প্রিয়ঙ্গনা পর্ব-৩৪+৩৫

0
2

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৩৪
লেখনীতে:আইশা তানভি

অপূর্বদের বাড়ি থেকে ফিরে থম মেরে বসে আছে ইরজা। কিছুই বলছে না। বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে উঠল আলমিরের। বারবার তাকে প্রশ্ন করার পরও ইরজার নীরবতা, উদাসীনতা আর এই পাথর রূপ আলমিরকে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে।

“কিছু বলবে?”

ইরজা কথা বলল না। তার দৃষ্টি স্থির, নিষ্কম্প, বিবশ। আলমির ক্রোধে হিসহিসিয়ে বলল–

“চুপ করে আছ কেন? কি হয়েছে বলবে কিছু আমাকে? শশী কাঁদছে কেন? তুমি কেন চলে এলে?”

ইরজা নিরুত্তর, নিশ্চল, নির্বাক। শুধু কী এক অমোঘ ঘোরে সে নির্নিমেষ চেয়ে আছে। আলমির আরও রেগে গেল। ইরজার নিস্তব্ধতা তাকে অঙ্গার করে দিচ্ছে।

“তুমি…।”

আলমিরের ফোন বাজল। স্ক্রিনের নাম্বারটা দেখে কিছুটা শান্ত হয়ে রুম ছেড়ে বারান্দায় এলো। ইরজা বিছানা থেকে নামল। লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। কেমন অসহ্য যন্ত্রণায় মন, মস্তিষ্ক সব জ্বলে, পুড়ে যাচ্ছে! বুকের পাঁজরে চাপ লাগছে। কী ভয়ং কর পরিস্থিতিতে প্রিয়তা তার স্বামীরূপী পুরুষটিকে কাছে পায়নি। পায়নি কারো সহমর্মিতা। কী কষ্ট বুকে আগলে নিয়ে, চোখের ধারায় বুক ভাসিয়ে প্রতিটা অক্ষর, প্রতিটা শব্দ সে লিখেছে। কেন লিখেছে প্রিয়তা? সে কী তার জন্যই লিখছে? প্রিয়তা কী জানত, কেউ তার সেই কষ্টের দিনগুলো পড়ে শ্বাস আটকে ম রে যেতে যেতে বেঁচে থাকবে? ইরজার আহত, কাতর, ভগ্ন হৃদয়ের অলিতে গলিতে এইসব প্রশ্নেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বারান্দায় এসে কল রিসিভ করল আলমির।

“বলুন অপূর্ব ভাই।”

“ইরজার কী অবস্থা?”

“না বললে বুঝবো কী করে কী অবস্থা! আসার পর থেকে চুপ করেই বসে আছে। এতবার জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে বলো, না, একটা শব্দও মুখ থেকে বের করছে না।”

অপূর্ব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল—

“সময় দাও ওকে। ও ঠিক বুঝে নেবে, কখন ওকে বলতে হবে।”

“কী বলতে চাইছ তুমি? তোমরা আসলে কী লুকাচ্ছ আমার কাছ থেকে?”

“ইরজাকে ভালোবাসো তো?”

“বাসি।”

কোনো ভণিতা ছাড়াই অকপটে, নির্দ্বিধায়, সাবলীল কণ্ঠে জবাব দিলো আলমির। অপূর্ব খানিকটা অবাকের সাথে পুলকিত হলো। তার পরিকল্পনা ব্যর্থ যায়নি। আলমির বলল—

“তোমার কথায় আমি ইরজাকে বিয়ে করেছি। তুমি বলেছ, ওকে বিয়ে করলে আমার জীবন শোধরাবে। তোমার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আমি জানি তুমি আমাকে কতটা স্নেহ করো। প্রিয়তা কখনো আমাকে কিছু বলেনি। না এই বাড়ির একটা মানুষ। তুমি আমাকে বলতে। এখন তুমিই বলো, কেউ যদি আমাকে কিছু না জানায়, তাহলে কী করে আমি তা জানব?”

“প্রিয়তার সাথে যা হয়েছে তার সবটা তো আমি জানি না। যতটুকু জেনেছি ততটুকুই তোমাকে জানিয়েছি। সেই একই জিনিস ইরহার সাথে যেন না ঘটে, আর তুমিও যেন দ্বিতীয়বার হেরে না যাও, এজন্যই আমি ইরজাকে তোমার উপযুক্ত মনে করেছি। ইরহার মুখে ইরজার সব কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, এই মেয়ে অন্যদের মতো নয়। আর তার প্রমাণ তুমি নিজেই পেয়েছ। তবে ওর মনটাও যে অন্যদের মতো নয়, সেটা আমি আজ বুঝতে পারছি। নিজে ভেঙ্গে চুরে গুড়িয়ে গিয়েও তোমার গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি।”

“কীসের কথা বলছ তুমি?”

অপূর্ব ক্লান্ত হাসে। সেই হাসিতে শব্দ নেই। বলল—

“তা তোমাকে ইরজাই বলবে। আমি অন্য কারণে তোমাকে ফোন করেছি। আমার একটা হেল্প প্রয়োজন।”

“বলো।”

“আমার রিনি অসুস্থ।”

অপূর্বর কণ্ঠ কেঁপে উঠল। আলমির অস্থির কণ্ঠে শুধাল—

“কী হয়েছে?”

“কনজেনিটাল হার্ট ডিফেক্ট। ডাক্তার বলেছে ইমিডিয়েট অপারেশন করাতে।”

“আগে কেন বলোনি?”

আলমিরের কণ্ঠে চাপা রাগ। অপূর্ব অত্যন্ত শান্ত, প্রকম্পিত গলায় বলল—

“এই তো কিছুদিন হলো জানলাম।”

“তাহলে দেরি করছ কেন?”

অপূর্ব কিছুক্ষণের জন্য থমকালো। বলল—

“আমার কিছু টাকা লাগবে আলমির। আমি পরে তোমাকে ফেরত দিয়ে দেবো।”

আলমির ক্ষেপে উঠল। খরখরে স্বরে বলল—

“ফেরত দেবার কথা আসছে কেন? ও শুধু তোমারই মেয়ে, আমার কিছুই না? এই সম্পত্তিতে রিনিরও হক আছে। ও ওর হক নেবে। সেখানে ফেরতের কথা আসবে কেন?”

লাউডস্পিকার দেওয়া। সব শুনছে শশী। কী বিদঘুটে, বিষাক্ত, বীভৎস যন্ত্রণায় তার বক্ষ পাটা ছিড়ে যাচ্ছে! কাকে কী ভেবেছিল সে?

“হু। ঠিক আছে।”

“তুমি আমাকে অ্যাকাউন্ট নাম্বার আর অ্যামাউন্ট সেন্ট করো। কাল সকালে টাকা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। দেরি করবে না আর।”

“ওকে। ইরজার খেয়াল রেখো।”

“রাখব।”

“রাখছি।”

“হুম।”

অপূর্ব ফোন রেখে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসল। আর বলল—

“কার ক্ষতি করেছ তুমি? যে তোমার মেয়েকে নিজের সন্তানের মতো মনে করে! মা না থেকে আলমির মানুষ হয়েছে, আর সব থেকেও তোমরা হয়েছ পশু। আলমির তোমাকে ক্ষমা করবে কি না জানি না, তবে আমি তোমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করব না। এক পুরুষকে বাবা আর এক অসহায় মা’কে তার সন্তান থেকে আলাদা করে ফেলেছ তুমি। ছিঃ শশী! ছিঃ! ”

শশী অপ্রকৃতিস্থের মতো কাঁদতে থাকে। অপূর্ব আরও বলল—

“সবাইকে সাজা শরীরে দিতে হয় না শশী। তোমার এই অনুতাপবোধ তোমাকে শান্তিতে নিশ্বাস নিতে দেবে না। যত দিন বাঁচবে, নিজের এই অপরাধবোধ তোমাকে জীবন্ত লা শ বানিয়ে রাখবে। প্রিয়তাকে তো আর পাবে না। ক্ষমা চাইবে কার কাছে?”

তিরস্কারপূর্ণ এই বাক্য শশীর হৃৎপিণ্ডে খঞ্জরের মতো বিঁধল। কী করে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে সে?
,
,
,
লাইট অফ। রুমে এসে আবারও চটে গেল আলমির। বাতি জ্বালালো। তেড়ে গিয়ে ইরজার হাত ধরে তাকে বসিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে প্রশ্ন করল—

“কী হয়েছে তোমার?”

ইরজার আরক্ত চোখ। কঠোর দৃষ্টি। বলল—

“ঘুম পাচ্ছে আমার। লাইট অফ করুন।”

“আগে তুমি আমার কথার জবাব দাও।”

“কীসের জবাব চান আপনি? কোন কথার জবাব দেবো? জবাব না দিলে কী আপনি কিছুই বুঝতে পারেন না?”

আলমির অবাক হলো। ইরজা নিজেই কোনো কথা বলছে না। এখন তার উপরেই রাগ ঝাড়ছে!

“কী বুঝিনি আমি?”

ইরজা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। সংক্ষুব্দ অভিব্যক্তি। সরোষে বলল—

“কেন ছেড়ে গিয়ে ছিলেন প্রিয়তাকে আপনি? কেন ওর কোনো খোঁজ নেননি? কেন জানতে চাননি ও কেমন আছে? কীসের ভালোবাসা ওর প্রতি আপনার?”

আলমির ভারী শ্বাস ফেলল। রাগে দিশেহারা আলমিরের মুখবিবরে গহন কম্পন। সে তিরিক্ষি স্বরে বলল—

“কী করতাম আমি? কেউ কিছু না বললে কী করে জানব আমি? দেশে ফেরার পর কতবার ওকে জিজ্ঞেস করেছি, কী হয়েছে তোমার? কেন এমন করছ? কে কী বলেছে? কোনো জবাব নেই। কোনো কথা নেই। এতবার জিজ্ঞেস করার পরও কিচ্ছু বলেনি আমাকে। ”

আলমির থামল। পুরো শরীর কাঁপছে তার। সে আবারও বলতে শুরু করল—

“সারাক্ষণ চুপ করে ঘরের কাজ করত। কাছে আসতে চাইত না আমার। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলত, ভালো লাগছে না। কী ভালো লাগছে না? শরীর না মন? না বললে কেমনে বুঝব আমি?”

পাশের টেবিলের সব ফেলে দিলো রাগের দহনে। কেঁপে উঠল ইরজা। ক্রোধের শিখায় আরও জ্বলে উঠে আলমির। পেছনের চেয়ারে মা রল এক লাথি । ইরজা কান চেপে ধরল। ফুঁসে উঠে আরও বলল—

“বাড়ির সবাই চুপ। কারো সাথে কারো কোনো ঝামেলা নেই। আমি আসাতেই সব ঝামেলা উধাও। শুধু শেষ হলো না প্রিয়তার অভিমান। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে বলো?বলল, আপনি আর যাবেন না। এখানেই থাকেন। আমার একা ভালো লাগে না। বললাম, তাহলে তোমাকে তোমার বাড়িতে দিয়ে আসি। বলল, না। এখানেই থাকবে। আমার সাথেই থাকবে। বাবা বলতে লাগলেন, আর কতদিন বউয়ের আঁচলের তলায় থাকবি। ফিরতে হবে। ওকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম। সেই একই কথা। এখন তুমিই বলো, যদি কিছু নাই বলে তাহলে আমি কাকে প্রশ্ন করব? বলো? উত্তর দাও। ”

ভাঙা চেয়ারের টুকরো ছুড়ে মার ল ড্রেসিং টেবিলে। ঝনঝন শব্দে আয়নাটা ভেঙ্গে পড়ল। ইরজা ধীরগতিতে শ্বাস নিচ্ছে। ওই ক্রোদে দিশেহারা, রক্তচক্ষুর পুরুষটিকে দেখে তার এই মুহূর্তে ভয় হচ্ছে। প্রচণ্ড ভয়!

আলমির সংক্ষোভে এগিয়ে গেল। ইরজার দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল—

“হ্যাঁ, সব দোষ আমার। প্রিয়তাকে ভালোবাসা আমার অপরাধ। ওকে বিয়ে করা, ওকে পাবার জন্য বাবার সব কথা মেনে নেওয়া,ওকে ভালো রাখার জন্য ওকে ছেড়ে যাওয়াও আমার অপরাধ। বাবা মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো তাদের সব কথা মেনে নেওয়া, ভাইবোনদের ভালোবাসাও আমার অপরাধ। আর এখন সবচেয়ে বড়ো অন্যায় করেছি তোমাকে বিয়ে করে, তোমাকে ভালোবেসে। আমার জীবনটাই দোষে ভরা। আমার বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো দোষ, অন্যায়, অপরাধ।”

ইরজাকে ঝাড়া দিয়ে সরে এলো আলমির। তার ক্রোধাগ্নি জ্বলা আঁখি দুটো জলে থৈ থৈ করছে। আচানক শীতল কণ্ঠে বলল—

“প্রিয়তাও কিছু বলেনি, তুমিও কিছু বলবে না। কিন্তু তোমরা সবাই চাও, আমি সব বুঝে নেই। কেন? আমি কী ফেরশতা?”

এক জোরালো লাথি বসাল বিছানায়। ইরজার দম আটকে এলো। আলমিরের চোখ,মুখ সব ভিজে গেছে। গায়ের শার্টটাও ভিজে সেঁটে গেছে গায়ের সাথে। বলল–

” এই তুমি চেয়েছ প্রিয়তাকে আমি ভুলে যাই। আর এই তুমিই এখন প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা ক্ষণ প্রিয়তাকে মনে করিয়ে দিয়ে আমার ক্ষতটাকে তাজা করে তাতে এসিড ঢালছ। কী চাও তুমি? এক কাজ করো না কেন, এভাবে তিলে তিলে মা রার চেয়ে একেবারেই মে রে ফেল আমাকে। এত অপরাধ নিয়ে আমার বেঁচে থাকাটাই বৃথা।”

আলমির বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে গিয়ে ইরজার হাত দুটো নিজের গলদেশে চেপে ধরল। ইরজার ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি। হাসফাস করে বলল—

“ছাড়ুন, কী পাগলামি করছেন আপনি?”

আলমির ছাড়ল। আফসোসের সুরে বলল—

“হ্যাঁ, পাগল আমি। তোমরা আমাকে পাগল বানিয়েছ। একজন ম রে গিয়ে, আরেক জন বেঁচে থেকে। আমার কিছু হয় না কেন? মা চলে গেল, প্রিয়তাও চলে গেল, তোমার জীবনটাও নরক বানিয়ে দিলাম। সব দোষ আমার, সব।”

আলমির হনহন করে বেরিয়ে গেল। ইরজা দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো। তার অশ্রুজল খুব সাবধানে বইছে। আলগোছে পেটের ওপর হাত রাখল।

“কিছু না জেনেও এতটা ভেঙ্গে পড়েছে যে মানুষটা, যে সবকিছুর জন্য নিজেকেই দোষারোপ করছে, তাকে কী করে এসব বলব আমি? সব শুনলে উনাকে সামলাবো কী করে আমি? কী করব এখন আমি? যে আছে তাকে সাবলাবো না যে আসতে চলেছে তাকে?”

চলবে,,,

#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব:৩৫
লেখনীতে:আইশা তানভি

মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলো ডিঙিয়ে বাইরে আসে ইরজা। ভ্রূকুটি করে সন্দিহান চোখে দাঁড়িয়ে আছেন শরীফ আশরাফ। তাকে দেখে ইরজা কিছুটা ঘাবড়ে গেল। তিনি ভারিক্কি গলায় জিজ্ঞেস করলেন—

“কোথায় গেছে আলমির?”

“জানি না।”

“এত আওয়াজ কীসের ছিল?”

যুতসই জবাব খুঁজে পাচ্ছে না ইরজা। ঝগড়ার কথাও বলতে পারছে না। সে নীরব রইল। শরীফ আশরাফ আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। রুমের ভেতর চলে গেলেন। শ্বাস ফেলল ইরজা। সে আহিলের দরজার কাছে গেল। করাঘাত করতেই আহিল বেরিয়ে এলো।

“আরে তুমি? কিছু বলবে?”

ইরজা কণ্ঠ নামিয়ে নত মুখে বলল—

“আপনার ভাইয়া রাগ করে বেরিয়ে গেছে। একটু গিয়ে দেখবেন কোথায় গেছে?”

“এত রাতে….ফোন দাও।”

“কল রিসিভ করছে না।”

“ঝগড়া করলে কেন?”

ইরজা অপ্রস্তুত চোখে চাইল। ইরহা এসে দাঁড়াল পেছনে। আহিল বলল–

“চিন্তা করো না। ভাইয়া চলে আসবে। ও আমাদের মতো এত বেপরোয়া না। হয়তো রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি তাই বেরিয়ে গেছে। তুমি ঘরে যাও, ও ঠিক চলে আসবে।”

“আপনি একটু কল করে দেখেন না।”

অগত্যা আহিল কল করল আলমিরকে। সে কল রিসিভ করল না। ইরজা ফিরে গেল রুমে।
,
,
,
আঁধার কালো। টলটলে ঝিলের জল। দূর থেকে আসা আলোতে তরঙ্গের উথাল পাথাল দেখা যাচ্ছে। দমকা হাওয়া। রাস্তায় এখনো কতিপয় মানুষের আনাগোনা আছে। আলমির ফুটপাতে ঝিলের ধার ঘেঁষে বসে আছে। নির্লিপ্ত, নিশ্চল চাহনি।

“মন খারাপ?”

আলমির জবাব দিলো না। প্রিয়তা হাসল। নিঃশব্দ হাসি। পূনরায় বলল—

“কথা বলবেন না? ”

তবুও সাড়া দিলো না আলমির। প্রিয়তা কাছ ঘেঁষে এলো। আলমিরের কাঁধে হাত রাখল। বলল—

“আমি কী চলে যাব?”

“চলে যাও, আমার কাউকে প্রয়োজন নেই।”

প্রিয়তা হাসি মুখে আলমিরের পাশে এসে বসল। আজ সে ফিকে বাদামী রঙের সুতি শাড়ি পরেছে। আলমির ঘাড় বাকিয়ে তার দিকে চাইল। প্রিয়তার ঠোঁটে হাসি। প্রবল সমীরণে তার চুল উড়ছে। এলোমেলোভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে চোখে, মুখে। আলমির বলল—

“কেন এসেছ?”

“আপনাকে দেখতে।”

“আমি কী মরে গেছি?”

“কষ্ট পেয়েছেন?”

“না। আমার কষ্ট পেতে নেই।”

প্রিয়তা গাঢ় হাসল। বলল—

“কেন ঝগড়া করলেন ওর সাথে?”

“তো কী করব? ”

“ওর সাথে ঝগড়া করলে কী আপনি ভালো থাকবেন?”

“তো কী করতাম বলো? ও কিছুই বলছে না আমায়। তুমিও কিছু বলোনি আমাকে।”

“আমি চাইনি আপনার কষ্ট হোক। ইরজাও চায় না আপনার কষ্ট হোক।”

“তাই? এজন্য বুঝি কিছু না বলে আমাকে ছেড়ে গিয়ে সবচেয়ে বড়ো কষ্টটা তুমিই দিলে?”

“আমি কোথাও যাইনি। আমি আপনার এখানে আছি। আপনি চাইলেও আমাকে এখান থেকে সরাতে পারবেন না।”

আলমিরের বুকের আছে হাত রাখল প্রিয়তা। আলমির শিউরে উঠল। এই প্রথম এই অদৃশ্য ছোঁয়া তার অঙ্গে লাগল। আলমিরের অবচেতন মন সব সত্যি মেনে নিচ্ছে। সে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠে—

“প্রিয়তা!”

প্রিয়তা মিঠে হাসল। বলল—

“আমি সবসময় আপনার এখানেই আছি আলমির।”

আলমিরের চোখ বেয়ে লোনা জল নামে। প্রিয়তা হাত সরিয়ে নেয়। আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসে। আলমিরের কাঁধে মাথা রাখে।বলতে থাকে—

“আমি অনেক চেয়েছি সব ঠিক হয়ে যাক। কিন্তু সব আরও বিগড়ে যাচ্ছিল। আমি কখনো চাইনি, এই মানুষগুলোর সত্য জেনে আপনি কষ্ট পান। যারা আপনার সত্যিকারের আপন। কিন্তু….।”

“কিন্তু কী প্রিয়তা?”

প্রিয়তা কাঁধ থেকে মাথা তুলল। আলমিরের দিকে তাকাল। বলল—

“আপনি বাড়ি ফিরে যান আলমির। ইরজার আপনাকে প্রয়োজন। আপনি ওর পাশে না থাকলে ও আমাকে ন্যায় এনে দিতে পারবে না। আপনি ফিরে যান।”

প্রিয়তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে। আলমির উন্মত্ত হয়ে ওঠে। প্রিয়তার নাম ধরে ডাকতে থাকে। প্রিয়তা হারিয়ে যায় বাতাসে। নীরবে, অরবে।
,
,
,
রুম পরিষ্কার করতে করতে রাত দুটো বেজে গেল। ইরজা ঘড়িতে সময় দেখে বিছানায় বসল। উঠে পড়ল চটজলদি। ড্রয়ারে কাপড়ের নিচ থেকে কাগজগুলো বের করে আনলো। বিছানায় বসে পাতা উল্টাতে লাগল। এসবে শুধু আহিল, শশী, আমেনার করা কটুবাক্য, গালিগালাজ নিয়ে লেখা। ইরজা অন্য কিছু খুঁজছে। তার চোখ আটকালো এক পাতায়।

(অতীত)

* প্রিয়তা চা বানিয়ে এনেছে। শরীফ আশরাফ টিভি দেখছিলেন। তাকে চা দিতেই চায়ের বদলে প্রিয়তার হাতে অযাচিতভাবে স্পর্শ করলেন শরীফ। প্রিয়তা দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। চা দিয়ে দ্রুত চলে গেল সে।

* আজ অনেক কাজ। প্রচণ্ড গরম। প্রিয়তা কোমরে আঁচল গুজে নিলো। তাকে দ্রুত কাজ সারতে হবে। ঘামে ভেজা পিঠের বাক। কী এক অবাধ্য সুড়সুড়িতে লোনা জলের ধারা নামছে। বুক, গলা সব ঘেমে আছে। শরীফ আশরাফ সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই রান্না ঘরে চোখ পড়ল। ধীরপায়ে রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে পা রাখলেন। চেয়ে রইলেন অনিমেষ। প্রিয়তার সারা অঙ্গে লোভাতুর চাহনিতে গিলে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। হাত বাড়িয়ে তার শরীর স্পর্শ করে কিছু নিতে গেলে চকিতে সরে আসে প্রিয়তা। শরীফকে দেখে লজ্জায় আঁচল খুলে তড়িৎ বেগে মাথায় ঘোমটা টানে। শরীরের বাকি অংশও ঢেকে ফেলে। শরীফ মৃদু হেসে বলল—

“ও আসলে…আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে।”

“পানি টেবিলে আছে বাবা।”

“ও আচ্ছা।”

শরীফ বেরিয়ে গেলেন। গা হিরহির করে উঠল প্রিয়তার। আজকাল শরীফের আচরণ তাকে বিশ্রী অনুভূতি দিচ্ছে।

ইরজার চোখের কোলে আ গুন জ্বলে উঠল। ঘৃণায় মুখ তেতো হয়ে উঠেছে।

“ছিঃ! এ কেমন বাবা?”

রাগে, ক্ষোভে তার গা কাঁপতে লাগল। ইরজা পড়া বন্ধ করল না। আবারও পাতা উল্টালো।

* পানিতে পিছলে গিয়ে প্রিয়তার পা মচকে গেল। মেয়েটা বিছানায় কাতরাচ্ছে। দরজা ঠেলে ভেতরে এলো আহিল। তাকে দেখে কিছুটা সংযত হলো প্রিয়তা।

“কী হয়েছে তোমার?”

প্রিয়তা কাতর কণ্ঠে বলল—

“তেমন কিছু না। পায়ে ব্যথা পেয়েছি।”

“দাঁড়াও, আমি স্প্রে করে দিচ্ছি।”

ভলিনির ব্যথা নিরাময়ের একটা স্প্রে বোতল আনল আহিল। প্রিয়তা মানা করলেও সে শুনল না। পায়ের গোড়ালিতে স্প্রে করতে করতে আহিলের দৃষ্টি প্রিয়তার সাদা পা দুটোর ওপরের দিকে উঠতে লাগল। সে খুব চালাকির সাথে প্রিয়তার শাড়িতে হাত দিয়ে ওপরের দিকে ঠেলতে লাগল। প্রিয়তার কেমন যেন লাগছে। সে দ্রুত পা সরিয়ে নিলো।

“কী করছেন আপনি?”

আহিল থতমত খেয়ে বলল—

“কই, কিছু না তো।”

“আপনি যান আহিল ভাইয়া। আমার কিছু লাগবে না।”

“আরে, তুমি..।”

“তুই এখানে কী করছিস?”

শশীর কথায় ভয় পেয়ে গেল আহিল। সে দ্রুত প্রস্থান করল। শশীর রাগান্বিত দৃষ্টি। প্রিয়তাকে বলল–

“ও এখানে কেন এসেছে?”

“আমার পায়ে ব্যথা করছিল। তাই…।”

“তাই ওকে ডেকে এনেছিস?”

“আমি ডাকিনি। আহিল ভাইয়া নিজেই এসেছেন।”

“চুপ কর। তুই কী বাচ্চা, বুঝিস না কিছু? ও একটা পুরুষ মানুষ। নিজের দিকে তাকিয়েছিস? তোর এই রূপ দেখলে ও নিজেকে থামাতে পারবে? পরে তো আমার ভাইয়ের দোষ দিবি। দেখ প্রিয়তা, একটা কে তো আঁচলে বেঁধেছিস, এখন আরেকটাকে নিয়ে টানাটানি করিস না। আহিল যেন আর কখনো তোর রুমে না আসে। দরজা আটকিয়ে রাখবি। বুঝেছিস, কী বলেছি?”

“জি আপা।”

“এই নে ফোন। আলমির ফোন করবে। তুই আবার ওকে এসব বলে ওর মাথা খারাপ করে দিস না। কাজে মন বসবে না ওর।”

প্রিয়তা মাথা ঝাঁকায়। শশী আর আমেনা এসব বলেই প্রিয়তাকে দমিয়ে রাখে।

ইরজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একটা রাক্ষসপুরীতে এত ছোটো একটা মেয়ে কী করে ছিল? হায়!
ইরজা আরও পড়ে।

* গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে প্রিয়তা। আজ কোন ভুলে দরজা লাগায়নি। মেয়েটা ভীষণ ক্লান্ত থাকে। বিছানায় পিঠ ছোঁয়াতেই ঘুম এসে যায়। প্রিয়তার ঘুমন্ত শরীর তাকে জানান দিলো খারাপ কিছুর। কেউ তার শরীরকে নোংরাভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। চোখ খুলতেই তাকে ঝাঁপটে ধরল। মুখ চেপে ধরায় চেঁচাতে পারল না সে। প্রিয়তার চোখ ফেটে জল বের হচ্ছে। শ্বাস রুখে যাচ্ছে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে পুরুষটির তলপেলে লাথি বসাল সে। ছায়া অবয়বটি তাকে ছেড়ে দিলো। প্রিয়তা চেঁচিয়ে ওঠার আগেই অবয়বটি দৌড়ে পালালো। প্রিয়তা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেছে। কাপড় টেনে নিলো গায়ে। এ ঘটনার কয়েকদিন ঠিক মতো ঘুমাতে পারল না প্রিয়তা। একটা ভয়াতুর দৃষ্টি দিয়ে আহিলকে দেখত। কিন্তু তার সন্দেহে কখনো প্রদীপ জ্বলেনি।

“আহিল ! ছিঃ! ”

ক্রোধে মাথা ফেটে যাচ্ছে ইরজার। বোনের কথা মনে পড়তেই বুকটা ঝাঁঝরা হলো তার। তবে ইরজা প্রতিজ্ঞা করল, এর শাস্তি আহিলকে পেতেই হবে। প্রিয়তার সাথে করা কোনো অন্যায়ের কারো ক্ষমা নেই।

চলবে,,,