প্রিয়জন পর্ব-১৫

0
1072

#প্রিয়জন (১৫)

ঢাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে জাহিনের ছোট্ট সংসার। সেই ফ্ল্যাটে আজ নতুন মানুষের আগমন ঘটল। এমনিতেই ছেলেটা গোছানো স্বভাবের। মানুষটাও ভেজালহীন। তিন কামড়ার বড়ো একটা বাসা। প্রতিটা রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দা থাকলেও, জাহিন যে কক্ষে থাকে, সেই কক্ষের লাগোয়া বারান্দাটা বিশাল ও ছাদ খোলা। একপাশে ছোট্ট বসার টেবিল, চেয়ার। বিকালে কিংবা সকালে, এখানে বসে চায়ের সাথে দারুণ এক দৃশ্য ও অনুভব করা যাবে। পুরো ফ্ল্যাট ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছিল হুর। জাহিন ফ্রেশ হয়ে এসেছে। হাতে তোয়ালে। বারান্দায় মেলতে এসেছিল। তখন দেখল, মেয়েটা চোখ বন্ধ করে প্রাণ খোলা নিশ্বাস নিচ্ছে। ওর দু চোখে প্রশান্তি এসে স্পর্শ করে গেল। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে, কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল,”ছোট্ট সংসারে, অসুবিধা হবে নাকি?”

এ প্রশ্নে পাশ ফিরতে চাইল হুর। তবে পারল না। মানুষটার বাহুর সাথে ওর বাহু ঠুকে গেল।

“চলে এসেছেন। আমি রান্না বসাই।”

প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে চাইছিল মেয়েটি। তবে তার পূর্বেই হাতটা জাহিনের পুরুষালি হাতের দ্বারা আটকে গেল।
“দেরি হচ্ছে তো। আপনার ক্ষুধা পায় নি?”

“পেয়েছে।”

“তাহলে রান্না বসাই?”

“আজ নয়। অর্ডার করে দিয়েছি। একটু পর ই এসে যাবে।”

এ কথার পর মেয়েটি একটু মৌন হলো। জাহিন আরো কিছুটা এগোতে চেয়েছিল। তবে পারল না। সহসাই মেয়েটি বলে ওঠল।

“তাহলে, প্লেট পরিষ্কার করি।”

জাহিনের একটু মন খারাপ হলো। মেয়েটা শুধু পালাতে চায়। অথচ ওর মন চায় সব সময় ভালোবাসতে। কাছাকাছি আসতে।

“যাও।”

একদম থমথমে মুখে জবাব দিল জাহিন। অনুমতি পেয়ে, হুর ও চলে এল। সেই সাথে একবার পেছন ফিরেও তাকাল। পুরুষটি অতি সুদর্শন। একটু একটু করে মেয়েটিকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এই মানুষটা হয়তো জানে না, হুরের অন্তরে তার জন্য কতটা জায়গা তৈরি হয়েছে।

খাবার এসে গিয়েছে। কাচ্চি অর্ডার করেছিল জাহিন। একদম ধোঁয়া ওঠা গরম গরম। হুর সময় নিয়ে টেবিল সাজিয়েছে। যার দরুণ একটা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে খাবারের টেবিলটায়। জাহিন বসতে বসতে বলল,”নিজেকে মেহমান মনে হচ্ছে।”

অধরে হাসি রেখে, প্লেটে খাবার বাড়তে লাগল হুর। আর সেদিকে তাকিয়ে রইল জাহিন। খাবার বেড়ে দিয়ে মেয়েটি যখন চোখ ঘুরাল, তখনই নজরে এল, ঘোরে ডুবে থাকা দৃষ্টিখানা। ও সর্তক হলো। একটু গলা পরিষ্কারের ন্যায়, দু বার উহুম, উহুম আওয়াজ করল। এতে ঘোর ভাঙল জাহিনের। বিষয়টি বুঝে, স্বীয় ঠোঁট কামড়ে ধরল ছেলেটা।

“আরো দিব?”

প্লেটে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি খাবার তুলে দিয়েছে হুর। জাহিন হেসে ফেলল।
“দুজনের খাবার বেড়ে দিয়েছে।”

“কমিয়ে দিচ্ছি।”

বলেই হাত বাড়াল হুর। তবে বাঁধা দিল জাহিন। নত দৃষ্টি, মেয়েটির দিকে নিক্ষেপ করে বলল,”প্রয়োজন নেই। তুমি বোসো।”

“আচ্ছা।”

এক চেয়াল পরে বসতে নিচ্ছিল মেয়েটা। জাহিন ভ্রু কুঁচকে বলল,”অত দূরে কেন? কাছে আসো।”

কথা মতন কাছের চেয়ারটিতে বসল হুর। জাহিন সময় নিয়ে, কাচ্চির সাথে লেবুর রস, আর সালাদ মাখিয়ে নিল। লোকমা করে সামনে বাড়াতেই মেয়েটির চোখ হলো বড়ো বড়ো।

“এভাবে তাকাও কেন? হা করো।”

“আপনি খান না। আমি নিয়ে নিচ্ছি।”

“হা করো। বেশি কথা কেন বলো?”

