#প্রিয়জন (১৯) | সমাপ্তি |
মনের দূরত্ব নেমে এসেছে হাঁটুর কাছে। আর একটু অপেক্ষা। তারপর ই সব সুন্দর হবে। এমন ই এক সুখী মন নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল হুর। রোদের বিন্দু গুলো ত্বক স্পর্শ করে যাচ্ছিল। অল্প বাতাসে উড়ছিল কিছু অবাধ্য চুল। ভালো লাগছিল। কিছু সময় নিজেকে দিতে হয়। একান্ত ভাবে অনুভব করতে হয়। এই সময়টা শুধু নিজের। পৃথিবীর সবার প্রবেশ ই এখানে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ এই সময়টায় হুর ভাবছিল তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত। খুব দ্রুত নিজেকে মেলে দিবে সে। যেখানে জাহিন জানবে সব সত্য। আর মুক্ত হবে হুর। সেই সত্য শোনার পর জাহিনের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়ে একটু সন্দিহান থাকলেও, ও নিশ্চিত মানুষটা তাকে ছাড়বে না। কোনো কিছুর বিনিময়েই না। বিকেলের এই সুন্দর মুক্ত আবহাওয়ায় ও যখন নিজেকে নিয়ে ভাবছিল, তখনই মেজাজ তপ্ত করে দিয়ে কলিং বেজে ওঠল। ইষৎ বিরক্ত জাগল মেয়েটির ললাটে। মেলে রাখা ওড়নাটা ভালো মতন টেনে নিয়ে ফিরল বসার ঘরে। ততক্ষণে আগুন্তুক বেশ কবার নক করে ফেলেছে। এমন বেহাল দশা দেখে মেয়েটির বিরক্তি বাড়ে। সেই সাথে কিছুটা চিন্তা ও হয়। ও যখন দরজায় লাগানো দূরবীনের কাছে চোখ রাখতে যাবে, তখন ই ওপাশে থাকা ব্যক্তিটির কণ্ঠ ভেসে আসে।
“হুর, দরজা খোলো। দ্রুত খোলো।”
যেন কোনো শিকারী তাড়া করে। আর শিকার বাঁচার চেষ্টা করছে। মেয়েটি ভাবনার অতলে হারিয়ে যাবে,যাবে ওমনি ওপাশের কণ্ঠটা পুনরায় বাজে।
“দরজা খোলো, খোলো প্লিজ।”
ধ্যান ফিরে মেয়েটির। তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দেয়। ওপাশের ব্যক্তিটির নিশ্বাস যেন ভার হয়েছিল। দরদর করে ঘামছে তখনো।
“ঠিক আছ? ঠিক আছো তুমি?”
দরজায় দাঁড়িয়ে ই প্রশ্ন করে জাহিন। হুর বিস্মিত হয়। চেয়ে থাকে অপলক ভাবে।
“কথা বলছো না কেন? ঠিক আছো তো তুমি?”
কিছুটা ভয় মেশানো তার গলায়। চিন্তা খেলা করছে মুখশ্রীতে। হুর জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকে। জাহিন যেন ধৈর্য হারায়। দু হাতে বাহু স্পর্শ করা ছিল। এখন মেয়েটিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। সেই স্পর্শে কেঁপে ওঠে মেয়েটি। জাহিনের হৃদয় স্বাভাবিক নেই। অসম্ভব ভাবে লাফাচ্ছে। ও আলগোছে মানুষটার পিঠে হাত রাখে। ধীরে শুধায়,”এমন অস্থির হয়ে আছেন কেন? কী হয়েছে?”
এ প্রশ্নের উত্তর জাহিন দেয় না। ও পাল্টা শুধায়,”কল রিসিভ করছিলে না কেন? ফোন কোথায়?”
“ফোন….’
বলতে গিয়ে আটকায় মেয়েটি। কোথায় রেখে এসেছে, তা আসলে মনে নেই। বোধহয় মিউট করা কিংবা চার্জ হারিয়ে অফ হয়ে আছে। মেয়েটির অবস্থা দেখে ঘটনা বুঝতে পারে জাহিন। নিজেকে শান্ত করে।
“তৈরি হয়ে নাও।”
“কেন? কোথায় যাব?”
“গ্রামে।”
“কেন?”
“একটু দরকার।”
“কিন্তু কী দরকার?”
