প্রিয়জন পর্ব-১৩+১৪

0
1114

#প্রিয়জন (১৩)

স্বীয় কক্ষ আটকে বসে ছিল হুর। তখনই দরজায় নক পড়ে। ও কথা বলে না। মৌন থাকে। ভয়ে বিছানার সাথে লেগে যায় পিঠ। দু চোখ ভিজে অশ্রুতে। তাহিরের বলা কথা গুলো কানে এসে বাজতে থাকে। সম্পর্ক ভাঙার রিমঝিম শব্দ ভেতরটাকে দহন দেয়। কম্পন ধরে শরীরে। তবু ও ওঠার সাহস পায় না। এমনকি কথা ও বলে না। বসে থাকে হাঁটুতে মুখ গুজে। এবার দরজায় নকের সাথে সাথে বেজে ওঠে কণ্ঠটাও।

“হুর, দরজাটা খোলো। খোলো প্লিজ। আমি এসেছি। খোলো প্লিজ।”

শব্দ গুলো কানে পৌঁছানো মাত্রই মেয়েটার বুকের ভেতরে থাকা ভয়ের দল আরো বেশি করে আ’ন্দো’লন করে। ও কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় ভুগে। তারপর, দ্বিধা ভেঙে ছুটে আসে দরজার কাছে। ত্বরান্বিত হয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পায় মানুষটাকে। মেয়েটি নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। লুটিয়ে পড়ে স্বীয় মানুষটার বুকে। শক্ত হাতে চেপে ধরে শার্ট। এই আলিঙ্গন জাহিনের হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। মেয়েটি অবলম্বন চাচ্ছে। চাচ্ছে এক টুকরো ভরসা। জাহিন তা পূর্ণ করে। দু হাতে মেয়েটিকে জড়িয়ে নেয়। আদুরে ভাবে বলে,”এই বোকা মেয়ে। দরজা আটকে ছিলে কেন? জানো, ভয় লাগছিল।”

আসলেই মেয়েটা বোকা। বোকা না হলে, এভাবে দরজা লাগিয়ে বসে থাকত না। তাহিরের বলা কথায়, সম্পর্ক ভাঙার ভয়ে কান্না করত না। জাহিন ওকে শান্ত করতে, আদরের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছ। দেখি তো।”

বলেই মেয়েটির মুখশ্রী দু হাতের তালুতে নিয়ে আসে। তখনো কাঁদছে বোকা মেয়েটা। জাহিন মুগ্ধ নয়নে দেখে। এই মেয়েটাকে কাঁদলেও যে ভীষণ সুন্দর লাগে। তবে, এই কান্নাটা যে ও বেশি সময় সহ্য করতে পারে না। তাই কান্না থামাতে দু হাতের তালু দ্বারা গালে জমে থাকা নোনা জলের বিন্দু মুছে দেয়। কিছুটা শক্ত ভাবে বলে,”আবার কাঁদলে ঠাস করে চ ড় লাগাব। কেঁদে অস্থির। বাচ্চাদের মতন করলে চলে?”

মেয়েটি তখনো কিছু বলে না। চেয়ে থাকে মানুষটার মুখশ্রী পানে। এই মুখশ্রী’র মানুষটাকে ধীরে ধীরে সে অন্তরে লালন করতে শুরু করেছে। প্রকৃত ভালোবাসায় শামিল করে চলেছে। তার অন্তরের শুদ্ধতা দিয়ে আলিঙ্গন করেছে। কিন্তু সেটা যদি ভেঙে যায়, এই ভয়েই তো ওর অন্তর কাঁপে। কেঁদে ফেলে পুনরায়। জাহিন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। হতাশ হয়, তবে মুখশ্রীতে কোনো বিরক্তি রাখে না। একদম নিরলসভাবে আরো একবার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,”কান্না কেন করো?”

কান্না যদিও থামছে না। তবে মুখ খুলে মেয়েটি। ওর হাত দুটো তখনো মানুষটার পিঠ খামচে আছে। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে ও বলে,”আমাকে ছাড়বেন না কখনো। কথা দিন, কখনো ছাড়বেন না।”

“কথা দিলে কান্না থামবে?”

“জানি না। আমাকে ছাড়বেন না বলেন।”

কাঁদতে কাঁদতে হুর চাতক পাখির মতন চেয়ে থাকে। উত্তরের তৃষ্ণায় বুক ভারী হয়। ওর এমন মুখশ্রী জাহিনের হৃদয়কে শান্ত করে। ও এইটুকু বুঝে, মেয়েটি তার প্রতি আসক্ত হয়েছে।

“মিছে, মিছে ভয় পাচ্ছ। আমি তোমাকে কেন ছাড়ব? তিন কবুলের শক্তি এত কম নয় হুর। দেখো, তোমাকে ছেড়ে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাই তো চলে এলাম। বলো তো, আমার কোনো আচরণে তোমার মনে হয়েছে, তুমি শুধু আমার প্রয়োজন? বলো, মনে হয়েছে এমন কিছু? আমি তো তোমাকে শুধু প্রয়োজনে বিয়ে করিনি হুর। তোমাকে প্রিয়জন করতে চেয়েছি। অন্তরে জায়গা দিতে চেয়েছি। তোমার অন্তরে নিজের জায়গা করতে চেয়েছি। আমি কি তোমার অন্তরে নেই?”

শেষ প্রশ্নে হুরের কান্না থামে। ও চমকায়। দৃষ্টি ঘুরে এদিক সেদিক। জাহিন তার শক্ত হাতে পুনরায় মেয়েটির গাল স্পর্শ করে।

“বলো, তোমার অন্তরে আমি আছি নাকি নেই?”

এই ছোট্ট প্রশ্নের জবাব, ছোট অর্থেই দেওয়া সম্ভব। তবু, মেয়েটি দ্বিধায় ডুবে। মিথ্যে জবাব দিবে না সে। তাই চোখ বন্ধ করে। অন্তরকে প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করে এই মানুষটার স্থান নিয়ে। উত্তরটি মিলে যায় ত‍খুনি। এই মানুষটার স্থান তার অন্তরে রয়েছে। যে মানুষটাকে দু চোখে হারায় সে, সেই মানুষটার স্থান তো অন্তরে থাকবেই। ও চোখ মেলে চায়। চোখে তখনো বিন্দু বিন্দু জল। হাতের বাঁধন আরো বেশি শক্ত করে ও। মাথা থাকে প্রিয় স্বামীর বুকে। জবাবে বলে,”আপনি আমার অন্তরে আছেন। সব সময় থাকবেন। কোথাও হারাবেন না।”

ঠিক এই জবাবটিই চেয়েছিল জাহিন। ও আলগোছে মেয়েটির মাথায় হাত রাখে। আদুরে স্পর্শে বুদ হয়ে যায় মেয়েটি। জাহিন চায় না, তাদের এই সুন্দর মুহূর্তে আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আগমন হোক। তাই সে চুপ থাকে। কোনো প্রশ্ন করে না। বরং ভরসা দেয়। বোঝায়, তার হৃদয়ে মেয়েটির বিস্তার ঠিক কতখানি।

সেদিনটা ভালো ভাবেই কেটেছে হুরের। ভালো লাগছে না অজুহাতে সে ঘরেই ছিল। জাহিন নিজেই খাবার নিয়ে এসেছিল। রাতের খাবার খেয়ে সে আর বের হয় নি। প্রিয় স্বামীর বক্ষে মাথা রেখে, শান্তির ঘুমটি দিয়েছিল। ওদিকে, তাহির নামের অভিশাপটি ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল। শুভ্র সকালে পৃথিবীর বুকে আলো পৌঁছানো মাত্রই তার দরজায় নক পড়ল। ভ্রু কুঁচকে দরজা খুলতেই দর্শন ঘটল জাহিনের সাথে। জাহিন অধরে হাসি রেখে বলল,”ভেতরে আসি?”

তাহির মানা করল না। সরে দাঁড়াল। এতে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল জাহিন।

“ঘরের ওপর রাগ ওঠিয়েছ মনে হচ্ছে।”

চারপাশে নজর বুলাতে বুলাতে বলল জাহিন। তাহিরের মাথা সর্বদাই উত্তপ্ত। সে হুটহাট যে কোনো কাজ করে বসে। এবার ও তার ব্যতিক্রম হলো না। রাগে কটমট করতে করতে ও বলল,”আমাকে জ্বালাতে এসেছ তাই না?”

যেন কিছু বুঝে নি, এমন ভাবে তাকাল জাহিন। তাহিরের রাগ আরো বৃদ্ধি পেল। ও এগিয়ে এসে বরাবর হলো। জাহিন কিন্তু একটু ও রাগল না। ও বরং শান্ত সুরে বলল,”তোমাকে জ্বালাতে কেন আসব? বরং তুমি আমার হবু স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে। শুনেছি, সে নাকি তোমায় ধোঁকা দিয়েছে।”

নীরবে আ ঘাত করায় বরাবরই পারদর্শী ছেলেটা। তাহিরের রাগ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তবে সেটা প্রকাশ করে না। ও বরং বলে,”তাতে কী? বিদ্রুপ কিন্তু তোমার ও হয়েছে। সো স্যাড। তোমার মতন নম্র, ভদ্র ছেলের হবু স্ত্রী পালিয়ে গেল। তা ও বাড়ির ছোট ছেলের সাথে। লজ্জা, লজ্জা।”

তাহিরের দৃষ্টি ও কণ্ঠে বিদ্রুপ। ছোট থেকেই জাহিনকে সহ্য করতে পারে না সে। জাহিনের প্রিয় সব কিছুতেই ওর নজর। যদিও এবার ঘটনা উল্টোই হয়েছে। জাহিন হেসে এগিয়ে আসে। তাহিরের শার্টের কলার ঠিক নেই। সেটাই ঠিক করে দিয়ে দু বাহুতে স্পর্শ করে।
“আমি কিন্তু রাগ করি নি। বরং কষ্ট হচ্ছে, তুমি ধোঁকা খেয়েছ বলে।”

তাহির রাগে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে। এদিকে বিজয়ের হাসি নিয়ে প্রস্থান করে জাহিন। ফিওনার সাথে ওর বিয়ের বিষয়টা ছিল ছোট্ট একটা গেইম। যা তাহির টের ও পায় নি। তাহির থাকাকালীন সময়ে হুরের সাথে ওর বিয়েটা অসম্ভব হয়ে ওঠত। তাই ফিওনার সাথে বিয়ের নাটকটা করে সে। তাহির ভেবেছিল, তার জালে পা দিয়েছে ফিওনা। অথচ, বিষয়টা ছিল উল্টো। ফিওনা নয়, বরং তাহির ই জালে পা দিয়েছিল। যেই জালটা ছিল স্বয়ং জাহিনের। ও এমনই। রাগ দেখাবে না। উঁচু গলায় কথা ও বলবে না। নীরবে নিজের কাজটি করে ফেলবে। অথচ শ’ত্রু পক্ষ টের ও পাবে না।

চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি

#প্রিয়জন (১৪)

সকালের নাশতাটি নাকোচ করার কোনো উপায় নেই। জাহিন বুঝে, হুরের অস্বস্তি হয়। তবু ও চায়, মেয়েটি স্বাভাবিক হোক। সেটাও নিজ থেকে। একই সাথে উপলব্ধি করুক, তিন কবুলের শক্তিকে। রুমার সাথে গত রাতে কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন তাহির নিজের ভুলটি উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাছাড়া ঐ মেয়েটিও তো ধোঁকা দিয়েছে। এর কারণটি অবশ্য কেউ জানে না। সব শুনে, জাহিন স্বাভাবিক ই থেকেছে। ও চাচ্ছে না, তাহির কিংবা হুরের সম্পর্কের কথাটা আর কোথাও জানাজানি হোক। এমনটি হলে, হুরকে হয়তো পরবর্তীতে ছোট হতে হবে। তাই সে চুপ থেকেছে। এমনকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মেয়েটিকে নিয়ে ঢাকায় থাকবে। নাশতার টেবিলে বসে, এসব ই ভাবছিল ও। তখনই রুমা ডাকলেন।

“খাচ্ছ না কেন? জাহিন, মন খারাপ তোমার?”

দৃষ্টি মেলে তাকায় জাহিন। ছোট করে বলে,”না। তবে একটা কথা ভেবেছি।”

“কী?”

“ঢাকায় ফিরব। সাথে হুরকেও নিব।”

এ কথায় ডাইনিং এর পরিবেশ নীরব হয়। তাহির ভ্রু কুঁচকে তাকায়। শান্ত সুরে জাহিন বলে,”কাজের চাপ তো বেড়েছে। দেখা যাবে, ঠিক মতন আসতেও পারছি না। তার থেকে ভালো, ও বরং আমার কাছে থাক।”

এই বিষয়ে ভদ্রমহিলার কিছুটা অনাগ্রহ রয়েছে। জাহিন ছোট থেকেই ঢাকায় বড়ো হয়েছে। খুব একটা পিছুটান নেই তার। তাই বাড়িতে ফিরে না বললেই চলে। তিনি ভেবেছিলেন, বউয়ের টানে হলেও এখন থেকে ছেলেটা বাড়ি ফিরবে। কিন্তু সেই পথটিও বন্ধ হবার উপক্রম। তিনি হতাশ হয়ে পড়লেন। তবে কিছু করার নেই। তাহিরের করা অন্যায়টি তার হৃদয়কে এখনো দ হ ন দেয়। জাহিন ও হয়তো মন থেকে তাহিরকে ক্ষমা করতে পারছে না। বাড়িতে অবস্থান করলে, দুই ভাইয়ের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ও রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে তিনি বলেন,”ঠিক আছে। তুমি যেটা ভালো মনে করো।”

পুরো ঘটনায় তাহির আর হুর চুপ ছিল। দুজনের কেউ ই কথা বলেনি। তবে মনে মনে হুর স্বস্তি বোধ করে। এখানে থাকলে তাহিরের মুখোমুখি হতে হবে। এতে করে ওর অন্তরের ভয়টি আরো বাড়বে। বিষয়টি ভেবে নিয়ে মনে মনে জাহিনের প্রতি কৃতজ্ঞ হলো হুর।

সব কিছু ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহিন। ও চাইলেই, তাহির আর হুরের অতীত নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারে।কিন্তু এখানেও একটা ভয় রয়েছে। ওদের সম্পর্কটা সবে একটু একটু করে, প্রস্ফুটিত হচ্ছে। এই সময়ে অতীত খোলামেলা হলে, দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হুর হয়তো ভাববে, জাহিন তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। অথবা নিজেকে ছোট মনে করবে সে। তাই ও চায়, যদি বিষয় গুলো সামনে আনতেই হয়, তবে সেটা হুর ই আনুক। এমন তো নয়, সে কিছু জানে না। ও তো জেনে বুঝেই মেয়েটিকে ভালোবেসেছে। হুর তখন তৈরি হচ্ছে। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। জাহিন এগিয়ে এসে সাহায্য করার প্রয়াস করতেই মেয়েটি মুখ খুলল।

“ওখানে আমরা সব সময় থাকব?”

“বলা যায়। মাঝে মাঝে এখানে বেড়াতে আসব শুধু।”

“ওহ।”

বলেই মৌন হয় হুর। জাহিন একটু বোঝার চেষ্টা করে। তারপর বলে,”মন খারাপ মনে হচ্ছে।”

“না। তেমন কিছু না।”

“কিছু বলার থাকলে, বলতে পারো।”

সামান্য দোমনা খেলা করছে মেয়েটির মুখশ্রীতে। ও ভেবেছিল এখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি হবে। পড়াশোনাটা চালিয়ে যাবে। কিন্তু এখন তো ঢাকায় চলে যাচ্ছে।

“হুর।”

মেয়েটা তখনো দোটানায় ডুবে। ভরসা দিতে জাহিন তার দু হাত খানা বাহুতে রাখে।

“বলো। কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত তুমি? ঢাকায় যেতে ইচ্ছে করছে না?”

“তেমন না।”

“তাহলে?”

“ভেবেছিলাম পড়াশোনাটা চালিয়ে যাব।”

বাক্যটা বলেই মাথা নত করে মেয়েটি। জাহিন হাসে। এই সামান্য কথা বলতেও মেয়েটির মনে এতটা দ্বিধা!

“চিন্তা কোরো না। আমি তো আছি। আগেই ভেবেছি। ঢাকায় আমার বাসার কাছে অনেক ভালো ভালো ভার্সিটি আছে। সেখান থেকেই পড়াশোনা করতে পারবে। বোকা মেয়ে, সব কিছু আমার মাথায় আছে।”

আদরের সাথে গাল খানা ছুঁয়ে দিল জাহিন। হুর মায়া, কৃতজ্ঞতা নিয়ে পুরুষটির দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মেলাল। তার সাথে এই মানুষটার বয়সের ফারাক রয়েছে। গুণে গুণে নয় বছরের বড়ো মানুষটা। অথচ, তাকে কতটা বুঝে।

রুমা জাহিনের আসল মা না হলেও, ছেলেটার প্রতি কোনোকালেই অবহেলা ছিল না তার। তিনি সব সময় ছেলেটাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছেন। তবে দূরত্ব বজায় রেখেছে জাহিন ই। ওর ওপর কখনোই জোর করেন নি তিনি। সব সময় চেয়ে এসেছেন ছেলেটা ভালো থাকুক। আজ ও তাই চেয়ে যাচ্ছেন। বিদায়ের আগ মুহূর্তে হুরের সাথে দেখা করলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”জাহিন খুব ভালো মনের। নম্র, ভদ্র, শান্ত। ওর সাথে তোমার সংসার দারুণ হবে। তুমি শুধু, ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখো।”

হুর কৃতজ্ঞতার সাথে দৃষ্টি নামাল। তারপর বলল,”আপনি দোয়া করবেন মা।”

“তা তো করবই মা। তোমাদের জন্য দোয়া আছে আমার।”

ওমন সময় ই ঘরে প্রবেশ করল জাহিন। গাড়ি তৈরি। রুমা এগিয়ে এসে ছেলের বরাবর দাঁড়ালেন।

“এবার গেলে নিশ্চয়ই অনেক পরে আসবে?”

“সম্ভব হলে আগেই আসব।”

“সেই অপেক্ষাতেই রইলাম।”

ঠোঁট সামান্য প্রসারিত করে পাশ কাটিয়ে গেল জাহিন। কাবাড থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র বের করে বলল,”হুর, এগুলো ও নিয়ে রাখো।”

হুর তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল। সব গুলো কাগজ লাগেজে ভরে নিল। সেদিকে তাকিয়ে উষ্ণ একটি হাসি এল রুমার ঠোঁটে। তিনি জানেন, এদের দুজনের সংসার দারুণ হবে। এরা সব সময় ভালো থাকবে। তবু সব সময় এদের ছোট্ট সংসারের জন্য দোয়া করবেন তিনি।

বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। তাহিরের সাথে দেখা হয় নি কারোই। আগ বাড়িয়ে জাহিন ও চায় নি দেখা করতে। যে যার মতন রয়েছে। এটাই ভালো। গাড়িতে ওঠে বসতেই রুমা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,”তাহিরটা যে কোথায় গেল।”

তিনি কাউকে একটা ডাকতে চাইছিলেন। তবে জাহিন বাঁধা দিয়ে বলল,”দেরি হয়ে যাবে। ও থাকুক নিজের মতন। এমনিতেও, ফিওনার দেওয়া ধোঁকায় কষ্ট পেয়েছে।”

এই মুহূর্তে রুমা কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। হুর বিদায় জানাল। তারপরই গাড়িটা চলতে শুরু করল। গাড়িটা যত আগাচ্ছে, হুরের হৃদয় ততটাই শান্ত হচ্ছে। অবশেষে তাহির নামক অশান্তির থেকে মুক্তি পাচ্ছে সে। ও মনে মনে ভেবে নিয়েছে, এই বন্ধনটা আরেকটু দৃঢ় হলেই, জাহিনের সাথে সব কিছু নিয়ে আলোচনা করবে। হৃদয়ের দ্বিধা ভেঙে তৈরি করবে সুন্দর এক দ্বিধামুক্ত সংসার। বিষয়টি ভাবতেই মেয়েটির দু চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। জাহিন পাশ ফিরে চায়। অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে শুধায়,”চোখে জল কেন?”

মেয়েটি উত্তর দেয় না। ওড়নার কোণে জল মুছতে থাকে। তারপর বলে,”এমনি, চোখে যেন কি পড়েছে।”

ওর কথায় জাহিন হাসে। মন পড়ার ক্ষমতা না থাকলেও, মেয়েটির হৃদয়ের অনেক কথাই সে বুঝতে পারে। তাই তো চোখের জল দেখেও বিচলিত হলো না সে। কারণ ও জানে এই অশ্রু দুঃখ থেকে নয়। এই অশ্রু, সুখের। মেয়েটির এই সুখ সুখ অনুভূতি আরেকটু বাড়াতে হাত বাড়াল ও। আদরের সাথে গাল স্পর্শ করে দিয়ে বলল,”সব সময় মনে রাখবে। তুমি আমার শুধু প্রয়োজন নও হুর। যাকে প্রয়োজন শেষে ফেলে দিব। তুমি হলে আমার সেই প্রিয়জন। যার প্রয়োজন কখনোই ফুরাবে না। শেষ নিশ্বাস অবধি এক থাকব আমরা।”

অবলম্বন পেয়ে, মেয়েটার সুখের অশ্রু আরো বৃদ্ধি পায়। ও চোখে জল নিয়েই মুখশ্রীতে হাসি ফোঁটায়। একই ভাবে হাসে জাহিন ও। হাত সরিয়ে নিয়ে মনোযোগ দেয় সামনের দিকে। এদিকে হুর, মাথা এলিয়ে দেয় সিটের সাথে। চোখ বন্ধ করে, হৃদয়ে আঁকে সুন্দর একটা সংসার। যেই সংসারে কোনো দ্বিধা নেই। নেই কোনো তৃতীয় ব্যক্তি। এই সংসার শুধু জাহিন ও হুরের, একান্ত ও ভালোবাসার।

চলবে….
কলমে ~#ফাতেমা_তুজ_নৌশি