#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৩১
লেখনীতে:আইশা তানভি
রাত এগারোটা। অনেকটা নিস্তব্ধ এলাকার পথঘাট। রাস্তায় যদিও কোলাহল, তবে ভেতর গলিগুলো এখন অনেকটা তন্দ্রালু ভাবে ঢুলে পড়তে শুরু করেছে। শহরের আবাসিক এলাকাগুলো তো আরও নিশ্চুপ। যেন সর্বত্র অকৃত্রিম এক নীরবতা।
আহিল ধীরপায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে। বাড়িটা এখনো আলোকিত। সে ফোন করল কাউকে। মিনিট তিনেকে পর একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। উৎফুল্লতা চোখে-মুখে।
“আহিল! তুমি?”
আহিল বিধ্বস্ত, ধসে পড়া এক পুরুষ। লিনা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে। আহিলের ঠোঁটের কোণের রক্ত শুকিয়ে গেছে। গায়ে ধুলো জড়ানো। অন্য দিনকার মতো মাদকময় পুরুষালী সুবাসটা আর নেই।
আহিল ভারাক্রান্ত মনে সবটা খুলে বলল। আঁতকে উঠল লিনা। বলল—
“তাই বলে বাড়ি ছেড়ে চলে আসবে?”
“হ্যাঁ, ও বাড়িতে আর যাব না।”
বিচলিত লিনা প্রশ্ন ছুড়ল—
“এখন কোথায় যাবে?”
“আমাকে আজকের রাতটা তোমার এখানে থাকতে দাও।”
লিনা আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল—
“কী বলছ? বাবা জানলে মে রেই ফেলবে আমাকে।”
“তোমার বাবা তো কিছুদিনের জন্য শহরের বাইরে গেছে।”
“তাতে কী?না, আহিল, তুমি অন্য কোথাও ট্রাই করো।”
আহিলের অভিব্যক্তিতে প্রাণ নেই। যে মানুষগুলো গত কয়েকমাস তাকে মাথায় তুলে নেচেছে, আজ তারা দূর দূর করে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এই লিনাই এতদিন আহিলের বুকে লেগে থাকত, আর আজ তার বাড়িতে একটু ঠাই দিতে পারছে না। আহিল তেজ দেখিয়ে বলল–
“তাহলে আমার জিনিসগুলো ফিরিয়ে দাও।”
লিনা হতবাক হয়ে বলল—
“কেমন ছোটোলোক তুমি? গিফ্ট করা জিনিস ফেরত চাচ্ছ?”
“তো কী করব আমি? আলমির আমার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। একটা টাকাও নেই আমার কাছে। কোথায় যাব আমি?”
“তা আমি কী জানি? যাও এখান থেকে।”
চরম অপমান! আহিল ক্রুদ্ধ হয়ে লিনার চুল চেপে ধরে বলল—
“এই তোদের জন্য আমার আজ এই অবস্থা! আমার টাকায় এতদিন মজমাস্তি করে এখন আমাকে চিনিসই না। ”
বাড়ির ভেতর থেকে একটি ছেলে বেরিয়ে এলো। আহিল হতবুদ্ধি হয়ে গেল। এ তো তাদেরই একজন। ভাঙা পুরুষটি এবার সব বুঝতে পারল। লিনার মতো মেয়েদের এটাই কাজ। টাকা পয়সাওয়ালা ছেলেদের চুষে খাওয়া। সর্বশ্রান্ত করা। আজ আহিল নিঃস্ব বলে কেউ নেই তার। সে উন্মাদের মতো হাসতে শুরু করল। ছেলেটিকে ইঙ্গিত করে হো হো হাসির জোয়ার তুলল। বলল—
“এই লিনা একটা নাগিন। শরীরের রক্তে বিষ ঢেলে একদম মে রে ফেলবে। সাবধান!”
লিনা ভ্রূকুটি করে তাকায়। ছেলেটি এই কথার মানে বুঝতে পারে না। সে লিনাকে প্রশ্ন করে। লিনা জানায়, আহিল একটা উন্মাদ। তাকে পছন্দ করে। পাত্তা দেয় না বলে আবোলতাবোল বলে।
রাস্তায় এলোমেলো হাঁটতে থাকে আহিল। কেউ নেই, কিছু নেই। খিদেয় তার পেট পুড়ে যাচ্ছে। চোখ জুড়ে ঘুম। পকেট হাতড়ে একটা টাকাও পেল না। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সব বন্ধ।
আহিলের পিপাসা পেয়েছে। দূরে একটা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে। সে দ্রুত হেঁটে গেল। দোকানদার ভেবেছে কিছু নেবে। আহিল পানি চাইল। পানি পান করল। বেঞ্চির ওপর নত মুখে বসে রইল। দোকানদার জিজ্ঞেস করল—
“কিছু খাইবেন? দোকান বন্ধ কইরা ফালামু।”
আহিলের খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু পকেটে টাকা নেই, এই অবস্থায় খাবার চেয়ে খাওয়াটা তার কাছে প্রচণ্ড লজ্জাকর! সে জবাব দিলো না। দোকানদার ভালো করে তাকে দেখে বলল—
“সারাদিন কিছু খান নাই ভাই?”
আহিল মিথ্যে বলল। বলল, তার সব টাকা পয়সা ছিনতাই হয়ে গেছে। কাল সকালেই সে শহর ছেড়ে চলে যাবে। আজকের রাতটুকু এই বেঞ্চিতে থাকতে চায়। দোকানদার পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না আহিলের কথা। তার কথার ধরণ আর পোষাক আশাক বেশ গড়মিলে। তবুও লোকটার মায়া হলো। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে কলা রুটি রেখেছিল, সেখান থেকে বের করে দুটো কলা আর একটা পাউরুটি দিলো। আহিল চেয়েও না করতে পারল না। কৃতজ্ঞতায় তার চোখে পানি জমে গেল। দোকানদার বেঞ্চ দুটো আর ভেতরে ঢোকালো না। রেখে গেল। খাওয়া শেষে দুটো বেঞ্চ একসাথে করে তার উপর শুয়ে পড়ল আহিল। মাথার নিচে হাত রেখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল।
আজ একটুখানি খাবারের জন্য পেটটা ছিড়ে যাচ্ছিল তার। আর কোনো একদিন এই খাবারকে কতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। মনে পড়ে, একদিন প্রিয়তা তরকারিতে লবন কম দিয়েছিল বলে সেই তরকারি বাটি সহ ছুড়ে ফেলেছিল আহিল। গরম তরকারি প্রিয়তার পায়ের উপর গিয়ে পড়েছিল। মেয়েটার চিৎকারে সেদিন কারো মায়া হয়নি। আহিলেরও না। আজ সেই কথা মনে পড়তেই চোখের কিনার ঘেঁষে জল নামল তার। অপূর্ব সুন্দর মেয়েটির সেই বীভৎস মৃত্যু, আচমকাই ভয় ধরিয়ে দিলো আহিলকে। কত অত্যাচার করেছে তারা প্রিয়তার ওপর। আহিল ছিল তখন সুযোগ সন্ধানী।
“সরি প্রিয়তা!”
অস্ফুটে বলল আহিল।
,
,
,
ইরজার কিছুই ভালো লাগছে না। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শশী চলে গেছে, দুই দিন ধরে আহিলেরও কোনো খোঁজ নেই। আমেনা আশরাফ রুমে বসে থাকেন। ঠিক মতো খান না, ঘুমান না। শুধু ছেলের শোকে কাঁদেন। ইরহাও তাই। এত নাজুক মেয়েটা!
