প্রিয়জন পর্ব-০২

0
1742

#প্রিয়জন (২)

বিয়ের দিন সকালে প্রচণ্ড মন খারাপ হয় হুরের। মন খারাপের কারণ সে খুঁজে পায় না। একটু পরে যেই মানুষটা স্বামী হতে চলেছে তাকে এখনো দেখে নি সে। দেখার জন্য ভেতর থেকে কোনো চঞ্চলতা ও নেই। যেন বিয়ে নয় চলছে পুতুল খেলা। আজ বলেছে আর কাল ই বিয়ে। আশ্চর্য অন্যের পাপের শাস্তি যেন তাকে দেওয়া হচ্ছে! জমিদার বাড়ি থেকে কয়েক জন মেয়ে পাঠানো হয়েছে। সকাল থেকেই তারা হাত পায়ে মুখে কি যেন মাখিয়ে বসিয়ে রেখেছে। রূপচর্চার চরম পর্যায়ে উঠানো হয়েছে! হুরের কোনো অনুভূতি নেই। কিছু মেয়ে নানান ভাবে মজা করে চলেছে। মেয়েটার সে দিকে ধ্যান ই নেই। হঠাৎ করেই বাহু তে ধাক্কা পায় ও। ঘুরে তাকাতেই দেখে দুটো মেয়ে হাসছে। অপ্রস্তুত হয় মেয়েটা। তিথি বলে,”কী গো ভাবি? কোন ধ্যানে আছ? আমরা এতক্ষণ ধরে এসেছি অথচ তোমার কোনো ধ্যান ই নেই!”

হুর ইষৎ অপ্রস্তুত হলো। তারপর শুধাল,”তোমরা?”

“আমরা হলাম তোমার ননদিনী।”

“ও আচ্ছা দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো তোমরা।”

হুরের পাশে বসে তিথি। জুহি আশে পাশে তাকিয়ে বলে,”শোনো ভাবিজান আমার ভাইয়া কিন্তু একদম অন্য রকমের। তাকে সব সময় হাতে রাখবে,কেমন?”

মৃদু হাসে হুর। ফিসফিস করে তিথি বলে,”আমার ভাইয়া যেন প্রথম রাতেই সব মিষ্টি পেয়ে যায় ভাবি। ওকে অপেক্ষা করিও না আবার।”

জুহির এহেন কথাতে লজ্জায় রাঙা হয় হুর। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা কী সব কথা বলছে! হুর কোনো উত্তর করতে পারে না। সে নিজে ও খুব বড়ো এমন নয়। সবে আঠারো শেষ করেছে। এই তো মাস খানেক আগে এইচ এস এস সি পরীক্ষা দিল। জুহি আর তিথি যেন আজ ঠিক করেছে হুর কে লজ্জায় মেরে ফেলবে। হুরের দম বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। কোনো মতে উঠান থেকে উঠে আসে সে। ক্লাস টেনের মেয়েরা এত দুষ্টু হয় নাকি?

সোনালী পাড়ের লাল বেনারসি পরানো হচ্ছে হুর কে। সাথে ভারী গহনার সেট। মুখে মেকাপের ছোঁয়া। সব মিলিয়ে হুর আজ নতুন ভাবে হুরের মতন সেজে ওঠেছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। দূর থেকে চোখের পানি ফেলেন লতিফা। মেয়েকে বিয়ে দিয়েই যেন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন। ওনি ও একই রোগে আক্রান্ত। হুমায়ুন সিগারেটের নেশায় মত্ত ছিল। তার সাথে বাইশ বছর সংসার করেছে লতিফা। হুমায়ুনের সাথে সাথে তাকে ও ম র ণব্যথি তে ধরেছে। দু চোখের কার্নিশের পানি টুকু মুছে নিয়ে এগিয়ে আসেন তিনি। হুর লতিফা কে দেখেই ছলছল নয়নে তাকায়। লতিফা মেয়ের কপালে চুমু দেন। হুরের বুক হু হু করে ওঠে। লতিফা চলে আসেন অন্য ঘরে। যেখানে বিয়ে পরানো হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর কবুল বলতে বলা হয় হুর কে। কয়েক বার শ্বাস ফেলে কবুল বলে হুর। বিয়ের মোহরানা তৎক্ষনাৎ পরিশোধ করতে হয় জাহিন কে। মেয়ে কে বিদায় দেওয়ার সময় ভেঙে পরেন লতিফা। আশে পাশের মহিলা রা সামলায় লতিফা কে। হুর এক বিন্দু চোখের পানি ও ফেলে না। সে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। মায়ের সামনে আর ভেঙে পড়বে না সে। জমিদার বাড়ির নিয়ম অনুসারে নতুন বউ কে পালকি কে তোলা হয়। পালকি চলা শুরু করলেই দু চোখ বেয়ে অশ্রু বেরিয়ে আসে। পালকি যত আগায় হুর যেন ঠিক ততটাই পেছন ফিরে তাকায়। ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা আসে না তার। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে তার ফেলে যাওয়া মমতাময়ী মা কে। কেন যেন বুক টা ভারী অনুভব হয়। আচ্ছা,এখন কি তার কিছু হারানোর ব্যথা অনুভব হচ্ছে? কী হারাবে সে? তার মমতাময়ী মা কে?

জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে জাহিন। তাকে দেখে নি হুর। এখন তাকে ঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মস্ত বড়ো ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে ওঠেছে। হুর বুক ভরে শ্বাস নেয়। তার দুটো চোখ বুজে আসতে চায়। সহসাই দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ঘুম ছুটে যায় ওর। ও চেপে বসে থাকে। বুকের ভেতর কেমন করছে। অপরিচিত মানুষের ঘ্রাণ অনুভব হচ্ছে। হুর দম আটকিয়ে বসে থাকে। জাহিন চুপচাপ স্বভাবের। জীবন নিয়ে তার অনেক বেশি ভাবনা রয়েছে। তবে সেটা প্রচার করে বেড়ানোর স্বভাব নেই তার। ও ধীরে ধীরে মেয়েটির পশে এসে বসে। হুর তখন মাথা নিচু করে আছে। ও শুধায়,”এভাবেই রাত পার করবে?”

প্রথমবারের মতন পুরুষ কণ্ঠটি শুনতে পায় সে। কম্পিত হয় দেহ। জাহিনের কথার জবাব মিলে না। ও হাসে। ফের শুধায়,”রাগ করে আছ নাকি?”

হুর মাথা দোলায়। নাকোচ করে বোঝায় রাগ করে নি।

“তবে?”

এবার মুখ খুলে হুর। মৃদু সুরে বলে,”কিছু হয় নি তো।”

“তাহলে এই ভারী কাপড় পরে আছ যে?”

“চেঞ্জ করে আসব?”

“অবশ্যই।”

জবাব পেয়ে তৎক্ষণাৎ ওঠে যায় হুর। চেঞ্জ করে আসে। এসে দেখে জাহিন নিজেও পোশাক পরিবর্তন করেছে। মানুষটির শরীর থেকে মন ভালো করার মতন সুবাস মিলছে। জাহিন এগিয়ে আসে। একদম বরাবর হয়ে দাঁড়ায়। হুর তখনো মাথা নামিয়ে আছে। পুরুষটি তার শক্ত হাতের সাহায্যে মেয়েটির থুতনি উঁচু করে ধরে। এতে দৃশ্যমান হয় সমস্ত মুখ। ওর মন জুড়ায়। এই মুখটির প্রতি বিশেষ মায়া অনুভব করে সে। ছোট ভাইয়ের করা সমস্ত কিছুই জানে ও। হুরকে প্রথম বার দেখেই জাহিনের মনে হয়েছিল এই মেয়ে শুধু তার। শুধুই তার। জাহিন কেমন করে তাকিয়ে আছে। এদিকে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলেছে হুর। জাহিন হাসে। কানের কাছে এগিয়ে যায়। তারপর ফিসফিস করে বলে,”শোনো মেয়ে তুমি আমার প্রয়োজন নও বরং প্রিয়জন। প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তবে প্রিয়জন ফুরায় না।”

ছেলেটির এহেন কথায় হুরের শরীর কেঁপে ওঠে। দু চোখে অশ্রু নামে। তবে সত্যিই কী প্রিয়জন পেল সে?

চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি