#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:১৯
লেখনীতে:আইশা তানভি
সায়াহ্নের আঁধার নেমেছে। মাগরিবের আযান পরেছে মসজিদে মসজিদে। উপুর হয়ে ঘুমিয়ে আছে ইরজা। ডায়েরির পাতায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সান্ধ্যকালীন নাশতার আয়োজনের জন্য রুম থেকে বেরিয়ে এলো ইরহা। ইরজার সাড়া শব্দ না পেয়ে তার রুমের দিকে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। ইরজা ঘুমিয়ে আছে। ইরহা নিঃশব্দে এসে শায়িত ইরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ডাকল—
“ইরজা, এই ইরজা। ওঠ, কিরে, সন্ধ্যা হয়েছে তো?”
ইরজা নড়ে উঠল। তন্দ্রালু ভাব চোখে, মুখে। উঠে বসল সে। বোনকে জিজ্ঞেস করল—
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ। তুই গোসল করিসনি? সেই একই কাপড় গায়ে।”
ইরজার মনে পড়ল ডায়েরির কথা। সে চট করে পেছনে তাকিয়ে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলল। বোনকে বলল—
“ও আসলে… ভীষন ঘুম পাচ্ছিল তাই। তোমার এখন কেমন লাগছে? শরীর ভালো আছে তো?”
“হ্যাঁ…আছে…।”
কেমন একটা দ্বিধায় জড়ানো উত্তর দিলো ইরহা। বোনের হাতটা ধরে মলিন সুরে বলল ইরজা—
“আহিল ভাইয়াকে বলো, একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে। ”
“বলব।”
“আচ্ছা, তুমি যাও আমি গোসল সেরে আসছি।”
“আয়। খেয়েছিস দুপুরে?”
ইরজা নিষ্পাপ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। ইরহা অবাক হয়ে বলল—
“না খেয়ে এত ঠান্ডা আছিস কী করে তুই?”
“আপু!”
লজ্জাকাতর কণ্ঠে বলে উঠে ইরজা। ইরহা হেসে ফেলে। ইরহা চলে যাওয়ার পর আবারও ডায়েরিতে কী লেখা আছে তা পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে ইরজা। ডায়েরি খুলেও ফেলে। তবে নিজেকে দমিয়ে নিয়ে গালের দু’পাশে দুটো করে চারটে আদুরে চড় মেরে শাষিয়ে দেয়। ডায়েরি এখন পড়া চলবে না।
গোসল সেরে রান্নাঘরে আসে ইরজা। ইরহা ততক্ষণে সবজি কেটে নিয়েছে। সবজি রোল বানাবে আর চা। ইরজা সাহায্য করল। নাশতা বানানো শেষে টেবিলে খাবার রেখে শাশুড়ি আর ননাসকে ডাকল। সবার আগে ছুটে এলো রিনি। সে এসেই খাওয়া শুরু করল। সসে ডুবিয়ে রোল খেয়ে আঙুলের ইশারায় বোঝাল বেশ মজা হয়েছে। শশী আর আমেনা এলো কিয়ৎপল বাদে। তারা নাশতা করে চলেও গেল। ইরহা শুধু পর্যবেক্ষণ করল ইরজাকে। আজ সারাদিন মেয়েটা না খাওয়া। তাও কোনো হেলদোল নেই। ইরহা শঙ্কিত হলো। আলমিরের সাথে কিছু হয়েছে? কী হতে পারে? তারা তো ঘুরতে গিয়েছিল। ওখানে কিছু হয়েছে?
শশী আর আমেনাকেও এই নীরবতা খোঁচা দিলো। এই মেয়ে এত চুপচাপ কেন? কী হতে পারে? নাকি ঝড়ের পূর্বের পূর্বাভাস !
ইরজা কিছুই খেল না। সে রাতের খাবার গুছিয়ে রুমে গিয়ে ঢুকল। ডায়েরিটা বের করে আনল ড্রয়ার থেকে। খুলে বসল বারান্দায়। বারান্দার বাতিটা জ্বালিয়ে নিলো।
(অতীত)
প্রিয়তা খুব ভয়ে ভয়ে হাঁটছে। সে কিছুতেই আলমিরের সামনে পড়তে চায় না। আড়চোখে এপাশ ওপাশ তাকায়। পেছনে তাকিয়েও দেখল। না, আলমির পিছু আসেনি। প্রিয়তা দ্রুত পা চালাল।
বাড়ি ফিরে রোজকার অভ্যাস মতো সব কাজ সারল। সুলতানা আজ ঘুমায়নি। বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল। সে উঁকিঝুঁকি মারছে। কিছু লোককে দেখে বাড়ির ভেতরে দৌড় দিলো।
“মা, ওনারা আসতেছে।”
সুমনা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তমিজ এগিয়ে বাড়ির বাইরে গেলেন। সুমনা ঘরে ঢুকে মেয়ের রুমে গেলেন। প্রিয়তা মন খারাপ করে বসে আছে। সুমনা রাগ ছুড়ে বললেন—
“এখনো শাড়ি পড়িসনি? ওরা এসে পড়েছে।”
পাত্রপক্ষ প্রিয়তাকে দেখতে আসতেছে। পাড়ার মানুষের কলকাকলিতে মেয়েকে আর ঘরে রাখতে চাইছেন না তমিজ। এমনিতেও গার্মেন্টসে চাকুরি করে বলে তার নামে বাজে কথা বলে মানুষজন। মেয়েটা তার চাঁদের মতো। এমন চাঁদ মেয়ের কপাল ভাঙতে চান না তিনি। তাই ভালো ঘর পেয়ে আর আপত্তি করলেন না। পাড়ার নজর আলী ভাই প্রস্তাব এনেছেন। ছেলের পড়াশোনা আছে। সৌদি থাকে। মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা শুধু ঘর খরচের জন্যেই পাঠায়। বলেছে বিয়েতে পাঁচ ভরি স্বর্ণ দেবে। তারা শুধু মেয়েকে চায়। এমন পাত্র হাতছাড়া করা যাবে না। গত রাতেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি।
“মা, আমি আরও পড়তে চাই। ”
প্রিয়তা কণ্ঠে আকুতি।
“এত পড়াশোনা করে কী করবি। সেই তো চুলারপাড়ে কাটবে সারা জীবন।”
সুমনার কথায় ভাটা পড়ে প্রিয়তার কণ্ঠে। সে নিম্ন স্বরে মাথা নত করে পড়ল—
“এত কম বয়সে কেন বিয়ে দিচ্ছ?”
“তোর চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হয়েছে আমার। আর কথা বাড়াস না মা। ওরা চলে এসেছ।”
“হ্যাঁ, মা, ওনারা চলে আসছে। আব্বু বলছে নাশতা দিতে।”
সুলতানা হুট করে রুমে ঢুকে বলল। সুমনা মেয়েকে তৈরি হতে বললেন। নিজে গেলেন নাশতার যোগাড় করতে। বিছানার ওপর বেগুনি রঙের লাল পাড়ের শাড়ি রাখা। সুলতানা বোনের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। ফুটফুটে হেসে বলল—
” আপা, তোমাকে এই শাড়িটায় অনেক সুন্দর লাগে! ওই যে গতবার শাকিল ভাইয়ের বিয়েতে পরেছিলে, ছেলেরা সবাই তোর দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল।”
প্রিয়তার এসব শুনতে ইচ্ছে করছে না। তার খুব কান্না পাচ্ছে। সে এখনি বিয়ে করতে চায় না। পড়তে চায়।
পাত্রপক্ষ অধীর আগ্রহে বসে রইল। নজর আলী প্রিয়তার এত প্রশংসা করেছে যে, পাত্র সেলিম প্রিয়তাকে এক নজর দেখার জন্য হাসফাস শুরু করেছে। উষর মরুর বুকে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো! সেলিমের তৃষ্ণার জল নামল। প্রিয়তা এলো। বেগুনি রঙের লাল পাড়ের শাড়ি পড়ে। সেলিম বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। ঘোমটা টানা ছোট্ট মুখখানি। নিঁখুত খাঁজে আঁকা মুখবিবর। নিটোল দেহতরী। তার ফর্সা হাত দুটো খালি। শুধু কানে এক জোড়া রিং ঝুলছে। সেলিম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, একদম সোনায় মুড়িয়ে দেবে সে প্রিয়তাকে। এই মেয়েকে তার চাই ই চাই। এই রুপ সে ছাড়া অন্য কারো চোখ দেখতে পারবে না। এই দেহ অন্য কেউ ছুঁতে পারবে না। সেলিমের বাবা, চাচাও অপলকে চেয়ে রইলেন প্রিয়তার দিকে। এতো খু নি রূপ!
নজর আলী বুঝতে পারলেন তার পকেট এবার মালদার হবে। প্রায় দশ হাজার টাকার বদৌলতে সেলিমের জন্য প্রিয়তার খোঁজ দিয়েছে সে। সেলিমের মেয়ে ঘটিত কেলেঙ্কারি আছে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে সেলিম তখনই ফিসফিসিয়ে বলল, যদি সে প্রিয়তার সাথে কালই তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে দশ নয় বিশ হাজার টাকা দেবে । নজর আলী চোখে সোনার হরিণ দেখলেন যেন! তার জিব লকলকিয়ে উঠল।
প্রিয়তাকে এনে তাদের সামনে বসাল সুমনা। তমিজ উদ্দিন কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। তাকে সেলিম বাঁধা দিলো। নজর আলী সব বুঝতে পারলেন। তিনি সুমনাকে প্রিয়তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন।
প্রিয়তা ঘোমটা সরিয়ে বিছানায় বসে রইল। তার চোখ দিয়ে অঝরে পানি নামছে। সেলিমের চাহনিতে কামলিপ্সা ঝকমক করছিল। যেন এখনই গিলে নেবে। ঘৃণা আসছে প্রিয়তার। হঠাৎ তার আলমিরের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল ছেলেটার মুগ্ধ করা চাহনিকে। আচ্ছা, ওই চিঠি! প্রিয়তা তড়িঘড়ি ব্যাগ হাতড়ে সেই চিঠি বের করল। নাম্বারটা খুব ভালো করে দেখল। সে কী একবার ফোন করবে? ফোন করে কী বলবে? এই ভেবে আবারও কান্না এলো প্রিয়তার। সে তো ছেলেটাকে ভালোবাসে না। তাহলে, তাহলে কীসের জন্য সে ফোন করবে? ছেলেটা কী তাকে ভালোবাসে? আচ্ছা, কী যেন নাম.. আলমির। প্রিয়তার হুঁশ হারিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে বাবার বাটন ফোনটার একটা একটা বাটন টিপে সে আলমিরকে কল করল। রিং হতেই থাকল। রিসিভ করল না কেউ। প্রিয়তা ফোনটা দুই হাতে চেপে রাখল। দরজার দিকে তাকাল। পরমুহুর্তেই তার অপরাধী মন তাকে চোখ রাঙাল। প্রিয়তা চুপসে যায়। সে ভুল করে ফেলেছে। ব্যস্ত হয়ে ফোন থেকে নাম্বার ডিলেট করতে গেলেই ফোন বেজে ওঠে। তাড়াহুড়োতে কল রিসিভ করে ফেলে প্রিয়তা। আলমির বলতে থাকে—
“হ্যালো, হ্যালো, কে বলছেন? ”
প্রিয়তা কথা বলে না। ফোন হাতের মুঠোয় নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই বসে থাকে। কিয়ৎপল বাদে প্রকম্পিত হাতে কান ছোঁয়ায় ইলেকট্রিক যন্ত্রটিতে। কম্পিত কণ্ঠে বলল—
“হ্যালো, আমি প্রিয়তা।”
আলমির দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তার কী যে খুশি লাগছে! আলমির কিছু বলতে পারছে না। চুপ করে প্রিয়তার নিশ্বাস শুনছে।
“আপনি আমার কথা শুনছেন?”
“বলো, প্রিয়তা।”
“এই আপা।”
সুলতানা ডেকে উঠল। প্রিয়তা মোবাইলটা কান থেকে সরিয়ে ফেলল। সমস্ত দেহ কাঁপছে তার। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে। গলা শুকিয়ে এসেছে।
সে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করল–
“কী?”
“পরশু তোমার বিয়ে আপা।”
“কী?”
প্রিয়তার সারা অঙ্গে যেন কেউ এসি ড ঢেলে দিয়েছে। ঝলসে যাচ্ছে তার ভেতর বাহির। ওপাশের ব্যক্তি কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
,
,
,
“এখানে কী করছেন?”
ইরজা চকিতে তাকাল। উঠে দাঁড়াল ফটাফট। অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল—
“কখন এসেছেন?”
“আপনি এখানে কী করছেন? ফ্লোর ঠাণ্ডা না? আর হাতে এটা কী?”
ইরজা লুকাতে চেষ্টা করল। কপট হেসে মিথ্যে বলল—
“এটা একটা উপন্যাস। আমার বান্ধবী দিয়েছে।”
“দেখি তো।”
“উহু। এটা স্বামীরা পড়তে পারবে না।”
আলমির হাসল। বলল—
“ও আচ্ছা। তাহলে কী আমি পড়তে পারব না?”
“আপনি কী আসামী?”
“নাতো।”
“তাহলে?”
“ওকে। পড়লাম না। তবে, এভাবে যেখানে সেখানে বই পড়া যাবে না। ”
“আপনিও প্রমিজ করুন, আমার বইয়ে হাত দিবেন না।”
“শর্তটা কেমন অদ্ভুত হয়ে গেল না? কী এমন আছে এই বইতে?”
“কী আছে বলব?”
“হু।”
ইরজা আলমিরের একদম সন্নিকটে এসে দাঁড়ায়। চিবুক উঁচু করে আলমিরের চোখে চোখ রাখে। মাদকভরা চাহনি। আসক্তি ভরা কণ্ঠে বলল–
“এই বইয়ে একটা অনিশ্চিত ভালোবাসার কাহিনি আছে। একজন নারীর গহন অনুরক্তির কাহিনি আছে। একজন স্ত্রীর অগাধ বিশ্বাসের কাহিনি আছে। আরও আছে….।”
আলমির ইরজাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। দুই হাতে পিষ্ঠদেশ বেঁধে ধরল। আলমিরের আচমকা সংঘাতে তার বুকে এসে পড়ল ইরজা। স্বামীর এহেন নির্লজ্জ কাজে ভড়কে যায় ইরজা। তার দৃষ্টিতে অবাধ কৌতূহল !
চলবে,,,