প্লেট নিতে যাচ্ছিল মেয়েটি। তবে থেমে যেতে হলো। কিঞ্চিৎ অস্বস্তি নিয়ে তাকাতেই জাহিনের দৃষ্টি শীতল হলো।

“চোখে এত অস্বস্তি কেন? আমি তোমার স্বামী হই হুর। খাইয়ে দেওয়ার জন্য এই শব্দটিই কী যথেষ্ট নয়?”

এই পর্যায়ে মেয়েটির চোখে মুখের দ্বিধা আর বাড়ল। আমতা আমতা সুর ধরে ও বলল,”সরি, আমি আসলে…’

“হা করো তো।”

আর কথা বাড়াল না ও। হা করল। জাহিন ও লোকমা মুখে তুলে দিল। খাবার চিবুতে চিবুতে হুরের দুটো চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। অতীতে তাহির নামক অভিশাপটিও তাকে খাইয়ে দিয়েছিল। আজ জাহিন ও খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ দুটোর মাঝে বিস্তর ফারাক। ঐ সময়ে হুরের হৃদয়ে শুধু ভালো লাগা কাজ করেছিল। তবে আজ মনে হচ্ছে, জীবনে সব রকম সুখের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। তিন কবুলের শক্তি ভীষণ ভাবে অনুভব করছে।

জাহিনের করা যত্ন, হুরকে প্রভাবিত করল। পরের দিন মানুষটার হাতে খাওয়ার জন্য মন আকুলিবিকুলি করছিল। কিন্তু বলতে না পারার য’ন্ত্রণা’টা ও ক্রমশ সমস্ত শরীরে ভর করে বসল। অলসতায় ভরে গেল দেহ। ব্যবসায়ীক কাজে জাহিনকে বের হতে হয়েছে। সে সকাল সকাল চলে গিয়েছে। লাঞ্চের আগে কল করেছিল। ঠিক মতন খেতে বলেছে। হুর সম্মতি জানিয়েছিল। অথচ, সে কোনো ভাবেই খাবারটি খেতে পারে নি। বেহায়া মন, গতরাতের ন্যায়, প্রিয় স্বামীর হাতে খাওয়ার জন্য পায়তারা করে চলেছে। দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে মেয়েটি বারান্দায় এসেছিল। ফুল গাছ থাকায়, একটি প্রজাপতি ফুলের কাছে এসেছে। দেখতে ভালো লাগছে। ওর আগ্রহ হলো। প্রজাপতি খানা ছুঁয়ে দেখার লোভটি সামলাতে পারল না। দু হাতের মুঠোয় প্রজাপতি খানা তুলেছে মাত্র। ওমনি রিংটোন কানে বেজে ওঠল। জাহিন কল করেছে ভেবে, চট করেই কক্ষে প্রবেশ করল ও। নতুন ফোন কিনে দিয়েছে মানুষটা। তাই নাম্বার গুলো সেইভ নেই। ও কলটি রিসিভ করল। হাসি হাসি মনে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ভেসে এল। এই নিশ্বাসের শব্দটি খুব করে অনুভব করতে পারে হুর। ওর গলা ধরে এল।

“মা।”

ওপাশের ব্যক্তিটি শব্দহীন কেঁদে চলেছেন। মেয়েকে দেখার, ছোঁয়ার বড়ো লোভ হচ্ছে। অথচ, উপায় নেই।

“মা, এটা তুমি? কথা বলো। কথা বলো প্লিজ।”

এবার লতিফা জবাব দিলেন। কান্নাটা খুব ভালোই গিলে নিতে পারলেন। যার দরুণ কোনো কিছুই বুঝল না হুর।

“কেমন আছিস মা? আমার ফোনে টাকা নেই। পাশের বাসা থেকে কল করলাম।”

“আমি তো ভালো আছি মা। খুব ভালো। তুমি কেমন আছ?”

ক্ষীণ সুরে লতিফা বললেন,”ভালো।”

সত্যি বলতে খুব একটা ভালো নেই তিনি। শরীরে নানান রোগের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে, কন্যার সাথে যখনই কথা বলেন, তখনই মন ভালো হয়ে যায়। ভালো হয় শরীর ও। এ যেন কোনো এক জাদুকারী শক্তি। অথবা, মায়ের মন এমনই হয়। সন্তানের সুখেই সুখী, দুঃখেই দুঃখী।

চলবে…..
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি