#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১৪
লেখনীতে:আইশা তানভি
খাবার গলায় বিঁধে যাওয়ায় হঠাৎ কেঁশে উঠল আলমির। তাকে দ্রুত হাতে পানি এগিয়ে দিলো ইরজা। পানি নিয়ে চুমুক দিলো আলমির। আনমনেই ইরজার হাত আলমিরের মাথার তালুতে চলে গেল। খুব যতনে আলতো হাতে ছোটো ছোটো চাটা বসাল সে। ইরজার এই কাণ্ডে হতবাক হয়ে গেল সবাই। বিস্ময়াভূত আলমির গ্লাসে অধর ছুঁইয়ে রেখেই চোখ উলটিয়ে পাশে দাঁড়ানো ইরজার দিকে চাইল। ইরহা খোঁচা মার ল ইরজাকে সকলের অগোচরে। উপস্থিত চোখগুলোর এহেন দৃষ্টিতে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো ইরজা। হাত সরিয়ে নিলো পলকেই। নিজের কাজে নিজেই বোকা বনে গেল।
তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসল আহিল। শরীফ আশরাফ নাক কুঁচকে কটাক্ষপূর্ণ চোখে তাকালেন। ঠোঁট বাঁকালেন আমেনা। শশীরও বিরক্তি ছোড়া চাহনি। ফিক করে হেসে ফেলল রিনি। আলমির চোখ নামিয়ে খাওয়ায় অভিনিবেশ করল। আমেনা আশরাফের ক্ষোভ বাড়ল। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল—
“আদিখ্যেতা !”
ইরজা চোখের কোটর ক্ষুদ্র করে চাইল। নাকের পাল্লা ফুলিয়ে ফেলল। আলমির আচমকাই বলে উঠে—
“তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? খেতে বসো।”
ইরহা শাশুড়ির দিকে চাইল। আমেনার উত্তপ্ত দৃষ্টি। আর কিছু বলার আগ্রহ মেয়েটার হলো না। সে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইরজা অবশ্য সময় নিলো না। সে চেয়ার টেনে টুপ করে বসে পড়ল। পরোটা, ডিম ভাজা, আর জুসের গ্লাস টেনে নিয়ে আরাম করে বসল। মাথায় অবশ্য বড়ো করে ঘোমটা টানা। ঘোমটায় মেয়েটাকে আরও মায়াবী লাগে!
আলমির ওষ্ঠে হাসি মাখল। পরোটা ছিড়ে মুখে পুরতে গেল ইরজা। অমনি দাঁপিয়ে উঠলেন আমেনা।
“বসে পড়লে যে?”
“খাবো তাই।”
“ভুলে যাওয়ার বাতিক আছে তোমার?”
“না। তবে আপনার বোধহয় না শোনার বাতিক আছে।”
“কী বলতে চাও তুমি?”
“আপনার ছেলে বসতে বলেছে, শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
“তর্ক করো না।”
আলমির মুখ খুলল।
“খাবার নিয়ে এত বাড়াবাড়ি না করলেই নয়। আমাদের যেমন খিদে লাগে ওদেরও তো লাগে। বরঞ্চ বেশি লাগে। ওর কথা না হয় বাদই দিলাম। ইরহা তো সবার আগে ওঠে। মেয়েটা প্রতিদিন এত কষ্ট করে রান্না করে। কই, একদিনও তো ওকে জিজ্ঞেস করেননি, তোমার খিদে পেয়েছে? যেখানে আপনাদের ঘুম থেকে উঠতেই খিদেয় মরমর অবস্থা হয়।”
“এটা এ বাড়ির নিয়ম।”
“নিয়ম মানুষের উর্ধ্বে নয়। মানুষের জন্য তৈরি নিয়ম। নিয়মে জন্য মানুষ নয়। আজ থেকে ওরা আমাদের সাথেই খেতে বসবে।”
“বউয়ের জন্য তোর অনেক দরদ দেখছি!”
শশীর কথায় ছোট্ট করে প্রশ্রয়ের হাসি হাসল আলমির। বলল—
“একটাই তো বউ, দরদ থাকবে না?”
“লজ্জা করছে না তোর? সবাই আছে এখানে।”
“আমি তো বলিনি কেউ নেই। তুই তো বললি, বউয়ের জন্য দরদের কথা। বউ না হয় দু’দিন আগে এসেছে। তোকে ফেলে কখনো খেয়েছি আমরা? সেই তুই যদি শশুরবাড়ি গিয়ে ও বাড়ির সবার পরে তোকে খেতে হয়, তখন সেটা তোর কেমন লাগবে?খিদে পেটে বসে থাকতে পারবি?”
“আমার সাথে তুলনা করছিস ওর?”
“ও আর তুই সমান কই? ও তো বউ ম রা এক বয়সে বড়ো পুরুষকে বিয়ে করে সংসার করছে। আর তুই….। রিনি এখানে, তাই কিছু বললাম না।”
“মুখে লাগাম লাগা আলমির। একটা মেয়ের জন্য পরিবারের সবার বিপক্ষে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস?”
শরীফ আশরাফ প্রশস্ত গলায় ছেলেকে ধমকে উঠলেন।
“একটা মেয়ে…. হ্যাঁ, একটা মেয়েই। যে তোমাদের কাছে শুধু একটা মেয়ে সে কারো স্নেহের বোন, কারো আদরের মেয়ে, কারো প্রিয় স্ত্রী। তোমাদের কাছে সে মাত্র শুধু হলেও, কারো কারো কাছে অনেক কিছু।”
“বাহ্, ভাইয়া! বাহ্! তোমার ডায়লগ ডেলিভারি শুনে তো মনে হচ্ছে তোমাকে স্ক্রিপরাইটার হওয়া উচিত।”
আহিলের উপহাসে ছোড়া বাক্যে আলমির দুর্বোধ্য হেসে বলল—
“চান্স পেলে অবশ্য করাই যায়। আমার জীবনটাই তো মুভি। ক্লাইমেক্স বাকি শুধু।”
সবার কথার এই তীর্যক জবাবে সকলের মাঝে গূঢ় ক্ষোভের তৈরি হলো। কিন্তু ইরজার বুকের মাঝে কী এক প্রশান্তির সুশীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে, তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না। আজকের সকাল, খুব মিষ্টি একটা সকাল! আলমির তার হয়ে বলেছে। এটা ভাবতেই প্রজাপতিরা উড়তে লাগল মনের কোণে।
,
,
,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা পান করছে আলমির। গ্রিলের ওপর হাত রেখে ঝুঁকে আছে। পেছনে এসে দাঁড়াল ইরজা।
“অফিসে যাবেন না?”
“না।”
শক্ত কণ্ঠে জবাব এলো। ইরজা অবশ্য একটু ঘাবড়ালোও। আবার প্রশ্ন করবে কি না ভাবতে লাগল। কিন্তু তার ভাবনার পূর্বেই আলমির পেছন ফিরে বলল—
“রেডি হও। আমরা বাইরে যাব।”
“কোথায়?”
“গেলেই দেখতে পাবে।”
ইরজা আর কিছু জানতে চাইল না। মন খুশিতে ঢগমগ করে উঠল। হাওয়ায় ভাসতে লাগল সে। কাবার্ড খুলে কী পরবে খুঁজতে লাগল। আলমির রুমে এসে দেখল, তখনও কাবার্ড হাতাচ্ছে ইরজা। সে জিজ্ঞেস করল—
“কী খুঁজছ?”
ইরজা বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল–
“কী পরব বুঝতেই পারছি না। আপনি বলুন না।”
আলমির খুশি মনে এগিয়ে এলো। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো শাড়ি থেকে একটা নীল রঙের জামদানি বের করে দিলো। ইরজার পছন্দ হলো। সে আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলল—
“এটার সাথে কী পরব? মানে ভারী গহনা নাকি…?”
