#প্রিয়ঙ্গনা
#পর্ব: ৩৬
লেখনীতে:আইশা তানভি
আহিলের প্রতি তীব্র সন্দেহ থাকলেও কোনো সুরাহা মেলেনি প্রিয়তার। ভয়ে, আতঙ্কে, অস্থিরতায় কেমন জবুথবু হয়ে থাকত। এর মাঝে একদিন পূনরায় সেই ঘটনা ঘটল। দরজা বন্ধ থাকার পরও। প্রিয়তা অবয়বটির বুকে খামছি বসাল। মুখেও আঁচড় কাটল। নরপিশাচটি পালিয়ে বাঁচে। বাকি রাত ঘুমালো না প্রিয়তা। ভয়ে তার হা-পা ঠাণ্ডা হয়েছে। কাঁপছে রীতিমতো।
ইরজা দম ফেলল। নিজের অস্তিত্ব সংকটে ভোগা মেয়েটির দিনগুলো কীভাবে কাটত তখন?
প্রিয়তা অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে। বয়স মাত্র সতেরো। এইটুকু বয়সে তার বাইরের জগতের বোধ খুব কম। পড়ালেখা আর ঘরকন্নার কাজ ছাড়া তেমন কিছু তার জানা নেই। স্বামী নামক পুরুষটির সাথেও বোঝাপড়াটাও অতি সামান্য। খুব কম সময় সে স্বামীর সাহচর্য পেয়েছে। একাকিত্ব, আতঙ্কিত পরিবেশ। শশুরবাড়িতে সব দোষ বউদের ঘাড়ে তোলা হয়। সেই হেতু জঘন্য কাজটির হোতা কে তা সঠিকভাবে নির্ণয় না করে সে কাউকে বলতে পারছে না। তার ভয় তাকে দাবিয়ে রেখেছে।
ইরজা আবারও পড়তে শুরু করল।
প্রিয়তা তার প্রশ্নের জবাব খুঁজছে। আহিলকে খুব করে লক্ষ্য করেও কোনো হদিস পাওয়া গেল না। শরীফ এড়িয়ে চলতে লাগল প্রিয়তাকে।
খেতে বসে মাথা নিচু করে রেখেছেন শরীফ। তার পাতে দই কাতলা তুলে দিলো প্রিয়তা। সহসা একটা সুগন্ধ এসে নাকে ঠেকল তার। এই পারফিউমের গন্ধ তার পরিচিত ঠেকছে। প্রিয়তার হৃৎকম্পন বাড়তে লাগল। শ্বাস ঘন হতে লাগল।
প্রিয়তা ডাকল—
“বাবা!”
শরীফ চট করে মাথা তুললেন। তার চোখের কোণে দাগ। আঁতকে উঠল প্রিয়তা। হাতের বাটিটা পড়ে গেল অসতর্কতায়। ছুটে এলেন আমেনা। তিনি খলবলিয়ে উঠলেন। বললেন—
“এই ফকিন্নির বাচ্চা, এটা কী করলি তুই? এত দামি বাটিটা ভেঙ্গে ফেললি?”
প্রিয়তা সেসব কানে তুলল না। সে কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল—
“আপনিই তাহলে এতদিন এমন নোংরামি করছিলেন? ছিঃ! কী করে পারলেন এমন করতে? আমি তো আপনার মেয়ের মতো।”
আমেনা কথার অর্থ উদ্ধার করতে পারেন না। কৌতূহলী গলায় বলেন—
“কী বলছিস এসব?”
প্রিয়তা থামল না। অশ্রুসজল চোখে জঘন্য ঘটনাগুলো বলে ফেলল। আমেনা আশরাফ বিস্ফোরিত চোখে স্বামীকে দেখছিলেন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন—
“আপনি এত নিচে নামলেন কী করে? ছিঃ! ”
শরীফ আশরাফ তড়িৎ বেগে গিয়ে আমেনার মুখ চেপে ধরলেন।
“চুপ, একদম চুপ। সব তোর জন্য হয়েছে।”
আমেনাকে রুমের ভেতরে নিয়ে গেলেন তিনি। কী কী যেন বললেন। ফিরে এসে আমেনা প্রিয়তাকে অনুনয়, বিনয় করতে লাগল। যেন এসব ঘটনা কাউকে না বলে। প্রিয়তার কাছে হাত জোড় করলেন আমেনা। নিষ্পাপ প্রিয়তা শাশুড়ির আহাজারিতে সংসার ভাঙার ভয়ে চুপ হয়ে গেল। তার এই নীরবতা তাকে পাথর বানিয়ে দিলো। ঠিক তার কয়েকদিনের মাথাতেই আলমির এসে পড়ল বাংলাদেশ। কাউকে কিছু না জানিয়েই। কারণ, প্রিয়তা তার সাথে কোনো কথাই বলছিল না।
ইরজা পাতা উলটালো। এরপর আর কিছুই লেখা নেই। আলমির আসার পর কী হলো তার কিছুই নেই এখানে। তাহলে কী প্রিয়তা আর ডায়েরি লিখেনি। কেন লিখেনি? কী হয়ে ছিল আলমির আসার পর? সেসব প্রশ্নেরা কিলবিল করতে লাগল ইরজার মস্তিষ্কে। ভাবতে ভাবতে তার চোখে ঘুম এসে গেল।
আড়মোড়া ভাঙতেই শক্ত কিছুর বন্ধন অনুভব করল ইরজা। তাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে আলমির। ইরজা নড়ে উঠল। আলমিরের ঘুম ছুটে গেছে।
“কখন এসেছেন?”
আলমির জবাব দিলো না। চেয়ে রইল।
“কথা বলছেন না কেন?”
“সরি।”
“কীসের জন্য?”
“গত রাতের জন্য।”
“আপনার কোনো দোষ নেই।”
ইরজা সশব্দে শ্বাস ফেলল। বলল—
“আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব?”
“করো।”
“আপনি দেশে ফিরে আসার পর কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে মানে?”
“প্রিয়তা আপনাকে কিছুই বলেনি?”
“না। শুধু কেমন চুপ হয়ে থাকত।”
“আপনি কারণ জিজ্ঞাসা করেননি?”
“করেছি। লাভ হয়নি।”
“ও কনসিভ করে ছিল, আপনি জানতেন না?”
“না। যাওয়ার পরে জানতে পারি।”
“আসেননি কেন ফিরে?”
“আসতে দেয়নি আমাকে। বলেছিল, সবাই খেয়াল রাখবে ওর। আমি যেন আরও পরে আসি। সবেই তো গেলাম।”
ইরজা আর প্রশ্ন করল না। বাকি উত্তর আমেনা আর শরীফ আশরাফ দেবেন।
,
,
,
“প্রিয়তা মারা যাওয়ার সময় আপনি কোথায় ছিলেন আহিল ভাইয়া?”
খাবার সময় এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় আহিল। সে আলমিরের দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে বলল—
“আমি ভার্সিটিতে ছিলাম।”
“আর বাকিরা?”
“হঠাৎ এসব প্রশ্ন কেন?”
আমেনা কঠোর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন। শরীফ আশরাফ ঘেমে যাচ্ছেন। গতকাল শশী ফোন করে বাবার সাথে অনেক ঝামেলা করেছে। নিজের ঔরসজাত মেয়েকে এতদিন পরিচয় না দেয়ার হেতু শশী শরীফ আশরাফের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মায়ের সাথে তার একচোট ঝগড়া হয়ে গেল। সে জানিয়ে দিলো, আর কোনোদিনও এই বাড়িতে আসবে না।
তাই শরীফ আশরাফ ভেতরে ভেতরে ভীষণ ক্ষেপে আছেন ইরজার ওপর। এখন আবার এই অহেতুক প্রশ্নের জন্য মেজাজ বিগড়ে গেল তার।
ইরজা বলল—
“একজন গর্ভবতী মহিলা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মা রা গেল, আর বাড়ির কেউ টের পেল না ! এটা কী করে হয়?”
“মা, শশী আপাদের ওখানে গেছিল। বাড়িতে শুধু বাবা ছিল।”
আহিলের জবাবে শরীফ দ্বিগুণ ঘাবড়ে গেলেন। ইরজা তার দৃষ্টি তাক করল শরীফ আশরাফের দিকে। আলমির ভ্রূ বাঁকিয়ে ফেলল। আমেনা উৎকণ্ঠিত।
“বলুন বাবা, কী হয়েছিল সেদিন প্রিয়তার সাথে?”
“কী হয়েছিল মানে? কী হবে? ও সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যায়?”
“আর তার আগেই যে আপনি ওকে তিলে তিলে মেরে ফেলেছিলেন, সেটা বলছেন না?”
সকলের অবাক বিস্ময় দৃষ্টি ইরজার পানে। এতসব অদ্ভুত কথায় প্রেশার পরছে ইরহার ওপর। তার কেমন অস্বস্তি হতে শুরু করেছে।
আলমির দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল—
“এসব তুমি কী বলছ?”
“ঠিকই বলছি। ”
আমেনা চিৎকার করে বললেন—
“এই মেয়ে, মুখ বন্ধ করো তোমার। ”
“কেন? ভয় হচ্ছে সত্যি বের হবার?”
শরীফ আশরাফ দাঁপিয়ে উঠলেন। চাপা রাগটা আর দমিয়ে রাখতে পারলেন না। তিনি বুনো মহিষের মতো তেড়ে গিয়ে ইরজাকে ধরলেন। আলমিরের দৃষ্টি প্রস্ফুটিত হলো। সে তার বাবাকে বাঁধা দিতেই শরীফের হাতটা ঝাড়া মেরে সরালো। সরোষে বলল–
“বাবা, কী করছেন আপনি?”
“এই মেয়ে একটা সাপ! একের পর এক মিথ্যে বলে সবাইকে ফাঁসিয়ে যাচ্ছে।”
ইরজা উপহাসমিশ্রিত হেসে বলল–
“আমি কাউকে ফাসাইনি। শুধু আঁধারে ঢিল ছুড়েছি। আর সেটা জায়গা মতো লেগেছে।”
শশীর কাছ থেকে ডায়েরির কথা শুনেই বেশি ঘাবড়ে গেছে আশরাফ।
ইরজা তীর্যক হাসল। বলল—
“শুনুন তাহলে মি. আলমির আশরাফ, কী করেছে আপনার পরিবার ওই ছোট্ট মেয়ে প্রিয়তার সাথে। যার অসহায়তা, ভয় আর সম্মানকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক অন্যায় করেছে তার সাথে।”
আলমিরের মুখে শব্দ হয় না। ভয়াল ত্রাসে সে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে। শরীফ দাঁতে দাঁত ঘষে যাচ্ছেন। ইরহার শরীর খারাপ হতে শুরু করল। নিশ্বাস ঘন হতে লাগল।
ইরজা বলে—
“আপনি প্রথমবার যখন দেশ ছাড়েন, তখন প্রিয়তাকে একা ছাড়েননি। ওর সাথে ওর সন্তানকেও ছেড়ে গেছেন।”
আলমির অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল—
“এসব তুমি কী বলছ?”
“ঠিকই বলছি। সেই বাচ্চাকে আপনার বোন নষ্ট করে দেয়, শুধুমাত্র এই ভেবে যে আপনার সন্তান হলে তার মেয়ে এই সম্পত্তিতে তার হক হারাবে।”
আলমিরের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়। যেই বোনকে সবসময় সে আপন বোন ভেবেছে সেই কিনা….!
“শুধু তাই নয়। শশী আপনার সৎ নয় আপন বোন। আপনার বাবা শরীফ আশরাফের পরকীয়ার ফসল আপনার বোন শশী।”
আমেনার শরীর কাঁপতে লাগল। ভয়ে তার হাত, পা শিথিল হয়ে এসেছে। শরীফ ফুসে যাচ্ছেন। আলমির তার বাবার দিকে তাকাল। ওই দৃষ্টিতে ঘৃণা!
ইরজা আরও বলল—
“এটা তো সবে শুরু। অকথ্য গালাগালি, অক্লান্ত পরিশ্রম তো নিত্য দিনের সঙ্গী ছিল প্রিয়তার। সন্তান হারিয়েও সে কারও একটু সহানুভূতি পায়নি। এই আহিল ভাইয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রিয়তার সৌন্দর্যে তার প্রতি কুদৃষ্টিতে ভোলেনি তার চোখ।”
ইরহার গা গুলিয়ে উঠল। আহিল ভিরমি খেল। ইরহাকে বলল—
“ইরহা আমার কথা শোনো।”
“একদম ছোঁবেন না আপনি আমাকে।”
“হ্যাঁ। মানছি আমি। প্রিয়তাকে আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু… আমি কখনো ওর দিকে হাত বাড়াইনি।”
“ভুল বললেন আহিল ভাইয়া। হাত বাড়িয়েছেন, শুধু ছুঁতে পারেননি।”
“আহিল!”
আলমিরের রাগ মাথায় উঠে গেল। ক্রোধে তার শরীর কাঁপছে থরথর করে। সে তেড়ে গিয়ে আহিলের গলা চেপে ধরল। ইরহা দূরে সরে এলো। আমেনা ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলেন। শরীফের সমস্ত ক্রোধ উগড়ে এলো ইরজার ওপর। সে আবার তাকে আক্র মণ করে বসল। ইরজার গলা চেপে ধরলেন শরীফ আশরাফ। আহিল বলতে লাগল—
“বিশ্বাস করো ভাইয়া….আমি…।”
আহিল কথা বলতে পারছে না। তার কণ্ঠরোধ হয়ে এসেছে। আমেনা আলমিরকে টানছে। এসব দেখে ইরহা আর সহ্য করতে পারল না। শরীর ছেড়ে দিলো। আহিল হাত বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল—
“ইরহা…..! ছাড়ো ভাইয়া।”
আলমির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আহিল। দৌড়ে গিয়ে ইরহাকে সামলে নিলো। মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আলমির দেখল, ইরজাকে মা রার প্রয়াস করছেন শরীফ।
সে ছুটে গিয়ে বাবার পিঠে খাবলে ধরে ছুড়ে ফেলল। শরীফ ঝড়ের বেগে ধ্বসে পড়লেন ডাইনিং এর চেয়ারের উপর। ইরজা ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। সে হড়বড় করে বলল—
“আপনার বাবা একজন জঘন্য মানুষ আলমির। প্রিয়তাকে মলেস্ট করেছে। বেচারি আপনার মায়ের কারণে মুখে কলুপ এঁটে রেখেছিল। আমি নিশ্চিত, আপনার বাবাই প্রিয়তাকে মেরে ফেলেছে।”
“হ্যাঁ, আমিই মে রেছি।”
ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য শরীফ মুখ ফচকে বলেই ফেললেন। আলমির নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আহিল হতচকিত। ডুকরে উঠলেন আমেনা। শরীফ ক্রুর হাসলেন। তীব্র, নিষ্ঠুর রাগে তার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। তিনি বললেন—
“মার তে চাইনি, কিন্তু ও আমার কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছিল না। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে পড়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে।”
আলমির যেন এক মুহুর্তের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল। এত ভয়ং কর, এত জঘন্য কী করে হয় কোনো বাবা! শরীফ উদ্ভ্রান্তের মতো হাসতে লাগলেন। বলতে লাগলেন–
“ওকে কী শুধু শুধু এই বাড়ির বউ করেছি? ওকে হাতের কাছে পাওয়ার জন্যই তোর সাথে বিয়ে করিয়ে ছিলাম।”
“বাবা!”
আলমির ঝাঁপিয়ে গিয়ে তার বাবার বুক খাবলে ধরল। বলল—
“কী করে পারলেন আপনি? কী করে! নিজের ছেলের বউয়ের সাথে?”
“নিজের ছেলে? কীসের ছেলে? তোর জন্য তো আমি শুধু একটা কেয়ারটেকার। এই বাড়ি গাড়ি সব তোর নামে? আমি কোথাকার কী?”
“তাই বলে আপনি?”
শরীফ শ্লেষাত্মক হেসে বললেন—
“ওই মেয়ের ওপর আমার এমনিই নজর ছিল।”
ধুম করে বাবার গালে এক ঘুষি বসাল আলমির।
“নরপিশাচ! আপনাকে বাবা বলতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার। আপনারা সবাই আমার প্রিয়তার দোষী। সব। যাদের আমি আপন ভেবেছিলাম তারাই আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। প্রিয়তা! ওকে আমার জন্য সব সহ্য করতে হয়েছে। আমিও সমান দোষী। দোষ যখন হয়েছে তার সাজাও হবে। আমি এখনই পুলিশকে ফোন করব।”
আহিল ইরহাকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে। নিজের করা পাপের হিসেব কষছে সে। কিন্তু তাদের বাবা! হায়! বাবাও বুঝি এমন হয়। মেয়েটার সাথে কী ভয়ং কর পাপ করেছে তারা!
আলমির ফোন হাতে নিলে তার দিকে গ্লাস ছুড়ে মা রে শরীফ। চোখে তার প্রতিশোধের আ গুন। ইরজাকে আজ খু ন করে ফেলবে। যত নষ্টের মূল এই মেয়ে! শরীফ আশরাফ এগিয়ে আসতেই হঠাৎ তার মাথায় বারি মা রল আমেনা। কপাল বেয়ে শ্লথ ধারায় লহু নামছে। শরীফ অবাক চোখে পেছন ফিরে চাইতেই আমেনা আরেকটা বারি মার ল তার মাথায়। পরপর ফুলদানির এলোপাথাড়ি আঘা তে শরীফ আশরাফ রক্তাক্ত বদনে মেঝেতে ঢলে পড়লেন।
“মা!”
আলমিরের দিকে তাকালেন আমেনা। তার ঠোঁটে ভাসা হাসি। বললেন–
“পাপ থেকে মুক্তি দিলাম তোর বাবাকে। এই লোকটার প্ররোচনায় পড়ে কত পাপ করেছি। তোর মা’কে মেরে ছি। নিজের মেয়ের পিতৃ পরিচয় গোপন করেছি। প্রিয়তাকে মরতে দেখেছি, শুধুমাত্র এই লোকটাকে বাঁচাতে। মেয়েটার ওই করুন চোখে রক্তে মাখামাখি হয়ে আমাকে বলেছিল, মা আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান। ওতো আপনাদেরই রক্ত! আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম শুধু। ”
আমেনা হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লেন। তার আঁখি যুগল লোনা জলে সয়লাব! তিনি বললেন–
“এত নিষ্ঠুর কী করে হয়ে গেলাম আমি? এক মায়ের আর্তনাদ আমার কানে পৌঁছাল না? কী করে? কী করে?”
অপ্রকৃতিস্থের মতো নিজের মাথায় আ ঘাত করতে থাকলেন আমেনা। আহিল চেঁচিয়ে উঠে মা’কে ডাকল। অচেতন ইরহা তার কোলে। আহিলের চোখের জলে প্রকম্পিত হচ্ছে কণ্ঠ। আলমির এসে ধরতে ধরতে কাত হয়ে পড়লেন আমেনা। ইরহাকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে ছুটে এলো আহিল। রক্তের নদীতে থপাস থপাস পা ফেলে।
আলমিরের কোলের উপর আমেনা। রক্তে রঞ্জিত মুখ। বললেন—
“আমাকে ক্ষমা করিস আলমির। নিজের সুখের জন্য তোর জীবনটা নরক বানিয়ে ফেললাম। কিন্তু সুখ পেলাম কই? ”
“মা!”
আহিল ডেকে ওঠে। আমেনা বললেন—
“আহিলকে ক্ষমা করিস বাবা। ওর এই অধঃপতন আমার কারণে। আমি ওকে সুশিক্ষা দিতে পারিনি। তুই ওকে তোর মতো বানিয়ে নিস বাবা। শশী ইচ্ছে করে কিছু করেনি। ওকে আমি বাধ্য করেছি। প্রিয়তাকে আমি বলে ছিলাম তোকে কিছু না বলতে। আমি বুঝতে পারিনি, আমার ভুলের কারণে ওকে ওর জীবন দিতে হবে!”
আমেনা বেগমের শ্বাস ক্রমশ লম্বা হতে লাগল। দৃষ্টি ম রে যাচ্ছে। ইরজা দাঁড়িয়ে আছে। অদূরে। কোনো হেলদোল নেই তার। আমেনা হেসে উঠলেন। খুব কষ্টে হাত দুটো জোর করে বললেন—
“ক্ষমা করিস মা।”
আমেনা মা রা গেলেন। ডুকরে উঠল আহিল। ইরজা চোখের পলক ফেলল। সে সিঁড়ির দিকে তাকাল। ইরজার মনে হলো, সেখানে রক্তমাখা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। তার ঠোঁটে হাসি। অনাবিল সেই হাসিতে ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে রয় ইরজা।
…সমাপ্ত…