জাহিনের মুখশ্রী ইষৎ গম্ভীর হয়। মেয়েটির গাল স্পর্শ করে বলে,”চলো যাই। কথা বাড়িও না লক্ষ্মী আমার।”
এ কথার পর মেয়েটি আর প্রশ্ন করে না। নীরবে তৈরি হতে যায়। তবে বুকের ভেতরটায় তখনো প্রশ্নের দল উঁকি দিয়ে থাকে। যার রেশ রয় পুরো রাস্তাতেই। তবে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে না সে।
অনেকদিন পর বাড়ি ফেরার বিশেষ এক আনন্দ হুরকে জাপটে ধরেছিল। তবে সবটা ধুলোর সাথে মিশে গেল যখন ও দেখল বাড়ির ভেতর থেকে গুনগুন আওয়াজ হচ্ছে। কেমন করুণ তার সুর। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। পাশ ফিরে চাইতেই জাহিনের গম্ভীর, আতঙ্কগ্রস্ত মুখশ্রী নজরে এল। মেয়েটা এক ছুটে চলে এল বাড়ির ভেতর। পাড়ার চাচিরা সব দলে দলে বসে আছেন। কেউ কেউ চোখের জল ফেলছেন। কেউ কেউ মুখশ্রী গম্ভীর করে আছেন। সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। হুরের পা থমকায়। হৃদয় চমকায়। ও যন্ত্রের ন্যায় এগিয়ে যায়। চাচিরা কি সব বলতে থাকেন। কেউ কেউ হাত খানা মাথায় স্পর্শ করান। কিন্তু সেসব কী মেয়েটিকে স্পর্শ করতে পারে? পারে না। ওর চোখ দুটো ক্রমশ আবছা হয়ে আসে। বুক ভাঙে কান্নায়। ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁতের দ্বারা। তারপর, তারপর অস্পষ্টভাবে আওড়ায়,’মা, মা গো।’
ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসে না। ঝাপসা দৃষ্টিতে মাটিতে শায়িত এক টুকরো সাদা কাপড় দেখতে পায়। ওর ভেতর মুচড়ে আসে। চিৎকার করে ওঠে।
“হায় আল্লাহ, আবার, আবার আমাকে এতিম করলে তুমি। ইয়া মাবুদ, কোন শাস্তি দিলে আমায়? এ কোন শাস্তি দিলে তুমি?”
জাহিন এই প্রথমবার এতখানি অসহায় অনুভব করল। মেয়েটিকে কীভাবে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারল না। অফিসে থাকাকালীন যখন সংবাদটা পেল, তখন ওর হৃদয় ভেঙে আসছিল। হুরকে কল করেও লাভ হয় নি। মেয়েটি রিসিভ করে নি। ওর ভয় বাড়ছিল। ভেবেছিল কোনো কিছু ঘটে গিয়েছে। ও ছুটে এসেছে অফিস থেকে। তবে বাসায় ফিরে সব শান্ত দেখে, একটুখানি স্বস্তি মিলেছিল। কিন্তু এখন, এখন কী উপায়? কীভাবে মেয়েটিকে সামাল দিবে ও? ওর ভেতরটা হাহাকারে ভরে ওঠে। উন্মাদের মতন কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটি। জাহিন দ্রুত ঘরের দিকে এগিয়ে আসে। যতক্ষণে কাছাকাছি হয়, ততক্ষণে মেয়েটির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ও দু হাতে আগলে নেওয়ার পর পর ই চেতনা হারায় মেয়েটি। আহা, কি করুণ সে দৃশ্য। প্রিয়জন বিয়োগ বড়ো নি’ষ্ঠুর হয়। এই দৃশ্য বড়ো দহনের।
এই শোক সহজে নামল না। বাবা হারানোর পর মেয়েটির জীবনের অবলম্বন ছিলেন মা। ও পুরো এতিম ছিল না। কিন্তু এবার যে পুরো এতিম হয়ে গেল। এই শোক মেয়েটিকে শহরে যেতে আটকে দিল। প্রায় একটা সপ্তাহ কেটে গেল মায়ের ঘরটায়। কারো সাথে ভালো মতন কথা হলো না। ঠিক ঠাক খাওয়া হলো না। শুধু মায়ের জন্য অশ্রু ঝড়াতে থাকল। প্রিয়তমার এমন শোক দেখে জাহিনের ভেতরটাও একটু একটু করে পু’ড়’ছিল। ওর সান্ত্বনা কোনো ভাবেই কাজে লাগছিল না। এদিকে শহরে ফেরার তাড়া চলে এসেছে। চুলোয় যাক সব ব্যবসা। জাহিন যাবে না বলেই স্থির করেছিল। কিন্তু সব কিছু তো আবেগ ধরে চলে না। কিছু জিনিস বিবেকেও লাগে। ও না গেলে ব্যবসাটা চলছে না। ওখানে যে কত মানুষ কাজ করে। তাদের পেট চলে ওখান থেকেই। তাই বাধ্য হয়েই যেতে হবে। কিন্তু হুরকে কোনো ভাবেই রাজি করানো যাচ্ছিল না। মেয়েটি চল্লিশ দিনের আগে কোথাও নড়বে না বলেই স্থির করেছে। এমন অবস্থায় জোর করার ইচ্ছে ও হচ্ছে না। আবার ছেড়ে চলে যাবে, মনটা সেখানেও সায় দিচ্ছে না। ঠিক সে সময়ই উদয় হলেন রুমা। জাহিন তার নিজের পেটে ধরা সন্তান নয়। তবে, মনটা ছেলেটাকে সন্তান হিসেবেই চিনে এসেছে। তাই তিনি ভরসা দিলেন, মেয়েটিকে দেখে রাখবেন। সেই ভরসায় সায় দিয়ে সেদিন রাতেই শহরের ফিরে গেল জাহিন। হুর পড়ে রইল তার মায়ের ছোট্ট নীড়ে। এখানে ওর মায়ের শরীরের ঘ্রাণ আছে। যা এখনো নাকে এসে স্পর্শ করে যায়। বাবার স্মৃতি মেখে আছে ঘরটায়। সব মিলিয়ে চোখের পলকে দিন কাটতে লাগল। কিন্তু বিপত্তি হলো সেদিন ভোর বেলায়। ফজরের নামাজ শেষে বাবা-মায়ের কবর জিয়ারতে বের হয়েছিল হুর। ফেরার পথেই ভয়ানক ঘটনাটা ঘটে গেল। কোথা থেকে যেন চলে এল তাহির নামের নোংরা কীট। পথ আগলে ধরল। চারপাশ তখন শুনশান নীরব। কব’রস্থা’নে ভোর বেলায় মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটি কী করবে বুঝতে পারছিল না। ওর মনে হচ্ছিল, এক ছোটে পালিয়ে যেতে হবে। মস্তিষ্ক’কে তৈরি ও করে ফেলেছিল। তবে তাহির তার নোংরা স্বভাবটা ঠিক ই জাহির করল। মেয়েটিকে চেপে ধরল শক্ত করে। অসভ্যর মতন কুটিল হাসি ঝুলিয়ে বলল,”এবার তোমার কী হবে সোনা? খুব তো সংসার পেতেছিলে। তোমার বর দারুণ খিলারি। চোখের আড়াল ই করে না। কিন্তু পাখি যে ফাঁদে পড়বেই। তোমার এই সুন্দর মুখে আমি যদি কলঙ্কের দাগ না বসাই তবে আমিও তাহি….
এ অবধি বলার পর, কথাটা পূরণ করতে পারল না তাহির। তার পূর্বেই হাতে টান পড়ল তার। এপাশ ফিরতে না ফিরতেই গাল বরাবর চ’ড় বসালেন রুমা। তার শরীর কাঁপছে। রাগের কারণে নিশ্বাস অবধি নিতে পারছেন না। ছেলেকে সর্বদা প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন তিনি। তবে, এ ছেলে যে এই পরিমাণ বিগড়ে গিয়েছেন তা যদি আগে টের পেতেন। আপসোস হতে লাগল। তাহির নিজেকে সত্যবাদী প্রমাণ করার জন্য বলল,”আমার সাথে ওর আগেই সম্পর্ক ছিল। ও আমাকে চিট করেছে। চিট করে জাহিনকে বিয়ে করেছে। সবটা সবটা ওর প্ল্যান।”
হুর তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে। এমনিতেই মেয়েটির মানসিক অবস্থার ঠিক নেই। তার ওপর এমন এক ঘটনা। রুমা পেছন ফিরে চাইলেন। মেয়েটির মাথায় হাত স্পর্শ করে বললেন,”বাসায় যাও মা। আমি দেখছি।”
এ কথার পর এক সেকেন্ড ও নষ্ট করে নি মেয়েটি। এক ছোটে চলে গিয়েছে বাড়ির পথে। সেদিকে তাকিয়ে তাহিরের হাত শক্ত হয়। ও কটমট করতেই দ্বিতীয় বারের মতন চড় এসে পড়ে গালে।
“অসভ্য ছেলে। নোংরা কোথাকার। আমি যদি জানতাম তুই এমন হবি, তাহলে পেটে আসার আগেই তোর জান নিয়ে নিতাম।”
তাহিরের মুখ রক্তিম হয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না ও। রুমা রাগে রি রি করতে থাকেন। একটু আগেই ছেলের কুকর্মের পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনেছেন। তাহির ভেবেছিল হুরকে তুলে নেবে। তারপর নিজের মতন ব্যবহার করবে। অথচ কিছুই হলো না। ও ভাবতেও পারে নি, সমস্ত পরিকল্পনা এভাবে ভেস্তে যাবে। রুমার আগমন সব কিছু শেষ করে দিয়েছে।
বাড়ি ফিরেই জাহিনকে কল করেছে হুর। আর নয়। আর এভাবে চলবে না। সবটা জানাতে হবে। কিন্তু কান্নার দমকে মেয়েটি যে কথাই বলতে পারছে না। ওপাশের ব্যক্তিটি আজ অস্থির হয় নি। ও শান্ত আছে। শান্ত থেকে সব সামাল দিয়েছে। হুরকে একা রেখে, এক সেকেন্ড ও শান্তিতে ছিল না সে। তাই তো সার্বক্ষণিক মেয়েটিকে নজরে রেখেছিল। সেই সাথে নজরে রেখেছিল তাহির কেও। তাহির যদিও অন্য শহরে ছিল। তবে, হুর গ্রামে এসেছে আর জাহিন ও নেই, এ কথা শুনেই চলে এসেছিল। সেই সাথে ছক কষেছিল মেয়েটিকে ব্যবহার করার। অথচ ও যদি জানত, ওর পরিকল্পনাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেওয়া ছেলেটা জাহিনের পাঠানোই লোক। তবে এভাবে ধরা পড়ত না। আপসোস, এভাবে মায়ের আদরে থাকা, আঁচলে থাকা ছেলের মুখোশ বেরিয়ে এল। সবটা স্মরণ করে জাহিন নিশ্বাস ফেলল। ও সর্বদা শীতল মস্তিষ্কের। ঝামেলা করবে, তবে অপর ব্যক্তি সেটা ধরতেও পারবে না। এদিকে হুর কেঁদে চলেছে সমানে। তার কান্না থামছেই না। জাহিনের অধরে একটুখানি হাসি এসে ধরা দেয়। ও আদর মিশিয়ে বলে,”আমি সবটা জানি হুর। সবটা জানি। তোমার অতীত জানি, তোমার বর্তমান জানি। আর আমি তোমার ভবিষ্যত ও জানব। কারণ তুমি আমার। শুধুই আমার।”
পরিশিষ্ট: মা চলে যাওয়ার পর পেরিয়ে গেল ৪০ টি দিন। মসজিদে মিলাদের আয়োজন হয়েছিল। এতিমখানায় ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সব শেষে মা-বাবার কবর জিয়ারত করে এসেছে হুর। এখন তার হৃদয় কিছুটা শান্ত। শোক নেমেছে অনেকটা। মন মেনে নিয়েছে বাস্তবতা। জাহিন ও এসেছে। দুজন সড়কের পথে হেঁটে চলেছে। একটা স্বস্তি খেলা করছে তাদের মাঝে। হুর অবাক হয়, অবাক হয় এটা ভেবে যে, একটা মানুষ এতটাও ভালোবাসতে পারে। আদৌ সম্ভব এমন ভালোবাসা? ওর জীবনে যদি জাহিন না আসত, তবে কোনো ভাবেই বিষয়টি মানত না ও। ও বুক ভরে দম নেয়। তারপর কিছুটা কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতেই অপর হাতের দ্বারা আগলে নেয় জাহিন। ভালো লাগায় নেচে ওঠে মেয়েটির মন। মা চলে যাবার পর, এই প্রথমবার মানুষটির সঙ্গ ও পুরো অনুভব করছে। অনুভব করছে একজন স্ত্রী রূপে।
রুমার শরীরটা ভেঙে গিয়েছে। স্বামী চলে যাবার পর সব সামাল দিয়েছেন একা হাতেই। তবু মনে হয়, ভদ্রলোকের কিঞ্চিৎ পরিমাণ ও সামলাতে পারেন নি তিনি। অসহ্য হয়ে ওঠেছে তার চারপাশ। জাহিন দরজায় নক করতেই দৃষ্টি ফেরালেন তিনি। অধরে কৃত্রিম হাসি এনে বললেন,”ঘরে এসো।”
ছোট কদমে কক্ষে প্রবেশ করল জাহিন। রুমা ওঠে দাঁড়ালেন। ছেলেটা যেমন লম্বা, শুভ্র ত্বকের তেমনই বুদ্ধিমান। বাবার অনুরূপ ই হয়েছে। লোকটার কথা স্মরণ করে আরো একবার অধরে হাসি জাগান তিনি। জাহিন নরম সুরে বলে,”আমরা চলে যাব আজ।”
চলে যাবার কথা শুনেই ভেতটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। কিছু বলার পূর্বেই জাহিন বলে,”আপনাকে ধন্যবাদ। আমি যতদিন ছিলাম না, হুরের দারুণ খেয়াল রেখেছেন।”
রুমা কথা হারালেন। তীব্র ব্যথাটা গিলে নিয়ে বললেন,”তাহিরের করা কাজের জন্য আমি জানি না কীভাবে তোমার কাছে ক্ষমা চাইব।”
“আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন? দোষ তো আপনার নয়।”
“আমার ই দোষ জাহিন। মানুষ করতে পারি না ছেলেটাকে।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন তিনি। তাহিরকে ভারতে পাঠানো হয়েছে। ওখানেই তাকে রাখা হবে। তা ও নজরে। সেই সাথে বেশ পরিশ্রমের কাজ ও দেয়া হয়েছে। এটাই আপাতত তার শাস্তি। সবার থেকে দূরে থেকে, কাজ কর্ম করে যদি, ছেলেটার শিক্ষা হয়। রুমা ভারী একটা নিশ্বাস ফেললেন। জাহিন প্রস্থানের পূর্বে বললেন,”নিজের খেয়াল রাখবেন। আপনি ছাড়া আমার আর হুরের এই দুনিয়ায় কেউ নেই। আমরা এতিম।”
এ কথার পর জাহিন কিন্তু এক সেকেন্ড দাঁড়ায় নি। চলে গিয়েছে। এদিকে রুমার বুক হু হু করছে। কান্নায় চোখ ভিজে যাচ্ছে। এই প্রথম, এই প্রথম ছেলেটা এভাবে বলল। তাকে আপন বলে স্বীকার করল। এক ছেলের করা অন্যায় যতটা দহন দিচ্ছিল, আরেক ছেলের দেওয়া সম্মাণে বুকটা ততখানিই শান্ত হয়ে গেল। জীবন হয়তো এমনই। শূণ্যস্থান কোনো না কোনো ভাবে পূরণ হয়েই যায়। শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা।
সেদিন রাতে অনাকাঙ্খিত এক ঘটনা ঘটে গেল। শহরে ফিরতে বেশ অনেকটাই রাত হয়ে গিয়েছে। তাই খাবার অর্ডার করে আনিয়েছিল জাহিন। দুজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে, ঘুমাতে এসেছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। জাহিন ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। ওমনি হুরের নরম হাত খানা শরীর স্পর্শ করে গেল। মুহূর্তেই ভেসে এল অপেক্ষার সেই সুর,’আপনাকে ভালোবাসি।’ এই প্রথম, এই প্রথম মেয়েটি ভালোবাসার কথা মুখে স্বীকার করল। দারুণ সুখে জাহিনের ঘুম পালাল। এদিকে দুষ্টু মেয়ে অপর ব্যক্তির ঘুম হরন করে, নিজে ঠিক ই ঘুমিয়ে পড়ল। সেই রাতটা জাহিনের নিকট বিশেষ হয়ে রইল। সমস্ত রাত জেগে, প্রিয়জন’কে মুগ্ধ নয়নে দেখল সে।
~সমাপ্ত |
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি