প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-২৯+৩০

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:২৯
লেখনীতে: আইশা তানভি

বুক ভরে শ্বাস ফেলল ইরজা। তার সন্দেহই ঠিক। আজ পোলাও, রোস্ট আর মুরগির মাংসের টিকিয়া বানাবে দুপুরের জন্য। বিশেষ কিছু না হলেও বিশেষ কিছু ঘটবে আজ। আলমিরের জন্য খাবার নিয়ে যাবে অফিসে ইরজা।

রান্না শেষ করে রুমে এলো সে। ডায়েরিটা বিছানার নিচে রাখা। সেটি বের করে কিছুক্ষণ বুকে চেপে রাখল। কেমন ভার হয়ে এলো বুক! মেয়েটা খুব কষ্টে ছিল হয়তো। বাইরে থেকে ফিরে এসে আজ আবারও ডায়েরির পাতাতে চোখ বুলাবে। তার আগে একটা সত্যের উদঘাটন প্রয়োজন।

বাসন্তি রঙের সবুজ পাড়ের শাড়ি পড়ল ইরজা। আজকাল মাঝে মাঝেই শাড়িতে জড়ায় গা। ভালো লাগে! চুলটা ছেড়ে রাখল না আজ। অফিসের লোকজন কী না কী ভাববে!

দুপুরের আগে আগেই বাড়ি ছাড়ল ইরজা। আমেনাকে বলে বেরিয়েছে আজ। কেন যেন আজ আমেনাকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল।

অফিসের সামনে পৌঁছে আলমিরকে কল করল ইরজা। আলমির কাজ করছিল। কল রিসিভ করে বিগলিত হেসে জিজ্ঞেস করল—

“কী খবর? আজ মেঘ ফুড়ে অকস্মাৎ বর্ষণ!”

ইরজা হেসে বলল—

“বলুন তো কোথায় আমি?”

“ধরণীতেই আছ।”

“কোথায় আপনি?”

“অফিসে।”

“খেয়েছেন?”

“এখনই যাব।”

“আজ একসাথে লাঞ্চ করলে কেমন হয়?”

“খারাপ না। তবে, লাঞ্চের পর একটা মিটিং আছে। সরি কথামালা!”

“সরি বললে হবে না।”

“জরুরি কিছু?”

“অবশ্যই।”

দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ইরজা। আলমির বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে গেল। স্তম্ভিত দৃষ্টি। খুশির মিশেলে অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল—

“তুমি?”

“হ্যাঁ, আমি। খাবার নিয়ে এলাম।”

“আনবিলিবেভল! আমাকে বলোনি কেন?”

“সারপ্রাইজ!”

ইরজা খাবারগুলো টেবিলের ওপর রাখল। তাকে বাহুডোরে বেঁধে নিলো আলমির।

“থ্যাংকস। ”

“কেন?”

“তুমি এলে তাই।”

“মাই প্লেজার! হাত- মুখ ধুয়ে নিন। খাবেন।

আলমির হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ওয়াশরুমে গেল। ইরজা এই সময়টুকু অযথা নষ্ট করল না। সে হেঁটে হেঁটে শরীফ আশরাফের কেবিন খুঁজে বের করল। দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে বলল—

“আসতে পারি বাবা?”

ইরজার কণ্ঠে বাবা ডাক শুনে চমকে তাকালেন শরীফ। হতভম্ব দৃষ্টি। কৌতূহলী মন।

“তুমি?”

“জি। আপনার ছেলের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। আপনার জন্যও এনেছি। ভেতরে আসব?”

“এসো।”

ইরজা খুশি মনে হেলেদুলে ভেতরে এলো। খাবারের ব্যাগ টেবিলের ওপর রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। শরীফ আশরাফ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ইরজাকে পর্যবেক্ষণ করছে। এই মেয়ের অবশ্যই কোনো মতলব আছে।

“আলমির খেয়েছে?”

“না। ”

“যাও, খেয়ে নাও গিয়ে।”

“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

নড়েচড়ে বসলেন শরীফ। সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন—

“কী কথা?”

“এক মিনিট..।”

ইরজা কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা রিপোর্ট বের করে শরীফ আশরাফকে এগিয়ে দিলো। বলল—

“এটা একটু দেখেন তো।”

শরীফ আশরাফ মেডিক্যাল রিপোর্টটি নিলেন। ডিএনএ রিপোট। তাকাতেই তার চোখের কোটর প্রশস্ত হলো। তিনি ভয়াতুর চোখে ইরজার দিকে তাকালেন। ক্ষেপে উঠে মুহুর্তেই বললেন—

“এসবের মানে কী?”

ইরজা নিরুত্তাপ। গাল ভরতি হাসি। বলল—

“মানে তো আপনি বলবেন বাবা।”

” এসব মিথ্যে।”

“এসব যে সত্য সেটা আপনিও জানেন।”

ইরজার অভিব্যক্তি শক্ত হয়ে গেল। বজ্রকঠোর দৃষ্টি। তার ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করল না ইরজা। শরীফ আশরাফ তটস্থ হয়ে আছেন। কী করবেন না কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি সহসা বলে উঠলেন—

“আলমির জানে?”

“এখনো না।”

শরীফ আন্দাজ করলেন, ইরজা যেহেতু আলমিরকে কিছু বলেনি, তার মানে তার অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। তিনি ইরজাকে প্রশ্ন ছুড়লেন—

“কী চাও তুমি?”

“তেমন কিছু না। শশী আপাকে অপূর্ব ভাইয়াকে ফিরিয়ে দেন। ওটাই উনার আসল ঠিকানা।”

“আমার মেয়ে কোথায় থাকবে না থাকবে সেটা তোমাকে বলতে হবে?”

“নাহলে আলমির জেনে যাবে যে, তার জন্মের আগেই তার মা’কে আপনি ধোঁকা দিয়েছেন। যার অবৈধ ফসল শশী আপা।”

“এই মেয়ে! কোনো সাহসে তুমি আমার মেয়েকে অবৈধ বলো? শশী আমার মেয়ে। আমি ওর জন্মদাতা পিতা।”

“তাহলে নিশ্চয়ই আপনি আমেনা আশরাফকে মিসেস আসমা খাতুনের আগেই বিয়ে করেছেন?”

“হ্যাঁ। আসমার সাথে বাবা জোর করে আমার বিয়ে দিয়েছেন। আসমা নিজেও জানত সব।”

“ও আচ্ছা। তাই বলুন। যাই হোক, আলমিরকে আমি কিছুই বলিনি। আপনি আমার কথা মেনে নিলে, আমিও চুপ থাকব। নাহলে..।”

“নাহলে কী করবে?”

“আলমিরকে সব বলে দেবো। উনি নিশ্চয়ই উনার মৃত মা’কে এটা জিজ্ঞেস করতে পারবেন না, যে উনি সবই জানত। ভেবে দেখুন।”

“দুই টাকার মেয়ে, আমাকে ব্ল্যাকমেল করো?”

চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন শরীফ। ইরজা কিছু মনে করল না। হেসে বলল—

“দুই টাকার মেয়ে আরও অনেক কিছু পারে।”

ওদিকে আলমির কল করতে করতে পেরেশান। ইরজা কল রিসিভ করল। ঢঙ করে কথা বলছে–

“হ্যালো, আমি একটু বাবার কেবিনে আছি। এখনই আসছি।”

শরীফ ফুঁসে যাচ্ছে। ইরজা শরীর জ্বালা হাসি দিয়ে বলল—

“আসি বাবা।”

ইরজা যাওয়ার পর মাথা ধরে বসে পড়লেন শরীফ। যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার।
,
,
,
ইরজা এখনো কেবিনে বসে আছে। আলমির তাকে যেতে দেয়নি। বলেছে, মিটিং শেষে একসঙ্গে বের হবে। প্রিয়তার ছবিটা কিছু সময় দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পুরো দেওয়ালটাই কাচের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দূরের আকাশে রক্তিম প্রভাকর চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
,
,
,
গাড়ি আনেনি তারা। রিকশায় ঘুরতে বেরিয়েছে। শহরের রাস্তা কী আদৌ ঘোরার উপযোগী? এই ধূলোবালি, কোলাহল, অসহনীয় জ্যাম! আলমিরের হাত ধরে তার কাঁধে মাথা রাখল ইরজা।

অনেকটা সময় রিকশায় ঘুরে ফুচকা খেতে দাঁড়াল তারা। তারা যখন খেতে ব্যস্ত তখন দেখল আহিলকে। একটা মেয়ের সাথে হাত ধরাধরি করে গাড়িতে উঠছে। আলমির বিমূঢ়, বিধ্বস্ত। সে জলদি পা চালিয়েও আহিলকে ধরতে পারল না। তারা একটা নামী রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়েছে। ম্যানেজারকে কল করল আলমির। তাদের ব্যাংক স্টেটমেন্টের ছবি পাঠাতে বলল। এতদিন ম্যানেজার বললেও, আলমির গায়ে মাখেনি সেই কথা। আহিলের ব্যাংক একাউন্ট ক্রমশ ফাঁকা হচ্ছিল।
,
,
,
ভীষণ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন আলমির, ইরজা। তারা সিদ্ধান্ত নিলো ইরহাকে এখন কিছুই জানাবে না। এটা তার শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর হবে। আলমির সিদ্ধান্ত নিলো আহিলের সাথে খোলামেলা আলাপ করবে। কিন্তু সেই রাতে আহিল ফিরল না। তাকে ফোন করেও পাওয়া গেল না।

ইরহা শুয়ে আছে। ইরজা নরম পায়ে এসে বোনের কাছে বসল। বোনের উপস্থিত ঠাওর হতেই উঠে বসল ইরহা। ম্লান হেসে বলল—

“কিছু বলবি?”

“আহিল ভাইয়ার কী হয়েছে?”

“জানি না তো।”

কেমন নিষ্প্রাণ, আগ্রহহীন জবাব।

“তুমি কখনো প্রশ্ন করোনি?”

“ইচ্ছে করে না।”

ইরজা আর প্রশ্ন করার সাহস পেল না। ইরহা আচমকা মনে করার ভঙ্গিতে বলল–

“ও বোধহয় নেশা করে। হয়তো মেয়ে মানুষের কাছেও যায়। আমি প্রায়ই ওর শরীরে বিভিন্ন দাগ দেখি। মেয়েলি পারফিউমের গন্ধ, কখনো কখনো…।”

ইরজা বোনকে জড়িয়ে ধরল। তার কান্না পাচ্ছে।

“আর বলো না আপু। আমি জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে।”

ইরহা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। ঝমঝম করে কেঁদে ফেলল। কাঁদলে নাকি মন হালকা হয়? তাই ইরজা চেয়েও বাড়ন করতে পারল না। ইরহা খুব কাঁদল। এতকাল যেই যন্ত্রণা বুকের মাঝে পুষে রেখেছিল তা মনে করে হাউমাউ করে কাঁদল। যেন এই কান্না তার সমস্ত কষ্ট ধুয়ে নিয়ে যাক।

চলবে,,,

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৩০
লেখনীতে: আইশা তানভি

ড্রয়িং রুমে বসে আছে সবাই। আমেনা আশরাফ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। অপূর্ব এসেছে। শরীফ আশরাফের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আলমির আজ অফিসে যায়নি। ইরহা, ইরজা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্বের নত শিয়র। সে হাত কচলাতে কচলাতে দ্বিধা নিয়ে বলল—

“আপনারা অনুমতি দিলে আমি শশীকে নিয়ে যেতে চাই। কথা দিচ্ছি, আর এমনটা হবে না। ”

আমেনা খেঁকিয়ে উঠে বললেন—

“আমার মেয়ে কোথাও যাবে না।”

“আমি যাব মা।”

শশী এসেছে। সে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের প্রস্ফুটিত দৃষ্টি। অপূর্ব দাঁড়িয়ে গেল। কতদিন পর শশীকে দেখতে পেল সে। মেয়েটার আ গুন জ্বলা মুখচ্ছবিটা কী মলিন, প্রাণহীন হয়ে গেছে। ইরজার দিকে সরু চোখে তাকালেন শরীফ। চোখে চোখে তাদের কথা হয়ে গেল। আমেনা তাজ্জব দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন—

“এসব কী বলছিস?”

“হ্যাঁ, মা। আমি যাব অপূর্বর সাথে। ওটাই আমার ঘর। তুমি দাঁড়াও অপূর্ব। আমি আসছি।”

শশীর নিজের রুমের দিকে গেল। ইরজা বলল—

“আপনিও যান ভাইয়া।”

কিছুটা সংকোচ নিয়ে অপূর্ব দোতলায় উঠে এলো।

শশী কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরছে। অপূর্ব দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল—

“সসরি শশী। আমার জন্য…।”

“তোমার জন্য নয়। যা হয়েছে আমার কারণে হয়েছে।”

ব্যাগের চেন আটকে স্বামীর কাছে এসে দাঁড়াল শশী। উন্নত শিয়রে অপূর্বর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল—

“আমাকে আগের মতো ভালোবাসতে পারবে অপূর্ব?”

