”
“ওটা তোমার। ইচ্ছে হলে দেবে। নাহলে নাই।”
ইরজা থামল। আলমিরের কণ্ঠস্বরের আর্দ্রতা তাকেও খুব করে ছুঁয়ে দিলো। সারাদিন অফিস করে এসে এসব ঝামেলা নিশ্চয়ই আলমিরকে কষ্ট দিচ্ছে! নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো ইরজার। তার রাগটা এত লাগামহীন কেন?
“আপনি কী ঘুমাবেন?”
“না।”
আলমির কপাল থেকে হাত সরাল। ইরজার দিকে তাকিয়ে উঠে বসল। কণ্ঠে সচলতা এনে বলল—
“কী বলবে বলো।”
ইরজা কাচুমাচু করছে। হাত কচলাচ্ছে। কী যেন বলতে চেয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আলমির অভয় দিয়ে বলল—
“বলো কথামালা।”
“শশী আপা আপনাকে তুই করে বলে কেন?”
“কারণ, ও আমার বড়ো।”
“উনি আপনার বড়ো?”
ইরজা বিস্ফোরিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল। আলমির সহজ গলায় বলল—
“হ্যাঁ। ”
“কতদিনের বড়ো?”
“হবে এক দেড় বছরের।”
” এত জলদি জলদি বাচ্চা নেওয়ার কী দরকার ছিল!”
কৌতুকপ্রদ কণ্ঠে হেয়ালি মনে বলে ফেলল ইরজা। আলমির স্মিত হেসে বলল–
“শশী আমার আপন বোন নয়।”
“কী?”
ইরজার বিস্ময় আকাশ ছুঁল। হতবাক দৃষ্টি। আলমির নিজেই বলল—
“শশী মায়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে। আমার মা মারা যাওয়ার আগ থেকেই কোনো এক জটিল রোগে অসুস্থ ছিলেন। এসব নিয়ে বাবা আর মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। আমি তখন তেমন বুঝতাম না। মায়ের সেই অসুস্থতার মধ্যে বাবা শশীর মা’কে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। কথা ছিল তিনি মায়ের সেবাযত্ন করবেন। তারপর হঠাৎ একদিন মা ম রে গেলেন। মায়ের শোক ভোলার আগেই শশীর মা’কে বাবা বিয়ে করে ফেললেন। আমাকে যে খুব অনাদর করতেন তা নয়। বাবা বললেন, মা চেয়েছেন যেন আমার কোনো অযত্ন না হয়। তাই তিনি মারা যাওয়ার আগে শশীর মা’কে বিয়ে করার কথা বলে গেছিলেন। আমিও মেনে নিলাম। মিসেস আমেনা আশরাফ হয়ে গেলেন আমার নতুন মা। আহিল আমার সৎ ভাই। ঠিক তেমন শশীরও। শশী আর আমার মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।”
আলমিরের গলা নিভে আসছে। ইরজার ইচ্ছে হচ্ছে, নিজের সাথে আলমিরের কপালটা একটু ঘঁষে নিতে। এই পৃথিবীতে তাদের দুজনার ভাগ্য এক। সবথেকেও কিছুই নেই। আলমির তার নিষ্প্রাণ কণ্ঠে আরও বলল—
“আমার বিয়ের ছয় মাস পর বাবা আমাকে জোর করে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়। এমন না যে আমাদের টাকা পয়সার খুব অভাব ছিল। তবুও ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে বাবা আমাকে দেশ ছাড়া করে। প্রিয়তা ফোন করে খুব কান্নাকাটি করত। কিন্তু কিছুদিন যেতেই ওর সাথে কথা বলাও দুষ্কর হয়ে পড়ল আমার জন্য। ফোন করলেই মা বলত, ও ওয়াশরুমে, হয়তো ঘুমাচ্ছে, নাহলে রান্না করছে। মা মারা যাওয়ার পর কখনো বাবার কথার অবাধ্য হইনি। এমন কি, যখন প্রিয়তাকে বিয়ের কথা বলেছিলাম বাবাকে, এক বলাতেই বাবা রাজী হয়ে যান। তাই তার কথা অমান্য করে দেশেও আসতে পারছিলাম না। ”
“তারপর?”
“তারপর…. তারপর দু’বছর কেটে যায়। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে এক প্রকার জোর করেই দেশে ফিরি আমি। কিন্তু..?”
“কিন্তু কী?”
“আমার প্রিয়তা বদলে যায়। যেই ছোট্ট, , মিষ্টি, পাখির ছানার মতো আদুরে প্রিয়তাকে আমি রেখে গিয়েছিলাম; সেই প্রিয়তা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। এতবার জিজ্ঞেস করলাম….. কিছুই বলল না। তিন মাস এভাবেই চলে গেল। আমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। এরপর যখন আবার ফিরলাম, আমার প্রিয়তাকে মাটির ঘরে রেখে আসতে হলো আমার।”
ইরজার চোখের পানি আর বাঁধ মানল না। টপটপ করে ঝরতে লাগল। সে স্থির দৃষ্টিতে সামনে বসে থাকা মানুষটাকে দেখছে। কী নির্দ্বিধায় জীবনের দুর্বিষহ ঘটনার বিবৃতি করছে। আলমিরের চোখের কোটর জলে পূর্ণ। অধরে কপট হাসি। ইরজাকে বলল—
“তোমার মনে হয় না, কেন আমি কোনো প্রতিবাদ করি না? ইচ্ছে হয় না। যার জন্য প্রতিবাদ করার ছিল, তার জন্য করতে পারিনি। এখন প্রতিবাদ করে কী করব? তবে তুমি ভেবো না, তোমাকে আমি প্রিয়তার মতো একা ছেড়ে দেবো। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না কথামালা। যখনই তোমার পিঠ দেওয়ালে ঠেকবে, একবার আমাকে ডেকো, আমি সর্বদা তোমার পাশে আছি। আর এসব ছোটোখাটো বিষয় তুমি নিজেই সামলাতে পারবে, আই নো।”
ইরজার চোখের পানি থেমে গেল। বলল—
“তাই বুঝি চুপ করে থাকেন?”
“তোমার ঝগড়া দেখতে ভালো লাগে আমার।”
ইরজা ফিক করে হেসে ফেলল। দুষ্ট কণ্ঠে বলল—
“অসহ্য বুইড়া!”
বলেই দিলো দৌড়। আলমির হাসল। বসে রইল অনড়ভাবে। বিড়বিড় করে বলল—
“তোমায় সব সত্য বলতে পারিনি কথামালা। না কখনো সত্যটা প্রিয়তা আমাকে জানতে দিয়েছে। আমার প্রিয়তা ম রেনি। ওরা আমার প্রিয়তার সাথে আমার সন্তানকেও কেড়ে নিয়েছে। তুমি আমাকে সত্য উদঘাটনে সাহায্য কোরো। আমি চিরকাল তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব কথামালা। আমার প্রিয়তাকে ইনসাফ পাইয়ে দাও।”
আলমির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার বুকের সমস্ত উত্তাপ বেরিয়ে আসে সেই নিশ্বাসের সাথে।
,
,
,
“এসব তোমার জন্য হয়েছে মা।”
“আমি কী করেছি?”
আমেনা কৌতূহল নিয়ে বললেন। শশী বলল—
“তুমিই না একদিন আলমিরকে বলেছিলে, মহিলাদের মাঝে কথা বলতে না। তাই তো নিজের বউকে লেলিয়ে দিয়ে নিজে চুপ করে থাকে। ”
আমেনা রুষ্ট গলায় বলল—
“আমার মনে হয় আলমির ইচ্ছে করেই এসব করছে। ওই বিচ্ছু মেয়েকে ও এজন্যই এই বাড়িতে এনেছে।”
“এরচেয়ে প্রিয়তা ঢের ভালো ছিল।”
শশীর গলায় আক্ষেপ। আমেনা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন।
,
,
,
ঠক, ঠক, ঠক। দরজায় আওয়াজ হলো। আলমিরের চোখ লেগে এসেছে মাত্র। ইরজা কাবার্ডে কাপড় গুছিয়ে রাখছে।
আলমির ঘুমাচ্ছিল দেখে, দরজার কাছে এলো। দরজা খুলল। মিষ্টি হাসির একটা ছোট্ট পরী!
“এসো।”
রিনি ভেতরে এলো।
“মামা ঘুমাচ্ছে?”
“হুম।”
“উঠিয়ে দেই?”
“না।”
ইরজাকে ডাকে। কান এগিয়ে দেয় ইরজা। ফিসফিসিয়ে বলল রিনি—
“কথা আছে মামার সাথে।”
ইরজাও তেমন ফিসফিসিয়ে বলল—
“আমাকে বলা যাবে না?”
“না রাঙা বউ। তোমাকে বলা যাবে না।”
“তাহলে কী করা যায়?”
“অপেক্ষা।”
খিলখিল করে হেসে ওঠে দুজন। ইরজা নাক টেনে দেয় রিনির। কী ভীষণ মায়াবী!
,
,
,
আলমিরের পাশ ঘেঁষেই বসেছে রিনি। তাকে নুডলস করে দিয়েছে ইরজা। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
মামাকে ইশারায় ডাকল রিনি। মুখের কাছে কান এগিয়ে দিলো আলমির—
“মাম্মি আর নিনা রাঙা বউকে বকছে।”
আলমির আড় চোখে ইরজাকে দেখল। ফের নিজের মুখটা রিনির কানের কাছে নিয়ে অনুচ্চ স্বরে বলল—
“কী বলেছে?”
“বুঝিনি।”
“মামা, ভাগ্নিতে কী ফিসফাস হচ্ছে?”
ইরজা চোখে দুষ্টুমি নিয়ে বলল। রিনি তার মিহি স্বরে প্রত্যুক্তি করল—
“বলা যাবে না তোমাকে। আমি পানি খাবো।”
“আনছি।”
ইরজা বাইরে যেতেই রিনি কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল–
“মাম্মি পাপাকে বলেছে, যদি রাঙা বউয়ের মতো একটা হার কিনে না দেয়, তাহলে মাম্মি আর যাবে না।”
“কখন বলেছে?”
“ফোনে বলেছে।”
“রাঙা বউকে কেমন লাগে?”
“খুব ভালো। মিষ্টি, মিষ্টি!”
আলমিরের চোখে খুশির ঝলক উঠল।
,
,
,
হঠাৎ করেই উত্তপ্ত পরিবেশ শীতল হতে শুরু করল। গুমোট প্রকৃতিতে হিম সমীরণের গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে আলমির।
“মন খারাপ?”
প্রিয়তা এসেছে। আলমির খুব বেশি একাকিত্ব অনুভব করলেই প্রিয়তা আসে।
“না।”
“তাহলে?”
“ভালো লাগছে না।”
“ইরজা আপনার যত্ন নিচ্ছে না?”
আলমির গ্রীবাদেশ বাঁকিয়ে তাকাল। নিষ্প্রভ গলায় জিজ্ঞেস করল—
“আবার আপনি বলা শুরু করলে?”
“ইরজাও তো আপনি বলে?”
“তুমি আর ইরজা এক?”
“আলাদাও তো নই।”
“তুমি ইরজা নও প্রিয়তা। যদি হতে, তাহলে এভাবে ছেড়ে যেতে না।”
“আমি সবসময় চেয়েছি আপনি ভালো থাকুন।”
“দেখো, আমি ভালো আছি। কিন্তু আমার ভালো থাকায় তুমি নেই। আমাদের সন্তান নেই। তাহলে কী সত্যি আমি ভালো আছি?”
“আপনি ইরজাকে আমাদের সন্তানের কথা বলেননি কেন?”
“জানি না। কেন যেন ইচ্ছে হয়নি বলতে।”
“আমি জানি কেন বলেননি?”
“কেন?”
“আপনি ভয় পেয়েছেন?”
“কীসের ভয়?”
“ভালোবাসার ভয়।”
“ভালোবাসার ভয়?”
“আপনি ইরজাকে ভালোবেসে ফেলেছেন।”
“পুরোপুরি সত্য নয়।”
“আমি মিথ্যে বলছি না।”
“আমি তোমাকে ভুলতে পারব না।”
“আমি ইরজার মধ্যেই বাঁচব। ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যান। অনেকদিন মা’কে দেখি না।”
“কাল সকালেই যাব।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
প্রিয়তা খুশি হয়।
“কী করছেন?”
আলমির পুরোদস্তুর ঘুরে তাকায়। দেখে ইরজা দাঁড়িয়ে আছে। আলমির বলল—
“শোনো, কাল আমরা এক জায়গায় যাব।”
“কোথায়?”
“গেলেই দেখবে।”
“আচ্ছা। আপনার জন্য চা আনি?”
“না।”
“মাথা ধরেছে। ইরহা কোথায়?”
“রুমে।”
“আহিল কী ওর গায়ে হাত তুলেছে?”
ইরজা নীরব রইল। আলমির বলল—
“ইরহার খেয়াল রেখো। ও যেন প্রিয়তারই আরেক রূপ!”
চলবে,,,
#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১৩
লেখনীতে:আইশা তানভি
তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সাথে দমকা হাওয়া। বজ্রপাতে আকাশ কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। আহিল বাড়িতে থাকলেও আলমির নেই। খারাপ আবহাওয়া দেখেও কী এক জরুরি কাজের বাহানা দিয়ে বেরিয়েছে সে। এই ভয়ং কর আবহাওয়ায় তীব্র ভয়ের সাথে যোগ হলো অনিশ্চয়তা। আলমির ফোন ধরছে না। রিং হয়েই যাচ্ছে। চিন্তায় মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো ইরজার।
কেমন অস্থিরতায় বক্ষস্থল কাঁপছে! অকস্মাৎ বিদ্যুৎ এর ঝলক উঠল আকাশে। থাই টানা হলেও পর্দায় ভাঁজ পড়া। তাই ওই ঝলক চোখ এড়ালো না ইরজার। কিছু সময়ের মধ্যে ক্ষীণ আওয়াজে বজ্রপাত শোনা গেলে। দরজা, জানালা সব বন্ধ হওয়ার দরুন আওয়াজ তেমন শোনা যাচ্ছে না। তবুও এক ভয়ানক শঙ্কা মনের দুয়ারে কড়া নাড়তে লাগল ইরজার। সে ছুটে বের হলো রুম থেকে। সোজা গিয়ে কড়া নাড়ল ইরহার দরজায়। বার কয়েক করাঘাত করলেও দরজা খুলল না ইরহা। ক্ষান্ত হয়ে শাশুড়ির রুমের দিকে গেল সে। শরীফ আশরাফ ফোনে কথা বলছেন। শশী আর আমেনা নিজেদের মধ্যে কূট কাচালি নিয়ে ব্যস্ত। রিনি মোবাইলে গেইম খেলছে। ইরজাকে দরজার কাছে দেখে উচ্ছলিত কণ্ঠে বলে উঠে—
“রাঙা বউ!”
শশী আর আমেনা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। তাকাতেই ইরজাকে দেখে কেমন অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল। ভ্রূকুঞ্চন করে বিরাগ দেখিয়ে শশী বলল—
“কী চাই?”
ইরজা বলল—
“রিনির মামা ফোন ধরছে না। উনি কোথায় গেছেন, আপনারা কী জানেন? বাইরের অবস্থা তো ভালো না।”
আমেনা মুখ ঝামটা মে রে বললেন—
“কেন, তোমার স্বামী কী আমাদের বলে যায় নাকি কোথায় যায়?”
“না, মানে…।”
কেমন উদ্ভট একটা অস্বস্তিতে মন খারাপ হয়ে গেল ইরজার। সে হতাশ হয়ে রুমে ফিরে গেল। সে যাওয়ার পর শরীফ আশরাফ আনমনেই ভ্রূ কুঁচকালেন। মোবাইল ফোন খানায় আলমিরের নাম্বার খুঁজে বের করে কল করলেন। রিং হচ্ছে না। চিন্তায় আবিষ্ট হয়ে গেলেন তিনি। ম্যানেজারকে কল করলেন। ম্যানেজার জানালো, আলমির অফিস ছেড়েছে সন্ধ্যার পরপরই। শরীফ বসে রইলেন। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠেছে।
মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে ইরজা। এখন তো কলও যাচ্ছে না। ইরজার কেমন কান্না পেয়ে গেল। এই বাড়িতে ওই মানুষটাকে নিয়ে ভাববার কেউ নেই? তাই বুঝি প্রিয়তার অভাব আজও মানুষটাকে পীড়া দেয়! তাই তো কথায় কথায়, আমার প্রিয়তা, আমার প্রিয়তা বলে। ইরজার আচমকা কী যেন হলো। সে সত্যিই সত্যিই কেঁদে ফেলল। ঠিক তখনই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল উচ্চ শব্দে। স্ক্রিনে আলমিরের নাম্বার দেখা যাচ্ছে। ইরজা চট জলদি কল রিসিভ করে বলল—
“হ্যালো, কোথায় আপনি?”
আলমির নিরুদ্বেগ গলায় প্রত্যুত্তরে বলল—
“আমি ঠিক আছি। চার্জ শেষ হয়ে গেছিল মোবাইলের।”
“তার আগেই কল করেছিলাম।”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
ইরজার রাগ উঠে গেল। ক্রোধের চোটে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। চেঁচিয়ে বলল—
“কী এমন ব্যস্ত ছিলেন আপনি? বাড়িতে কেউ চিন্তা করছে সেই খেয়াল নেই আপনার? বাইরের অবস্থা দেখেছেন? কী ভাবেন নিজেকে?”
আলমির ও প্রান্ত থেকে হেসে ফেলল। পরম মায়া জড়ানো কণ্ঠে বলল—
“আমার জন্য চিন্তা হয় কারো?”
ইরজার রাগ আরও বেড়ে গেল। খেমটি মে রে বলল—
“ফাজলামো করেন?”
আলমির একটু চুপ থেকে অত্যন্ত ভারী সুরে বলে—
“কথামালা,
তোমার দুঃশ্চিন্তার প্রদীপ, আমার নিরন্তর জীবনের শিখা।”
“একদম ছন্দ আওড়াবেন না। কী ভেবেছেন আপনি? এসব বললেই আমি সব ভুলে যাব? ভাবেন কী আপনি? কতবার ফোন করলাম, একবারও রিসিভ করলেন না। ফোন বন্ধও করে ফেললেন। আবার জিজ্ঞেস করছেন চিন্তা হয় কি না? কেন, শুধু প্রিয়তাই আপনার জন্য চিন্তা করে, আর কেউ করে না? এজন্যই শুধু আমার প্রিয়তা, আমার প্রিয়তা বলেন। সব চিন্তা যখন প্রিয়তারই তাহলে আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?”
“রাগ করেছ কথামালা?”
“আপনি আমার সাথে কথাই বলবেন না।”
ঝাড়ি দিয়ে কথা বললেও, ইরজার গলার স্বর যে কেঁপে যাচ্ছে তা খুব করে বুঝতে পারল আলমির। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে সেখানে বসে পড়ল ইরজা। রাগ, অভিমান আর ক্ষোভের মিশ্রণে তার আঁখিদ্বয় থেকে তরতর করে স্বচ্ছ জলের ধারা বইতে লাগল। এই প্রথমবার কোনো পুরুষের জন্য কাঁদল ইরজা। শেষবার যখন সে পালিয়ে গিয়েছিল এক কাপুরুষের সাথে, তখনও সে কাঁদেনি। শুধু নিজের ওপর চরম অভিমানে একমাস কারো সামনেই যায়নি। কথা বলেনি। তবে আজ, ওই বেখেয়ালি পুরুষটার জন্য তার হৃদয়পুরে অনল জ্বলছে। পুড়ছে সব। ঝলসে যাচ্ছে সব। কী যন্ত্রণা !
,
,
,
আলমির ফিরল রাত দশটা নাগাদ। বাড়ির সবার তখন খাওয়া শেষ। রিনি ঘুমিয়ে পড়েছে। মা, মেয়ের গুজুর গুজুর চলছে। শরীফ আশরাফ আজকাল খুব দুর্বলতা বোধ করছেন। অফিসে যাচ্ছেন না কিছুদিন ধরে। তবে, ছোটো ছেলে কিছু একটা নিয়ে খুব পীড়াতে তা ঠিক ঠাওর করতে পেলেন তিনি।
পা গুটিয়ে, হাত পা ভেঙে বাবুদের মতো গোল হয়ে শুয়ে আছে ইরজা। চোখ জুড়ে গভীর ঘুম। আলমিরের জন্য সদর দরজা খুলেছে সোলায়মান। ছেলেটা সকলের পরে ঘুমায়। বাড়ির সবার প্রয়োজন শেষ হলেই বিছানায় পিঠ লাগায় সে।
আলমির রুমে ঢুকতে গেলে দেখল দরজা ভেতর থেকে লাগানো। একটু চমকে গেল সে। পরক্ষণে স্ত্রীর রাগের কথা মাথায় আসতেই সহজ হলো । দরজায় আলতো হাতে চাপড় বসাল। কোনো শব্দ এলো না ভেতর থেকে। আলমির মোবাইল ফোন বের করে কল করল ইরজাকে। বালিশের তলায় থাকা ফোনের রিংটন ইরজার কর্ণকুহরে পৌঁছাল না। আলমির বেশ কয়েকবার কল করল। কিন্তু কাজ হলো না। কিছু একটা ভেবে আর করাঘাত করল না। দোতালায় চারটা বেডরুম। সিঁড়ি থেকে উঠতেই একপাশে ডাইনিং স্পেস অন্যপাশে কিছুটা জায়গা পেরিয়ে গিয়ে রান্নাঘর। রান্নাঘরের পাশে সরু করিডোর। সেখান থেকে একটা বারান্দা। থাই লাগানো বারান্দার ভেতরের দিকে রান্নাঘরের দেয়ালের দিকটায় একটা ডিভান পাতা। সেখানেই বসে পড়ল আলমির। সোলায়মান নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল একপাশে। নিম্ন স্বরে প্রশ্ন করল—
“খাবেন না স্যার?”
আলমিরের মুখবিবরে ক্লান্তির ছাপ। বিষণ্ণ আঁখিদ্বয়। মলিন সুরে বলল—
“তোর ম্যাডাম খেয়েছে?”
“না।”
“বাকিরা? আহিল বাড়িতে আছে?”
“সবাই খেয়েছে। আহিল স্যার বাড়িতেই আছেন। ”
“তুই খেয়েছিস?”
“জি।”
“তাহলে শুয়ে পড়। বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে যাস। আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না।”
সোলায়মান চলে যাওয়ার সময় একটা বাতি ছাড়া বাকি সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে যায়। আঁধারের মহলে আবছা আলোয় ডাইনিং টেবিলটা দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে শরীফ আশরাফের কামরাও দেখা যায়। আলমিরের রুমের শেষ প্রান্তের দিক দিয়ে আরেকটা সরু করিডোর ভেতরের দিকে। সেইদিকে দুটো রুম। একটা আহিলের। অন্যটায় শশী এলে থাকে।
আলমির ব্লেজারটা খুলে হাতের ভাঁজে নিল। পা উঠিয়ে শুয়ে পড়ল সটান হয়ে। মাথা ঝিমঝিম করছে। ঘুম আসবে। গভীর ঘুম!