“আমরা কোনো বিয়েতে যাচ্ছি না কথামালা। কোনো ফাংশনও নয়। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে দুঃখের ছায়ায় সুখেরা ঘুরে বেড়ায়। আমরা সেই সুখ দেখতে যাব। তুমি যাবে তো আমার সাথে?”
ইরজার কী যেন হলো। সে কথাই বলতে পারল না। শুধু কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল—
“হু।”
আলমির যখন রুম থেকে বের হতে যাবে তখন পেছন ফিরে বলল—
“চুল খোলা রেখে। তোমায় ভালো লাগে।”
বসন্তের ভোরের আবছা কুয়াশার মতো এক স্নিগ্ধ পরশে ভিজতে লাগল ইরজা! মায়াময় এই ক্ষণ তার কাছে অতীব প্রার্থিত হয়ে উঠল আচমকাই! কী এক অদ্ভুত, অঘোষিত, হৃদয় শিহরিত ভালো লাগায় বিবশ হয়ে গেল সে!
,
,
,
আলমিরের সামনে বসা আহিল বেজায় ক্ষিপ্ত। একটা ডিল নিয়ে দুই ভাইয়ের কথা কাটাকাটি। সেই প্রজেক্ট একাই সামলাতে চায় আহিল। কিন্তু আলমির পুরো দায়িত্ব আহিলের ওপর ন্যস্ত করতে চায় না। আহিল বলল—
“প্রজেক্ট আমার নামে সাইন হবে। যদি তা না হয়, তাহলে আই কোয়াইট।”
“কেন, কোম্পানির প্রতি কী তোর কোনো দায়িত্ব নেই?”
“অবশ্যই আছে। আমার দায়িত্ব প্রুভ করার স্পেস তো আমাকে দিচ্ছ না।”
“জিহান অভিজ্ঞ। তোর হেল্প হবে।”
“আই ডোন্ট ওয়ান্ট। আমি একাই পারব। আর ওকে যদি নিতেই হয়, ওকে আমার আন্ডারে কাজ করতে হবে।”
“অসম্ভব। এর আগেও তোর ভুল ডিসিশনে কোম্পানির অনেক বড়ো লস হয়েছে।”
“বারবার এক কথা বলবে না ভাইয়া।”
“আলবৎ বলব। ভুল থেকে তোর শিক্ষা হয়নি।”
“ভুলে যেয়োনা ওই কোম্পানি আমারও।”
“সেভেনটি ফাইভ পার্সেন্টের মালিক আমি।”
আহিলের ক্ষোভ তার সীমা ছাড়াল। তেড়ে উঠে বলল—
‘জাস্ট স্টপ ইট। এই কোম্পানির শেয়ার ফিফটি ফিফটিই হবে।”
“কোনোদিনও সম্ভব নয়। বাবার ফিফটি পার্সেন্ট আমাদের দুই ভাইয়ের। সেটা উনি না দিয়ে পারবেন না। আইন মানবে না। তার ওপর উনি চাইলেই এই শেয়ারে শশীকেও হক দিতে পারেন। তাতে করে তোর শেয়ার আরও কমবে।”
“শশী! হোয়াই? ও আমাদের আপন বোন নয়।”
“এটাও বাবার ইচ্ছে।”
“সম্পত্তির জন্য এখন আমাকেও পর করে দিচ্ছিস?”
শশী আড়াল থেকে দুই ভাইয়ের কথা শুনে ফেলেছে। আহিলের বক্তব্যে মনে দুঃখ পেল সে। কাঁদো কাঁদো স্বরে আহিলকে প্রশ্ন করল। বেচারা আহিল সরাসরি এই প্রশ্নে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। শশী কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে দৌড়ে গেল। আহিল নাক পাটা ফুলিয়ে ফেলল। খু ন করে ফেলার মতো রাগ হচ্ছে তার। তার মা বোনের প্রতি ওভার পজেসিভ। তবে শশীর প্রতি বাবার অতিরিক্ত মহাব্বতের কারণ আজ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারল না আহিল। কেন অন্যের মেয়েকে এত মায়া?
চলবে,,,