প্রিয়জন পর্ব-৫+৬

0
1524

#প্রিয়জন (৫)

হুরের ছোট্ট একটা ঘর রয়েছে। তবে বেশ পরিপাটি করে গোছানো। মেয়েটার মাঝে কোনো সংকোচ দেখা যাচ্ছে না। ও খুব যত্নের সাথে জাহিনের ব্যাগ পত্র তুলে রাখল। বাইরে থেকে কথা শেষ করে এসে জাহিন সেটাই দেখল। সাধারণ ভাবেই, এমন পরিবেশে কখনোই তার থাকা হয় নি। একটু অসুবিধা হবে মনে হচ্ছে। ওর মুখশ্রী দেখে হুর শুধাল,”কিছু ভাবছেন?”

“ভাবছি তো।”

“কী?”

“তোমার কথা!”

একটা মৃদু হাসিতে মেয়েটির অধর প্রসারিত হলো। জাহিন এগিয়ে এসে খাটে পা তুলে বসল। একটা বিষয় ভালো, ঘরটার মেঝে পাকা করা। নতুবা, মানিয়ে নিতেও খুব কষ্ট হতো।

“আপনার ব্যাগ পত্র ওখানটায় রাখা।”

ঘরের এক কোণে ছোট্ট একটা পুরাতন স্টিলের আলমারি রয়েছে। সেখানটায় নির্দেশ করল হুর। জাহিন একবার চোখ বুলিয়ে হুরের দিকে নজর ফেরাল।

“আমরা এখানে কদিন থাকব?”

প্রশ্নটা করল হুর। জাহিন একই সুর ধরে বলল,”তোমার যত দিন ইচ্ছে হবে।”

“আমার ইচ্ছে?”

“হুম।”

“কিন্তু আপনার অসুবিধা হবে না?”

সত্যিকার অর্থে কিঞ্চিত অসুবিধা হবে। তবে সেটা প্রকাশ করল ও না। বরং হেসে বলল,”তোমার অসুবিধা হবে?”

এহেন প্রশ্নে মেয়েটি তব্ধা খেল যেন। জবাব দিতে পারল না। জাহিন হেসে ফেলল।

“বোকার মতন কথা বললে। অসুবিধা কেন হবে?”

“না, ঠিক তা নয়। আপনি তো এমন পরিবেশে অভ্যস্ত নন।”

“কেন? আমি কি এই এলাকার মানুষ নই?”

“হলেও, আপনি তো এখানে থাকতেন না। শহরেই ছিলেন। তাছাড়া জমিদার বাড়ির কাছে আমাদের এই কুঁড়েঘর কিছুই না।”

জাহিন কিন্তু জবাব দিল না। ও একটু সময় নিল। তারপর মাথা দোলাল। এহেন আচরণে হুর প্রশ্ন নিয়ে চেয়ে রইল। এবার জাহিন বলল,”সেটা ঠিক বলেছ।”

“আপনি তাহলে আজ থেকে,কাল চলে যেয়েন। আমি কটা দিন থেকে যাই।”

“মনে হচ্ছে আমাকে তাড়াতে চাচ্ছ।”

“আমি সেটা বোঝাতে চাই নি।”

“কিন্তু মনে তো হচ্ছে।”

“আপনার অসুবিধা হবে ভেবে বলেছি।”

মাথাটা নত করে বলল ও। জাহিন ভালো মতন মেয়েটাকে দেখতে লাগল। তার থেকে অনেকটা ছোট এই মেয়ে। প্রথম যখন দেখেছিল, তখন তো আরো ছোট ছিল। এখন তবু পরিপক্ব একটা ভাব এসেছে।

সাধ্য মতন আয়োজন করেছেন লতিফা। তবু তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। এত এত খাবার দেখে হুর বলল,”এত সব কেন করেছ?”

মেয়ের দিকে তাকিয়ে লতিফা বললেন,”বোকার মতন কথা বলছিস কেন? এত সব কোথায়। জমিদার বাড়ির তুলনায় এগুলো কিছু?”

“কিন্তু আমাদের তুলনায় তো অনেক কিছু মা।”

হুর পুনরায় চোখ বুলাল। দুপুরের খাবারের আয়োজন এত বিশাল যে, একটা বড়ো টেবিলেও জায়গা হবে না। ও মায়ের দিকে সরল চোখে তাকাল। তারপর হুট করেই নজরে এল মায়ের কানের দিকটায়। সেটা দেখে আঁতকে ওঠল ও।

“মা, তোমার কানের দুল কোথায়?”

লতিফা একটু চমকালেন। কানে হাত দিলেন। তারপর আমতা আমতা করে বললেন,”আছে, খুলে রেখেছি।”

হুর যেন বিশ্বাস করতে পারল না। বিশ্বাস করার মতন ও না। ও মায়ের দিকে ছলছল নয়নে চাইল।

“দুল বিক্রি করে দিয়েছ?”

এ কথায় লতিফা মেয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। হাত দ্বারা গাল স্পর্শ করে বললেন,”ছেলেটা প্রথমবার এ বাড়ি এসেছে। একেবারে যা তা তো খাওয়ানো যায় না।”

মেয়েটির চোখ থেকে জলের বিন্দু নেমে গেল। টুপ করে পড়ল মেঝেতে। হাতের সাহায্যে দু চোখ মুছে নিয়ে বলল,”এত বড়ো ঘরে আমাকে বিয়ে কেন দিতে গেলে মা?”

“এমন কেন বলছিস?”

“তুমি আজ দুল বিক্রি করেছ। কাল আবার কি বিক্রি করে খাওয়াবে বলো তো।”

“এমনটা বলতে নেই মা।”

হুরের কান্নাটা বাড়তে লাগল। মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন লতিফা। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”তুই সুখে থাক মা। কোনো দুঃখ তোকে স্পর্শ না করুক।”

এ কথার বিপরীতে মেয়েটার বুক যে আরো ভারী হয়। ও হয়তো সুখে থাকবে। তবে, কোথাও একটা দোটানা যে রয়েছে। তাহির যখন ফিরবে, তখন বিষয় টা কেমন হবে। কীভাবে সব কিছু সামাল দিবে হুর?

চলবে…

#প্রিয়জন (৬)

গোসল করে আসায়, হুরকে হুরের মতন ই দেখাচ্ছে। এই সময় মেয়েদের অতিরিক্ত স্নিগ্ধ লাগে। সতেজ মনে হয়। মেয়েটি যখন চুল গুলো মুছে নিচ্ছে, জাহিন তখন মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে। ফর্সা, কোমল পিঠে কিছু পানির বিন্দু জমেছে। চুল মুছে নিয়ে মেয়েটি ঘুরে তাকাতেই দৃশ্যটি দেখতে পেল। এমন ভাবে তাকানোয় লজ্জা এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। সেটা খেয়াল করে জাহিন বলল,”সরি।”

তার বিনয় যে কাউকে মুগ্ধ করবে। হুর ও এই মানুষটাতে দিন কে দিন মুগ্ধ হচ্ছে। তবে কোথাও একটা বাঁধা তৈরি হয়। এই বাঁধা ওর অতীত। ও মাথাটা নত রাখে।

“এবার চলুন। খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

অনেকক্ষণ আগেই খাবার তৈরি হয়েছিল। তবে হুরের গোসলের জন্য খাওয়াটা আটকে ছিল। জাহিনের বিরোধ ছিল। মেয়েটিকে রেখে সে খাবে না। তাই কী না, গোসল করে আসতে হলো তাকে।

শীতল পাটি বিছিয়ে রাখা। সেখানে অনেক অনেক খাবার। লতিফা মিনমিনে সুরে বলল‍েন,”কষ্ট নিও না বাবা। এভাবেই খেতে হবে।”

জাহিনের ঠোঁট প্রসারিত হলো। ও এগিয়ে গিয়ে বসল শীতল পাটিতে।

“এভাবে বলবেন না আন্টি। পাটিতে বসে খাবার খাওয়া আমার বিশেষ পছন্দের। ছোট বেলার কথা স্মরণ হচ্ছে।”

“তবু, জামাই মানুষ তুমি। গরিবের এই….’

তাকে আটকাল জাহিন। বলল,”এভাবে বললে আমি এ বাড়িতে আর আসতে পারব না আন্টি। লজ্জা লাগবে আমার।”

“ছি, ছি বাবা। এ কথা বোলো না। তুমি খাবার খেতে বসো। এই হুর, দাঁড়িয়ে কেন? জামাইকে খাবার দে।”

হুরের যেন টনক নড়ল। ও একটা ঘোরে ডুবে গিয়েছিল। ওর বার বার মনে হচ্ছে, মায়ের কানের দুলের কথা। বিষয়টি মনে হতেই ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।

“কী রে। এখনো দাঁড়িয়ে?”

“দিচ্ছি মা।”

হুর নিচু হয়ে প্লেট এগিয়ে দিল। তাতে পরিমাণ মতন ভাত, তরকারি দিয়ে বলল,”আর কিছু দিব?”

“উহু।”

“খাওয়া শুরু করো বাবা।”

“আপনারা বসবেন না?”

“তুমি আগে খাও বাবা।”

“এটা হয় নাকি? আপনারা ও বসুন।”

“পরে খাব আমরা। তুমি শুরু করো।”

“একদম ই না। হুর, আন্টির জন্য খাবার দাও তো।”

“না, বাবা। তুমি আগে খাও। শুধু শুধু….’

“আপনাদের রেখে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না আন্টি।”

ভদ্রমহিলার গলা রোধ হলো। চোখ হলো টলমলে। সে হুরের দিকে চাইল। ইশারায় প্লেট দিতে বলল। হুর একদম চুপচাপ সব কিছু করে যাচ্ছে। মায়ের জন্য খাবার তুলে দিয়ে সে বলল,”আমি পরে খাব।”

“কেন?”

“আপনারা খেয়ে নিন। আমি পরিবেশন করছি।”

“পরিবেশন তো করেছোই। এখন তুমিও বোসো। কথা বাড়িও না।”

মেয়েটির পা থমকে আছে। ওর যে খেতে ইচ্ছা করছে না। তবু মুখের ওপর মানা করতে পারে না। অল্প একটু খাবার তুলে নেয়। তারপর শুরু হয় খাওয়ার পর্ব। লতিফার হাতের রান্না ভালো। মায়েদের রান্না যদিও ভালোই হয়, তবে লতিফার রান্নার আলাদা করে প্রশংসা করতেই হয়। জাহিন তৃপ্তি নিয়ে খাবার খায়। লতিফা এটা সেটা এগিয়ে দিতে থাকেন। অনেক শখ ছিল একটা ছেলের। তার দু চোখ অশ্রুতে ভেজে। তবে বোধহয়, সৃষ্টিকর্তা শখটা পূরণ করেই দিলেন।

খাবার খেয়ে বসতে নেই। একটু চলাফেরা করে নিতে হয়। জাহিন আর হুর ও বের হয়েছে। গ্রামীণ পরিবেশে খুব একটা থাকা হয় নি জাহিনের। অনেক ছোট থেকেই সে শহরে মানুষ হয়েছে। ইট পাথর দেখে বড়ো হয়েছে। ওরা কাঁচা মাটির সড়ক দিয়ে চকের দিকে এসেছে। ক্ষেতে ধান বোনা হয়েছে। ফলে চারপাশ কেমন সবুজ লাগে। হুর নীরবে পথ চলে। কথা শুরু করে জাহিন।

“তুমি অনেকটা চুপ হয়ে আছ মনে হচ্ছে।”

চমকায় মেয়েটি। সে এখনো ধ্যানেই ছিল। ওর চমকানো ভাব ও লক্ষ্য করেছে জাহিন।

“না, ঠিক আছি তো।”

“কোথায় ঠিক আছ? কথাই তো বলো না।”

“না মানে কী বলব।”

“কিছু বলার নেই?”

মেয়েটির চোখে দ্বিধার দেখা মিলে। জাহিন হতাশ হয়ে পড়ে। তার সাথে এই মেয়েটি এখনো সহজ হতে পারে নি।

“হুর।”

বড়ো মায়া লাগে কণ্ঠটায়। মেয়েটি তাকায়। ডাগর দুটো চোখের দৃষ্টি পুরুষটির মুখশ্রী স্পর্শ করে যায়।

“তুমি অসম্ভব সুন্দর।”

ছোট একটা বাক্য। তবে কেমন জাদু মিশানো। হুরের সমস্ত শরীরে কম্পন ধরে। জাহিন এগিয়ে এসে মেয়েটির হাত স্পর্শ করে।

“তোমার মন খারাপ?”

“উহু।”

“তাহলে?”

“আপনার অসুবিধা হবে আমাদের বাড়িতে।”

“হচ্ছে না তো।”

“আমি দেখেছি, আপনি গোসল করতে পারেন নি ঠিক মতন।”

এ কথাটা মিথ্যে নয়। টিনের বেড়া দিয়ে তৈরি গোসলখানায়, জাহিনের গোসল হয় নি ঠিক মতন। তবু ও লুকানোর প্রয়াসে বলে,”ভুল দেখেছ।”

মেয়েটি কিছু বলে না। পুরুষটি তার হাতের তালু দ্বারা ওর গাল স্পর্শ করে। নরম গালে, পুরুষটির শক্ত স্পর্শ পেয়ে নড়েচড়ে ওঠে সে।

“চলুন বাসায় যাই।”

সহসাই বলে ওঠে মেয়েটি। জাহিনের কপালে ভাঁজ তৈরি হয়।

“মাত্রই তো এসেছি।”

“না মানে,….”

ও আটকায়। কি বলবে বুঝতে পারে না। এলোমেলো লাগে। দ্বিধা তৈরি হয় বুকে। সেটি বুঝে জাহিন। তাই বলে,”চলো ফিরে যাই।”

তারপর চলতে থাকে গন্তব্যের দিকে। এবার অনুশোচনা জাগে মেয়েটির অন্তরে। পুরুষটি তার থেকে কিছুটা আগানো। বড়ো মায়া দিয়ে গাল খানা স্পর্শ করেছিল। আর ও কী না দ্বিধায় পড়ে, মানুষটাকে বিভ্রান্ত করলে। এই অন্যায়, পাপ, হুরকে একটু একটু করে দহন দিতে লাগল। এক সুখময় য ন্ত্র ণা প্রতি নিয়ত তাকে গ্রাস করে চলেছে। জাহিনকে তার ভালো লাগে। মানুষটার স্পর্শ তাকে পরিপূর্ণ করে তুলে। কিন্তু, তাহির নামক দ্বিধাটি সেই সুন্দর বিষয় গুলোকে প্রতিনিয়ত এলোমেলো করে দেয়। শুধু মনে হয়, যখন তাহির ফিরবে তখন কেমন হবে। সব কিছু ঠিক থাকবে তো? নাকি সব কিছু ভাসিয়ে নেবে বানের জলের মতন।

চলবে…
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি