#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১৬
লেখনীতে:আইশা তানভি
আলমিরকে দেখে বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে বলে উঠে সুলতানা–
“ভাইয়া আপনি?”
আলমির খুব সহজভাবে বলল—
“কেমন আছ সুলতানা?”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন? মা দেখে যাও কে আসছে।”
সুলতানার কণ্ঠে আনন্দলহরী। কলপাড় থেকে তার মা সুমনা চেঁচিয়ে উঠে বললেন—
“কে আসছে?”
“দেখে যাও।”
সুলতানার তীব্র উচ্ছ্বাসে ভাসা দুই চোখ, ওই কণ্ঠ চিরে আসা স্ফুর্তি, দেহে খুশির তরঙ্গ ওঠা ভঙ্গিতে চমকিত হলো ইরজা। সুলতানা কাছে এলো। উচ্ছলিত কণ্ঠে বলল—
“কতদিন পরে আসলেন!”
আলমির হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলল —
“সময় পাইনি।”
সুমনা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে কলপাড় থেকে এলেন। বলতে লাগলেন—
“কে আসছে এই অবেলায়?”
“বড্ড অবেলায় চলে আসলাম আম্মা?”
আলমিরের কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্যে জমে বরফখণ্ড বনে গেলেন সুমনা। তার নিষ্কম্প, মায়া ঝরা, আবেগপূর্ণ দৃষ্টি। ওই দৃষ্টিতে অব্যাখ্যাতীত স্নেহের ছায়া।
“ভালো আছ বাপজান?”
“আমি ভালো আছি আম্মা।”
সুমনার চোখ ভিজে উঠেছে। আলমিরকে দেখলেই মেয়েটাকে তার ভীষণ মনে পড়ে। বুক জ্বালা করে। খা খা করে বক্ষ কোটর। কী এক শূন্যতায় অবশ হয়ে আসে দেহ! তিনি এগিয়ে এলেন। আলমির তাকে সালাম দিলো। ইরজাকে প্রথমে ততটা ঠাওর না করলেও আচমকা তার কণ্ঠে সুলতানা আর সুমনার তীক্ষ্ম চাহনি আঁকড়ে ধরল তাকে।
“আসসালামু আলাইকুম!”
সুমনা ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকালেন। ইরজার ফর্সা টকটকে রঙ রোদে ঝলসে উঠেছে। সুমনার হঠাৎ প্রিয়তাকে ঠাওর হলো। ইরজার মুখের আদল অনেকটা প্রিয়তার কাছাকাছি। গোলগাল মুখ। যেমন এক মায়ের পেটের দুই বোন হলে হয়। তবে, প্রিয়তার সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করার মতো নয়।
সফেদ গোলাপী ত্বকের মেয়েটির ছিল কোমর ছাড়ানো দীর্ঘ কেশ। সরু কালো ভ্রূ। যেন নিজে হাতে আঁকা। ওই ভ্রূ তলে চিত্রকরের নিঁখুত হাতে আঁকা দুটো চোখ। তলোয়ারের ন্যায় শাণিত নাসিকার পরে ওষ্ঠ ভাঁজ। গাঢ় গোলাপী রঙ। সচরাচর এমন হয় না। দেহের গড়নে মনে হবে, এক একটি অঙ্গ যেন কোনো শিল্পী তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে নিজ হাতে এঁকেছেন। ওই চোখের ব্রীড়াময় চাহনি কিংবা ওই ঠোঁটের হৃষিত হাসিতে কোনো পুরুষ হৃদয় এক পলকের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে যাবে! ঠিক এমনটা ছিল প্রিয়তা। তাই তো শত পুরুষের কুনজর থেকে মেয়েকে হেফাজতের জন্য মাত্র সতেরো বছরেই তাকে বিয়ে দিয়ে ছিল বাবা তমিজ উদ্দীন।
সুমনা কিছুটা মিইয়ে গলায় অবাক চোখে বললেন—
“ও..ও কে?”
“ও আমার স্ত্রী।”
“তুমি বিয়ে করছ?”
“জি।”
ইরজার কেন যেন মনে হলো এই প্রশ্নের উত্তরে সুমনা রেগে যাবেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কৃষ্ণ গহ্বর ফেড়ে আসা আ গুন ফুলকির মতো খুশির হলকা ছিটিয়ে বলে উঠেন —
“সত্যি? তুমি বিয়ে করছ?”
“জি।”
তিনি আত্মহারা গলায় চেঁচিয়ে ডাকলেন—
“প্রিয়তার বাপ, বাইরে আসেন। দেখেন কে আসছে। ”
তমিজ উদ্দীনের হঠাৎ করেই বুকের ব্যাথাটা বেড়ে ছিল। তাই দোকান বন্ধ করে বাড়িতে এসে শুয়ে আছেন। এই মুদি দোকানটাও আলমিরের গড়ে দেওয়া। প্রিয়তার মৃত্যুর পর গার্মেন্টসের সুপারভাইজারের চাকুরিটা ছেড়ে পরিবার সমেত গ্রামে চলে আসেন তিনি। স্ত্রীর অধৈর্য কণ্ঠে কোনোমতে বিছানা ছেড়ে বাইরে এলেন তমিজ। আলমিরকে দেখে তিনি আশ্চর্যচকিত। তবে ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট হাসিটা ফুটে উঠল। খুশির আমেজ নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন—
“বাপজান, ভালো আছ? অনেকদিন পর আসলা?”
“জি, আলহামদুলিল্লাহ্। আপনার শরীর কেমন?”
“ভালোই। এই একটু বুকে ব্যথা করছিল সকালে। তাই বাড়িত চলে আসলাম। আরে, তোমরা বাপজানরে এখানে দাঁড় করাইয়া রাখছ কেন?”
তমিজ উদ্দীন সহসা থমকে গেলেন। একটা মেয়ে আলমিরের সাথে। তিনিও কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন–
“ওকে তো চিনলাম না?”
সুমনা সগ্রাহে বললেন—
“ও আমাদের সুলতানার আরেক বোন।”
ঠিক এমন একটা জবাবের প্রত্যাশা ইরজা কস্মিনকালেও করেনি। আলমির খুশি হলো। এই মানুষগুলোর এই ভালোবাসা, এই স্নেহের ছায়াতল, এই আন্তরিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল প্রিয়তা। তাই তো প্রথম দেখাতেই আলমিরের হৃদয় কুঠিরে সংগোপনে জায়গা গড়েছিল মেয়েটি।
তমিজ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কী যে খুশি হলেন তিনি। গদগদ কণ্ঠে বললেন—
“সত্যি নাকি? আগে বলবানা!”
“আব্বা, আপনি এত ব্যস্ত হবেন না।”
আলমির কী সহজভাবেই না এই মানুষগুলোকে আপন করে নিয়েছে। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে ইরজা। তমিজ বললেন—
“কী বলো ব্যস্ত হবো না। আমার মা আর বাপ আসছে। আমি খুশি হবো না? আসো মা, আসো। তোমার চরণের ধূলায় আমার ঘর আনন্দে ভরে উঠুক।”
কী আদর, কী সম্মোধন! এ কেমন সম্পর্কের মায়াবী বেড়াজাল! এ জন্যই কী প্রিয়তাকে আজও ভুলতে পারেনি আলমির। যার পরিবার এত ভালোবাসায় ঘেরা, তাদের মেয়ে না জানি কেমন? ইরজার হঠাৎ করেই প্রিয়তাকে জানতে ইচ্ছে হলো। খুব। সে সিদ্ধান্ত নিলো, সে প্রিয়তাকে জানবে। প্রিয়তার মতো হতে চাইবে।
,
,
,
তমিজ উদ্দীন বাজারে গেলেন। দুপুর রোদে ঘাম ছুটে গেল তার। ফিরলেন ক্লান্ত হয়ে। বাজারের ব্যাগ থেকে একটা তিন কেজি ওজনের কাতলা মাছ বের করলেন সুমনা। তাদের সকলের চোখে আনন্দ। আধা কেজি গলদা চিংড়ি, দুই কেজি গরুর মাংস, একটা কচি লাউ, আর ফেরার পথে বন্ধুর রউফের বাড়ির বড়ো মোরগটা নিয়ে এলেন। এতগুলো বাজার দেখে আলমির বলল—
“এত বাজার কেন করলেন আপনি?”
“কেন করব না? আমার মা প্রথমবার আসছে। তাকে কেমনে আপ্যয়ন না করি? খবর দিয়ে আসলে তো আমি সকালেই বাজারে যেতাম। যাই হোক, রাতে থাকবা আজ। প্রিয়তার মা তোমার জন্য রাঁজহাস রাখছে। সকালে রাঁজহাসের মাংস দিয়া ছিটা রুটি হইব।”
“আব্বু, তুমি শশা আর টমেটো আনো নাই কেন? সালাদ করব কি দিয়ে?”
সুলতানা মন মরা কথায় তমিজ জিব কাটলেন। অস্থির হয়ে বললেন—
“আরে মা, ভুল হয়ে গেল। তুই চিন্তা করিস না। আমি এখুনি যাচ্ছি।”
আলমির বলল—
“কী বলেন আপনি? এখন আবার বাজারে যাবেন?”
“কিচ্ছু হইব না। আমি যাব আর আসব।”
ইরজা সবার মাঝখানে কথা বলতে অপ্রস্তুত বোধ করছিল। তারা সবাই দুপুরে খেলেও খাননি তমিজ উদ্দীন। লোকটা আবার বাজার যেতে চাইছে। তাহলে দুপুরের খাবার খাবেন কখন? সে ব্যস্ত স্বরে বলল—
“আপনি তো দুপুরে খাননি!”
“আমার পেট ভরা মা। তোমরা আসছ না, আমার দুই দিন না খেলেও চলবে।”
মানুষ কী করে এত আপন হয়। ইরজার কান্না পেয়ে যায়। তার মামা মামীও তাকে ভালোবাসে। কিন্তু অদেখা, রক্তের সম্পর্কবিহীন এই মানুষগুলোর এই নিঃস্বার্থ, প্রলোভনহীন, নিরুপদ্রূপ ভালোবাসার কী নাম দেবে সে?
চলবে,,,