প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-২৩+২৪

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২৩
লেখনীতে:আইশা তানভি

আজ ভোর থেকেই নীলাম্বরের মন ভালো নেই। কিয়ৎপল এদিক সেদিকেই বুক ভরে রোদনঝরা দৃষ্টি। কৃষ্ণ জলদের গুচ্ছ গুচ্ছ পাহারাদার এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যদেব চোখ রাঙাতেই পথ আগলে দাঁড়ায়। মেঘ কন্যার মন খারাপ হয়। চট করেই কেঁদে ফেলে। এমন দিনে আকাশের সাথে সাথে মনুষ্যকুলেরও মন খারাপ হয়। চারদিক কেমন সজীব কিন্তু স্তব্ধ হয়ে আছে, যেন আঁধার শামিয়ানায় ঘিরে আছে চারপাশ।

আজ এই ঝিরিঝিরি বাদল দিনে ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা আর সেই তেলে বেগুন ভাজা হবে। সাথে আছে কলিজা ভুনা। একদম মাখো মাখো করে। বাড়ির সব পুরুষ আজ দুপুরে একসাথে খাবে। শশীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পায়তারা করছে অপূর্ব। কিন্তু শশী নাছোড়বান্দা। এই আরাম আয়েশের জীবন তাকে খুব করে টানে যেটা তার মধ্যবিত্ত স্বামীর ঘরে নেই। শশুর – শাশুড়ির সাথে বনিবনা না হওয়াই আলাদা থাকে সে। অপূর্বর ভাগ্য ভালো যে তার বাবা নিজের জীবনের ছোট্ট উপার্জনে একটা টিনশেড বাড়ি করেছিল, সেই বাড়িতে থাকেন তারা। পেনশনের কিছু টাকা আর অপূর্বর দেওয়া সামান্য টাকায় তারা দিনযাপন করেন। তবে মন ভরে না শশীর। শৈশব কেটেছে তার উচ্চবিলাসে। কিন্তু ঘোরের বশে করে ফেলেছিল ভুল। প্রেমের উন্মত্তা জোয়ারে ভেসে বিয়ের আগেই গর্ভধারণ করে সে। তাই বাবা শরীফ আশরাফ নিজের সম্মান বাঁচাতে অপূর্বর সাথেই বিয়ে দিয়ে ছিলেন শশীকে। কিন্তু কিছুদিন পরপর স্বামীর সাথে ঝগড়া করে এই বাড়িতে উঠত সে। থাকত দীর্ঘ সময় ধরে। এভাবে চলছে শশীর দোটানার জীবন। বাধ্য হয়ে মেয়ের ভালোর জন্য তাকে বোডিং স্কুলে দিয়েছিল অপূর্ব। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে ঝগড়া করে মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে এখানে এসে গেড়ে বসে শশী। অপূর্ব ভীষণ বিচক্ষণ হলেও প্রেমের ঘোরে করে ফেলেছিল এক ভুল। তার খেসারত তাকে হয়তো আজীবন দিয়ে যেতে হবে।

বোনের মা হওয়ার অবর্ণনীয় খুশিতে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিয়েছে ইরজা। আগের মতো ক্যাটক্যাটে স্বভাব কিছুটা থিতিয়ে এসেছে। তবে ইরজাকে সবচেয়ে বেশি উন্মনা, অসহিষ্ণু, নিষ্প্রভ করে রাখে প্রিয়তার সেই ডায়েরি। আজ অনেকদিন হলো ডায়েরির পাতায় চোখ বোলায়নি সে। ইচ্ছে করেনি যে তা নয়। তবে তীব্র অভিমান, অদমনীয় ক্ষোভ, আর এক রাশ হতাশা তাকে বারংবার বাঁধ সেধেছে। আলমিরের সাথে সম্পর্কটাও খুব স্বাভাবিক চলছে। খুব জরুরি না হলে কথাবলাও তেমন হয় না।

সোলায়মান দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের কাছে। তাকে ডাকল ইরজা। বলল—

“তুমি যাও, গিয়ে রেস্ট নাও।”

গতরাতে হঠাৎ করেই জ্বর আসে সোলায়মানের। তবে কাউকে সে জানায়নি। ঘণ্টা কয়েক তাকে দেখতে না পেয়ে তার রুমে গিয়েছিল ইরজা। সিঁড়ির নিচে ছোট্ট এটাচ বাথরুম ওয়ালা রুমে থাকে সোলায়মান। সোলায়মানের প্রতি এই স্নেহটুকুও আড়চোখে দেখছে অনেকে। তবে সেসবের তোয়াক্কা করে না ইরজা।

