#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২৫
লেখনীতে:আইশা তানভি
বিষণ্ণ বিকেল! মন খারাপের উদাস বেলা! ছাদে দাঁড়িয়ে অন্তরীক্ষে চেয়ে আছে ইরজা। রুমে ঘুমিয়ে আছে আলমির। একা একা ভালো লাগছিল না তাই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ হলো।
আজ সকাল হতে অনেক কাজ করেছে সে। রিনির আজ জন্মদিন। রাঙা বউয়ের কাছে তার হরেক বায়না। ইরজাও ছোট্ট প্রাণটাকে মানা করতে পারেনি। একটা কেক অর্ডার দিয়েছে অনলাইনে। বেশ কিছু রান্না করেছে সে। তেমন কেউ আসবে না। রিনির দাদা- দাদী, ইরহার মা-বাবা, অফিসের একদম থার্ড গ্রেডের কর্মচারিবৃন্দ। অফিসের স্টাফদের দাওয়াতের আইডিয়াটা ছিল ইরজার।
“একা!”
আহিলের তীর্যক প্রশ্ন। ইরজা চোখ নামিয়ে আনলো। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল–
“আপনি? ”
“হ্যাঁ। অন্য কেউ আসার কথা?”
“আমার অন্য কেউ আছে সেটা নিশ্চয়ই জানেন? তাহলে আশা করতে দোষ কোথায়?”
“আছে না নেই… সেটা তো একমাত্র তুমিই জানো।”
“কী বলতে চান আপনি?”
আহিল হাসল। তার হাসিতে অদ্ভুত ব্যঙ্গ। বলল—
“তুমি যথেষ্ট স্মার্ট আর সুন্দরী….বাট।”
ইরজাকে আপাদমস্তক জহুরি চোখে দেখে আফসোসের সুর ঠেলে পূনরায় বলল—
“কিন্তু প্রিয়তার ধারে কাছেও নেই। আলমির ভাই তোমাকে কেন বিয়ে করছে সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। তোমাদের মাঝে সব ঠিক আছে তো?”
“সব বলতে?”
“সব বলতে সব। যেমনটা আমার আর তোমার বোনের।”
ইরজা কপালে ভাঁজ তুলে বিরক্তি ছুড়ল। আহিলের দৃষ্টিতে কী যেন! এই অদ্ভুত, কুরুচিপূর্ণ প্রশ্নের আসল হেতু ইরজা আঁচ করতে পারল। সে খিলখিল করে হেসে বলল—
“সব ঠিক আছে কিনা সেটা না হয় কিছুদিন পরেই বুঝবেন। আর বিছানায় সব ঠিক থাকলেই হয় না। নিজ অর্ধাঙ্গিনীর যত্নও নিতে হয়। স্বামী – স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। শুধু যে স্ত্রীই তার দায়িত্ব পালন করবে তা নয়। স্বামীকে তার কর্তব্য পালন করতে হবে। আপুর এই সময়টায় আপনাকে তার পাশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু আপনি…।
আপনি জানেন, আপুর এখন কয় মাস চলছে। আই থিংক জানেন না। কারণ, জানার প্রয়োজনবোধ করেননি। ”
ইরজা গজগজ করতে করতে চলে যায়। আহিল দাঁত খিঁচে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখছে।
,
,
,
আলমির গায়ে কটি জড়াতেই রুমে ঢুকল ইরজা। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল—
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“একটা জরুরি কাজ আছে।”
“একটু হাঁটতে পারছেন কী অমনেই দৌড়াদৌড়ি শুরু আপনার? কে বলেছে আপনাকে অফিসে যেতে।”
“কেউ না। দরকার আমার। তাই।”
আজ পনেরো দিনের বেশি হবে বাইরে যাওয়া বন্ধ আলমিরের। অফিসের যাবতীয় কাজ ঘর থেকেই তদারকি করে।
“বেশি কথা না বলে চুপচাপ এখানে বসুন। রিনির জন্মদিন মনে নেই?”
“আছে। ওর জন্য গিফ্ট তো লাগবে।”
“গিফ্ট? আপনি গিফ্ট আনতে যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ।”
ইরজা কৌতূহল দমাতে না পেরে বলল—
“কী আনবেন আপনি?”
আলমির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল—
“ও একটা ব্রেসলেট চেয়েছিল। ভাবছি গোল্ডের একটা ব্রেসলেট দেবো।”
“আপনারা কী এসব দামী দামী গিফ্ট ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না?”
“তাহলে তুমিই বলো।”
“আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক করে রেখেছি।”
“কী।”
“সারপ্রাইজ। বলা যাবে না।”
“আচ্ছা।”
আলমির তবুও দরজার দিকে যেতে চাইলে তার পথ আগলে দাঁড়ায় ইরজা। চোখ রাঙিয়ে বলল–
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“বললাম তো কাজ আছে।”
“কাজের গুষ্ঠির ষষ্ঠি! খুলুন বলছি।”
আলমির যারপরনাই অবাক হলো মেয়েটির কর্মকাণ্ডে। সে টেনেটুনে শার্টের ওপর থেকে কটিটা খুলে ফেলল। শার্টের বোতামে হাত দিতেই আলমির হাত ধরে বলল–
“এখন কী জামা কাপড় সব খুলে ফেলবে নাকি? তোমার ইরাদা তো আমার ভালো ঠেকছে না।”
বোকা বনে গেল ইরজা। সে ফটাফট আলমিরকে ছাড়তে চাইল। কিন্তু দুষ্ট পুরুষটি ছাড়ল না। বুকের মাঝে গেঁথে নিলো। গভীরভাবে। অচ্ছেদ্য আলিঙ্গনে। গাঢ় মায়ায় বলল–
“কথামালা!”
ইরজা অস্ফুট জবাবে বলল—
“হু।”
“তোমার শর্ত কী পূরণ হয়নি?”
ইরজা জবাব দিলো না। মিশে রইল। স্বামীর উষ্ণ কায়ায় সঙ্গে নিচ্ছিদ্র বন্ধনে। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ!
এই মন খারাপের বিকেল বেলা ইরজার কাছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রহর হিসেবে ধরা দিলো। এক পবিত্র আশ্লেষে একে অপরের শ্বাসে মিশে গেল।
,
,
,
সন্ধ্যার সময়টুকু ছিল আনন্দের। এক ঝলমলে মন খুশি করা সন্ধ্যা! রিনির খুশি আঁকাশ ছোঁয়া। সারা ড্রয়িং রুমে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সে। আজ তার সঙ্গী হয়েছে অফিস স্টাফদের ছেলে মেয়েরা। শশী, আমেনা একপাশে দাঁড়িয়ে রিনির উচ্ছ্বাস দেখছে। আহিলের মনে কেন যে হতাশা, তা আজও কেউ আন্দাজ করতে পারছে না। ইরহার মতো সঙ্গী পেয়েও যেন কিছুই না পাওয়ার তীব্র অসন্তোষ তার মন জুড়ে। রিনির দাদা- দাদীও সকল কষ্ট ভুলে গেলেন নাতিনের খুশির জোয়ারে।
ইরজা এখনো তৈরি হচ্ছে। মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে সে। ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি রঙের ম্যাট লিপস্টিক। চোখে কাজল। কানে ঝাপটা আকৃতির পাথরের দুল। তার পুরো সাজ বিছানায় বসে দেখেছে আলমির। ইরজা শশব্যস্ত হয়ে বলল—
“আপনি এখনো বসে আছেন কেন? রেডি হোন।”
আলমির বিছানা থেকে নামল। আচমকা ইরজাকে জড়িয়ে ধরল। ইরজা চমকে বলল—
“আরে কী করছেন, ছাড়ুন।”
আলমির ছাড়ল না। আজ কেন জানি তার ভয় করছে। বুকের কোথাও অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে। ইরজা একটু আলগা হলো। আলমির দুই হাতে হালকা করে আবদ্ধ করে রাখল ইরজাকে। তাদের মাঝে ইঞ্চি কয়েক দূরত্ব। ইরজা চিবুক তুলে আলমিরের চোখে তাকাল। ওই চোখে ভয়।
“আপনি ভয় পাচ্ছেন?”
“তোমাকে হারাতে পারব না আমি।”
“এভাবে কেন বলছেন?”
“আমি যখনই কাউকে ভালোবেসেছি, তখনই সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।”
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
জবাব শূন্য চিত্তে ইরজাকে বুকের সাথে পিষে ধরল আলমির। ইরজাও তার প্রণয়ীকে গাঢ় আলিঙ্গন বেঁধে নিলো।
“আমি কোথাও যাব না আপনাকে ছেড়ে আলমির। কোথাও না।”
“প্রিয়তাও বলেছিল। কিন্তু ও ওর কথা রাখেনি।”
“আমি প্রিয়তা নই। আমি আমার কথা রাখব। আপনি আমার পাশে থাকবেন তো?”
“থাকব কথামালা। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না আমি।”
আলমিরের মাথাটা ধরে তার কপালে চুমু আঁকল ইরজা। বাচ্চাদের মতো বুঝিয়ে বলল—
” এখন চলুন। সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
ইরজা আলমিরকে ছেড়ে যেতে চাইল। আলমির হাত টেনে ধরল। ইরজা পেছন ফিরে বলল–
“প্লিজ আলমির। ছাড়ুন আমার হাত। আপনি রেডি হয়ে নিচে আসুন।”
“হুম।”
আলমির হাত ছেড়ে দেয়। ইরজা চলে যাওয়ার পর বিছানায় ঠিক করে রাখা জামা কাপড়গুলো হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলমির।
গত দিনগুলোতে যে সেবাযত্ন ইরজা তাকে করেছে, তার ঋণ সে কখনো শোধ করতে পারবে না। তাদের সম্পর্কের সংজ্ঞাও বদলেছে। পেয়েছে ভালোবাসাময় এক নাম। প্রিয়তা তাদের মাঝের এখন আর দেওয়াল নেই। সে এখন তাদের সম্পর্কের ভিত। ইরজা নিজের জায়গা নিজে তৈরি করেছে। আলমির অবলীলায় এখন প্রিয়তার কথা বলতে পারে। ইরজার জায়গায় অন্য কেউ হলে এটা সম্ভব হতো না।
,
,
,
একটা প্রজেক্টরে রিনির ছোটোবেলার ছবি দেখানো হচ্ছে। কী যে খুশি মেয়েটা! তার উপুর হয়ে শুয়ে থাকা, ঠেলেঠুলে উঠে বসা, দেওয়াল ধরে ধরে দাঁড়ানো। নিজের শৈশবকে নিজ চক্ষে দেখতে পেরে রিনির আনন্দ আর ধরে না। ইরজা এসব কালেক্ট করেছে। সবার কাছে থেকে দারুণ দারুন গিফ্ট পেয়েছে রিনি। তবে দাদা-দাদী চলে যাবার কথা শুনতেই মন খারাপ হয়ে গেল তার।
চলবে,,,
#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২৬
লেখনীতে:আইশা তানভি
রিনির জন্মদিনের পরের দিন থেকেই অপূর্ব শশীকে তাড়া দিচ্ছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। শশী কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। এই নিয়ে গত তিন চারদিন ধরে তাদের মধ্যে মন কষাকষি,বাক- বিতণ্ডা চলছে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। অপূর্ব অগ্নিশর্মা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—
“তুমি যাবে কি না বলো। আমার পক্ষে এই বাড়িতে থাকা আর সম্ভব নয়।”
শশী তাচ্ছিল্যতা ছুড়ে বলল–
“তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও, আমি তো তোমায় ধরে রাখছি না।”
রিনি বিছানায় গুটিসুটি মে রে বসে আছে। বাবা-মায়ের কলহ তার মনটাকে বিক্ষিপ্ত করে তুলেছে।
অপূর্ব দন্ত নিষ্পেষণ করে বলল–
“কী বলতে চাও তুমি? তোমার কারণে আমি আমার বাবা- মাকে পর্যন্ত একা রেখে এসেছি। শুধুমাত্র তোমার সুখের জন্য।”
শশী বাঁকা হাসল। উপহাস ছুড়ে বলল—
“সুখ! সুখ বলতে কী বোঝায় তা জানো তুমি? কী দিয়েছ বিয়ের পর থেকে আমাকে? একটা দামী শাড়ি,একটা দামি গহনা, ভ্যাকেশনে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া; কোনটা করেছ তুমি? রেখেছ তো পনেরো হাজার টাকার ভাড়া বাসায়! আছে কী তোমার?”
