#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১৫
লেখনীতে:আইশা তানভি
কেঁদে কে টে একাকার শশী। মায়ের কোলে উবু হয়ে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে সে। আমেনা আশরাফ মেয়ের ক্রন্দনের হেতু জানতে পেরে বেজায় নাখুশ হলেন। ছেলেকে প্রশ্ন করার জন্য মন তৈরি করলেন। শরীফ আশরাফ উৎকণ্ঠিত এমতাবস্থায়। তিনি গম্ভীর চিত্তে আজ অফিস যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
,
,
,
আলমির গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট জুড়ে মিষ্টি একটা হাসির ঝলক দেখা যাচ্ছে ইরজার। নীল রঙা জামদানির পরেছে সে। সাথে হালকা ধরনের গহনা । খোলা চুলগুলোর খানিকটা অংশ একপাশে সামনের দিকে ফেলে রাখা। আলমির ছোট্ট করে হেসে ইরজাকে গাড়িতে ওঠার জন্য আহ্বান করল। ঠিক ওই সময় গম্ভীর মুখে এসে দাঁড়ালেন শরীফ আশরাফ। তিনি মুখে কাঠিন্যতা ঝুলিয়ে বললেন—
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“একটু বাইরে যাচ্ছি। ”
“এখন কী ঘোরার সময়? অফিসে ঝামেলা চলছে।”
“আহিল আছে। বেশি ঝামেলা হলে আমাকে জানাতে বলবেন।”
“সব ঝামেলা ফোনে সামাল দেওয়া সম্ভব?”
“দরকার পড়লে চলে আসব।”
আলমির ইরজাকে ইশারা করল গাড়িতে ওঠার জন্য। শরীফ বললেন—
“গাড়িটা আমার লাগবে।”
“আরেকটা তো আছে।”
“ওটা নিয়ে আহিল বেরিয়ে গেছে।”
বাবার সাথে আর তর্ক করল না আলমির। ইরজাকে বলল—
“এসো আমার সাথে।”
দরজা লাগিয়ে গাড়ির কাছ থেকে সরে এলো আলমির। তারা যখন গেইট পার হচ্ছিল, শরীফ আশরাফের মেজাজ ক্রমশ তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছিল। সেই তেতে ওঠা মেজাজে কী এক অদৃশ্য ভয় আচমকা তাকে ছুঁয়ে গেল। প্রিয়তা নামক এক লাস্যময়ীর করুণ আর্তনাদের সেই মুখশ্রী ভেসে উঠল শরীফের চক্ষু দর্পণে।
,
,
,
রাস্তায় নামতেই কেমন যেন ইতস্তত বোধ করছে ইরজা। পাশাপাশি, কাছাকাছি হেঁটেও যেন হৃদয় থেকে তারা বহু দূরে। ইরজা সহজ গলায় প্রশ্ন করল–
“কোথায় যাচ্ছি?”
“কোথাও। আমার সাথে যেতে আপত্তি আছে?”
“মোটেই না।”
হাসি মুখে জবাব দিলো ইরজা। খোলা চুলের এলোমেলো ভঙ্গি, চোখের পাল্লায় দীপ্ত খুশি, ঠোঁটের ভাঁজে মন কেমন করা হাসিতে এক মায়াবী মুখবিবরের ওই জলন্ত অনুরক্তিতে আসক্ত হতে ইচ্ছে হলো আলমিরের। সংগোপনে বক্ষ পাঁজরের অভ্যন্তরে লুকায়িত অনুভূতি তাকে কড়া নাড়ছিল। হেলেদুলে, হেসে হেসে পথ চলছে ইরজা। কখনো আলগোছে, কখনো অসাবধানতায় আঙুলে আঙুলের ছোঁয়াতে কেঁপে উঠছে মনের দুয়ার। কী লজ্জা! কী লজ্জা !
ইরজার এই আসক্তি লুকোয় না পুরুষটি থেকে। এক প্রগাঢ় ভালোবাসার ভেজা অনুভূতিতে মনটা অবগাহন করল আনমনেই। আচমকা ইরজা থেমে গেল। আলমির চমকে তাকাল পেছনে। জিজ্ঞেস করল—
“থেমে গেলে যে? হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”
“হচ্ছে।”
“আরেকটু। সামনেই গাড়ি আছে।”
“উহুহ এখনই।”
আলমির আশেপাশে তাকাল। কোনো গাড়ি দেখতে পেল না সে। ঈষৎ চিন্তাগ্রস্ত দৃষ্টি। ইরজা নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল—
“উপায় বলব?”
আলমির ফিকে হেসে বলল—
“বলো।”
“হাতটা ধরি? হাঁটতে কষ্ট হবে না তাহলে।”
আলমির অমায়িক ভঙ্গিতে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল—
“ধরো।”
ইরজা খুশিতে লাফিয়ে ওঠার ভঙ্গিতে এগিয়ে আলমিরের হাত চেপে ধরল। কী হলো কে জানে! ইরজার সারা অঙ্গ এক লহমায় কম্পিত হলো। অনুরণন শুরু হলো ওষ্ঠে। অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে আবিষ্ট হয়ে গেল। ইরজা থমকে রইল। তার পা দুটো আর চলছে না। আলমির খুব যতনে ইরজার হাত ধরল। গাঢ় মায়া নিয়ে বলল—
“চলো। আজ প্রাইভেট কার নয়। তোমায় নিয়ে হাঁটব আর লোকাল গাড়িয়ে চড়ব। আপত্তি নেই তো?”
“উহু।”
না বোধক মাথা নাড়াল ইরজা। তারা হাঁটছে। ইরজার হাত করতলে চেপে হেঁটে যাচ্ছে আলমির। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কিছু মানুষের মুগ্ধ চোখ তাদের অনবরত দেখে চলছে।
কিছু দূর যাওয়ার পর রিক্সায় উঠল তারা। তারপর বাস। বাস গিয়ে থামল শহর থেকে কিছু দূরে একটি ছোট্ট গ্রামে। ইরজা নামল। তার চোখে অফুরন্ত বিস্ময়। শহর থেকে দূরে এই গ্রামে কেন?
দুপুর রোদ মাথায় নিয়ে প্রথমে রিক্সা পরে ধূলো ওড়া মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে আলমির আর ইরজা একটি বাড়িতে এসে পৌঁছাল। বাড়িটি ছোটো, তবে বেশ গোছানো আর মন ভালো করা পরিবেশ। চারপাশে টিনের বেড়া দেওয়া। দরজাটাও টিনের তৈরি। সেটি ঠেলে ভেতরে ঢুকল দুজন। ঢুকতেই একটা জামগাছ। পাশে আমগাছ। দুটো গাছের বিশাল ডালপালার দরুন উঠোন ভরা ছায়া। ছায়া মাড়িয়ে রোদের দেখা পেল দুজন। চৌচালা ঘর। ঘরের পাশে কলপাড়। কলপাড় থেকে পানির আওয়াজ আসছে, সাথে কারো কড়া কণ্ঠ—
“তাড়াতাড়ি কর। এতক্ষণ কী করছিলি? থাপড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দেবো।”
ইরজা কিঞ্চিৎ চমকে আলমিরের দিকে তাকাল। সে সহাস্য বদনে বলল—
“প্রিয়তার মা। ওর বোনকে বকছে। মেয়েটা কাজে একদম ফাঁকিবাজ !”
“আপনি আমাকে এখানে কেন এসেছেন?”
“মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হারিয়ে কী করে বেঁচে থাকে তা দেখাতে।”
“আপনাকে দেখেছি তো। আমার আর কাউকে দেখার নেই।”
“রাগ হচ্ছে আমার ওপর?”
“কেন?”
“এখানে এনেছি তাই।”
“হওয়া উচিত। কিন্তু হচ্ছে না।”
আলমির এবার সাথে সাথে কথা বলল না। সময় নিলো। বলল—
“কথামালা,
আমার জীবনের প্রথম প্রিয় নারী ছিল আমার মা। তারপর প্রিয়তা। তারা দুজনই আমাকে অপূর্ণ রেখে চলে গেল। তুমি হবে আমার পূর্ণতা? আমার প্রিয়ঙ্গনা?”
ইরজা তার রুদ্ধশ্বাসে নির্বাক চোখে অবশ হয়ে চেয়ে রইল আলমিরের ওই মুখ পানে। ধীর লয়ে চোখের পলক ফেলতে ফেলতে বলল—
“আপনি আমাকে দেবেন সেই সুযোগ?”
আলমির রোদের মতো হাসল। বলল—
“কথামালা,
আমার অন্তিম শ্বাস তোমার ওই নীল শাড়ির আঁচলে বিছিয়ে যাক।”
ইরজার ইচ্ছে হলো এই পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা ভুলে ঠিক এই রোদ চড়া নিষ্ঠুর দুপুরে আলমিরকে জড়িয়ে ধরতে। চিৎকার করে বলতে–“আমি হতে চাই আপনার একান্ত প্রিয়ঙ্গনা।”
কিন্তু ওই দুজন মুগ্ধ মানব-মানবীকে আচমকা ভড়কে দিয়ে সুলতানা বলে উঠল—
“আপনারা কারা?”
তারা দুজন ত্রস্ত চোখে তাকাল।
চলবে,,,