দুপুরের রান্না শেষ হতে একটু দেরি হয়ে গেল। ইরহাকে যতটা সম্ভব ভারী কাজ থেকে দূরে রাখে ইরজা। গরম, ধোঁয়া এসবে যেন বোন আর বোনের অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকেও দারুন মনোযোগ তার। সোলায়মানও অসুস্থ। তাই একা একা সব সামলে নিতে একটু বেগ পেতে হলো ইরজাকে।

খাবার টেবিলে সাজিয়ে গোসলে গেল ইরজা। ততক্ষণে বাড়ির পুরুষরা সব ফিরে এসেছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পেল আলমিরকে। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। একটা সুতি শাড়ি পরেছে ইরজা। বেগুনি রঙের মোটা পাড়ের জলপাই রঙা শাড়ি। ভেজা চুল একপাশে পড়ে আছে। বারান্দায় টাওয়েল মেলে রুমে এলো ইরজা। আলমির দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটার সিক্ত কুন্তল, ভেজা পল্লব, চোরা চাহনির ওই মুখখানিতে কী অমোঘ মায়া! চুল আঁচড়ে ভেজা চুলে খোঁপা করে নিলো ইরজা। মাথায় ঘোমটা টেনে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল–

“খাবার বাড়ছি, আসুন।”

বিগলিত হাসল আলমির। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এলো। দাঁড়িয়ে রইল ইরজা। ইরহাকে জোর করে খেতে বসাল। তাকে ঔষধ খেতে হবে তাই। সবাই খেতে শুরু করলেও আলমির বসে রইল। মাথা তুলে বলল—

“তুমিও বসো। ”

“আমি পরে খেয়ে নেব।”

“কেন? খিদে পায়নি তোমার?”

ইরজা সশব্দে শ্বাস ফেলল। একটা প্লেট নিয়ে তাতে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল–

“খিদে সহ্য করতে শিখে গেছি। ”

খাবার নিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই পেছন থেকে আহিল জিজ্ঞেস করল—

“কোথায় যাচ্ছ?”

“সোলায়মানকে খাবারটা দিয়ে আসি। বেচারা অসুস্থ!”

“সোলায়মানের জন্য খুব টান দেখছি!”

অধরের কোণে কেমন তাচ্ছিল্যতা আহিলের। ইরজা বলল—

“মানুষের জন্য মানুষের টান থাকবেই। কখনো দেখেছেন অ মানুষের জন্য মানুষের টান হতে?”

আহিল অপমানবোধ করল। ইরহার দিকে কেমন ক্ষোভিত চোখে তাকাল। অপূর্ব হেসে কৌতুক করে বলল—

“বাহ্! সেয়ানে সেয়ানে যুদ্ধ লাগলে সেটা উপভোগ্য হয়। এতদিন তো বাঘ আর হরিণের লড়াই দেখেছি।”

কথার টিপ্পনি বুঝতে পেরে খলবলিয়ে উঠল শশী।

“বেশি কথা বলো না।”

“সেটার সুযোগ কই দাও?”

শরীফ আশরাফ নাক ফোলালেন। জামাতাকে মোটেও পছন্দ না আমেনার। অপূর্বর এই তীর্যক কথার কারণে শশুড় বাড়িতে তাকে বিষ চোখে দেখা হয়।
,
,
,
ইরহাকে ঔষধ দিয়ে পানি দিলো ইরজা। বিছানার ওপাশটায় বসে আছে আহিল। তার চতুর, চোরা, বিষময় চাহনি। নাকের ডগায় একরাশ মুগ্ধতার সাথে ঘৃণার কলতান।

“তুমি রেস্ট নাও আপু। কোনো কিছু লাগলে আমাকে বলবে।”

“থাকো তো রুমের ভেতরে। বলবে কী করে?”

“ডেকে নেবেন। নাকি সেটাতেও অসুবিধা?”

ইরহা ইশারা করে তর্ক করতে নিষেধ করল। দমে গেল ইরজা। সে বেরিয়ে যেতেই খেঁকিয়ে উঠে আহিল।

“তোমার বোনের মুখে চিরতা পাতা দিয়েছিলে?”

ইরজা মুচকি হাসল। তার বোনটা বিচ্ছু। কাউকে ছাড় দেয় না।
,
,
,
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো ইরজা। খুব ঘুম পাচ্ছে তার। তবে চট করেই তার ঘুম উবে গেল। বিছানায় একটি গিফ্টবক্স রাখা। ইরজা সন্তর্পণে বিছানার কাছে এসে বাক্সটি হাতে নিলো। সেটির ওপর খুব যতনে লেখা—-

“কথামালা,
বিরহ জলে সর্বশ্রান্ত মন, বাড়ে হৃদয় দহন
ছুঁয়ে যাক বৃষ্টির জলের মতো অন্তরের সমস্ত ক্ষরণ।”

ইরজা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল। অধীর আগ্রহে বাক্সটি খুলতেই একটা শাড়ি, পাথরের কারুকার্য খচিত চুড়ি, কান আর গলার জিনিস পেল। দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে এলো তার। কৌতূহল বাড়ল। শাড়িটি হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখতেই একটা কাগজ বেরিয়ে এলো। ইরজার আড়ষ্টতা বাড়তে লাগল। অন্তঃকরণে কী চাপা স্ফুরণ! কাগজটি খুলতেই দেখল সেখানে টানা টানা অক্ষরে কিছু লেখা।

” কথামালা,
যদি সম্ভব হয়, শাড়িটা পরো। সন্ধ্যায় বাইরে যাব। ডিনার বাইরে করব। যদি চাও তোমার পছন্দের কোনো জায়গায়। একটু তো রহম করো!”

শেষের বাক্যে অস্ফুট হাসল ইরজা। তার রাগ গলে গেল। কেমন উষ্ণ প্রেমে শরীরটা অসাড় হয়ে এলো।
,
,
,
সন্ধ্যার কিছু সময় পরে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল আলমিরের গাড়ি। ফোন বাজল ইরজার। কানে তখন দুল লাগাচ্ছিল সে। ফোন বাজতেই ছুটে এসে রিসিভ করল।

“হ্যালো!”

এই কণ্ঠে ছিল হর্ষ। ছিল আবেগের প্রাচূর্য। আলমির শীতল গলায় বলল–

“রেডি?”

“হ্যাঁ।”

ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া খুশিতে উদ্বেলিত স্বর। আলমির বলল—

“আমি নিচে আছি। এসো।”

ইরজা ফোন রাখল হাতব্যাগে। চেইনটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে আরেকবার দেখে ফটাফট বের হলো। ইরজার এই তাড়াহুড়ো দেখে শশী ভ্রূকুঞ্চিত করে বলল—

“কোথায় যাচ্ছ?”

ইরজা দম ফেলল। সে চাচ্ছে না এখন কোনো ঝামলা হোক। তাই রয়ে সয়ে জবাব দিলো—

“রিনির মামা এসেছে। যেতে বলেছে আমাকে।”

“এত রাতে বাইরে কী? আর ঘরের কাজ করবে কে?”

“সব গুছিয়ে রেখেছি। রাত হোক আর দিন, আমি তো অন্য কারো সাথে যাচ্ছি না।”

শশী ক্ষেপে উঠে আমেনাকে ডাকল।

“মা,মা,দেখে যাও।”

ইরজা দাঁড়াল না। সে চটপট সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল। আমেনা আসার পূর্বেই সে আলমিরের গাড়ির কাছে। আলমির দরজা খুলে দিলো। বিমুগ্ধ চিত্তে ইরজাকে দেখছে আলমির। রোজ গোল্ড কালারের শাড়ি। সাথে ডায়মন্ড কাট পাথরের নেকলেস। হাত ভরতি চুড়ি। চুল খোলা।
,
,
,
একটা ভালো মানের রেস্তোরাঁয় এসেছে দুজন। সামনাসামনি বসে একে অপরের। মেজেন্টা কালারের টেবিল ক্লথের ওপর একটা ছোটো ফুলদানি, টিশু স্ট্যান্ড। সাথে ক্যান্ডেল স্ট্যান্ডও আছে। আলমিরের দিকে নয়, তাকে এড়িয়ে চলার মিথ্যে অভিপ্রায়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে ইরজা। আলমির বুঝতে পেরে নিগূঢ় হাসছে। আচমকা ইরজার মুখভঙ্গি বদলে গেল। থমথমে হয়ে খেল মুখ। চাহনি সরু হলো। শ্বাস ভারী হয়ে উঠল। তেতো হয়ে উঠল অভিব্যক্তি। সহসা উঠে দাঁড়াল ইরজা। হনহনিয়ে সামনের দিকে গেল। তার দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরল আলমির। তিন টেবিল সামনে এক জোড়া কপোত-কপোতী। ইরজা গিয়েই ছেলেটাকে কিছু একটা বলল। ছেলেটা দাঁড়াতেই ঠাস করে এক দাবাং চড় বসাল ছেলেটার গালে। আলমির হতভম্ব হয়ে গেল।

চলবে,,,

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২৪
লেখনীতে: আইশা তানভি

নোমান হকচকিয়ে গেল। তীব্র আক্রোশের সাথে তেড়ে এসে ইরজাকে মার তে গেলে তার হাত চেপে ধরে আলমির। নোমান অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছায়। আলমির বজ্রকঠোর কণ্ঠে বলে উঠে—

“সাবধান! ভুলেও এই ভুল যেন না হয়।”

“আপনি কে?”

নোমান উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল। আলমির হাত সরিয়ে বলল—-

“যাকে চড় মার তে যাচ্ছিলেন তার স্বামী।”

বিপন্ন দৃষ্টি নোমানের। রাগে ফুলে ফেঁপে আছে ইরজা। লাগামহীন ক্রোধ চক্ষুজল নামিয়ে এনেছে। নোমানের সাথে একটা মেয়ে আছে। মেয়েটি বিস্ফোরিত চোখে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে। ইরজা খলবলিয়ে উঠে বলল–

“কাপুরুষ ! ইচ্ছে করছে তোকে একটা লা থি মা রি!”

নোমান দাঁত খামটি মে রে বলল—

“চড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দেবো বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! তোর সাহস হয় কেমনে আমার গায়ে হাত তোলার? বডিগার্ড আছে, তাই সাহস দেখাচ্ছিস!”

“শা লা! তোকে আজ…।”

ইরজা ছেলেটার গলদেশ চেপে ধরতে চাইছিল। তাকে সরিয়ে নিয়ে চেপে ধরে রাখল আলমির। শান্ত স্বরে বলল—

“রিল্যাক্স! এত হাইপার হওয়ার কী আছে?”

“হাইপার হবো না? ছাড়ুন আমাকে।”

আলমির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নাক কুঁচকে বলতে লাগল—

“এটা একটা খচ্চর। আমাকে পড়াতে এসে এটা সেটা বলে আমার মন গলিয়ে যখন যা পেয়েছে হাতিয়েছে আমার কাছ থেকে। একবার প্রায় দশ হাজার টাকা নিয়েছে মায়ের অসুখের কথা বলে। আমাকে বিয়ে করবে বলে পালিয়ে আসতে বলে শা লা, বেইমান আর আসলই না। ওকে ইচ্ছে করছে….।”

“ও আচ্ছা, এই তাহলে তোমার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক?”

আলমির ফিচেল গলায় বলল। শক্ত চোখে তাকিয়ে মুখ ঝামটা মেরে উত্তর দিলো ইরজা—

“প্রেমিকের কপালে ঝাঁটা!”

দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মাথা ঝিমঝিম করছে। সে অবাকের মিশেলে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে শুধাল—

“তুমি এই মেয়েকে ঠকিয়েছ?”

“আরে না, না। ওকে তো আমিই চিনিই না।”

মেয়েটার রাগে কান্না পেয়ে গেল। নোমান মেয়েটাকে মানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটি নোমানের হাতে থাকা ব্রেসলেটটি খুলে নিলো। পকেট থেমে মোবাইল ফোন বের করে নিয়ে কান্নাজড়িত স্বরে বলল—

“কু ত্তা, তুই আমার সব জিনিস ফিরিয়ে দিবি। নাহলে তোকে খু ন করব আমি।”

মেয়েটি দ্রুত পা চালায়। সাথে চোখের পানি মুছতে থাকে। মেয়েটির পেছন পেছন ছুটে নোমান। আর বলে—

“তোকে দেখে নেবো।”

“নিস। আগে গার্লফ্রেন্ড সামলা।”

ইরজার রাগ কমল না। সে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে লাগল দরজার দিকে। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার আর স্টাফরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাগ্যিস, বৃষ্টির দিন বলে, আজ মানুষ কম ছিল!

উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছে ইরজা। আলমির হেসে বলল—

“এই তাহলে তোমার বয়ফ্রেন্ড? ব্যাটাকে এত জোরে চড়টা না মারলেও পারতে।”

উপহাসের হলকা। ইরজা আ গুন চোখে তাকাল। গা দুলিয়ে হেসে উঠল আলমির।

“একদম হাসবেন না।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

আলমির হাসি বন্ধ করল। কিয়ৎপল বাদ অনুচ্চ স্বরে রয়ে সয়ে বলল—

“স্যারের সাথে প্রেম….বাহ্.. তুমি তো দেখছি ভালোই সাহসী।”

“সাহস দেখেই তো আমাকে বিয়ে করেছেন, যেন আপনার আর আপনার বউয়ের বাসর লীলা পড়তে পারি।”

আলমিরের মুখের খুশি খুশি ভাবটা মুহূর্তেই উবে গেল। কণ্ঠ ভার করে বলল—

“তুমি নিজেই চাইছ এসব আমি ভুলে যাই, কিন্তু বারবার এসব বলে তুমি আমাকেই ইরেটেট করছ?”

“ও আচ্ছা তাই?”

ইরজা পুরো ঝগড়ার মুডে চলে এসেছে। তাই আলমির কথা বাড়াল না। ইরজা দমল না। ক্যাটক্যাটে স্বরে বলল—

“আমি বললেই কী আপনি ভুলে যাবেন?হা, হা, হা। হাউ ফানি! ভুলার হলে গত পাঁচ বছরেই ভুলে যেতেন। আমার প্রিয়তা, আমার প্রিয়তা বলে মুখে ফেনা তুলতেন না।”

রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে ইরজা। আলমির এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপ হয়ে রয়েছে। একটু দূরে তাদের গাড়ি রাখা।

“তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছ ইরজা।”

“আরে যান তো। আপনাদের সব পুরুষদের চেনা আছে আমার। শুধু নিজেদের স্বার্থই বোঝেন….. ধুর, আপনি কেন যাবেন? আমিই চলে যাই।”

ইরজা গাড়ির উলটো দিকে হাঁটা ধরেছে। আলমির ডাকতে লাগল—-

“দাঁড়াও বলছি, ওদিক কোথায় যাচ্ছ?এই আমার কথা শোনো।”

ইরজা আলমিরের দিকে ফিরল। জোরে জোরে বলল—

“দাঁড়াব না। শা লা আমার কপালই খারাপ! যেই থালে যাই সেটাই ফুটো। একজন রেখে পালিয়ে গেল, আরেকজন ধরে রেখে পালিয়ে বেড়ায়। ছাতার কপাল আমার!”

নিজের কপালে চাপড় বসিয়ে শাপ শাপান্ত করতে থাকল অভিমানে আচ্ছন্ন মেয়েটি। সে টের পেল না ঘাতক তাকে আ ঘাত করতে এগিয়ে আসছে। হেলমেট পরিহিত ছেলেটি মুহূর্তেই ইরজাকে ধাক্কা দিয়ে যাওয়ার অবস্থা। আলমির চেঁচিয়ে ওঠে।

“ইরজা!”

ইরজাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেও নিজে সরতে পারেনি আলমির। বাইকের সামনের চাকায় ধাক্কা লেগে পাশে উল্টে পড়ে। একপেশে হয়ে পড়ে যাওয়া ইরজা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে একটু ধাতস্থ হয়েই গা লাগা ল শুরু করে।

“ইত র, জানো য়ারের বাচ্চা! চোখে দেখিস না? রাস্তা কী তোর বাপের?”

ইরজার ঠাওর হলো এ অন্য কেউ নয় নোমান। রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। অকস্মাৎ আলমিরের ব্যথামিশ্রিত কণ্ঠে সচেতন হয় সে। রাস্তায় পড়ে থাকা আলমিরকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে ইরজা। আশেপাশের লোক জড়ো হয়। ইরজা অপ্রকৃতিস্থের মতো ছুটে গিয়ে আলমিরকে ধরে বসায়। মাথায় আ ঘাত লেগেছে। কনুই ছুঁলে গেছে। তবে আলমির উঠতে পারছে না। তার হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। তাকে ধরে উঠালো ইরজা। স্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল আলমির। লোকজন হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলল। আলমির মানা করল। ইরজাকে বলল, তাকে কষ্ট করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে। ইরজা তাই করল।
,
,
,
হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে গেল। আলমির গাড়ি থেকে বের হলো ইরজার হাতে ভর দিয়ে। হাঁটুতে আ ঘাত লাগায় হাঁটু ফুলে গেছে। ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়েছে আর বলেছে রেস্ট নিতে। কনুইয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। মাথার পেছনে দুটো সেলাই লেগেছে।

ঘরে ঢুকতেই আমেনা আশরাফ চটে গেলেন। তবে আলমিরের এহেন হালে বিচলিত হলেন পরক্ষণেই। সবাই এলো, শুধু এলো না আহিল। সব শুনেও রুমে বসে রইল। ঘটনার বিস্তারিত শুনে সবাই বকাঝকা করল। শরীফ আশরাফ কথার জালে ইরজাকেই দোষারোপ করলেন।
,
,
,
বিছানায় শুয়ে আছে আলমির। ব্যথায় জর্জরিত মুখে গহন হাসি। ইরজাকে আপাদমস্তক চোখের জালে আটকে রেখেছে সে। ইরজার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখছে বদ্ধদৃষ্টিতে। আলমিরকে ঔষধ খাইয়ে দিলো। বলল—

“অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ুন।”

“তুমি?”

“একটু কাজ আছে আমার।”

“কী কাজ?”

“সব কিছুর কৈফিয়ত কী আপনাকে দিতে হবে?”

ইরজা চলে যেতে চাইলে তার হাত ধরে আলমির। গাঢ় অনুরক্তি নিয়ে বলল—

“সরি কথামালা!”

“সরি কেন বলছেন?”

“আমার কারণে আজ….।”

“আপনার কারণে কিছুই হয়নি। ভালো হয়েছে ওই শয় তানটার সাথে দেখা হয়েছে। যদি আর কয়েকটা লা থি মারতে পারতাম, তাহলে শান্তি পেতাম।”

আলমির চুপ করে রইল। ইরজা পূনরায় বলল—

“সরি আমি। রাগের মাথায় আপনাকে উলটা পালটা বলে ফেলেছি। প্রিয়তা…।”

ইরজাকে থামিয়ে দিলো আলমির। বলল—

“তুমি কী সত্যিই চাও আমি প্রিয়তাকে ভুলে যাই?”

ইরজা এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। কেমন করে উঠল তার মন কুঠির। আজ এতদিন পর নোমানকে দেখে যে তার শুধু রাগ এসেছে তা নয়। সেই দিনগুলোর কথা মনে করে খারাপও লেগেছে। আলমিরের হাত সরিয়ে উলটো ঘুরে অন্যমনষ্ক মনে কয়েক কদম হাঁটল।

নোমান তো ছিল ধোঁকাবাজ। তবুও তাকে দেখে তার ভেতরটা হু হু করে উঠেছে। সেখানে প্রিয়তা তো ছিল আলমিরের প্রিয় স্ত্রী। যাকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। যার সাথে দীর্ঘদিন সংসার করেছিল। তাকে চিরতরে ভুলে যাওয়া কী এতই সোজা?

ইরজা নিজেকে প্রশ্ন করে। সে কী কখনো চাইবে নিজের মৃত্যুর পর তার স্বামী তাকে চিরতরে ভুলে যাক? কখনো চাইবে না। তাহলে অন্যের ক্ষেত্রে কেন সে স্বার্থবাদী?
আলমির তো তাকে কখনো অসম্মান করেনি, কিংবা তার কোনো প্রয়োজন অপূর্ণ রাখেনি। আলমির অনেকটা চেয়েওছিল তার দিকে এগোতে। কিন্তু ইরজার পুরোপুরি সম্মতি ছিল না। তাহলে কীসের ভিত্তিতে সে আলমিরকে দোষারোপ করছে? শুধুই কী প্রথম স্ত্রীকে পুরোপুরি ভুলে না যাওয়ার দরুন?

ইরজা নিজেকে বোঝাল। সে এই সম্পর্ককে একটা সুযোগ দেবে। প্রিয়তা হতে চায় না সে। সে ইরজা। ইরজাই থাকবে। সে নিজের জায়গা নিজে গড়বে। ইরজা কাউকে অসম্মান করে না। শুধু পালটা জবাব দেয়। সেখানে একটা মৃত মানুষের স্মৃতিকে এত কেন অসম্মান?

চলবে,,,