ছোটোবেলা থেকেই ইরহা সবার পছন্দের। সৌন্দর্যের সাথে তার নরম ব্যবহার, ভদ্রতা, নম্রতা ছিল অন্যন্য। তাকে সবাই ভালো চোখে দেখলেও ইরজা ছিল উগ্র, অপ্রকৃতিস্থ। আজ সেই ভালো মেয়েটার ভালো গুনই তার কপাল পোড়ালো।
শরীফ আশরাফ কী একটা ভয়ে আছেন। কিন্তু তা প্রকাশ পাচ্ছে না। আলমির তার কাজ নিয়ে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ডায়েরি নিয়ে বসল ইরজা। বিষণ্ণচিত্তে।
(অতীত)
গত পনেরো দিন জুড়ে আলমিরের পরীক্ষা চলল। বাবার নির্দেশে পরীক্ষা চলাকালীন যেন পড়ায় ব্যাঘাত না ঘটে, তাই প্রিয়তা ছিল শশীর রুমে তার সাথেই।
কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও প্রিয়তাকে কাছে পায় না আলমির। সারদিনের হাড় ভাঙা খাটুনির পর বিছানায় পিঠ লাগাতেই রাজ্যের ঘুম তাকে জেঁকে ধরে। একদিন, দুইদিন, তিনদিন; এভাবে কয়েকদিন চলল। একদিন আলমির খুব ক্ষেপে গেল। শুধু তো বাড়ির সবার দেখাশোনার জন্য তাকে বিয়ে করেনি। তারও কিছু ডিজায়ার আছে। প্রিয়তা স্বামীর চাওয়া বুজেও হার মানে। তার শরীর আর মন কোনোটাই সায় দেয় না। এ নিয়ে কিছুদিন মনমালিন্য চলে। একদিন আলমির জানায়, প্রিয়তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। বিয়ের পর তো ও বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আমেনা আশরাফ প্রথমে খ্যাচ খ্যাচ করলেও শরীফ রাজি হোন। মাত্র তিনদিনের জন্য বাবার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পায় প্রিয়তা। তার খুশি ধরে না।
সেই তিনটা দিন সবচেয়ে ভালো কাটল তাদের। একে অপরের পাশে থেকে, একে অপরের মাঝে মিশে থেকে। আলমির সবটা বুঝতে পারল।
কিন্তু আশরাফ ম্যানশনে ফিরে এসেই বাধঁল বিপত্তি। প্রিয়তাকে কোনোভাবেই কাছে পায় না আলমির। সেই ভোর থেকে একের পর এক কাজ করেই যায় প্রিয়তা। সকালের নাশতা থেকে শুরু করে রাতের খাবার পর্যন্ত। রিনির জন্য আলাদা খাবার বানানো, ফ্রি থাকলেই তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকা, কার কী লাগবে সব একা হাতেই করতে থাকে সে। আর সামান্য ভুলে পরিবার তুলে গালাগালি তো আছেই। প্রতিটা ক্ষণ আতঙ্কে কাটে প্রিয়তার।
এর মাঝেই আলমিরকে বিদেশ পাঠানোর পরিকল্পনা শুরু হলো। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করলেন শরীফ। দোটানায় পড়ল আলমির। প্রিয়তা কিছুতেই তাকে ছাড়তে চাইছে না।
“আপনি কী সত্যিই চলে যাবেন?”
আলমির নিরানন্দ গলায় বলল—
“বাবা তো তাই চাচ্ছেন। বলছেন, কয়েকটা বছর থেকে এলে ভালো হতো।”
প্রিয়তা কেঁদে ফেলল। আলমিরকে জড়িয়ে ধরে বলল—
“দোহাই লাগে আপনার, আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি থাকতে পারব না আপনাকে ছাড়া।”
প্রিয়তা সারা রাত কাঁদল। একটুও ঘুমালো না। তার সেই কান্নার জল আলমিরকে ন্যুব্জ করে ফেলল।
চলবে,,,
#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৩২
লেখনীতে:আইশা তানভি
পাশে থাকার দিনগুলো খুব দ্রুত কেটে গেল। আলমির চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে নিজ জঠরে কারো উপস্থিতি টের পেল প্রিয়তা। খুশিতে তার মনটা ভরে উঠল। কিন্তু এই খুশির ভাগ নেওয়ার কেউ ছিল না। প্রিয়তার কাছে কোনো ফোন ছিল না। আলমির কল করত বাবা কিংবা মায়ের ফোনে।
তখন যা একটু কথা হতো। একদিন ফোন করল আলমির। আমেনা ডাকলেন প্রিয়তাকে। রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে ফোনটা নিয়ে একটু রুমে যেতে চাইল। প্রিয়তা এই খুশির খবরটা সবার আগে আলমিরকে দিতে চাইল। কিন্তু আমেনা চেঁচামেচি শুরু করলেন। প্রিয়তা আর বলতে পারল না। ফোনটা তার কাছে দিলেও তাকে সেখানে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে। তাই ওপাশ থেকে আলমির আবেগঘন কিছু বললেও, এপাশ থেকে প্রিয়তার জবাব ছিল রসকসহীন। দেড় মাস চলে গেল। প্রিয়তা উশখুশ করছে। আর কত গোপন রাখবে?
সে আমেনার কাছে গেল।
শশী আর আমেনা টিভি দেখছে আর চা পান করছে। প্রিয়তা গিয়ে দাঁড়াল সেখানে। আড় চোখে তাকে দেখে আমেনা নাক কুঁচকালেন।
“কিছু বলবে?”
“জি।”
“কী?”
প্রিয়তার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। মা হওয়ার এই গাঢ় অনুভূতি কি করে বর্ণনা করতে হয়, তা জানা ছিল না ছোট্ট মেয়েটির। সে আমতা আমতা করে বলল—
“আমি…. আমি কনসিভ করেছি। রিনির মামাকে একটু জানাবেন।”
আমেনার চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। সে বিস্ময় নিয়ে বলল—
“কী বলছ? কয় মাস হলো?”
“দেড় মাস।”
“আল্লাহ্ শোকর। ঠিক আছে, ঠিক আছে। যাও। বলে দেবো ওকে। এটা নিয়ে এত আহ্লাদ করার কিছু নেই। বিয়ে যখন হয়েছে বাচ্চা তো হবেই। এটা আহামরি কিছু না।”
প্রিয়তা অবাক হলো। মানুষগুলোর মধ্যে একটুও খুশির ছাপ দেখল না। সেইদিন রাতে খুব কাঁদল প্রিয়তা।
দুইদিন পর একদিন রাতে হঠাৎ করেই তার তলপেটে ব্যথা শুরু হলো। প্রথমে পাত্তা দিলো না। কিন্তু ব্যথার তীব্রতা ধৈর্য হারালো। সহসা প্রিয়তার মনে হলো তার নিম্নাঙ্গ বেয়ে কিছু নামছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই র ক্তে ভরে গেল বিছানা। অসহনীয় ব্যথায় কাবু হয়ে গেল সে। গলা কা টা মুরগির মতো বিছানায় তড়পাতে লাগল। লহুর ধারা বাধ মানল না। নিরন্তর স্রোতের মতো ভাসিয়ে ফেলল।
প্রিয়তা তার সন্তান হারালো। কেন এমনটা হলো সে জানল না। কী অপরাধে আল্লাহ্ পাক তার মাতৃত্ব কেড়ে নিলেন তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেল। নিষ্প্রাণ প্রিয়তা তাদের ভালোবাসার ফুলটির কথা স্বামীকেও জানাতে পারল না। আমেনা নিষেধ করলেন। বললেন, যে চলে গেছে তার কথা বলে আলমিরকে দুর্বল না করতে।
ইরজা কয়েক পাতা ফড় ফড় করে উল্টানো। আর কিছু লেখা নেই। এখানেই শেষ প্রিয়তার ডায়েরি। ইরজা উতলা হয়ে উঠল। এর পরেই কী প্রিয়তা মারা যায়? না তো? এর মাঝে তো আলমির দেশে এসেছিল। তাহলে? তাহলে প্রিয়তা আর লেখেনি কেন? ও কী লেখার অবস্থায় ছিল না? অজস্র প্রশ্নেরা মাথাটা খেয়ে ফেলছে ইরজার।
,
,
,
আলমির একটু আগেই ফিরেছে। সে ফেরার পর থেকে তার আশেপাশেই ঘুরছে ইরজা। বিচক্ষণ পুরুষটি বুঝতে পারল, ইরজা কিছু বলতে চায়।
ইরজাকে কাছে টেনে এনে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখল। এরপর হাত টেনে নিয়ে চুমু এঁকে বলল—
“কিছু বলবে?”
“আপনি বিদেশ যাওয়ার পর প্রিয়তা তাদের বাড়িতে গিয়ে ছিল?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন? ডায়েরি পড়া আবার শুরু করেছ?”
“বলুন না।”
“হ্যাঁ।”
“কেন? কী হয়েছিল ওর?”
“জানি না। মা বলেছিল, ওর মন ভালো নেই। তাই ওর বাবা এসে ওকে নিয়ে গেছে।”
“আপনি কিছু জিজ্ঞেস করেননি?”
“কোন ব্যাপারে?”
কপালে ভাঁজ তুলে প্রশ্ন করল আলমির।
“মন কেন ভালো নেই।”
“করেছি। বলেনি। আর বলবেই বা কী? সারাদিন ঘরের কাজ করে ফুরসৎ মিললে তো। কাজের লোক বানিয়ে রেখেছিল ওকে। ”
“আপনি কিছু বলেননি কেন?”
“আমার কাপুরুষতা! আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছিল তারা। ওখানে থেকে কিছুই করার ছিল না। আমার চোখের পর্দা তখনো সরেনি।”
ইরজার কেমন ঝিমুনি দিয়ে উঠল মস্তিষ্ক। আলমির তার সন্তানের কথা জানে না! ভাবুক ইরজার অধরে গাঢ় চুম্বন করল আলমির। ইরজার দৃষ্টি সরু, নিরুত্তাপ। আলমির বলল—
“কেন শুধু শুধু ওই ডায়েরি পড়ে নিজে কষ্ট পাচ্ছ আর আমাকেও নিজের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছ? আমি জানি, কী ভয়ং কর ভুল করেছি আমি। আর তার জন্য প্রিয়তাকে হারিয়েছি।”
ইরজা কোনো কথাই বলল না। স্বামীর বুকে মাথা রেখে মিশে রইল। আজ প্রিয়তার জন্য কান্না আসছে ইরজার। মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য। কী অমানবিক জীবন ছিল তার। কী মুহূর্ত পার করেছে সে। এসব ভাবতে ভাবতে ইরজার বাহুডোর আরও দৃঢ় হলো।
“কী হয়েছে কথামালা?”
ইরজা সাড়া দিলো না। আরও গুজে গেল আলমিরের বক্ষস্থলে।
,
,
,
ইরহার ঘুম আসছে না। হাত -পা জ্বালাপোড়া করছে। মাথাটাও ভারী হয়ে আছে। দুই দিন ধরে কোনো খোঁজ নেই আহিলের।
ইরজা বোনের জন্য দুধ নিয়ে এলো। ইরহা বসে আছে। বোনকে দেখে মলিন চোখে তাকাল।
,
,
,
আহিল ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটি বেঞ্চে বসে আছে। তার মোবাইল বন্ধ। চার্জ নেই। দু দিন কী করে কাটিয়েছে তার হিসেব সে রাখেনি। দু দিনেই তার শরীরে ছাপ পড়েছে দীর্ঘ দিনের অভুক্তের। কত মানুষ যাচ্ছে। কিন্তু তার যাওয়ার জায়গা নেই। আহিল বেঞ্চ থেকে উঠল। সোজা হাঁটা ধরল। তার উদ্দেশ্য কারো জানা নেই।
,
,
,
রাত তখন সাড়ে বারোটা। ঘুম আসছে না। তাই লাইট জ্বালিয়ে বসে আছে ইরহা। আহিলের নাম্বারে কল করে করে হতাশ সে। কী করছে মানুষটা? কোথায় খাচ্ছে? খাচ্ছে তো? নাকি না খেয়েই আছে? কিছু হয়নি তো?
ইরহার কান্না পায়। তার মোবাইল বেজে ওঠে। সাবধানে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। আহিলের কল এসেছে। সে রিসিভ করে।
“হ্যালো!”
ইরহা কথা বলল না। ঠোঁট চেপে রাখল। তার গলা চিরে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইছে। আহিল আবার বলল—
“হ্যালো ইরহা! শুনতে পাচ্ছ? ”
ইরহা তবুও কথা বলল না। আহিল তার রুখে রাখা কান্নার শব্দ টের পাচ্ছে।
“কথা বলবে না? ফোন রেখে দেবো?”
“কেমন আছেন আপনি?”
“যাক, তুমি কথা তো বললে।”
“আপনি কোথায়? বাড়িতে কেন আসছেন না। সবাই চিন্তা করছে আপনার জন্য। বাবা-মা কেউ ঠিকমতো খেতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না।”
“তুমি.. তুমি চিন্তা করো না?”
ইরহা থেমে গেল। আহিল বলল—
“আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। যাদের আমি আপন ভেবেছিলাম তারা আজ টাকা নেই বলে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কারো কাছে ক্ষমা চাইব না। শুধু একজনের কাছে চাইব। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে ইরহা?”
“প্লিজ, আপনি ফিরে আসুন। আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন তাতেই আমি খুশি।”
“আমি বাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”
“আমি এক্ষুণি আসছি।”
ইরহা ফোন হাতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সন্তপর্ণে সিঁড়ি বেয়ে নামে। সদর দরজা খুলে বের হয়। ইরজা দেখতে পায়। বোনের এই চোরের মতো বেরিয়ে যাওয়ার হেতু খুঁজতে পিছু নেয়। গেট খুলে বাইরে আসে ইরহা। আহিল দাঁড়িয়ে আছে। এই দুদিনেই কেমন শুকিয়ে গেছে মানুষটা। চুল উষ্কখুষ্ক। মলিন মুখ, শুষ্ক ঠোঁট। ঘন আঁধারের এই আবহে আহিল দুই হাত জোড় করে ইরহার কাছে ক্ষমা চায়। ইরহা ক্ষমা করে না। নিষ্পাপ মেয়েটি এই দুঃসাহস করতে পারে না।
ইরজা শ্বাস ফেলে। সে দাঁড়িয়ে রয়। সব ঠিক হয়ে যাক। সবাই ভালো থাকুক। কিন্তু প্রিয়তা? ওই ছোট্ট মেয়েটি যে একরাশ কষ্ট নিয়ে বিদায় দিয়েছে এই পৃথিবী থেকে, তার কী হবে?
,
,
,
পরদিন ভোরটা ছিল অকল্পনীয়। আহিল তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইল। আলমির ভাইকে নিরাশ করল না।
বিকেলের ম্লান আলো। আমেনা বারান্দায় বসে আছেন। কেমন উদাস, উন্মনা দৃষ্টি। ইরজা এসে দাঁড়াল সেখানে। আমেনা দেখেও না দেখার ভান করল।
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।”
“বলো।”
“প্রিয়তার মিসক্যারেজ হয়েছিল?”
আমেনা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ভয়ভীত, চতুর দৃষ্টি।
“কী হলো, কথা বলছেন না যে?”
“কে বলেছে তোমাকে? আলমির?”
“তাকে তো আপনি জানতেই দেননি।”
“দেখো মেয়ে!”
“কেন বলেননি আলমিরকে? কেন জানাননি তাকে তার সন্তানের কথা? কেন আপনাদের জানানোর দুই দিন পরেই প্রিয়তা তার সন্তানকে হারায়?”
অবাক, হতবাক, বিমূঢ় আমেনার শ্বাসের গতি বাড়ল। এই মেয়ে এসব কী করে জানল?
“ভাবছেন আমি কী করে জানি? আমি আরও অনেক কিছু জানি? আলমির যাওয়ার পর কী কী করেছেন ওর সাথে।”
“কে বলেছে তোমাকে?”
“প্রিয়তার সন্তানকে আপনারা মেরে ফেলেননি তো?”
“এই মেয়ে! কী বাজে বকছ?”
“আমি কিন্তু সেটাও বের করে ফেলব। যদি সত্যিই আপনি এই কাজ করে থাকেন, তাহলে কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়ব না।”
ইরজা চলে যাওয়ার পর হাসফাস করতে থাকে আমেনা। এই মেয়ে এসব কী করে জানে? যদি সত্যিই জেনে যায়, সে আর শশী মিলেই প্রিয়তাকে খাবারের সাথে মিসক্যারেজের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিল, তাহলে? ভাবতে ভাবতে যেন জ্বর উঠে গেল আমেনার।
,
,
,
পুরো রুমে পায়চারী করছে ইরজা। প্রিয়তার ছোটোবেলা থেকেই ডায়েরি লেখার অভ্যেস। সম্ভবত এই ডায়েরি শেষবার যখন বাবার বাড়ি গিয়েছিল, সাথে নিয়েছিল। কিন্তু আর ফেরত আনেনি। কিন্তু এর পরের কাহিনি! সেসব নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও প্রিয়তা লিখেছে। কিছু তো লিখেছে। তবে কোথায়? ইরজা সমস্ত রুমে চোখ বোলাল। আজ সারাদিন সে খুঁজবে। যদি কিছু পায়। প্রিয়তার মৃ ত্যু সাধারণ ছিল না। একজন আট মাসের গর্ভবতী সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে তড়পাতে তড়পাতে ম রে গেল, আর তার চিৎকার কেউ শুনল না? তা কী করে হয়?
চলবে,,,