#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১৮
লেখনীতে:আইশা তানভি
কলেজের গেট থেকে বের হলো প্রিয়তা। সাথে তার দুই বান্ধবী লামিয়া আর হেনা। গেটের কাছে ফুচকাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছেন। তিন বান্ধবী আনন্দ উচ্ছ্বাসে লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হেনা বলল—
“মামা, তিন প্লেট ফুচকা দিন তো।”
দুই বান্ধবী কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত হলেও, প্রিয়তার গায়ে কালো রঙের বোরখা। ফুচকাওয়ালা ফুচকা দিতেই তিন বান্ধবী হাত বাড়িয়ে নিলো। মুখের নেকাবটা খুলল প্রিয়তা। কৃঞ্চ গহ্বর থেকে যেন এক ফালি রূপোলি চাঁদ বেরিয়ে এসেছে! টকটকে ফর্সা রঙ প্রিয়তার। যেন টোকা দিলের রক্ত ক্ষরণ হবে! ঝকঝকে সাদা দাঁতের দূরন্ত হাসি!
আলমির বন্ধুদের নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। হাসির কলতানে তাকাতেই তার নরম দৃষ্টি জোড়াতে আ গুনের হলকা লাগল। ওই দৃষ্টি ঝলসে যায়। আর নড়ে না। স্থির হয়ে রয় প্রিয়তার মুখের ওপর। মেয়েটার হাসি যেন অতর্কিতে ছোড়া খঞ্জ র। বিঁধে গেল ঠিক হৃদয়ের মধ্যিখানে। ওই মুগ্ধ, মোহগ্রস্ত নজর আর সরে না। বন্ধুরা টিটকারি শুরু করল। হৃদয় হারালো আলমির।
কলেজ ছুটির পর বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল প্রিয়তা। কিছুদূর যেতেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো, কেউ পিছু নিয়েছে তার। প্রিয়তা থামল। পেছন ফিরতেই দেখল আলমিরকে। উহু, কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। আলমিরও থমথমে মুখে তাকিয়ে রইল। প্রিয়তা ঘুরে দাঁড়াল। মনে শঙ্কা দমিয়ে রেখে আবারও চলতে শুরু করল। কিন্তু মোড়ের ভেতর ঢুকতেই আবারও সেই একই অনুধাবন। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরতেই সেই মানুষটাকে আবার দেখল। প্রিয়তা এবার আর নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল। আলমির অল্প বিস্তর হেসে বলল—
“তুমি মঈন স্যারের কাছে পড়ো?”
“না।”
সোজাসাপ্টা উত্তর। আলমির আরেক পশলা হেসে প্রশ্ন ছুড়ল—
“তুমি কী স্বপ্না?”
“না। আপনি কে? আমাকে এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন?”
“ও সরি। আমি আসলে তোমাকে স্বপ্না ভেবেছিলাম। স্বপ্না আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। আজ আমার বন্ধু আসেনি। ও একটা জিনিস দিয়েছিল আমাকে। ওটা দিতে এসেছিলাম।”
“আমি স্বপ্না নই।”
“তোমার নাম কী?”
“আমার নাম দিয়ে আপনি কী করবেন?”
“কিছু না। আচ্ছা, আসি আমি।”
প্রিয়তা দাঁড়িয়ে রইল কৌতূহলী দৃষ্টিতে। আলমির আর পেছন ফিরে তাকাল না। এক প্রশান্তিময় খুশিতে তার বুক ভরে এসেছে।
,
,
,
রাতে পড়তে বসেছে প্রিয়তা। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। পা নাড়িয়ে যাচ্ছে হাওয়ার গতিতে। অকস্মাৎ তার মনে পড়ল কলেজ থেকে ফেরার সময়ের ছেলেটির কথা। হাতের কলমটি মুখে পুরে প্রিয়তা ভাবতে লাগল।
“আপা, কী ভাবো?”
সুলতানা বিছানায় এসে বসল। শোয়া থেকে উঠে বসল প্রিয়তা। প্রিয়তার চুলের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুর তুলল সুলতানা—
“ইশ! তোমার চুলের মতো যদি হতো আমার চুল!”
প্রিয়তা একগাল হেসে বলল—
“হবে, হবে।”
“ছাই হবে।”
“তুই পড়তে বসিস না কেন?”
চুরি করে ধরা খাওয়ার মতো মুখ করে ফেলল সুলতানা। বলল—
“আম্মু আলুর চপ বানাচ্ছে। খেয়ে পড়তে বসব। যাই আমি।”
“এই শোন….।”
সুলতানা দৌড়ে পালায়। প্রিয়তা মিষ্টি করে হাসে। তার দীঘল কালো চুল গড়াগড়ি খাচ্ছে বিছানায়।
—————
“আপনি এখানে কী করছেন?”
ত্রস্তে তাকায় ইরজা। টেবিলের ওপর থেকে খপ করে ডায়েরিটা নিয়ে লুকিয়ে ফেলল। টেবিলের ওপর ছোট্ট একটি ল্যাম্পশেড। সেই আলোতো না ঘুমিয়ে প্রিয়তার ডায়েরি পড়ছিল ইরজা। ও বাড়ি থেকে আসার সময় সুলতানা দিয়েছে তাকে। সে অবশ্য সুলতানাকে প্রশ্ন করেছিল–
“তুমি এটা আমাকে কেন দিচ্ছ?”
“আপার জায়গা এখন আপনি আছেন।”
“পড়েছ এটা?”
“না। আপা বলেছে, কারো ব্যক্তিগত জিনিস তাকে না বলে ধরতে নেই।”
“তাহলে আমাকে কেন দিচ্ছ?”
“আপা তার সব মনের কথা ডায়েরিতে লিখত। জানি ও বাড়িতে আপার সাথে কী হয়েছে। আদৌ অ্যাকসিডেন্ট নাকি অন্য কিছু। আমি জানি না এই ডায়রিতে কিছু লেখা আছে কি না।”
“পড়তে পারতে। তোমার ভাইয়াকে বলতে পারতে।”
“পারতাম। কিন্তু যে কথা আপা কখনো ভাইয়াকে বলেনি, তা বলা উচিত মনে করিনি। আপনি পড়ুন। আমার আপা খুশি হবে।”
ইরজা ডায়েরিটা নিয়ে এলো তাই। বাড়ি ফেরার পর থেকে কী এক উৎকণ্ঠায় তার সারাদিন কাটল। রাতে আলমির ঘুমানোর পর সুযোগ বুঝে ডায়রিটা বের করে টেবিলে রেখে পড়তে লাগল।
আলমিরের প্রশ্নে কিছুটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল ইরজা। আমতা আমতা করে বলল—
“ও…আসলে ঘুম আসছিল না…তাই…একটু….বই পড়ছিলাম।”
“রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
“জি।”
ইরজা কোনোমতে ডায়েরিটা আলমিরের চোখ থেকে আড়াল রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আলমির তাকে আর কোনো প্রশ্ন করল না। সেও গিয়ে শুয়ে পড়ল।
,
,
,
ভোরের আলো ফুটেছে। প্রভাকর ধীরগতিতে উদিত হচ্ছে। ঘুম ভেঙ্গে গেল ইরজার। তার ঘুম ভালো হয়নি আজ। আলমির আর প্রিয়তা রাতভোর তার মস্তিষ্কে দৌড়ে বেরিয়েছে।
রান্নাঘরে ইরহাকে সাহায্য করছে ইরজা। নাশতায় আজ রিনির জন্য নুডলস করেছে ইরজা। ইরহা রুটি আর হালুয়া তৈরি করেছে। কিছু ফল কেটে নিয়েছে। টেবিলে খাবার দিয়ে ইরহাকে জিজ্ঞেস করল ইরজা—-
“আপু, তুমি ঠিক আছ?”
“কেন?”
“এমন লাগছে কেন?”
“কয়েকদিন ধরে শরীরটা খারাপ লাগছে। সকালে উঠলেই দুর্বল লাগে।”
“এক কাজ করো, তুমি খেয়ে রেস্ট নাও। দুপরের রান্না আমি করব।”
“আরে কিছু হবে না আমার।”
“জেদ করো না তো।”
বোনের মলিন মুখ দেখে তার অসুস্থতা ধরতে পারল ইরজা। বাড়ির সবাই নাশতা সেরে নিলো। অফিসের কথা বলে কোথাও চলে গেল আহিল। শরীফ আশরাফও বেরিয়ে গেলেন। আলমির যাওয়ার সময় ইরজাকে রান্নাঘরে দেখতে পেল। ইরহার কথা বলতেই জানাল তার অসুস্থতার কথা। আলমির চলে যায়। মা,মেয়ে ভীষণ অবাক। আজ ইরজা এত শান্ত কেন? ইরহার অসুস্থতার কথা শুনে দুজন তক্কে তক্কে রইল। ইরজা কোনো ভুল করলে তাকে ভালো করে ধরবে। হলোও তাই। প্রিয়তার কথা ভাবতে ভাবতে তরকারি পুড়িয়ে ফেলল মেয়েটি। আমেনা চেঁচামেচি করলেও আজ কোনো জবাব দেয়নি ইরজা। নিজের ভুল শুধরে সমস্ত কাজ শেষ করল। দুপুরে কোনো পুরুষ এলো বাড়িতে। তাই আমেনা, শশী আর রিনিকে খাইয়ে বোনের জন্য খাবার নিয়ে গেল তার রুমে ইরজা। সবার খাওয়া শেষ হলো। রুমে এসে আবারও ডায়েরিটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। নাওয়া খাওয়া ভুলে ডুব দিলো ডায়েরির পাতায়।
,
,
,
প্রিয়তা দাঁড়াল। তাকে স্যার পড়া ধরেছে। আলমির যাচ্ছিল করিডোর দিয়ে। নিচতলায় ক্লাস রুম। জানালা দিয়ে হঠাৎ চোখ গিয়ে পড়ল দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির ওপর। আলমির থমকে গেল। সে দাঁড়িয়েই রইল।
ক্লাস শেষ। ব্রেক আওয়ার। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা বাইরে বেরিয়ে মাঠে হাঁটছে। প্রিয়তা বসে রয়েছে। তার নেকাব তুলে রাখা। পানি খাওয়ার জন্য খুলেছে। পানির বোতল টেনে নিতেই আলমিরকে ঢুকতে দেখল সে। চটজলদি মুখ ঢেকে ফেলল। আলমির পেছনের দিকে তাকাল। প্রিয়তার আশে পাশে তেমন কেউ নেই। আলমির বলল—
“তোমার নাম প্রিয়তা?”
“আপনাকে কে বলেছে?”
“তোমার বান্ধবীরা ডেকেছে তখন শুনলাম।”
“তো?”
আলমিরএকটা কাগজ প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিলো। মেয়েটার চোখে উৎসুকতা, ভয়, অস্থিরতা। আলমির চলে যেতেই প্রিয়তার বান্ধবীরা ঢুকল। ত্রসনে প্রকম্পিত দেহে কাগজটি খুবলে নিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলল প্রিয়তা। আতঙ্কিত চোখ জোড়াতে সে আলমিরের চলে যাওয়া দেখছে। হেনা জিজ্ঞেস করল—
“ছেলেটা কে রে?”
“জানি না।”
“কেন এসেছে?”
“মঈন স্যারের কাছে পড়ি কি না জিজ্ঞেস করল।”
প্রিয়তার সারা দেহ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরল প্রিয়তা। আজ আর আলমির তার পিছু নিলো না। নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে গোসল সেরে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমালো প্রিয়তা। উঠল সে বিকেলে। মা’কে ঘরের কাজে সাহায্য করতে করতে মাগরিবের আযান পড়ল। নামাজ শেষে পড়তে বসল সে। ব্যাগের ভেতর থেকে বই বের করতে গিয়ে সেই কাগজের কথা মনে পড়ল। হন্যে হয়ে সেটি খুঁজে বের করে খুলল প্রিয়তা।
প্রিয় প্রিয়তা,
কালকের জন্য সরি। মিথ্যে বলেছি আমি। আমার নাম আলমির। মাস্টার্সের পরিক্ষার্থী। ভয় পেয়োছ নিশ্চয়ই। তোমার চোখ বলছিল। নাম্বার দিলাম। আমি অপেক্ষায় থাকব।
018********
চলবে,,,