,
,
,
ভোরের আলোয় আলোকিত পৃথিবী। ধরণী জপতে শুরু করল দিবসের গান। নামাজ শেষে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে ইরহা। গন্তব্য রান্নাঘর। তবে পথেই থেমে যায় সে। আলমিরকে চোখে পড়ল তার। বেচারা বুকে হাত ভাঁজ করে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। ডিভানের হাতলে পা উঠানো। ব্লেজারটা এখনো বুকের ওপর। ইরহা একটু এগিয়ে এসে রুমের দরজার দিকে তাকাল। ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে গেল। দরজার পাটাতনে ধাক্কা দিতেই বুঝল, ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া। নাক কুঁচকে এলো ইরহার।
সে ডিভানের কাছে এসে ডাকল—
“ভাইয়া! ভাইয়া!”
আলমিরের চোখ ছুটে গেল। অকস্মাৎ ইরহাকে দেখে কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে পা নামিয়ে উঠে বসল। ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ কচলে বলল—
“তুমি উঠলে কেন?”
“সকাল হয়েছে।”
আলমির এদিক ওদিক তাকাল। বারান্দা থেকে আলো আসছে। আলমির বলল—
“কাজ করতে করতে ঘুম চলে এসেছিল।”
আলমিরের দৃষ্টি নত। কেমন চোরা চোরা চাহনি। ইরহা বলল—
“মিথ্যে বলবেন না ভাইয়া। আপনি মিথ্যে বলতে পারেন না।”
আলমির মুখ ভরতি শ্বাস ফেলল। বলল—
“তোমার বোন ঘুমিয়ে পড়েছিল। নক করলাম। শুনল না। হয়তো ক্লান্ত ছিল। তাই আর ডাকিনি। ”
আলমির উঠল। দরজার কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে ঠক ঠক আওয়াজ তুলল। এক সময় দরজা খুলল। কোনো কথা না বলেই আলমির ভেতরে ঢুকে পড়ল। ইরহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রান্নাঘরের দিকে যেতে নিতেই দেখল, নিচ থেকে সোলায়মান উঠে আসছে।
,
,
,
আলমির কোনো কথাই বলল না। ব্লেজার নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে তোয়ালে আর জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। ইরজা খুবই বিব্রত। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সকাল হয়ে গেছে। আলমির কী এখন বাড়ি ফিরেছে? যদি ফিরে, তাহলে সারা রাত কোথায় ছিল? আর যদি রাতে ফিরে তাহলে? মোবাইল ফোনটা খুঁজল ইরজাহ পেয়েও গেল। আলমিরের মিসড কলগুলো চোখে ভাসল তার। ইশ!
শাওয়ার শেষে বের হলো আলমির। ইরজার মুখশ্রীতে অপরাধবোধ। ব্রীড়াময় চাহনি। তোয়ালে বারান্দায় মেলে দিয়ে ভেতরে এলো আলমির। তার চুল এলোমেলো। পাতলা টিশার্ট পরা। বিছানায় বসল। ইরজা থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ও হচ্ছে। আলমির মাথা তুলল। অত্যন্ত শীতল গলায় বলল—
“রাতে খাওনি কেন?”
ইরজা অবাক হলো। কী জবাব দিবে ভেবে পেল না। পাল্টা প্রশ্ন করল—
“কোথায় ছিলেন আপনি?”
“একটা সাইট ভিজিটে গেছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।”
“কাল যাওয়া কী খুব দরকার ছিল? আকাশের অবস্থা তো ভালো ছিল না।”
আলমির আর জবাব দিলো না সেই প্রশ্নের। উলটো বলল—
“আমার খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করো।”
যারপরনাই অবাক হলো ইরজা। এই লোক এত স্বাভাবিক থাকে কী করে?
চলবে,,,