অপূর্ব নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। ঝপ করে স্বামীর বুকে পড়ল শশী। কেঁদে ফেলল সে। বলল—

“আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও অপূর্ব।”

“তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও কমেনি শশী।”

কিছু সময় চলে গেল। শশী বলল–

“আমরা সবাই একসাথে থাকব। আমরা বাবা-মার কাছে চলে যাব।”

“হু।”

শশী নীরবে কাঁদছে। আর বুক ভরে ইরজার জন্য দোয়া করছে।
,
,
,
সন্ধ্যার পরের সময়। আমেনা আশরাফ ভারাক্রান্ত মনে রুমে বসে আছেন। মেয়ে চলে যাওয়ায় কেমন শূন্য শূন্য অনুভূতি হচ্ছে তার। তাকে চা দিয়ে এসেছে ইরজা। আহিলের অপেক্ষায় আজ বাড়ি থেকে বের হয়নি আলমির। শরীফ আশরাফ জরুরি কাজে বেরিয়েছেন।

আহিল ফিরল সন্ধ্যার অনেক পরে। ঢুলতে ঢুলতে, ভগ্ন শরীরে,অবসাদগ্রস্ত মনে। আলমির রুমের দরজায় দাড়িয়ে আছে। আহিলকে দেখে বলল–

“দাঁড়া।”

আহিল থমকালো। কেমন বিপন্ন দৃষ্টি। রক্তিম আঁখি জোড়া। আলমির হেঁটে এলো কাছে। রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল ইরজা। আহিলকে দেখেই নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। নির্ঘুম চোখ দুটোতে রাজ্যের বিষাদ। ভাঙাচুরা চোয়াল। অক্ষিকোটরের চারপাশে কৃষ্ণ বলয়। ইশ! আগে কেন খেয়াল করেনি ইরজা? বোনের স্বামী বলে? হয়তো। নাহলে দেখতে পেত, কী করে একটি হাসিখুশি, লাবন্য ঝরা মুখবিবর, শীতের শুষ্কতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। ইরজা ঘাড় বাঁকিয়ে আলমিরকেও দেখল।

“কাল সকাল থেকে কোথায় ছিলি?”

আহিলের যেন কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছে। সে অক্ষিপুট প্রস্ফুটিত করে চেয়ে বলল—

“বাইরে।”

“বাইরে কোথায়?”

“সে জবাব আমি তোমাকে দেবো না।”

“আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমাকে জবাব দিতেই হবে।”

আহিল গায়ে মাখল না সেই কথা। তাচ্ছিল্য হেসে বলল—

“তোমার বাড়ি?”

“হ্যাঁ আমার। কী করিস আজকাল তুই?”

আলমির আহিলের খুব কাছে এসে দাঁড়াল। আহিল চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আলমির বলল—

“তুই নেশা করিস? ”

“করি। তাতে তোমার কী?”

সপাটে এক চড় বসাল আলমির। রেলিং এর উপর ঝুঁকে গেল আহিল। চেচামেচিতে ছুটে এলেন আমেনা। ইরহাও নরম পায়ে এসে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

আহিলের ক্রোধ জাগল। সরোষে আলমিরকে ঘুষি মারল। অকস্মাৎ ঘটনায় ছিটকে পড়ল আলমির। আহিল ফুঁসে যাচ্ছে। অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে ভাইকে দেখছে। আলমির উঠে এসে আহিলের কলার চেপে ধরে বাম গালে ঘুষি বসাল। মেঝেতে পতিত হলো আহিল। রাগে বিহ্বল আহিল দিশেহারা হয়ে তেড়ে এলো। দুই ভাইয়ের হাতাহাতি লেগে গেল। মুখ চেপে কান্না রোধ করে রাখতে চাইছে ইরহা। আমেনা আহিলকে সরিয়ে নিতে এগিয়ে এলেন। ইরজা আলমিরকে।
আহিলকে সরিয়ে নিতে পারলেও আলমির দাঁড়িয়েই রইল। আমেনা চিৎকার করে বললেন—

“তুই আমার ছেলের গায়ে হাত তুললি?”

“হ্যাঁ, তুললাম। কী খবর রাখেন আপনারা? ও কী করছে আপনি জানেন?”

আহিলের ঠোঁট কে টে রক্ত গড়াচ্ছে। দৃষ্টি ঝাপসা হচ্ছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। মা ধরে রাখলেন ছেলেকে। আলমির বলল—

“ওকে এখনই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলুন।”

“তুই আমার ছেলেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছিস?”

মাঝখান থেকে আহিল দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠে—

“যাবো না। কী করবে তুমি?”

“জানে মে রে ফেলব।”

“আলমির!”

আমেনা চড় মারতে এগিয়ে এলেন। তার হাত চেপে ধরল ইরজা। উদ্ভাসিত দৃষ্টি আমেনার। অবিশ্বাস চোখে। ইরজা বলল—

“বড়ো ভাই ছোটো ভাইকে তার অন্যায়ের জন্য শাসন করছে। মা হয়ে আপনার উচিত, ন্যায়কে সমর্থন করা নাকি অন্যায়কে।”

“তুমি আমাকে ন্যায় অন্যায় শেখাচ্ছ? একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে, আরেকজন আমার গায়ে হাত দিচ্ছে।”

“ভুল বললেন মা। আমি আপনার গায়ে হাত দেইনি। শুধু ন্যায়ের পক্ষ নিয়েছি।”

“বাহ্! ন্যায়! আমার ছেলেকে রক্তাক্ত করে আমাকে ন্যায়ের পক্ষ দেখাচ্ছ?”

“ছেলের রক্ত আপনার চোখে পড়ল আর আমার বোনের… আমার বোন যে ধুকে ধুকে মর ছে তার খবর রেখেছেন? স্বামী হিসেবে কোন দায়িত্বটা পালন করেছেন আহিল ভাইয়া? আজ পর্যন্ত আপুকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়েছে? কখনো জিজ্ঞেস করেছে, কেমন আছ তুমি? কখনো খোঁজ নিয়েছে, রাতে ওর ঘুম হয় কি না? শুধু গর্ভে সন্তান দিয়েই বাপ হওয়া যায় না মা। আজ আপনার সন্তানের এইটুকু রক্ত দেখে আপনার বুকটা জ্বলে যাচ্ছে… আপুর গর্ভেও তো আহিল ভাইয়ের সন্তান… কই তার তো পুড়ছে না। নিজের ছেলেকে সন্তানের মায়া কেন শিক্ষা দেননি?”

আমেনা নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলেন। নির্বাক দৃষ্টি। ইরহা কেঁদেই যাচ্ছে। যন্ত্রণার নিষ্পেষণে ভেতরটা দুমড়ে মুছড়ে যাচ্ছে। ইরজা থামল না। ক্রোধে জ্বলে উঠে আরও বলল—-

“যে সময়টায় স্বামীকে সবচেয়ে বেশি কাছে প্রয়োজন স্ত্রীর, সেই সময়টায় আপনার ছেলে নেশা করে বেড়াচ্ছে, মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবারও কী ভেবেছেন, সেই অন্তঃসত্ত্বা নারীর কেমন লাগছে। ভেবেছেন কখনো মা?”

আহিল ঘৃণা ছুড়ে তাকাল ইরহার দিকে। মেয়েটার ওই রোদনস্ফীত মুখটাও আহিলের নেশায় আহত মনে মায়া জাগাতে পারল না। আলমির বলে উঠে—

“ওকে বলো, হয় ও এসব ছাড়বে, নাহলে এই মুহুর্তে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে।”

আহিল তীর্যক হেসে বলল—

“ঠিক আছে। চলে যাচ্ছি আমি। এটাই তো তুমি চাও। এই বাড়ি গাড়ি সব আত্মসাৎ করতে। যেখানেই যাই, শুধু আলমির আর আলমির। এটা আলমিরের ওটা আলমিরের। আমার কী? আমার কিচ্ছুই না। তো কীসের আশায় থাকব আমি?”

ইরহা ডুকরে উঠল। বলল—

“কোথায় যাবেন আপনি?”

“তুই জেনে কী করবি? তোর তো সব আছে। তোর বোন, তোর ভাই। তোর খেয়াল ওরাই রাখবে। আমি আমার পথে চলে যাব।”

আহিল ছুটে চলে। ইরহা দৌড়ে এসে স্বামীর হাত চেপে ধরে।

“আপনি যাবেন না প্লিজ। এই টাকা পয়সা কিচ্ছু লাগবে না আমার। আমার আপনাকে হলেই হবে। এই সন্তান আমাদের। ওর বাবাকে ওর লাগবে। দয়া করুন। আপনি যাবেন না।”

আমেনাও বিলাপ শুরু করলেন। কিন্তু আহিলকে থামানো গেল না। বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে তার। বদ্ধ উন্মাদ। ইরজা আর আলমির দাঁড়িয়েই রইল। আচমকা বলল আলমির।

“চিন্তা করো না। দু দিনেই বাড়ি ফিরবে। ও জানে না টাকা ছাড়া কেউ কারো না। যাদের ভরসায় ও বাড়ি ছেড়েছে ওরা ওকে কুকু রের মতো তাড়াবে। আমি ওর সব কার্ড বন্ধ করে দিয়েছে। ”

আমেনা কাঁদতে থাকলেন। তার পাপের ঘড়া উপচে আঁখিজল নামছে। এর শেষ কোথায়?

চলবে,,,