প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-২১+২২

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২১
লেখনীতে:আইশা তানভি

ইরহার প্রেগন্যান্সির খবর ছড়িয়ে গেল। সবার মাঝে তুমুল উদ্দীপনা। রিনি তো মহা খুশি। শশী এতদিন চোটপাট করলেও, এখন ইরহার প্রতি তার মন নরম হয়েছে। শরীফ আশরাফও উচ্ছ্বসিত। হবু দাদা হওয়ার খুশিতে তিনি ইরহাকে একটা হার গিফ্ট করলেন।

আজ ইরহার বাবা-মা’কে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। তাদের খুব আপ্যয়ন করা হয়। আমেনা আশরাফও কিছুটা থিতিয়ে আছেন। তবে চিন্তানিমগ্ন আহিল। মা’কে একা পাচ্ছে না কোথাও। আমেনা আশরাফ ছেলের সাথে একা কথা বলতে চান।

ইরহার বাবা-মা চলে যাওয়ার পর ইরহাকে নিজের রুমে নিয়ে এলো ইরজা। সেখানে আরও আছে রিনি। সকলের মাঝে খুশির হিমেল হাওয়া। ইরজা বলল—

“আপু, বাবু হলে কিন্তু আমি নাম রাখব।”

“আচ্ছা।”

“ছেলে হবে না মেয়ে হবে বলো তো?”

“আমি কী করে বলব?”

“একটা মেয়ে বাবু হলে ভালো হবে। একদম রিনির মতো।”

রিনির নাক টিপে দেয় ইরজা। ইরহার মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। খিলখিল করে হাসে। তবে মনকুঠিরের কোথাও একটা সংকোচ, সংশয় উঁকি দিচ্ছে। সবার মাঝে খুশির ছায়া দেখলেও আহিল এখনো নিরুত্তেজ। কী এমন হয়েছে তার?
,
,
,
ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে মা-ছেলে। আহিলের চোখে- মুখে অমাবশ্যার অমানিশা। মা আমেনাও অনেক বিধ্বস্ত। তিনিই মুখ খুললেন—

“খুশি হয়েও আমি খুশি হতে পারছি না। যদি মেয়ে হয়?”

আহিল নিশ্চুপ। তার নত মুখ। আমেনা নিজ গরজেই বললেন—

“আমারই কপালের দোষ। কোন কুক্ষণে তোর বাপের সাথে আমার দেখা হয়েছিল!”

আহিল নীরবতা ভাঙল। বলল—

“এখন আমি কী করব?”

“এই বাড়িটা আলমিরের মায়ের। এটা ওই পাবে। ব্যবসায়ের শেয়ারেও ওর পার্সেন্টেজ বেশি। পরিবারের বড়ো ছেলে। আমি তোদের জন্য কী করব?”

“তুমি বাবাকে কেন কিছু বলছ না?”

“ওই শয়তানটার জন্যই এতকিছু। ”

“কী বললে?”

আমেনা চুপ হয়ে গেলেন। শরীফ আশরাফ ভীষণ ধূর্ত স্বভাবের সাথে উচ্চবিলাসী। তার এই লোভই একদিন তাকে ডোবাবে। সাথে আমেনা আশরাফকেও। সেই শঙ্কায় সর্বদা তটস্থ হয়ে থাকেন তিনি।
,
,
,
ডায়েরিটা পায়ের ওপর নিয়ে বসে আছে ইরজা। পড়বে কী পড়বে না ভাবছে। তার মনের মাঝে নানা রকম প্রশ্নেরা দ্বার খুলেছে। ইতিউতি করে ডায়েরিটা খুলল ইরজা। অতীতের স্মৃতিতে ডুব দিলো।

(অতীত)

খাওয়া শেষে প্লেটে হাত দিয়ে বসে আছে আলমির। শরীফ আশরাফ টিশুতে মুখ মুছে ছেলের দিকে চাইলেন। আমেনা বসে আছেন।

“কি হলো?”

আলমির নম্র স্বরে বলল—

“আমার কিছু বলার আছে।”

“বল।”

আহিলের মাঝে চঞ্চলতা দেখা গেল। সে জমে রইল সেখানেই। আলমির তাকে বলল—

“তুই ঘরে যা। বাবার সাথে আমার কথা আছে।”

কিছুটা রাগি চোখে ভাইকে দেখল আহিল। মায়ের কড়া দৃষ্টিতে উঠে চলে গেল। আমেনা কৌতূহল গলায় বললেন—

“কী এমন গোপন কথা তোর?”

“গোপন না।”

আলমির হাত ধুয়ে নিল। বলতে লাগল—

“আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। ও আমাদের কলেজেই পড়ে। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। ওর নাম প্রিয়তা। বাবা গার্মেন্টসের সুপারভাইজার। মা বাড়িতেই থাকে। দুই বোন ওরা। শান্তিনগরে ওদের ছোট্ট একটা বাড়ি আছে। ওরা ওখানেই থাকে। প্রিয়তার বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। আগামী পরশু ওর বিয়ে।”

“তো, এখন আমি কী করতে পারি?”

আমেনার বিস্ময় যেন শেষ হচ্ছে না। এই ছেলে এতদূর কী করে গড়ালো? মাথা উন্নত করে চাইল আলমির। বলল—

“আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।”

শরীফ আশরাফ চোখের আকৃতি বদলানেন। রাগে মাথা ছিড়ে যাচ্ছে আমেনার। শরীফ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—

“একজন গার্মেন্টেসের সুপারভাইজারের মেয়েকে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিস?”

আলমির জবাব দিলো না। শিয়র নত করে টেবিলের দিকে আঁখি যুগল নিবদ্ধ করে রইল। আমেনার ক্রোধ যেন বেড়েই যাচ্ছে। তিনি কিছু বলতে গিয়েও স্বামী নির্দেশনায় থেমে রইলেন।

“পরীক্ষা শেষ হোক।”

“পরশু প্রিয়তার বিয়ে।”

“তো? এখন আমি কী করতে পারি?”

“আপনি ওর বাবার সাথে কথা বলতে পারেন।”

“কোন বিষয়ে?”

আলমির মাথা তুলল। সেই চাহনি নমনীয়তা। বাবার মুখের দিকে সরল দৃষ্টি রেখে বুকে সাহস সঞ্চার করে আলমির বলে—-

“আমাদের বিয়ের বিষয়ে?”

“বিয়ে করে খাওয়াবি কী?”

আমেনা ফট করেই রাগ উগড়ে প্রশ্নটা করে ফেললেন। শরীফ নাক ফোলালেন।

“আমার পরীক্ষা শেষ হতে আর কিছুদিন বাকি। আমি কিছু একটা যোগাড় করে নেব। ছেলেকে বিয়ে করালেই কী বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? ”

শরীফ নড়েচড়ে বসলেন। একটা সুপারভাইজারের মেয়েকে ছেলের বউ করাটা সমীচীন মনে হচ্ছে না তার। তিনি কাষ্ঠ গলায় বললেন—-

“পছন্দ করা আর প্রেম করা এক নয়। তুই কোনটা করেছিস?”

“ওকে আমি পছন্দ করি।”

“মেয়েটার কোনো ছবি আছে?”

আমেনা খেঁকিয়ে উঠলেন।

“আপনিও কী ওর সাথে পাগল হয়ে গেলেন?”

“কথা বাড়িয়ো না।”

শরীফের কঠোর স্বরে থমকে গেলেন আমেনা। আলমির বলতে শুরু করল—

“আমি একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছি। আমার মোবাইলটা প্রিয়তার বোনের মাধ্যমে ওর কাছে পাঠিয়েছি। ওর বাবা-মা দেখলেই নিশ্চয়ই ঝামেলা করবে।”

“সেটা কী হওয়ার নয়?”

“আমি ইচ্ছে করেই করেছি।”

“মেয়েটার সাথে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হবে?”

“হতে পারে।”

শরীফ ঠাণ্ডা মেজাজে কিছু সময় ভাবলেন। ছেলেকে কঠোর স্বরে না করতে পারলেন না। কিন্তু নিজের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান বিবেচনায়, এমন ঘরে ছেলেকে বিয়ে করাতেও নারাজ তিনি। ছেলেকে সময় দিতে বললেন। পরে জানাবেন।

সেই রাতে আলমিরের ঘুম হলো না। সারারাত ছটফট করে কাটাল। পরদিন সকালেই বাবার মুখোমুখি হলো সে। বাক বিতণ্ডায় রাজি হলেন শরীফ আশরাফ। তবে তার কিছু শর্ত আছে। এহেন অবস্থায় সকল অন্যায় শর্তও সঠিক মনে হলো আলমিরের কাছে।
,
,
,
বাড়ির পুরোনো মরচে পড়া লোহার গেটটি হালকা হাতে ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন শরীফ। আলমিরও আছে সাথে। বাড়িতে মাত্র চারটি প্রাণী। তাই হৈ চৈ কম থাকার কথা। কিন্তু ভেতর ঘর থেকে খুব শোরগোল আসছে। আলমিরের কলিজা কেঁপে উঠল। অস্থিরতায় হাত- পা অবশ হয়ে আসছে। সুলতানা বেরিয়েছে ঘর থেকে। আলমিরকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে রাগ দেখিয়ে বলল—

“আপনি মিথ্যে কথা বলেছেন। আপনি স্যার না। আর ওই ফোন কেন দিছেন? আপা তো কোচিং এ পড়ে না।”

আলমির ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল—

“তোমার আপু কোথায়?”

“আজকে আপার বিয়ে। ঘরে সবাই আছে। উনি কে?”

সুলতানা শরীফ আশরাফকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন ছুড়ল।

“উনি আমার বাবা। তোমার আপুর তো কাল বিয়ের কথা ছিল।”

“হ্যাঁ। ওই যে আপনি মোবাইল দিছিলেন, ওই কারণে আব্বু খুব রাগ হইছে। তাই আজকেই বিয়ে।”

আলমির যেন এক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল। চাপা কষ্টে শ্বাসকষ্ট শুরু হলো তার। মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে!

শরীফ আশরাফ ছেলেকে অভয় দিলেন। তারা ভেতরে গেলেন বাড়ির। ঘরে ঢুকতেই দেখলেন খুব কোলাহল। মহিলাদের তেমন অংশগ্রহণ নেই। কিছু পুরুষ লোক বসে আছে বসার রুমে। তমিজ খুব চমকালেন। বললেন—

“আপনারা কারা?”

শরীফ জবাব দিলেন—

“আমরা আপনার মেয়েকে দেখতে এসেছি।”

“দেখতে এসেছেন মানে? আমার মেয়ের আজকে বিয়ে।”

“কাল দেখতে এসে আজ বিয়ে, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমাদের কোনো কারণ নেই।”

তিনি হেঁটে গিয়ে চৌকির ওপর বসলেন। নড়বড়ে চৌকি। আলমিরের দিকে তাকালেন। আলমির নিরুপায়। অসহায় দৃষ্টি। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেলিম আড়চোখে নজর আলীকে ইশারা করল। নজর আলী তমিজকে ডেকে নিয়ে বাইরে গেলেন। কিছু সময় পর ফিরে এলেন। তমিজ আসতেই শরীফ বললেন—

“আপনার মেয়েকে নিয়ে আসুন। আমি একবার দেখতে চাই। ”

“আপনি বললেই হলো? আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আপনারা যান এখন।”

“বিয়ে হয়ে তো যায়নি। আপনি আনুন। আমি একবার দেখতে চাই ওকে। কেন আমার ছেলে দুদিনের পরিচয়ে আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছে।”

আলমির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তমিজ ক্ষেপে উঠলেন। শরীফ আশরাফও নাছোড়বান্দা। তিনি গো ধরে বসে রইলেন। তবে বাবার উপস্থিতিতে একটা কথাও বলল না আলমির। সেলিমের বুক ধড়ফড় করছে। শরীফ আশরাফের পোষাক আশাক তাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। পোষাকে নিপাট ভদ্রলোক। কথাবার্তায় উচু পর্যায়ের মানুষের ছাপ পাওয়া যায়। সেলিম তার বাবা, চাচাকেও উষ্কে দিলো। তারাও এই সেই বলে ঝামেলা পাকালেন। শরীফ আশরাফ অত্যন্ত শীতল মেজাজে বসে রইলেন। তার এক কথা, তিনি প্রিয়তাকে না দেখে নড়বেন না।

বাধ্য হয়ে প্রিয়তাকে আনা হলো। লাল রঙের বেনারসিতে তার দেহ মোড়ানো। কানে,গলায় সোনার জিনিস। ঘোমটা টানা সোনা মুখ। যেন ওই অঙ্গে আ গুন জ্বলছে! কী উত্তাপ। সোনা রঙে ঝলমল করছে প্রিয়তা। কেউ দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। শরীফ আশরাফ এবার বুঝতে পারলেন, তার সাদাসিধে ছেলে কোথায় এত সাহস পেয়েছে!
প্রিয়তাকে দেখে লালা ঝরছে সেলিমের। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই গিলে ফেলে। সবার চাহনি উপেক্ষা করে এক জোড়া চোখ প্রিয়তার হৃদয় দ্বারে করাঘাত করল। ওই দৃষ্টিতে অনিঃশেষ মুগ্ধতা। প্রিয়তা বিস্মিত। ছেলেটা সত্যিই এসেছে!
শরীফের কথা মতো প্রিয়তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। তমিজ গরম হয়ে গেলেন। শরীফ আশরাফকে ছেলেসহ চলে যেতে বললেন।

শরীফ সুলতানাকে ডাকলেন। এক টুকরো কাগজ দিতে বললেন। সুলতানা ছুটে গিয়ে তার স্কুলের খাতা নিয়ে আসলো। শরীফ একটা কলমও চেয়ে নিলেন। তারপর লিখলেন আর বললেন—

” ওরা বিয়ের কত কাবিন দেবে?”

তমিজ খলবলিয়ে উঠলেন। মেজাজ দেখালেন নজর আলীও। সেলিম আর তার বাবা, চাচাও কম যান না। শুধু বলল না আলমির। বাবার শর্ত, এই বিয়ে তখনই হবে যখন আলমির তার সব কথা মেনে চলবে। আলমির মেনে নিয়েছে।

তমিজ খাপছাড়া কণ্ঠে বললেন—

“পাঁচ লাখ।”

“আমরা পনেরো লাখ ধরলাম।”

সকলে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। আলমিরের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি। তিনি আবারও প্রশ্ন ছুড়লেন—

“গহনা?”

নজর আলী দাঁত কেঁলিয়ে হেসে বললেন—

“পাঁচ ভরি।”

“আমরা দশ ভরি। বিয়ের সমস্ত খরচ আমরা বহন করব। ছেলে কী করে আপনাদের?”

“মাসে এক লাখ টাকা কামায়।”

সেলিমের চাচা বললেন। শরীফ তীর্যক হেসে গর্ব করে বললেন—

“আমার ছেলে নিজেই একটা কোম্পানির মালিক। তার কোম্পানিতে প্রায় চারশ শ্রমিক কাজ করে। মাস্টার্স পরীক্ষা দিচ্ছে। বিদেশেও পড়ার জন্য যেতে পারে। আপনাদের মেয়ের কোনো কিছুর অভাব হবে না। আর আই থিংক আপনাদের মেয়েও আমার ছেলেকে পছন্দ করে। বাকিটা ভেবে দেখুন।”

তমিজ পাথর বনে গেলেন। এত কিছুর কথা শুনে তার কান যেন বন্ধ হয়ে আসবে। শরীফ আশরাফ সেলিমকে প্রশ্ন ছুড়ল—

“এটা কী তোমার প্রথম বিয়ে?”

সেলিম থতমত খেয়ে বলল—

“হ্যাঁ।”

“খবর পেলাম, তোমার প্রথম বউ নাকি বিয়ের পর দিনই পালিয়ে গেছে!”

তমিজ আকাশ থেকে পড়লেন। এতবড়ো মিথ্যাচার। তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। ভেতর ঘরে গিয়ে সত্যিই প্রিয়তাকে প্রশ্ন করলেন। সব ঘটনাও খুলে বললেন। প্রিয়তা একরাশ জড়তা নিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। তমিজ সেই খবর শরীফকে জানালেন। নজর আলী চট করেই বলে উঠলেন—

“এইসব ধান্দাবাজী তমিজ মিয়া।”

শরীফ মৃদু হাসলেন। ফোন করে ড্রাইভারকে ডেকে আনলেন। বললেন—

“যাও, তোমার ম্যাডামের কাছে থেক দশ ভরি গহনা নিয়ে আসবে। আধা ঘণ্টার মধ্যে আসবে।”

ড্রাইভার চলে যেতেই পকেট থেকে চেকবই বের করে অ্যামাউন্ট লিখে সই করে রাখলেন। এই রকম আশ্চর্যজনক ঘটনায় হতবিহ্বল তমিজ। তিনি নজর আলীকে সেলিমদের নিয়ে যেতে বললেন। গায়ে পড়ে তারা কিছুক্ষণ উচ্চবাচ্য করলেন। সেলিম তো মারামারির পর্যায়ে চলে গেল। তাকে পুলিশের ভয় দেখালেন শরীফ।

আছরের পর বিয়ে পড়ানো শেষ হলো। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াল প্রিয়তা।

প্রায় এশারের ওয়াক্ত হয়ে গেল বাড়ি পৌঁছাতে আলমিরদের। আমেনা আশরাফ মুখে তালা মে রে বসে রইলেন। আলমির বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ।

বাসর ঘর বলতে কিছু নেই। প্রিয়তার গায়ে তার মায়ের সবচেয়ে ভালো শাড়িটা জড়ানো। বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান না হলেও বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। প্রিয়তা গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। লাজুক দৃষ্টি অবনত। আলমির এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“সরি!”

প্রিয়তা চোখ তুলল। সাথে সাথে আবার নামিয়ে ফেলল। আলমিয় পূনরায় বলল—

“কালকের ঘটনার জন্য আমি সত্যিই সরি। ”

“মোবাইলটা কেন দিয়ে ছিলেন?”

“ওটা কী এনেছ?”

“হুম।”

“আসলে….. তুমি রাগ করবে না তো বললে?”

প্রিয়তা নিঃশব্দে মাথা এপাশ ওপাশ করল। আলমির বলল—

” তোমার বিয়ের কথা শুনে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তুমি তো আর আমার কথা বলবে না। তাই আমি নিজেই নিজেকে ধরা দেওয়ার চেষ্টা করলাম।”

“সে জন্য ফোন পাঠিয়ে দিলেন? এজন্য কী কোনো উপকার হয়েছে? উলটো আমাকে মা র খেতে হয়েছে আর রাগ করে আব্বু বিয়েটাও একদিন এগিয়ে দিয়েছিল।”

“আমি আসলে বুঝতে পারিনি এমনটা হবে। তোমাকে মে রেছে?”

“হুম।”

অস্ফুট কণ্ঠে বলল প্রিয়তা। আলমির বলল—

“খুব বেশি মে রেছে? দেখি কোথায় মে রেছে?”

আলমির উঠে আসতে গেলে প্রিয়তা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল—-

“একদম সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন না।”

আলমির থেমে গেল। রহস্য হেসে বলল—

“তুমি তো অনেক চালাক? বুঝে ফেললে?”

প্রিয়তা বোকা বোকা চোখে চাইল। আলমির ওষ্ঠ ভরা হেসে প্রিয়তার কাছাকাছি এসে বসল। প্রিয়তা নিজেকে একটু সরিয়ে নিলো। আলমির একদৃষ্টে চেয়ে আছে। এক ঐন্দ্রজালিক ক্ষণ! মাদকময় এই নিস্তব্ধতাকে আরও প্রেমময় করে তুলছে প্রিয়তার লাজুকতা। প্রিয়তার গায়ে খয়েরী রঙের সুতি শাড়ি। তার ফর্সা ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক দেওয়া। গা ভরতি গহনা। কী যে মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে! প্রিয়তা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। আলমির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—

“এগুলো পরে ঘুমাতে পারবে না। আমি খুলে দেই?”

প্রিয়তা ভূত দেখার মতো চমকে বলল—

“না।”

“তুমি কী ভয় পাচ্ছ আমাকে?”

প্রিয়তা কেমন করে যেন তাকাল। আলমির ফিচেল হেসে বলল—

“তোমাকে আজকে আমার সাথেই থাকতে হবে।”

কী সর্বনাশা কথাটা এই ছেলে হাসতে হাসতে বলে ফেলল! প্রিয়তার হঠাৎ কেমন ভয় করে উঠল। সে হুট করে বিছানা থেকে নেমে পালাতে চাইল। আলমির তার হাত ধরে বলল—

“এই কোথায় যাচ্ছ?”

প্রিয়তার সারা শরীরে বিদ্যুৎ দৌড়ে গেল। একটা জোরালো ঝাকুনি লাগল। বরফের মতো শীতল দৃষ্টিতে সে আলমিরকে দেখতে লাগল। আলমির আরেক হাত কাজে লাগাল। দুই হাতে প্রিয়তার বাজু ধরে তাকে বিছানায় বসাল। প্রিয়তা নড়ল না।

“তুমি বসো। আমি এগুলো খুলে দিচ্ছি।”

প্রিয়তার উদ্ভাসিত দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে অবাধ কৌতূহল, মিষ্টি আতঙ্ক, প্রগাঢ় মায়ায় বেষ্টিত ভয়! আলমির প্রিয়তার ঘোমটা সরাল। আলগোছে, খুব যতনে তার কানের, গলার, হাতের গহনাগুলো একটা একটা করে খুলে ফেলল। প্রিয়তা বসে রইল স্থবির দৃষ্টিতে। সহসা প্রিয়তার খোঁপা খুলে দিলো আলমির। মেয়েটার ভারী চিকুর ঝপ করে বিছানায় পড়ল। পুরুষটি বিস্ময়ে ডুবে গেল।

“তোমার চুল..?”

প্রিয়তা ভ্রূ বিলাস করে বলল—

“কী আমার চুল?”

“এত বড়ো?”

প্রিয়তা নাক কুঁচকে চুলের কিছুটা সামনে এনে থু থু ছিটালো। আলমির ভড়কে গিয়ে বলল—

“এমন করলে কেন?”

“আপনি আমার চুলে নজর দিলেন কেন?”

“এখন তো আমি তোমার সবকিছুতে নজর দেবো। তখন?”

এই কথার জবাব আর দিতে পারল প্রিয়তা। সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

“আরে, কী সমস্যা তোমার? কিছু হলেই দাঁড়িয়ে যাও।”

“আমি বাথরুমে যাব।”

“ও। ওয়াশরুম ওইদিকে। যাও।”

“আমি কাপড়ও বদলাব।”

“আচ্ছা।”

প্রিয়তা তার সাথে নিয়ে আসা ব্যাগ থেকে হলুদ, লাল, সবুজের মিশ্রণে একটা থ্রিপিচ বের করল। সাথে আলমিরের ফোন।

“আপনার মোবাইল।”

আলমির ফোনটা হাতে নিল। প্রিয়তা ওয়াশরুমে চলে যায়। প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয় প্রিয়তা। আলমিরের মুগ্ধতা কমে না। প্রিয়তা এসে আলমিরের সামনে দাঁড়ায়। সালাম করে।

“আরে কী করছ?”

“মা বলেছে সালাম করতে।”

“আর কী বলেছে তোমার মা?”

“অনেক কিছু।”

“সেই অনেক কিছুটা কী?”

প্রিয়তা মিহি হাসে। তার ভীষণ লজ্জা করছে। আলমির তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার পিঠ ঠেকায় নিজের বুকে। আলগোছে হাতের বাঁকে প্রেয়সীকে বেঁধে নেয়। চুলের বহরে নাক ডোবায়। লম্বা শ্বাস টানে। কাঁধে চিবুক রেখে বলল—

“বলো, আর কী কী বলেছে।”

“সবাইকে সম্মান করতে, বড়দের সব কথা শুনতে, গুরুজনদের মেনে চলতে, শ্বশুড় -শাশুড়ির সেবা করতে…।”

“আর? আমার কথা কিছু বলেনি?”

“বলেছে।”

“কী।”

“আপনি যা বলবেন বিনা তর্কে তাই করতে।”

“ব্যস, এইটুকুই?”

“আর কী বলবে?”

প্রিয়তাকে নিজের দিকে ঘোরাল আলমির। নত মুখশ্রীর চিবুক ধরে উঁচু করে বলল—

“আমাকে ভালো বাসতে বলেনি?”

“যান।”

লজ্জায় সরে আসতে চায় প্রিয়তা। আলমির তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। গাঢ় বন্ধনে। প্রিয়তার কেমন হাসফাস লাগে। দেহে কাঁপন ওঠে। প্রিয়তমার সুশ্রী মুখবিবর আঁজলায় তুলে ক্ষণপল অপলক চেয়ে থাকে আলমির। নিমীলিত দৃক দ্বয়ে ভারী শ্বাসের উচ্ছলতা। ওই বদ্ধ পল্লবে আলতো করে অধর ছোঁয়ায় আলমির। প্রাণ প্রেয়সীর ঘন শ্বাসের উষ্ণতায় হৃদয়ে কাঁপন ধরে পুরুষটির। সে নিজেকে রুখতে পারে না। প্রাণনারীর রঞ্জিত অধরোষ্ঠ তাকে টানছে। আলমিরের নেত্রদ্বয়ে ঘোর লেগে আসে। প্রিয়তার কম্পিত ঠোঁট জোড়াতে গহন আবেশে সংসর্গ আঁকে পুরুষালী ওষ্ঠের। প্রিয় পুরুষের প্রণয়মাখা স্পর্শে কাতর হয়ে ওঠে প্রিয়তার সারা অঙ্গ। যে অঙ্গে আলমিরের একান্ত বিচরণ।

ঠাস করে ডায়েরিটা বন্ধ করে ইরজা। কী এক গভীর আক্রোশে হাত – পা কাঁপছে তার। মেজাজ বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। যে ছোঁয়ার এত অনুরক্তি, এত আসক্তি আজ পর্যন্ত সেই ছোঁয়া তার ভাগ্যে জোটেনি। প্রিয়তার জায়গায় কখন যেন নিজেকে বসিয়ে ফেলল ইরজা। তবে প্রাণপ্রিয়র ভালোবাসা কেন তার হবে না। আজ আলমিরের ওপর অযাচিত ক্রোধে মনটা বিষাক্ত হয়ে উঠল ইরজার। প্রিয়তার জন্য এত পাগলামি,তাকে পাওয়ার এত অনুনয়, কই পাশাপাশি শুয়েও তো তাকে কখনো এমন করে ছুঁয়ে দেয়নি আলমির, কখনো তার দিকে ওই বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেনি। তাহলে এই সম্পর্কের কী মানে? কী ভবিষ্যৎ এই সম্পর্কের? যেখানে আজ পর্যন্ত প্রিয়তাকেই আলমির ভালোবাসে। রাগে, দুঃখে চোখ জোড়া ভিজে উঠল ইরজার। সে প্রতিজ্ঞা করল এই ডায়েরি আর সে পড়বে না। কেন আরেকজনের প্রেম কাহিনি পড়ে তার মনে আগু ন জ্বলবে? কেন তাকে বিনিদ্র রজনী কাটাতে হবে? কেন?

চলবে,,,

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২২
লেখনীতে:আইশা তানভি

আলমির আজ একা ফেরেনি। ফিরেছে শশীর স্বামী অপূর্বকে নিয়ে। যখন তারা দোতালায় এসে থামল রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখল ইরজা। আলমিরের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রিনি ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছিল। বাবাকে দেখে দৌড়ে এলো। খুশিতে ঝাঁপিয়ে উঠে বলল—

“পাপা!”

অপূর্ব মেয়েকে কোলে নিয়ে মুখ ভরে চুমু খেল। ঝলমলে হেসে বলল—

“মাই প্রিন্সেস! কেমন আছ?”

“ভালো।”

“মাম্মি কোথায়?”

“তুমি এখানে?”

শশীর কণ্ঠস্বরে রাগের আভাস। আমেনাও সাথে এলেন। অপূর্ব খুব সুন্দর করে হেসে শাশুড়িকে সালাম জানাল। শশীর দিকে তাকিয়ে বলল–

“তোমার গহনা বানিয়ে এনেছি। এবার তো বাড়ি যেতে অসুবিধা নেই তোমার?”

শশী মুখ ঝামটা মে রে সরে গেল। ইরহা চমৎকার হেসে বলল–

“কেমন আছেন ভাইয়া?”

“ভালো। কংগ্রেস!”

ইরহা লজ্জা পেল। অপূর্ব কৌতুক করে বলল—

“শালা বাবু এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল! কী বলো আলমির ভাই?”

আলমির ছোট্ট করে হেসে বলল—

“তা তো অবশ্যই।”

“তুমি নিশ্চয়ই ইরজা?”

ইরজাকে ইঙ্গিত করে শুধাল অপূর্ব। ইরজা আলতো হেসে বলল—

“জি। আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

“কেমন আছেন?”

“ভালো।

“বাবা ফেরেনি?”

বাড়িতে নেই শরীফ আশরাফ। ইরজা জবাব দিলো না। তার পরিবর্তে জবাব দিলো ইরহা। বলল—

“বাবা ফেরেননি। রিনির মামাও ফেরেননি।”

আলমির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল–

“কেন?”

তদ্দণ্ডে ডোর বেল বাজল। আহিল আর শরীফ ফিরেছে।

খাবার খাওয়ার পর যে যার যার রুমে চলে গেল। থালাবাসন গুছিয়ে রাখছে ইরজা। সোলায়মান দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বলল—

“তুমি যাও। ঘুমাও।”

“জি।”

“কাল সকালে বাজারে যেতে হবে।”

“আচ্ছা। ”

“সকাল সকাল উঠবে।”

“জি।”

সব কাজকর্ম সামলে নিয়ে রুমে এলো ইরজা। আলমিরকে দেখেও না দেখার ভান করল। বিছানা ঝাঁট দিয়ে টেনেটুনে ঠিক করছে। তৎক্ষণাৎ আলমির বলল—

“কী হয়েছে? আজ কার ওপর রাগ উঠেছে?”

ইরজা জবাব দিলো না। তাকালও না। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বালিশ ঠিক করে রাখল। জবাব না পেয়ে আলমির নিজেই কাছে চলে এলো। ইরজার হাত ধরল। হাত ধরতেই রেগে আ গুন হয়ে তাকাল ইরজা।

“হাত ছাড়ুন।”

“কী হয়েছে?”

“যাই হোক, তাতে আপনার কী?”

“এভাবে কথা বলছ কেন?”

“কীভাবে কথা বলব?”

“কোনো ভুল হয়েছে আমার?”

“বিয়ে কেন করেছেন আমাকে?”

“আবার একই প্রশ্ন!”

“জবাব দিন। কেন বিয়ে করেছেন আমাকে?”

আলমির হতাশ হলো। ইরজার হাতটা ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ইরজা বলল—

“প্রিয়তাকে তো পাগল হয়ে বিয়ে করেছিলেন। ওকে মোবাইল পর্যন্ত পাঠিয়ে ছিলেন।”

আলমির চট করে তাকাল। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে চেয়ে বলল–

“তুমি এসব কী করে জানলে?”

“সব জানি আমি। সব?”

“কে বলেছে তোমাকে?”

“পনেরো লক্ষ টাকা কাবিন, দশ ভরি গহনা। দেখতে গিয়েই বিয়ে। বিয়ের পর বাসর।”

“ইরজা!”

বিকট শব্দে ধমকে উঠল আলমির। ইরজা কেঁপে উঠল। ক্ষণপলের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সে। আলমির সাধারণত তার নাম ধরে ডাকে না। ইরজার চোখ ভিজে উঠল। আলমির বদ্ধ শ্বাস ফেলল। বলল–

“সরি। এসব কী বলছ তুমি? কে বলেছে তোমাকে এসব?”

ইরজা জবাব দিলো না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর বলল—

“যদি প্রিয়তাকেই ভালোবেসে থাকেন, তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করেছেন? আমি আপনার প্রিয়জন না প্রয়োজন?”

“কোনটা শুনলে খুশি হবে?”

“সত্য।”

“আমার চোখের দিকে তাকাও। কী দেখছ?”

আলমির নিজের ডান চোখ দেখিয়ে প্রশ্ন করল। ইরজা বলল—

“আমাকে।”

“আর এই চোখে?”

“আমাকে।”

“যদি নিজেকেই দেখতে পাও, তাহলে যে নেই তাকে ভেবে কেন কষ্ট পাচ্ছ?”

“কষ্ট পাচ্ছি, কারণ আপনি আমাকে প্রিয়তার মতো ভালো বাসেননি, কষ্ট পাচ্ছি, কারণ আজ পর্যন্ত আপনি আমার দিকে ওই চোখে তাকাননি, কষ্ট পাচ্ছি, কারণ যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই তার কোনো নাম নেই?”

“এই সম্পর্কের কোনো নাম নেই?”

“নেই।”

“যদি বলি আছে?”

ইরজা শব্দ করে তাচ্ছিল্যভরা হেসে উঠল। আলমির বলল—

“তুমি রেগে আছ কথামালা, তাই এসব বলছ।”

“আমি সত্যি বলছি।”

“ভালোবাসো আমাকে?”

ইরজা কেমন করে যেন তাকাল। কোনো জবাব দিলো না। আলমির পূনরায় প্রশ্ন ছুড়ল—

“ভালোবাসো আমাকে?”

“বাসি না, বাসি না, বাসি না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। অনেক, অনেক, অনেক।”

ইরজার নেত্রযুগল সয়লাব হয়ে গেল নোনা জলে। তারপর একছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। হতবাক আলমিরের মস্তিষ্ক ধরতে পারছে, ইরজা কী করে এসব জানে?
ভালোবাসে না, তাই এত কষ্ট পাচ্ছে। আর ভালোবাসলে? আলমির ওই লোনা সাগরে ডোবা চোখে এক মুহুর্তে যেন নিজেকে দেখতে পেয়েছিল! যখন সে প্রিয়তাকে প্রথমবার হারাতে বসেছিল।
,
,
,
ঘড়ির কাটা তখন একটার ওসপার। আলমির শুয়ে আছে। ইরজা আর রুমে আসেনি। তাই নিজেই বের হলো সে।

ইরহার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। জল তেষ্টা পেয়েছে। হাতড়িয়ে দেখল, পানির জগে পানি শেষ। তাই জগ ভরতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ইরজাকে চোখে পড়ল তার। ঘুমায়নি। ডিভানের ওপর পা তুলে চিবুক গেড়ে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। সে এগুতে যাবেই তখনই আলমিরকে দেখতে পেল। ইরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আলমির। বলল—

“রুমে চলো।”

“আপনি যান।”

“কথা আছে তোমার সাথে।”

“আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”

“ভালো হবে না কিন্তু।”

“কী করবেন আপনি?”

উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল ইরজা। দৃক দ্বয়ে আ গুন ঝরছে! আলমির বলল—

“কী করব দেখবে?”

ইরজাকে কোলে নিতে গেলেই সে সাবধান করে দেয়—

“একদম ছোঁবেন না আমাকে।”

“তাহলে চলো। নাহলে কিন্তু ইরহা দাঁড়িয়ে আছে।”

ইরজা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। ইরহাকে দেখতে পেয়ে হনহনিয়ে রুমে চলে গেল। তার পিছু পিছু গেল আলমির। ইরহা কতক্ষণ সেভাবে দাঁড়িয়েই রইল।

বিছানায় বসে আছে ইরজা। দৃষ্টিতে কঠোরতা। আলমির দরজা আটকে এলো। ইরজার সামনে এসে মেঝেতে বসে পড়ল। ইরজা চরম অবাক হয়ে বলল—

“নিচে কেন বসেছেন?”