অপূর্বর মেজাজ চড়া হলো। সে দাঁপিয়ে এসে বলল–
“আমার কিছু নেই সেটা কী তুমি আগে দেখতে পাওনি? বিয়ের আগে কেন ভাবোনি এসব?”
“তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে কে? একটা ভুল করে ফেলেছিলাম, তাই জোর করে বাবা তোমার মতো একটা দারিদ্রের হকারের সাথে বিয়ে দিয়েছে আমার।”
অপূর্ব তেতে ওঠে। ক্রোধে তার চোখের কোটর লাল হয়ে গেছে। নাকের ঢগা কাঁপছে থরথর করে। প্রকুপিত কণ্ঠে বলল—
“ভুল যখন করেই ফেলেছ, তাহলে এবার শুধরে নাও। মুক্তি দাও আমাকে।”
“মুক্তি! তুমি এমনিতেও মুক্ত।”
“ওকে ফাইন। আজ এই মুহূর্তে তোমার সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করলাম। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি।”
রিনি কেঁদেই যাচ্ছে। বাবা-মায়ের ঝগড়ায় মেয়েটা অসহায়। অপূর্ব তেড়ে গিয়ে মেয়ের হাত ধরল। তাকে বাঁধা দিলো শশী। স্বামীর হাত থেকে মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল—
“রিনি কোথাও যাবে না। ও এখানেই থাকবে। ”
“রিনি আমার কাছেই থাকবে। তুমি থাকো তোমার বড়োলোক বাবার ঘরে।”
রিনিকে নিজের কাছে নিয়ে জড়িয়ে রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল শশী—
“রিনি আমার মেয়ে। ওকে আমি জন্ম দিয়েছি। ও আমার সাথেই থাকবে। তুমি যাও আমার সামনে থেকে।”
অপূর্ব ক্ষোভে তেড়ে এলো। আঙুল উচিয়ে শশীকে শাসিয়ে বলল—
“ও আমারও মেয়ে। আমি ওর বাবা। আজ এতগুলো বছর এই মেয়েটার জন্য তোমার সব অন্যায় আমি সহ্য করেছি। ও তো তোমার জীবনের ভুল! তাহলে ওকে কেন ছাড়তে চাইছ না?”
“আমার মেয়ে তোমার সাথে কোথাও যাবে না। যে ভুল আমি করেছি, তা ওকে করতে দেবো না। তুমি ওকে দেবেটা কী? যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।”
“একটু তো লজ্জা করো শশী। এতটা নির্দয় হও কী করে? কী করিনি তোমার জন্য আমি? রাতদিন কুকুরের মতো খেটে তোমার সব চাওয়া পূরণ করার চেষ্টা করেছি। আর তুমি…। ছিঃ! আমার বলতেও লজ্জা করে যে, তোমার মতো একজনকে ভালোবেসেছি আমি।”
“কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি না। ক্লান্ত হয়ে গেছি তোমার সাথে ভালোবাসার নাটক করতে করতে। প্লিজ, লিভ মি! আই হেট ইউ! প্লিজ, ফর গড সেক, মুক্তি দাও আমাকে। তোমার সাথে আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। না আমার মেয়ের।”
বিহ্বল, অবিশ্বাস্য, বিস্ফোরিত দৃষ্টি অপূর্বর কাকে এতকাল ভালোবেসেছে সে? কার জন্য নিজের বৃদ্ধ বাবা -মাকে ছেড়ে এসেছে? কার জন্য গাধার মতো খেটেছে সে? এক ছলনাময়ী, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীনার জন্য। না, আর নয়। এই সম্পর্কের আর কোনো মানে নেই। ক্ষোভে ভেতরটা বিধ্বংসী হয়ে উঠল অপূর্বর। মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে শশীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল—-
“ছাড় আমার মেয়ের হাত। তোকে আর আমার প্রয়োজন নেই। তুই থাক তোর এই অট্টালিকায়। আমার মেয়ে তার গরীব বাবার কাছে মানুষের মতো মানুষ হবে। তোর মতো লোভী, আত্ম অহংকারী, ছলনাময়ী নয়।”
“হেহ, ছাড় আমার মেয়েকে। নাহলে তোকে আমি।”
“কী করবি তুই?”
“তোকে আমি….।”
শশী রাগে দিশা হারিয়ে ফেলল। বাবা-মায়ের এহেন হালে ভীতসন্ত্রস্ত রিনি। তার শরীর কাঁপছে থরথর করে। চোখে অথৈ জল। শশী টেবিলের ওপর থেকে ছোট্ট, গোলাকার অ্যাকুরিয়ামটা নিলো। সেটি সজোরে ছুড়ে মার লা অপূর্বর দিকে। অপূর্ব পাশ কাটিয়ে যায়। মায়ের এরূপ উগ্রমূর্তিতে আতঙ্ক ঘিরে ফেলে রিনিকে। সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অপূর্ব যারপরনাই অবাক হলো। সে রিনিকে গিয়ে ধরল। তাকে নিয়ে হাঁটা ধরতেই শশী ছুটে আসতে চাইল। কিন্তু পারল না। অ্যাকুরিয়ামটা ছুড়ে মারার সময় কিছুটা পানি ছিটকে বেরিয়ে পড়েছিল শশীর কয়েক হাত দূরে। সেই পানিতে অসাবধানতায় পিছলে পড়ে বিছানার শেষ প্রান্তের কোনার ওপর। ধড়াস শব্দে মুহুর্তেই লুটিয়ে পড়ে শশী। গলগলিয়ে লহুর স্রোত মাথার তলদেশ থেকে ছড়াতে থাকে। শব্দে থমকে গিয়ে পেছন ফিরে মাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে এক আর্ত চিৎকার মা রে রিনি।
,
,
,
আজকাল বেশিই খারাপ লাগে শরীরটা ইরহার। কিন্তু শরীরের চেয়ে মন পোড়ায় তাকে বেশি। আহিল কেমন যেন অন্য মনষ্ক হয়ে থাকে সবসময়। তার প্রতি উদাসীনতা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। অন্তরঙ্গতার সময়টুকু খুবই বিতৃষ্ণায় কাটে ইরহার। তার অপারগতা আহিলকে আরও জটিল করে তুলে। রুষ্ট হয় স্বামীরূপী পুরুষটি। ইরহা কোনোভাবেই নিজের বিষণ্ণতা, খারাপ লাগা, মানসিক অস্থিরতা আহিলকে বোঝাতে পারে না। আজকাল স্বামীর পাশেও যেন নিজেকে কাঁটাস্বরূপ মনে হয় ইরহার। ভালো লাগে না তার কিছুই। শুয়ে ছিল সে। ঘুম এসেছিল আঁখি যুগলের তটে। চিৎকার, চেঁচামেচি তার গাঢ় ঘুমকে টলাতে না পারলেও রিনির গগনবিদারী চিৎকার তার কর্ণকুহরে সাড়া ফেলল। সে উঠে বসল। ধীরে বিছানা থেকে নেমে হেঁটে বাইরের দিকে এলো।
,
,
,
আজ প্রিয়তার ডায়েরি নিয়ে বসেছে ইরজা। মনে মনে পণ করল, এমন কিছুই সে পড়বে না যাতে তার মন খারাপ হয়। স্বামীর সঙ্গে অন্য নারীর ঘনিষ্ঠতা কোনো স্ত্রীই মেনে নিতে পারে না। প্রিয়তা আলমিরের স্ত্রী ছিল। এটি তার ব্যক্তিগত দিনলিপি। সেই ক্ষেত্রে ইরজাকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নিজের মনঃকষ্টের কারণ হবে এমন কিছুই তার পড়া উচিত নয়।
সে দুষ্ট হাসি দিয়ে নিজেকে নিজে বলল–
“মেয়েটা পাগল ছিল! ছিল কোমল, আদুরে, নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ। যেমনটা রোদ ঝলমলে নীলাভ আকাশ! নাহলে কী এত সুন্দর অনুভূতি কলমের কালিতে এত চমৎকার করে কেউ লিখে রাখে ? তবে প্রিয়তা, তুমি মেয়েটা ভীষণ অবুঝ, নাহলে কী আলমিরের মতো পুরুষকে ছেড়ে চলে যেতে? যাই হোক, এজন্য তোমাকে এক ঝুড়ি ধন্যবাদ। তুমি না গেলে, এত চমৎকার একজন পুরুষকে আমি পেতাম না। এখন তোমার প্রতি আমার হিংসে নয়, দয়া হচ্ছে। আমি কিন্তু আলমিরকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। মনে রেখো। সে শুধুই আমার। তোমার পাত্তা নেই। আর শোনো পাগল মেয়ে, এভাবে বরের কথা লিখতে নেই। নজর লাগবে!”
ইরজা খিলখিলিয়ে হাসে। প্রাণ জুড়ানো প্রভাতের বৃষ্টি ভেজা হাসি। সে পূনরায় নিজেকে বলে—
“তুমি ভীষণ দুষ্টও প্রিয়তা! যাই হোক, আমি বাবা তোমার ওসব রোমান্টিক সিন আর পড়ব না। বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার হয়ে গেছে। এখন শুধু পড়ব এই রাক্ষসপুরীর রাক্ষসগুলো তোমার সাথে কেমন ট্রিট করেছে। নাকি শুধু নিজেদের রোমান্স দিয়ে ভরিয়ে রেখেছ ডায়েরি?”
প্রশ্নটা বাতাসে ছুড়ে ডায়েরি খুলল ইরজা।
(অতীত)
আলমিরের নগ্ন বুকে আলুলায়িত প্রিয়তা শুয়ে আছে। দুজনের ঘন শ্বাসে গভীর তন্দ্রা। দরজায় করাঘাত পড়ল। এত জোড়ে পড়ল যে ধড়ফড় করে উঠে বসল প্রিয়তা। অসংবৃত বুকের ভাঁজে কাপড় টেনে আতঙ্কিত চোখে দরজার দিকে তাকাল। চোখ দুটো খুব কষ্টে মেলে ধরে উঠে বসল আলমির। বাইরে চেঁচামেচির আওয়াজ। প্রিয়তা ভয় নিয়ে বলল—
“বাইরে..।”
“তুমি বসো, আমি দেখছি।”
আলমির পড়ে থাকা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে নিলো। নিজেকে পরিপাটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রিয়তা। চুলে খোঁপা করে মাথায় টানল ঘোমটা। আলমির দরজা খুলে হতবাক। মা, বোন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে চাপা আক্রোশ। শশী খেঁকিয়ে উঠে বলল—
“কীরে, শুনলাম রাজকুমারী বিয়ে করে এনেছিস, তাই বুঝি ঘুম থেকে উঠতে দশটা বেজে গেছে?”
আলমির দৃষ্টি সরু করে তাকাল। অনেকটা সংকোচ নিয়ে রুমের ভেতর দিকে দেওয়াল ঘড়িতে তাকাল। সকাল ন’টা চল্লিশ। প্রিয়তাও কেমন আঁতকে উঠল। এত বেলা কখন হয়ে গেল?
“দেখি সর, তোর রাজরানীকে দেখি।”
প্রিয়তা সব শুনতে পায়। সে ধীরপায়ে আলমিরকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। মিষ্টি কালারের থ্রিপিচ পরেছে প্রিয়তা। যেন একটা রসগোল্লা! শশীকে এই রূপ নির্বাক করে দিলো। এমন সোনা রঙে জন্মায় খুব কম মেয়ে। যেন মাখন! হাত ছোঁয়ালেই গলে যাবে। শশী কাছে এলো। প্রিয়তার দুই গালে আঙুল চেপে ধরে বলল–
“তুমি কী সত্যিই এত ফর্সা নাকী মেকাপ করে এসেছ?”
না, মেকওভার নয়। এই মেয়ের গায়ের রঙ আসলেই অবিশ্বাস্য রকম সুন্দর। আর ত্বকের মসৃণতা যেন তুলোর মতো মখমলে !
শশী এবার পূর্বের রূপে ফিরে এসে বলল–
“ও আচ্ছা, এজন্য বুঝি আলমির তোমাকে রুমের মধ্যে ধরে রেখেছে। বাইরে বের হলে যদি মরচে পড়ে যায়!”
“কী ফালতু কথা বলছিস?”
আলমির মুখ খুলতেই আমেনা বললেন—
“ভালোই তো হয়েছে। বিয়ে করেছে, এখন বউ নিয়ে সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখলেই হবে।”
“এসব কী বলছেন মা?”
“কী বলছি তুই শুনতে পাচ্ছিস না? সকাল দশটা বাজে, নতুন বউ এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে! এক কাজ কর, ওকে নিয়ে তুই রুমে যা। আমি তোদের জন্য নাশতা বানিয়ে আনছি।”
“বাড়িতে কী কাজের লোক নেই?”
“আলমির!”
বাবার কণ্ঠে মাথা নত করে ফেলল আলমির। শরীফ আশরাফ আড় চোখে প্রিয়তার দিকে তাকালেন। পর মুহুর্তে বললেন—
“বাড়ির একটা নিয়ম আছে। সেটা তোমার বউকে জানিয়ে দিয়ো। বড়োলোক বাড়ির বউ হওয়ার মানে এ নয়, শুধু স্বামীকে নিয়ে ভাবলেই হবে, বাড়িতে আরও মানুষ আছে।”
প্রিয়তার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ভয়ে, আতঙ্কে শরীর অবশ হয়ে আসছে। দেয়ালের আড়াল থেকে তাকে দেখছে আহিল। কী ভয়ং কর সুদর্শনা!
“ইরজা!”
ঘন পায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এলো ইরহা। তাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল ইরজা—
“কী হয়েছে আপু? এমন করছ কেন?”
শ্বাসের মাত্রাতিরিক্ত গতির জন্য কথা বলতে পারছে না ইরহা। তাকে বিছানায় বসতে বলল ইরজা। ইরহা না করল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—
“শশী আপা….শশী আপার মাথা ফেটে গেছে। সব রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। রিনি কাঁদছে। ”
ইরহা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বোনকে বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে ইরজা বলল–
“তুমি ভয় পেয়ো না আপু। আমি দেখছি। তুমি এখানেই বসো। একটুও নড়বে না।”
ইরজা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ইরহার চোখে শুধু রক্ত আর রক্ত!
চলবে,,,