প্রিয়তম পর্ব-০৭

0
165

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

রিতু ভেবেছিলো বাবা বেশ রাগ করবে ওর সাথে, হয়তো বকবেও রাতে মিথ্যে বলার জন্য৷। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। বাবুল মিয়া হাসিখুশি মনেই ওর সাথে কথা বললেন, হইহই করে একগাদা বাজার করে নিয়ে এলেন। দুপুরেও ভূরিভোজন আয়োজন ছিলো। রিতু মিনমিন করে বাবার পিছুপিছু ঘুরছিলো মাফ চাইবার জন্য। বাবুল মিয়া ভাবলেন মেয়ে তার ন্যাওটা হয়েছে ভীষণ, তিনি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— আমার মাইয়া গুলা একেবারে বাপ ভক্ত।
সেদিনের ছোট্ট দুইটা কইতর আজ সংসারী। এহন তোরা দু-বোন ভালো থাকলেই হবে। আমার আর
কিচ্ছু চাওয়ার থাকবো না…
রিতু আমতাআমতা করে বলল,
— বাবা রাতে ওনি, মানে স্যার তোমার সাথে শুয়েছিলো?
— সাথে না, আমার ঘরে শুইছিলো। আমি তো
পড়ার ঘরে ঘুমাইছি নাহিদের সাথে…
উফ, অংক স্যার! আবার মিথ্যে? কত বড় ফাজিল দেখো! রিতু বিরক্তি লুকিয়ে বলল,
— কখন গেল?
— তুই তখন বললি না ও ঘুমাইতেছে, শুইনা আমি
চইলা গেলাম! নাহিদও ছিলো। এর কিছুক্ষণ পরই তো আইলো…
— এরপরই এলো?
— হ। কইলো ঘুম ভাইঙা গেছে, নতুন জায়গায় ঘুমও আসতাছে না। আমি আর নাহিদ কইলাম চলো তাইলে তিনজনে মিলে আড্ডা দিই। ঐ আড্ডা দিতে দিতেই তো ঘুম আইসা গেলো পোলাডার। ক্লান্তিতে আমার বিছনায় শুইয়াই ঘুমাই পড়লো। নতুন জামাই আরাম কইরা আমার বিছানায়, তারে তো আর তাড়াই দিতো পারি না। আমি সেইজন্য নাহিদের লগে ঘুমাইলাম।

রিতু দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ ওকে তাহলে মিথ্যে বলেছে! রাতে এক কাহিনী করে ওকে আবার অন্য কাহিনী শুনিয়েছে। লোকটা আসলেই খারাপ, এত খারাপ লোক জীবনে আর দেখেনি সে। সব খারাপিও শুধু ওর সাথেই। আর বাদ বাকি সবার কাছে সে ধোঁয়া তুলসী পাতা। রিতু চুপচাপ রান্নাঘরে চলে গেলো।

.

এরপর দুটো দিন তেমন ঝামেলা বা ঝগড়াঝাটি হলো না দু’জনের। সব স্বাভাবিকই রইলো। তবে কথাবার্তা কম হলো ওদের মধ্যে। চলে যাবার আগের দিন ইফাদ একগাদা শপিং করে নিয়ে এলো সবার জন্য। ছোটখালা সবুজ শাড়িটি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললেন,
— জামাইয়ের পছন্দ আছে…
বড়ফুফু তো ফিরোজা রঙের জামদানি পেয়ে
গদগদ কন্ঠে ইফাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,
— বাঁইচা থাকো বাপজান, শত সন্তানের পিতা হও…
শুনেই রিতুর কাশি ওঠলো। ইশিতা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
— কাশোস কেন? চিন্তা করিস না। তোর দশাও আমার মতোই হইবো। তোর জামাইও কইবো গ্র‍্যাজুয়েশন
শেষ না কইরা নো বাচ্চা গোষ্ঠী….
রিতু জবাব দিলো না তবে চোখ পাকিয়ে চাইলো বোনের দিকে। ইশিতা কিছু হয়নি এমন একটা ভান করলো। ইফাদ ওকে উপহার দিলো পারফিউম, ওর স্বামী এজাজ পেলো রিস্টওয়াচ। ফুফা আর শ্বশুরকে দিলো পাঞ্জাবি। সবাই দারুণ পছন্দ করলো। সকলের থেকেই প্রশংসা কুড়ালো ইফাদ। রিতু চুপচাপ বসে বসে দেখছিলো। সবার জন্য এতকিছু এনেছে লোকটা! সত্যিই খরুচে লোক। রিতু প্রশংসা করলো অংক স্যারের। তবে মনে মনে। মুখফুটে কিছুই বললো না। সবাইকে উপহার বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে আসার পর ইফাদ রিতুর গিফটটা দিলো। হাতে একটা
বক্স ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— এটা তোমার জন্য!
— কি এটা?
— খুলে দেখো।
রিতু বক্স খুলে দেখলো একটা ক্যালকুলেটর।
কিছু বুঝতে না পেরে ও বোকার মতো তাকালো ইফাদের দিকে।
— গতবার তো ভুলভাল ক্যালকুলেটর চেপে অংকে একদম গোল্লা পেয়েছিলে। তাই দিলাম…
পুরোনো ক্ষত মনে পড়ায় ফুঁসে ওঠলো রিতু। ক্যালকুলেটরটা বিছানায় ছুঁড়ে বলল,
— আপনি আমাকে অপমান করছেন স্যার…
— মোটেও না। সামনে তো টেস্ট এক্সাম, তোমার লাগবে। মনে করে নিয়ে এলাম। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গিফট করাই তো ভালো তাইনা?
রিতু চোখমুখ শক্ত করে এবার বলল,
— শুনুন স্যার, আমি ঠিক করেছি আর পড়ালেখা করবো না।
ইফাদ ভ্রু কুঁচকে ফেললো,
— পড়ালেখা করবে না? কেন?
— আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে৷ বিয়ের পর পড়ালেখার কোনো দরকার নেই।
ইফাদ বসা ছিলো। সটান ওঠে এসে ওর ঘাড় ধরে
রাগী গলায় বলল,
— দ্বিতীয়বার এ কথা বলো দেখি, ঘাড় মটকে দেব একন…
রিতু গা করলো না তেমন,
— দিলে দিন৷ কিন্তু আমি আর পড়ালেখার ধার
ধারছি না।
— কেন? কী সমস্যা?
— আমার সমস্যা তো আপনি।
— আমি?
— হ্যাঁ আপনি। এই আপনার জন্যই তো আমি ফেল করেছিলাম…
— আমার জন্য?
— হুঁ।
ইফাদ বিস্মিত হলো,
— আমি কী করলাম?
— আপনি হার্ড প্রশ্ন করেছিলেন বলেই তো…
ইফাদ অবাক গলায় বলল,
— মানে তুমি পড়াশোনা করবে না, প্রশ্ন ধরতে পারবে
না, এসব আমার দোষ?
— অবশ্যই আপনার দোষ।
ইফাদ বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো।
— তোমার এসব অযুহাত অন্য কোথাও গিয়ে দেখিয়ো, আমাকে না।
রিতু ওর কথা না শোনার ভান করে হাই
তুলতে তুলতে বিছানার দিকে এগুলো,
— আপনাদের বাড়ি ফিরে ক্যালকুলেটরটা আমি রাজিকে দিয়ে দেব। ও তো ক’দিন পর এস.এস.সি দেবে। ওর লাগবে।
— দিলে দিও। আমার ঘরে কী ক্যালকুলেটর নেই
নাকি! এটা তো আমি স্পেশালি তোমার জন্য এনেছি…
— পড়ালেখাই যখন করবো না, তখন এসবের
কোনো দরকার নেই।
ইফাদ কপালে ভাঁজ ফেলল,
— তোমার দরকার না হলেও আমার আছে। আমার
বউ হায়ার স্টাডিজ করবে না, এটা তো ভাবতেই পারি না আমি।
— তাহলে কোনো হায়ার স্টাডিজ করা মেয়েকেই বিয়ে করতেন, ফেল্টুস আমাকেই কেন?
ইফাদ কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
— সেতো তোমাকে দেখে জ্বরে কুপোকাত হয়ে গিয়েছিলাম বলে৷ অন্য কাউকে স্বপ্নেও ভাবা অসম্ভব ছিলো। আমি তো তোমার বাবাকেও কথা দিয়েছি…
রিতু ওঠে বসলো। চোখ বড় বড় করে চাইলো,
— কী কথা দিয়েছেন?
ইফাদ গম্ভীর স্বরে বলল,
— বলেছি আপনি শুধু আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিন, আমি ওকে অংকে এক্সপার্ট বানিয়ে দেব।
— ঠিক এজন্যই আমি পড়াশোনা করবো না।
মূর্খ থাকবো।
ইফাদ ধৈর্যহারা হলো,
— একটু ভেবে দেখো রিতু, ইন ফিউচারে যখন আমাদের বেবি… আই মিন যখন তুমি মা হবে তখন বাচ্চাদের কি শিক্ষা দেবে? ওদের জন্য হলেও কিন্তু তোমার পড়াশোনা করাটা দরকার!
রিতু মিষ্টি হেসে বলল,
— কেন? আপনি তো আছেনই। অংকে এক্সপার্ট! ফিউচারের একজন শিক্ষিত বাবা!
ইফাদ ওর হাসি দেখে থতমত খেয়ে বলল,
— কেন এমন করছো রিতু? পড়াশোনাটা করতেই
হবে তোমার।
— আপুর যখন দুলাভাইয়ের সাথে বিয়ে হলো তখন থেকেই আমি চাইতাম আমার যে বর হবে সে
অন্যকিছু যাই হোক, কিছুতেই যাতে টিচার না
হোক। কিন্তু কি চাইলাম আর কি হলো? বাবা আমার জন্য এই আপনাকেই নিয়ে এলো…
ইফাদ অবাক হয়ে বলল,
— কেন চাইতে না?
রিতু বিরক্তি নিয়ে বলল,
— সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকে বলে। এই দুলাভাইকেই দেখুন না, আপুকেও পড়া নিয়ে
ভীষণ প্যারা দেয়। ডিরেক্ট বলে দিয়েছে গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট হবার পরই বাচ্চাকাচ্চার কথা ভাববে। আপু বেচারি একটা বাচ্চার জন্য কত কান্নাকাটি করলো, দুলাভাই তো কানেই তুলেনি। এক কথা, আগে পড়া শেষ হোক, এরপর বাকিসব। বেচারি তো সারাদিন পড়া নিয়েই থাকে। এখানে এলেই ওর একটু ফুরসত মেলে। এসবের পেছনে অবশ্য আমার বাবার হাত আছে, দেখুন না আমাকেও সেই টিচার পাত্রের হাতে তুলে দিলো …
ইফাদ বিষন্ন, আহত গলায় প্রশ্ন করল,
— ইউ ডোন্ট লাইক মাই প্রফেশন? সিরিয়াসলি?
রিতু রেগে রেগে বলল,
— ওরকম নাকের ডগায় চশমা এঁটে, বেত হাতে
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পেট মোটা কেউ অন্যকে পড়াচ্ছে, বকছে, কানে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখছে ভাবলেই তো রাগ হয় আমার৷ অবশ্য আপনিও আমার সাথে কম
করেন নি। অনেক শাস্তি দিয়েছেন…

রিতুর মুখে এসব কথা শুনে ইফাদ সেভাবেই
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। পেট মোটা মানে?
ও তো যথেষ্ট ফিট। স্টুডেন্টদের যত্ন নিয়ে পড়ায়।
হ্যাঁ, শাসনও করে। তবে তা লিমিটের বাইরে বেত
নিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, বিশ্রিভাবে নয়। তাছাড়া চাকুরীর বয়সটাও বেশি না৷ এখনো এক বছর পূর্ণ হয়নি। বাপ-দাদার পারিবারিক ব্যবসা ফেলে নতুন কিছু অভিজ্ঞতার জন্যই চাকরিটা করা। এমন তো নয় যে, এই চাকরি না করলে না খেয়ে ম’রবে সে? উহু! কখনোই না। এসব ভাবতে ভাবতেই রিতুর দিকে চোখ পড়লো ওর। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মেয়েটা এমন কেন? ওর ওপর রাগ করে পড়ালেখাই করবে না বলছে। অদ্ভুত! কিন্তু ইফাদ তো হাল ছাড়ার পাত্র নয়৷ রিতুকে অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে। ভবিষ্যতে নিজের বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য হলেও পড়াশোনা ওকে করতেই হবে। দরকার পড়লে বউয়ের অপছন্দের চাকরি ছাড়বে। প্রয়োজনে বউকে সে মে’রে মে’রে পড়াবে। তবুও পড়াবে। ইফাদের জ্বলজ্বলে মুখটা শুকনো দেখালো। ওর শুকনো মুখটা দেখে রিতুর ভীষণ মায়া হলো। সেইসাথে পেট ফেটে হাসিও পেলো! কিন্তু পাছে স্যার বুঝে ফেলে সেজন্য ও মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। বহুকষ্টে নিজের হাসি চেপে
রেখে বলল,
— আমি ঘুমাবো। আলোটা নিভিয়ে দিন তো,
চোখে লাগছে।

_____________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…