“মায়া হয় আমার জন্য?”

“হয় না।”

খুব দ্রুত উত্তর দিলো সে। আলমির হেসে বলল—

“কথামালা,
মিথ্যের দহনে সত্য কী সত্য পুড়ে?”

“ছন্দ আওড়াবেন না।

“আওড়াব না।কী জানতে চাও বলো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবো।”

ইরজাও নিচে নেমে বসল। দুজন মুখোমুখি। আলমিরের চাহনিতে স্বাচ্ছন্দ্য। ইরজা বজ্রকঠোর। প্রশ্ন ছুড়ল—

“কেন বিয়ে করেছেন আমাকে?”

ভনিতা ছাড়াই উত্তর দিলো আলমির—

“সারাজীবন একা থাকতে পারব না বলে।”

“আমাকেই কেন বিয়ে করেছেন?”

“তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালো লাগেনি তাই।”

“প্রিয়তাকে এখনো ভালোবাসেন?”

“বাসি।”

“তাহলে আমাকে কী করে ভালোবাসবেন?”

“দ্বিতীয়বার যদি বিয়ে করা যায়, তাহলে দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যাবে না কেন? ”

“কই আমার জন্য তো কখনো পাগলামি করেননি?”

আলমির হাসল। বলল—

“সেই বয়স কী আর আছে?”

“বুড়ো হয়ে গেছেন?”

“তোমার মতে। আগে বলো তুমি এসব কী করে জানলে?”

“বলব না।”

“এখন আমাকে কী করতে হবে বলো? কী করলে তোমার রাগ ভাঙবে?”

“কে রাগ করেছে আপনার ওপর?”

“করোনি?”

“না। রাগ তার ওপর করা যায় যে রাগ ভাঙাবে। কে আমি আপনার?”

আলমির সতেজ হাসল। নির্মল চোখে তাকিয়ে বলল—

“কেউ না তুমি আমার?”

অদ্ভুত মাদকময় কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল আলমির। ইরজা শীতল চোখে তাকাল। মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আলমির ইরজার কাছে এগিয়ে নিয়ে গেল নিজের অধর। মেয়েটির পেলব কপোলের ত্বকে পুরুষটিরপুরুষ্ট অধর ছোঁয়ার পূর্বেই সরিয়ে নিল। রিনরিনে গলায় বলল—

“ছোঁবেন না আমাকে?”

আলমির ধাতস্থ হলো। বলল—

“কী চাও তুমি?”

“প্রিয়তাকে ছোঁয়ার সময় অন্য কেউ তো ছিল না আপনার মনে, তাহলে আজ কেন মনে একজনকে রেখে আমাকে ছুঁতে চাচ্ছেন?”

“আমি কী করতে পারি বলো।”

“যেদিন প্রিয়তাকে ভুলে শুধু আমাকে আপনার হৃদয়ে জায়গা দিতে পারবেন, সেদিন আমাকে ছোঁবেন।”

আলমির নরম হয়ে এলো। ইরজার দৃষ্টিতে উত্তাপ। আলমির বলল—

“ঠিক আছে। তাই হবে।
এখন বলো, এসব কী করে জানলে তুমি?”

“প্রিয়তার ডায়েরি থেকে।”

“প্রিয়তার ডায়েরি! ওটা তুমি কোথায় পেলে?”

“সুলতানা দিয়েছে।”

“ওটা দাও আমাকে।”

“কেন? কী করবেন আপনি?”

“ফেলে দেবো। কী দরকার তোমার এসব পড়ার? ”

ইরজা জবাব দিলো না। শুধু আলমিরের মুখের দিকে উন্মনা চোখে চেয়ে রইল।

ইরজার ঘৃণা হতো মানুষটাকে। তবে ধীরে ধীরে তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। প্রিয়তার প্রতি আলমিরের আসক্তি তাকে জানার জন্য উতলা করে তুলেছিল ইরজাকে। প্রিয়তাকে তার খুব জানতে ইচ্ছে করত। কিন্তু আজ যখন, প্রিয়তার সাথে আলমিরকে দেখল, কেন জানি বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। দুঃখে, অভিমানে সব ভেঙ্গেচুরে ফেলতে ইচ্ছে হলো। নিজেকে যতটা সাহসী আর কঠিন ভেবে সে ডায়েরিটা পড়তে চেয়েছিল, ততটা সাহসী সে নয়। তার মনটাও পাথর নয়। এখন আর প্রিয়তাকে তার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না। হিং সে হচ্ছে। আলমিরকে পুরোপুরি পেতে প্রিয়তা না থেকেও যেন চীনের প্রাচীর! এ বড়ো অন্যায়! এ বড়ো নিষ্ঠুরতা!

পাশাপাশি শুয়েও যেন একজন আরেকজন থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে। ইরজার অক্ষিকোটর বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল থেমেছে। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন সে। আলমির জেগে রইল। ইরজাকে সে চায়। তবে প্রিয়তাকে পুরোপুরি ভোলা কী সম্ভব?

চলবে,,,